চাঁদের রূপালি আলো ছড়িয়ে পড়েছে জুলফার ওপর। তার পরনে একটি সাদা রঙের শাড়ি, যার ওপর সোনালি সুতোয় কাজ করা নক্ষত্রের মতো ছোট ছোট ফুল। শাড়ির আঁচল বাতাসে দুলছে। গলায় ঝিলমিল করছে একটি সরু সোনার হার। খোলা চুল কাঁধ ছুঁয়ে পিঠের ওপর ছড়িয়ে পড়েছে।
মুখজুড়ে অপূর্ব লাবণ্য। চাঁদের আলোয় আরও উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। চোখে ভয় আর লজ্জার মিশ্রণ। সেই সঙ্গে একটা অব্যক্ত আকর্ষণও।
নাভেদ অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল জুলফার দিকে। তার চোখে মুগ্ধতা। সে প্রশ্ন করল, "আপনিই কি সেই রাতের নিকাবধারী?"
জুলফা চোখ নামিয়ে নিল। নিচু স্বরে বলল, "হুম, আমি ছি...."
সে কথা শেষ করতে পারল না। নাভেদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখে আরও সংকুচিত হয়ে গেল।
নাভেদ আগ্রহভরে জানতে চাইল, "কিন্তু কেন? কেন আপনি গোপনে আমার ঘোড়াকে খাবার দিতেন?"
জুলফা তখন নিজের ভেতরে ডুবে গেল। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই রাতের ঘটনা। সেদিন রাতে নাভেদ হাত ছাড়তেই সে প্রাণপণে পালিয়ে গিয়েছিল। পরের দুদিন সে আর সেদিকে যায়নি। তৃতীয় দিন শুনল নাভেদ তার ব্যবসা গুটিয়ে বাজার ছেড়ে চলে গেছে। তারপর আর কখনো নাভেদের দেখা পায়নি।
জুলফা নরম স্বরে বলল, "আমি শুধু আপনার ঘোড়াটিকে খুব পছন্দ করতাম।"
নাভেদের চোখে কৌতূহল ঝিলিক দিয়ে উঠল। সে আবার প্রশ্ন করল, "আর এখন? প্রতি রাতে আমার বেহালার সুর শোনার পেছনে কী রহস্য? কেন আপনি এভাবে নিঃশব্দে এসে দাঁড়ান?"
জুলফা তখন আরও বেশি অস্বস্তি বোধ করল। সে চোখ তুলে তাকাতে পারল না। কণ্ঠস্বর কাঁপল যখন সে বলল, "আপনার বেহালার সুর... ভালো লাগে।"
"গোপনে কেন শুনেন? আমাকে একবার জানালেই তো পারতেন।"
জুলফার চোখে লজ্জার আভা ফুটল। সে নত চোখে বলল, "ভয় পেয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, আপনি হয়তো আমার এই আচরণকে অপরাধ মনে করবেন।"
নাভেদের কণ্ঠে তখন একটা মধুর স্নিগ্ধতা, "অপরাধ? কী যে বলেন আপনি! বরং আমি তো কৃতজ্ঞ। আপনি আমার সুর এতটা পছন্দ করেন জেনে আমি অভিভূত। যদি আপত্তি না থাকে, আপনি সামনে বসেই শুনতে পারেন।"
জুলফা কৃতজ্ঞচিত্তে কাঁপা কণ্ঠে বলল, "আপনার অসীম দয়া। আমি... আমি জানতাম না আপনি এত মহৎ, এত উদার।"
নাভেদের চোখেও তখন আবেগের ছায়া নেমে এসেছে। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে এল। বলল, "আপনার যদি আপত্তি না থাকে, ভেতরে আসুন। আপনার জন্য একটা বিশেষ সুর বাজাতে চাই।"
জুলফার সারা শরীরে তখন অজানা শিহরণ। হঠাৎ করে তার মনে পড়ে গেল, সে মধ্যরাতে নিজের স্বামীর বাড়িতে দাঁড়িয়ে একজন পর-পুরুষের সঙ্গে কথা বলছে - যাকে সে গোপনে মন দিয়েছিল। এই উপলব্ধি তাকে এক মুহূর্তে সচেতন করে তুলল।
একদিকে নাভেদের প্রতি তার গভীর আকর্ষণ, অন্যদিকে স্বামীর প্রতি দায়বদ্ধতা। তার হৃদয় চাইছে নাভেদের আমন্ত্রণ গ্রহণ করতে, কিন্তু বিবেক বলছে এটা ঠিক হবে না। সে কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, "আজ... আজ নয়।"
তারপর দ্রুত পায়ে খাসমহলে ঢুকে দ্বিতীয় তলায় উঠে গেল। তার বুকের ভেতর তখনও গুমরে উঠছে একটা অজানা আবেগ। প্রতিটি কদমে সে অনুভব করছে একটা অদৃশ্য টান, যে টান তাকে পিছনে ফিরে যেতে বলছে।
ঘরে ঢুকতেই শব্দরের ঘুমজড়ানো কণ্ঠস্বর ভেসে এল, "কোথায় গিয়েছিলে?"
