অভ্র নীল - পর্ব ০২ - শারমিন আক্তার বর্ষা - ধারাবাহিক গল্প

অভ্র নীল 
পর্ব ০২ 
শারমিন আক্তার বর্ষা 
.
.
.
ঘড়ির এলার্ম হঠাৎ বেজে উঠল। নীল চোখ খুলল। ঘড়ি বন্ধ করে বিছানা ছেড়ে, জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় সে। দুই হাতে পর্দা সরিয়ে দিল। আজ আকাশ মেঘলা, বৃষ্টি হবে কি না জানা নেই। নীল কিছুক্ষণ পর ফ্রেশ হতে গেল। তোয়ালেটা চেয়ারে রেখে বারান্দায় পা বাড়ালো। একটা ছোট্ট চড়ুই ছানা উড়ে এসে রেলিংয়ে বসল। সে উড়তে শিখছে। একটু পর আবার উড়তে শুরু করল। বেশিক্ষণ উড়তে পারেনি। নেমে এসেছে। পাখির কাণ্ড দেখে নীলের মন খুব উত্তেজিত হয়ে উঠল। সে রুমে এসে পড়তে বসল। ফোন বাজছে, মনটা বারবার ফোনের কাছে ছুটছে। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে মেসেজ করছে তানজুম, তানিয়া ও কাজল। নীল বইটা বন্ধ করে ফোন তুলল। তারা দুপুরের পর সাফারি পার্কে যাওয়ার পরিকল্পনা করে। নীল যেতে রাজি হলো।

নীল আলমারি থেকে তার পছন্দের একটা জামা নিল। আব্বু আম্মুর সাথে নাস্তা সেরে ৯টার মধ্যে কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। কলেজের সামনে গাড়ি থামল, নীল নামল। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে তানজুম, তানিয়া, কাজল। লতিফ চাচা গাড়ি নিয়ে চলে যেতেই তারা এগিয়ে আসে। হঠাৎ একটি গাড়ি তাদের সামনে এসে থামল। তানিয়া, কাজল গাড়িতে উঠে বসে। তানজুম গাড়িতে বসে বলল, ' নীল, তাড়াতাড়ি উঠ।'

নীল কিছুই বুঝল না। জিজ্ঞাসা করে,
' আমরা কোথায় যাচ্ছি? ক্লাস করব না?'
' না। আজকে ক্লাস ফাঁকি দিব।' তানিয়া জবাব দিল।
' দুপুরের পর যাওয়ার কথা ছিল। তাহলে আমরা এখন ক্লাস ফাঁকি দিব কেন?'
' গাড়িতে, সেখানে যেতে এক ঘণ্টা এবং ফিরে আসতে এক ঘণ্টা লাগে। আর পার্ক পাঁচটায় বন্ধ হয়ে যায়। চারটায় গিয়ে এক ঘণ্টায় কী দেখব? তাই সকালে যাব। আর চারটার মধ্যে ফিরে আসব। একদিনের তো ব্যাপার টেনশন করিস না।' বলল কাজল।

কাজে পুরোপুরি ঢুকে পড়েছে অভ্র। দম ফেলার সময় নেই। মিটিং শেষ করে চেম্বারে বসল। টেবিলে রাখা গ্লাসটা নিয়ে পানি পান করল। শুভর কল এলো। শুভ অনর্গল বলল, ' সাফারিতে যাচ্ছি বাঘ আর হাতি দেখতে। তুই কি আমাদের সাথে যাবি না - কি একাই যেতে পারবি?'

' আমি যেতে পারব না। স্যরি রে, আমাকে অফিসের অনেক কাজ দেখাশোনা করতে হচ্ছে, তোরা যা।'
শুভ কান থেকে ফোন নামিয়ে নিল। আকাশকে বলল, ' ওঁ আসতে পারবে না। আমরা এখন কী করব?'

শুভর হাত থেকে ফোন নিল আকাশ। শক্ত কন্ঠে বলল, ' নীল যাচ্ছে। ঠিকানা পাঠাচ্ছি। তুই এক ঘণ্টার মধ্যে আসবি।'

নীল গাড়ি থেকে নেমে জায়গাটা ভালো করে দেখে নিল। বিশাল খোলা জায়গা। চারপাশে বাস ও গাড়ির ভিড়। বাইরে প্রচুর খাবারের স্টল এবং খেলনার স্টল রয়েছে। সব কিছু দেখে নিয়ে তারা টিকিট কেনার জন্য এগিয়ে গেল। গেটে নিরাপত্তা টিকিট চেক করার পরই প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। বেশ কিছুক্ষণ ধরে বসার জায়গাতে লোকজন বসে আছে তাই ওঁরা কাছাকাছি ঘুরতে লাগল। একটু পর তানজুম নির্জন জায়গা দেখে তাদের নিয়ে দাঁড়াল।