জুলফার বুক ধড়াস করে ওঠল। মুহূর্তের জন্য মনে হলো, তার সমস্ত গোপন ভাবনা, নাভেদের সঙ্গে সাক্ষাত, অনুভূতি সব প্রকাশ হয়ে গেছে। তৎক্ষণাৎ সে নিজেকে সামলে নিয়ে উত্তর দিল, "ভালো লাগছিল না। তাই একটু হাঁটছিলাম।"
শব্দর আর কিছু বলল না। জুলফার এই রাতের হাঁটাহাঁটি তার কাছে নতুন কিছু নয়। জুলফা যখন বিছানায় ফিরে এল, শব্দর ধীরে ধীরে তার দিকে সরে গেল। তার হাত জুলফার কোমরে জড়িয়ে ধরতে চাইলে জুলফা তৎক্ষণাৎ নিজেকে সরিয়ে নিল, যেন সে আগুনের স্পর্শ পেয়েছে।
"কী হলো?" শব্দর জিজ্ঞেস করল।
জুলফা উত্তরে বলল, "কিছু না। শুধু একটু গরম লাগছে।"
শব্দর আবার চেষ্টা করল। এবার সে জুলফার হাত ধরতে গেল, "এত রাতে হাঁটতে গিয়েছিলে। ক্লান্ত লাগছে না?"
জুলফা হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, "একটু ক্লান্ত লাগছে। আমি...আমি পানি খেয়ে আসি।"
শব্দরের মনে হলো জুলফার মন ভালো নেই। সে উঠে এসে জুলফাকে জড়িয়ে ধরল সান্ত্বনা দিতে।
জুলফা তখন মাথায় ধরে বলল, "মাথাটা একটু ব্যথা করছে। আপনি ঘুমান, আমি খোলা বাতাসে আরেকটু হাঁটি বারান্দায়।"
"ঠিক আছে। কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানিও।"
জুলফা মাথা নাড়ল। সে জানে, তার এই আচরণ শব্দরকে কষ্ট দিচ্ছে। কিন্তু সে নিজেও সূচের মতো তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করছে। শব্দরের স্পর্শ তার কাছে অসহ্য ঠেকছে। অবশ্য সবসময়ই অসহ্য লাগত। জুলফা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। রাতের আকাশে তারাগুলো মিটমিট করে জ্বলছে। দূরে কোথাও একটা শিয়াল ডাকল।
সারারাত জুলফা অস্থির অবস্থায় কাটাল। কখনো জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরের অন্ধকারে তাকিয়ে রইল। কখনো বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল, রাতের নিস্তব্ধতায় নিজের অন্তরের আর্তনাদ শুনতে চেষ্টা করতে। আবার কখনো বা পানি খাওয়ার অজুহাতে রান্নাঘরে গিয়ে আশ্রয় নিল। প্রতিবার শব্দর তাকে কাছে টানতে চাইলে, জুলফা কোনো না কোনো বাহানায় দূরে সরে গেল। সে নিজেকে অপরাধী মনে করছে, কিন্তু সেই অপরাধবোধও তাকে শব্দরের কাছে ফিরিয়ে আনতে পারছিল না।
ভোর হতে না হতেই শব্দর গভীর ঘুমে ঢলে পড়ল। জুলফার চোখে ঘুম নেই। তার চোখের সামনে বার বার ভেসে উঠছে নাভেদের মুখ। সে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে লম্বা করে শ্বাস নিল।
বাইরের তাজা হাওয়ায় তার ফুসফুস ভরে যায়, সেই শ্বাসও নাভেদের স্মৃতিতে ভারাক্রান্ত। কানে বাজছে নাভেদের কথা, "আপনার জন্য একটা বিশেষ সুর বাজাতে চাই।"
সেই কথা তার হৃদয়ে কী যে তীব্র শিহরণ জাগিয়েছে! রক্তের প্রতিটি কণিকা নৃত্য শুরু করেছে। জুলফা চোখ বন্ধ করে কল্পনা করল একটি সুরের স্বপ্ন, যে সুর নাভেদ শুধু তার জন্য তুলবে। সেই কল্পনায় সে দেখছে নিজেকে একটি সুন্দর বাগানে, যেখানে নাভেদ তার বেহালা নিয়ে বসে আছে। চারপাশে ফুল ফুটেছে, পাখিরা গান গাইছে, আর নাভেদের আঙুলের স্পর্শে বেহালা থেকে উঠছে অপার্থিব সুর। সেই সুরে জুলফা নিজেকে হারিয়ে ফেলছে, তার সমস্ত অস্তিত্ব সেই সুরের সাথে একাকার হয়ে যাচ্ছে।
সুন্দর কল্পনাটির সঙ্গে মনের কোনো কোণে আরেকটা চিন্তাও ঘুরপাক খাচ্ছে৷
তার মনে হচ্ছে, সে মহাপাপ করছে। কিন্তু সেই অপরাধবোধের চেয়েও বড় ছিল নাভেদের প্রতি তার অনুভূতি। সে জানে, এই অনুভূতি অবৈধ, অনৈতিক। তবুও সে নিজেকে সামলাতে পারছে না।
প্রতিটি পাপী পাপ করার সময় জেনে-বুঝেই পাপ করে। জানে যে, যা করছে তা অপরাধ।
জুলফাও জানে, তার এই অনুভূতি একটি পাপ। তবুও সেই পাপের মধ্যেও সে খুঁজে পাচ্ছে মুক্তি, এক অজানা আনন্দ।
সে জানে, এই স্বপ্ন কখনোই বাস্তবে রূপ নেবে না। তার জীবনের বাস্তবতা, তার সামাজিক দায়বদ্ধতা, তার পারিবারিক জীবন সব কিছু মিলে তাকে এই স্বপ্ন থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে। তবুও, সেই মুহূর্তে জুলফা নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সমর্পণ করেছে সেই কল্পনার কাছে।
দুপুরের রোদ্দুর যতই চড়তে থাকে, ততই জমিদার বাড়ির রান্নাঘরে ব্যস্ততা বাড়তে থাকে। এমন সময় জুলফা, নিজের ঘর ছেড়ে ধীর পায়ে রান্নাঘরের দিকে এগোল। সে নিজেকে আর চার দেয়ালে বন্দি করে রাখবে না।
তাছাড়া বিবাহিতা নারীর প্রতি নাভেদ কখনোই দুর্বলতা দেখাবে না। কিছুদিন পরই চলে যাবে । তাহলে কয়েকদিন জমিদার গিন্নি হিসেবে সামনাসামনি থাকলেই বা কী এমন ক্ষতি হবে? ঘরে থাকতেও আর ভালো লাগছে না তার।
রান্নাঘরে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জুলফার চোখে পড়ল ললিতার ওপর। ললিতার মুখে বিরক্তির ছায়া, জুলফার উপস্থিতি তার কাছে একটা অযাচিত বিরক্তির কারণ।
ললিতা ঠোঁট বাঁকিয়ে ব্যঙ্গের সুরে বলল, "আরে, দেখো তো কে এসেছে! নতুন বউ আজ রান্নাঘরে পা দিয়েছেন! এতদিন কোথায় ছিলেন? রাজকন্যার মতো ঘুমাচ্ছিলেন বুঝি?"