ড্রাইভার সাথে থাকায় সে অভ্রকে নিয়ে আসে। ড্রাইভারকে গাড়িতে বসতে বলে অভ্র এগিয়ে গেল। আকাশকে কল করল। ফোন রিসিভ করছে না, শুভর ফোন বন্ধ। টিকিট কেটে গেট দিয়ে ঢুকল অভ্র। এদিক ওদিক তাকিয়ে হাঁটতে লাগল। কাজল দেখে অভ্র এদিকে আসছে। অভ্র এখনো তাদের দেখেনি। কাজল তানজুমকে ইশারা করে যে অভ্র এসেছে। তানজুম ছক আঁকতে লাগলো। সে হঠাৎ বলল, ' নীল, তুই এখানে অপেক্ষা কর। আমরা একটু টয়লেট থেকে আসছি।'

নীল অবাক গলায় জিজ্ঞেস করল, 
' তিনজন একসাথে টয়লেট?'

তানিয়া বলল, 
'হ্যাঁ। কলেজে যাওয়ার পথে আমরা প্রচুর ফুচকা খাই। সে কারণে হয়তো এখন গ্যাস হয়ে গেছে।'

নীল ফ্যালফ্যাল করে ওদের দিকে তাকিয়ে। তারা চলে গেল। চোখের আড়ালে এসে একটা বড় গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। আকাশ আর শুভ একইভাবে অন্য গাছের আড়ালে লুকিয়ে আছে। অভ্রকে দেখে আকাশ শুভর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, ' আমাদের প্ল্যান কাজ করছে। এখন অভ্র শুধু তার মনের কথা বলতে পারলেই হয়।'

নীল একা দাঁড়িয়ে আছে। অভ্র মৃদু হেসে ওঁর পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল, 

' তুমি এখানে। একা আসছ?'

পুরুষ কণ্ঠটা অপরিচিত হওয়ায় নীল মাথা ঘুরিয়ে অভ্রর দিকে তাকাল। সাথে সাথে অভ্রকে উপেক্ষা করার চেষ্টা করল নীল। অভ্র তড়িঘড়ি করে তার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, ' আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাই। আর তুমি প্রতিবার পালিয়ে যাও। আমার কথা শোন।'
' আমার শোনার কিছু নাই।' নীল এক পা বাড়ায়।

অভ্র হঠাৎ নীলের হাত ধরল। নীল অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রাগান্বিত কন্ঠে বলল, ' আমার হাত ছাড়ুন।'
অভ্র বলল,
' আমার কথা শেষ হয় নাই। দাঁড়াও চুপচাপ।'
অভ্রর হাত থেকে নিজ হাতটি ছাড়িয়ে নিয়ে নীল হঠাৎ অভ্রর গালে চড় মারলো। তারপর উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে বলল, ' আমি আপনাকে পছন্দ করি না। আপনি প্লিজ আমাকে বিরক্ত করবেন না।' অভ্র মাথা নিচু করে ফেলল এরপর বিনাবাক্যে চুপচাপ চলে যায়।

রাত দুইটা বাজে। আকাশ ফোনে কথা বলতে বলতে কখন যে ঘুমিয়ে যায়। সহসা ফোন বেজে উঠল। গভীর ঘুম ভেঙে গেল রিংটোনের শব্দে। ঘুম ঘুম চোখে যন্ত্রটা হাতে নিল আকাশ। সে চোখ খুলে স্কিনে নামটা দেখার চেষ্টা করল। যন্ত্রটা কানের কাছে রাখে। আছিয়া চৌধুরী কাঁদছেন। সহসা সে উঠে বসল। আকাশ এক হাতে চুল ঝাঁকিয়ে বলল, ' কি হয়েছে আন্টি? আপনি কেন কাঁদছেন? চাচা আর তোয়া ভালো আছে তো?'

আছিয়া এলোমেলো কন্ঠে বললেন, ' বাবা, আমার অভ্র কোথায়? এত রাত হলো এখনও বাড়ি ফিরছে না কেন?'

আকাশ বলল,
' আন্টি আপনি কাঁদবেন না। আমি বিষয়টা দেখছি।'

আকাশ শুভকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। দুই ঘণ্টা এদিক ওদিক খোঁজার পর, অভ্রকে খুঁজতে খুঁজতে নীলের বাড়ির রাস্তার কাছে আসলো। ল্যাম্পপোস্টের নিচে গাড়ি পার্ক করে শুভ। তারপর বোতল থেকে পানি পান করে। শুভ ভেজা গলায় বলল, ' আমার মনে হয় আমরা এখানে অভ্রকে খুঁজে পাব।'

রাস্তার ধারে একজন লোক বসে আছে। একটা কুকুর তার সামনে লেজ ভাঁজ করে বসে আছে। লোকটির হাতে বেকারির রুটি, সে তা ছিঁড়ে ছিঁড়ে কুকুরকে দিচ্ছে। লোকটাকে দেখে শুভ বলল, ' ওটা অভ্র না?'