জুলফা নীরবতা বজায় রাখল, কোনো উত্তর দিল না। সে শুধু হাঁড়ি-পাতিলগুলো দেখতে লাগল, যেন ললিতার কথা কানেই যায়নি।
ললিতা আরও খিটখিটে স্বরে বলল, "কী গো, জিভ খসে পড়েছে নাকি? নাকি আমাদের সাথে কথা বলার মর্যাদা নেই?"
জুলফা ধীরে ধীরে শান্ত কণ্ঠে উত্তর দিল, "আমি শুধু রান্নার তদারকি করতে এসেছি।"
ললিতা এবার বিদ্রূপের হাসি হেসে বলল, "তদারকি! দিনমজুরের মেয়ে এসেছে, তাই শুধু তদারকি। হাতে হাত দিয়ে কাজ করা তো আপনার কাজ নয়। তাই না?"
জুলফা একটা হাঁড়ির ঢাকনা তুলে ভেতরের তরকারি দেখার চেষ্টা করল।
হঠাৎ করে ললিতা জুলফার হাত ধরে জোরে টেনে সরিয়ে দেয় সেখান থেকে। তার চোখে মুখে রাগ আর ঈর্ষা। সে গর্জন করে বলল, "এই যে! কী করছো? তোমার অত বড় দায়িত্ব নেই। যাও, গিয়ে আয়নায় মুখ দেখো। আর তোমার স্বামীকে খুশি রাখো। এই বাড়িতে তোমার এটুকুই কাজ। রান্নাঘরে থাকলে তোমার কোমল হাতে ময়লা লেগে যাবে।"
জুলফা আর চুপ করে রইল না। সে গভীর শ্বাস নিয়ে ললিতার দিকে তাকাল।
"ভাবিজান, আপনি কি মনে করেন আপনার এই আচরণ আমাকে ভয় দেখাচ্ছে?"
"ওমা! তুমি কথা বলছো?"
"শুধু কথা নয়, আমি নিজের অধিকার সম্পর্কেও সচেতন। এই বাড়িতে আমারও সমান অধিকার আছে।"
"তুমি কী মনে করো, এই কদিনে এ বাড়ির মালিক হয়ে গেছো? জমিদার বাড়ির বউ হওয়া এত সহজ নাকি?"
"মালিক হওয়ার কথা কে বলছে, ভাবিজান? আমি শুধু সম্মান চাইছি। সবসময় আপনি আমাকে অপমান করেন। এই বাড়িতে আমিও একজন সদস্য, তাই নয় কি?"
"সদস্য! তুমি এখানে অতিথি মাত্র। যতদিন শব্দরের মন জুড়ে থাকবে, ততদিনই এখানে তোমার স্থান।"
জুলফা এবার একটু হেসে বলল, যেন ললিতার কথায় সে বিচলিত হয়নি। "ভাবিজান, আপনি কি ভুলে যাচ্ছেন যে আমি এ বাড়ির জমিদারের স্ত্রী? আমার অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।"
ললিতার মুখ লাল হয়ে উঠল। সে চোখ পাকিয়ে, রাগে গরগর করতে করতে বলল, "তাই নাকি? দেখি কতদিন টিকতে পার! মনে রেখো, এই বাড়িতে আমিই প্রথম বউ।"
জুলফা শান্তভাবে জবাব দিল, " সেটা আমি জানি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আপনি আমাকে অপমান করতে পারবেন।"
ললিতা হঠাৎ করে হাঁড়ির ঢাকনা জোরে নামিয়ে রাখল। শব্দটা রান্নাঘরে প্রতিধ্বনিত হলো। তার চোখে জ্বলছে রাগের আগুন। সে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, "দেখো মেয়ে, তোমার সাহস তো কম নয়! আমার সঙ্গে গলা চড়িয়ে কথা বলছো? ভুলে যাচ্ছো আমি কে? আমি বনেদি ঘরের মেয়ে, এ বাড়ির বড় বউ। তুমি জানো না এই বাড়িতে আমি কত বছর আছি।"
জুলফা শান্তভাবে জবাব দিল, তার কণ্ঠস্বরে একটু ব্যঙ্গের সুর, "বছর গুনে লাভ নেই, ভাবিজান। প্রশ্ন হলো, এই বছরগুলোতে আপনি কী শিখেছেন? সম্মান দিতে, না শুধু নিতে?"
এই সময় জুলফা লক্ষ্য করল, রান্নাঘরের কোণে দাঁড়িয়ে থাকা দাসীরা কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। এতদিন যারা ললিতার অত্যাচার নীরবে সহ্য করে এসেছে, তারা এখন যেন একটু আনন্দই পাচ্ছে এই দৃশ্য দেখে। দাসীদের এই দৃষ্টি ললিতার চোখেও পড়ল। তার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। নিজের অবস্থান যে এভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, তা তার গর্বে আঘাত করল। সে চিৎকার করে উঠল, "চুপ করো!"
কিন্তু জুলফা থামল না। সে আরও শান্তভাবে বলল, "তাহলে আপনিও আমাকে সম্মান করুন। আমি এখানে কারও দাসী হতে আসিনি। আমি এসেছি স্ত্রী হিসেবে, পরিবারের সদস্য হিসেবে।"
ললিতা জুলফার দিকে এক পা এগিয়ে এল। সে গর্জন করে বলল, "তুমি কি আমাকে শিক্ষা দিচ্ছো?"
জুলফা পিছু হটল না। সে দৃঢ়তার সাথে দাঁড়িয়ে রইল। তার কণ্ঠস্বরে কোনো ভয় নেই, শুধু আত্মবিশ্বাস, "না, আমি শুধু আমার অধিকার দাবি করছি। আমি এই বাড়ির প্রতিটি কোণে যাব। আপনি যদি আমাকে সম্মান না দেন, আমিও আপনাকে সম্মান দেখাতে বাধ্য নই।"
ললিতা এবার সম্পূর্ণ হতভম্ব হয়ে গেল। তার চোখে মুখে এখন শুধু রাগ নয়, একটা গভীর আতঙ্কও ফুটে উঠেছে। এতদিন যে ক্ষমতা সে অবলীলায় ভোগ করে এসেছে, তা যেন হাতের মুঠো থেকে পিছলে যাচ্ছে। আর সবচেয়ে বড় কথা, এই অপমান ঘটছে তার প্রিয় দাসীদের সামনে। যারা এতদিন তাকে দেবী জ্ঞান করে এসেছে, তারাই আজ তার এই অসহায় অবস্থা দেখছে।
ললিতার গলা কেঁপে উঠল। সে চিৎকার করে বলল, "তুমি... তুমি..." কিন্তু কথা শেষ করতে পারল না। তার চোখে জল এসে গেল। রাগ, অপমান, হতাশা সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল।
দাসীরা এখন আর কৌতূহলী নয়, তারা বরং বিস্মিত। তাদের চোখে মুখে এখন সহানুভূতির ছায়া। ললিতাকে তারা কখনো এমন অসহায় অবস্থায় দেখেনি।
এই সময় লাঠির শব্দ শোনা গেল। ঠক্ ঠক্ করে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে সুফিয়ান রান্নাঘরে প্রবেশ করলেন। তার পিছনে শব্দর। সুফিয়ানের চোখে মুখে বিরক্তি। তিনি গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, "কী হচ্ছে এখানে? এত চেঁচামেচির কারণ কী? জমিদার বাড়িতে এ কেমন হট্টগোল?"
জুলফা তাড়াতাড়ি মাথার আঁচল টেনে দিয়ে বলল, "ভাইজান, আপনার স্ত্রী প্রতিদিন আমাকে অপমান করছেন। আমি আর সহ্য করতে পারছি না।"
ললিতা তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ করে উঠল, "মিথ্যা কথা! এই মেয়ে আমাকে অপমান করছে!"
সুফিয়ান লাঠি দিয়ে মেঝেতে জোরে আঘাত করলেন। শব্দটা সারা রান্নাঘরে প্রতিধ্বনিত হলো। তিনি গর্জন করে উঠলেন, "দুজনেই চুপ করো! এ কী কাণ্ড হচ্ছে আমার বাড়িতে? তোমরা কি ভুলে গেছ কোন বংশের বউ তোমরা?"
সুফিয়ানের গর্জনে ললিতা, জুলফা দুজনেই চমকে উঠল।
সুফিয়ান বললেন, "লজ্জা করে না তোমাদের? জমিদার বাড়ির বউ হয়ে এমন আচরণ! দাসীদের সামনে কলহ করছো? এ কেমন শিক্ষা পেয়েছো তোমরা? আমাদের পূর্বপুরুষেরা যে ঐতিহ্য রেখে গেছেন, তা কি এভাবেই ধ্বংস করবে?"
ললিতা কিছু বলতে যাচ্ছিল, "এই মেয়ে..."
সুফিয়ান কঠোর স্বরে বাধা দিলেন, "চুপ করো ললিতা! তুমি এ বাড়ির প্রবীণ নারী... বড় বউ। তোমার কাছ থেকে এমন আচরণ আশা করিনি। তোমার দায়িত্ব ছিল নতুন বউকে শেখানো, পথ দেখানো। কিন্তু তুমি কী করছো?"
জুলফা এবার কিছু বলার চেষ্টা করল, "ভাইজান, উনি প্রতিদিন..."
সুফিয়ান তাকেও থামিয়ে দিলেন, "তুমিও চুপ করো জুলফা! নতুন এসেছো বলে সব নিয়ম ভাঙতে পারবে? আমাদের বংশের ঐতিহ্য কোথায় গেল? তুমি কি জানো না, এই বাড়িতে কত বছরের শৃঙ্খলা, কত বছরের মর্যাদা?"
সুফিয়ান একটু থামলেন। তিনি গভীর শ্বাস নিলেন নিজেকে শান্ত করতে। তারপর বলতে শুরু করলেন, এবার তার কণ্ঠস্বরে রাগের চেয়ে বেদনা বেশি।
"শোনো, দুজনেই। আমাদের বংশের মর্যাদা শুধু টাকা-পয়সা নিয়ে নয়। আমরা জমিদার, কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, আমরা মানুষ। লোকে আমাদের সম্মান করে শুধু জমিদার বলে নয়, আমাদের আচরণের জন্য। কিন্তু তোমরা প্রতিদিন যা করছো, তা দেখলে লোকে কী বলবে? বলবে জমিদার বাড়িতে শিক্ষা-দীক্ষা নেই, সংস্কার নেই।"
ললিতা ও জুলফা চুপ করে রইল।
সুফিয়ান বললেন, "ললিতা, তুমি এ বাড়ির কর্ত্রী। তোমার দায়িত্ব নতুন বউকে শেখানো, তাকে অপমান করা নয়। তোমার মধ্যে দিয়েই তো এ বাড়ির ঐতিহ্য বহন করবে পরের প্রজন্ম। আর জুলফা, তুমি নতুন এসেছো। বড়দের সম্মান করতে শেখো। মনে রেখো, সম্মান পেতে হলে সম্মান দিতে হয়।"
জুলফা নিজের সম্পর্কে বলতে চাইল, "কিন্তু ভাইজান, আমাকেও তো সম্মান..."
সুফিয়ান ধীরে ধীরে বললেন, "সম্মান অর্জন করতে হয়, জুলফা। নিজের আচরণ দিয়ে। চেঁচামেচি করে নয়। শ্বশুর বাড়িতে এসেছো, এখানকার রীতি-নীতি শেখো। তারপর দেখবে, সবাই তোমাকে সম্মান করছে।"
সুফিয়ান দুজনের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালেন।
"আমাদের কুলমর্যাদা শুধু বাইরের লোকের কাছে নয়, নিজেদের মধ্যেও। তোমরা যদি এভাবে কলহ করো, তাহলে সেই মর্যাদা ধুলায় মিশবে। আমি চাই না আমার জীবদ্দশায় এমন হোক। বাড়িতে অতিথি এসেছে, আর তোমরা চেঁচামেচি করছো। এটা কি শোভা পায়? আর যদি এরকম হয়, তবে দুজনকেই বাড়ি থেকে বের করে দেব। আমার কাছে এ বাড়ির মর্যাদা সব কিছুর উপরে।"
সুফিয়ান ধীরে ধীরে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে সেখান থেকে চলে গেলেন। তার পদশব্দ মিলিয়ে যাওয়ার পরও রান্নাঘরে ছড়িয়ে রইল গুরুগম্ভীর নীরবতা।
নাভেদ বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ কানে আসা নারীদের চিৎকারে চমকে ওঠে। তার চোখ দুটো কৌতূহলে বড় হয়ে যায়, কান খাড়া করে শব্দের উৎস খুঁজতে থাকে। একজন অপরিচিত অতিথি হিসেবে সে ভেতরে ঢুকতে সংকোচ বোধ করে, তাই আর এগোল না। কিন্তু তার মনে প্রশ্নের ঝড় বইছিল, ভেতরে কী ঘটছে? কে এত চেঁচামেচি করছে? কিসের জন্য এত হৈচৈ?
বাইরে বসে সিদ্দিক নামের এক লোক মন দিয়ে জুতো সেলাই করছিল। নাভেদের বিস্ময়-মাখা মুখ দেখে সে চতুর হাসি হেসে বলল, "আরে মশাই, এটা তো রোজকার ব্যাপার। আমাদের দুই জমিদারনী যখনই মুখোমুখি পড়ে, তখনই শুরু হয়ে যায় তাদের কথার লড়াই। ওদের ঝগড়া দেখলে মনে হয় যেন দুটো বাঘিনী খামচাখামচি করছে। হা হা হা! এমন মজার তামাশা এখানে কাজ করা আমরা সবাই রোজই দেখি!"
সিদ্দিকের কথা শুনে নাভেদ হাসল। নারীরা যখন ঝগড়ায় মেতে ওঠে, তখন তাদের মুখ থেকে এমন সব কথা বেরিয়ে আসে, যা সাধারণত কেউ বলে না!
হয়তো দুই জমিদারনীর মুখ থেকেও বেরিয়ে আসছে এমন সব গোপন কথা, যা শুনলে লোকের চোখ কপালে উঠবে!
"কী রে, মনে আছে সেই দিনটার কথা? যখন তুই চুপি চুপি..."
নাভেদ আপনমনে হাসল। মেয়েদের ঝগড়া মানেই তো একটা গসিপ পত্রিকা! কত না শোনা কথা, কত না জানা ঘটনা, সব একসাথে উগরে দেওয়া।
সিদ্দিক কাজ শেষ করে বাড়ির ভেতর যাচ্ছিল হঠাৎ জমিদার বাড়ির সামনে একটি চকচকে মোটরগাড়ির আগমন তাকে থমকে দাঁড়াতে বাধ্য করল। সেই যুগের পল্লীগ্রামে এমন দৃশ্য ছিল অতীব দুর্লভ। গাড়ির দরজা খুলতেই সিদ্দিকের চোখ বিস্ময়ে প্রায় কপালছোঁয়া। গাড়ি থেকে নেমে এল দুই তরুণ-তরুণী, যেন চলচ্চিত্রের পর্দা থেকে বেরিয়ে এসেছে তারা।
যুবকটির পরনে ইস্ত্রি করা সাদা শার্ট, তার সাথে মানানসই কালো রঙের প্যান্ট। গলায় একটি রেশমি টাই। পায়ে চকচকে পালিশ করা জুতা, মাথায় কালো ফেডোরা হ্যাট।
তরুণীর পোশাক আরও বৈচিত্র্যময়। পরনে হাঁটু পর্যন্ত দৈর্ঘ্যের একটি রঙিন ফ্রক, যার ওপর নানা রকম ফুলের নকশা। কোমরে একটি চওড়া বেল্ট। পায়ে উঁচু হিলের জুতা আর মাথায় একটি ছোট্ট, সুন্দর হ্যাট। মেয়েটি পরীর মতো সুন্দর।
সিদ্দিক হতবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। এমন পোশাক তার চোখে পড়েনি কখনও। বাঙালি ছেলেমেয়েদের এহেন সাজসজ্জা ছিল তার কাছে কল্পনারও অতীত। তরুণীর মুক্ত চুল বাতাসে উড়ছে, আর যুবকের হাতে ধূমায়িত সিগারেট দেখে সিদ্দিকের চোখ আরও বিস্ফারিত হলো।
বিস্ময়াভিভূত সিদ্দিক নিজের মনেই ফিসফিস করে বলল, "ওরে বাবা! এরা কোথা থেকে এল?"
·
·
·
চলবে........................................................................