অভ্র হুইস্কি খেয়েছে। ওঁর নেশা চড়েছে। অভ্রকে ধরে গাড়িতে নিয়ে বসাল ওঁরা। এতক্ষণে ভোর হলো চারদিকে ফজর আজান দিচ্ছে। কলিংবেল শুনে দরজা খুললেন আছিয়া। যেন দরজার পাশেই বসে ছিল। ফজর নামাজ আদায় করতে উঠলেন রাজীব চৌধুরী ছেলের অবস্থা দেখে আকাশ ও শুভর থেকে কারণ জানতে চান। আকাশ সত্য কথাটাই বিস্তারিত বলল।

রায়হান সরকার এক সপ্তাহের জন্য নেপালে যান। ওখানের অফিসের সব কার্যক্রম শেষ করে উনি আজই ফিরছেন। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা অফিসে আসেন। হাতে একটু কাজ আছে সেটা সেরে বাড়ি যাবেন। রায়হান সরকারের পিএ দরজায় কড়া নাড়লেন। রায়হান বলল, 'আসো ফাহাদ।'
ফাহাদ বলল, 'স্যার, ব্যবসায়ী রাজীব চৌধুরী আপনার সাথে দেখা করতে আসছেন। আমি কি তাকে নিয়ে আসব?'
'দুই সপ্তাহ আগে পত্রিকায় যে রাজীব চৌধুরীকে নিয়ে একটি আর্টিকেল প্রকাশিত হয়। সে?'
'হ্যাঁ স্যার, তিনিই।'
'যাও, যাও। তাড়াতাড়ি নিয়ে আসো আর তার জন্য খাবারের ব্যবস্থা কর।'

ওঁরা দুজন মুখোমুখি বসে আছে। রাজীব কাজের কথা বলা বন্ধ করে একসময় মূল প্রসঙ্গ তুলে আনেন। একমাত্র ছেলের জন্য তিনি রায়হানের মেয়ের হাত চেয়েছেন। রায়হান রাজীবের মুখ থেকে ঘটনাটা শুনেছে, উনি আকাশের কাছ থেকে যতটুকু শুনেছে তাই বলেছে। উনার মেয়েটি তার চরিত্র ও সম্মান বজায় রেখেছে, গর্ববোধ করেন রায়হান। রায়হানের এখন নীলকে বিয়ে দেওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই। রাজীব চৌধুরীর কথা মাথায় রেখে তিনি তাকে একদিন বাসায় আসতে বলেন, মেয়েটিকে তাঁরা দেখবে, ওঁরা ছেলেটিকে দেখবে। পছন্দ হলে পরে বিয়ের কথা বলবেন।
রাজীব চৌধুরী আগামী শুক্রবার তারিখ দেন। তারপর উঠলেন।

সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরলেন রায়হান। এতদিন পর বাবাকে পেয়ে মেয়ের আনন্দের শেষ নেই। শুক্রবার দু'দিন পর, হাতে সময় বেশি নেই। সে চিন্তা থেকেই নীল ও স্ত্রী রোজাকে মেয়েকে দেখতে আসার কথা জানালেন। নীলের হাসিবরণ মুখটা মূহুর্তেই ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

রায়হানের মা রাহেলা খাতুন ছেলের কথা শুনে বললেন, ' হুট করে দেখতে আসবে বললেই কি হয়? তাছাড়া ছেলে ও তার পরিবার কেমন আগে জানা দরকার তারপর বাকি সব কিছু হবে।'

রায়হান মুচকি হেসে বললেন, ' মা, ওঁরা আসবেন শুক্রবার। আপনি তখন তাদের নিজ চোখে দেখে নেবেন। তারা ভীষণ ভালো লোক আপনার ওদেরকে পছন্দ হবে।'

রাত দশটায় বাসায় ফিরল অভ্র। সে তার বাবার সাথে দেখা করতে তার রুমে আসলো। রাজীব তার ছেলের উদ্দেশ্য বললেন, ' শুক্রবার আমরা মেয়ে দেখতে যাব। মেয়ে পছন্দ হলে তোমার মা তাকে আংটি পরিয়ে দেবেন। তারপর আমি বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করব।'
অভ্রর মন সাঁই দিচ্ছে না, যেতে চায় না সে। ছোটো থেকে বাবার সব কথা মাথা পেতে নিয়েছে অভ্র, কখনও মুখে মুখে তর্ক করেনি। স্বভাবত এখন চুপ করে রইল।
.
.
.
চলবে...........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন