অভ্র নীল - পর্ব ০৩ - শারমিন আক্তার বর্ষা - ধারাবাহিক গল্প

অভ্র নীল 
পর্ব ০৩ 
শারমিন আক্তার বর্ষা 
.
.
.
শুক্রবার খুব দ্রুত এলো। সপরিবারে বেরিয়েছেন রাজীব চৌধুরী। কিছুক্ষণের মধ্যেই আসবেন। রায়হান সরকার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন আয়োজনের কোনো কমতি রাখেন নি। নীলকে সাজিয়ে তোলার জন্য ওঁর বান্ধবীরা আসে। মিসেস রোজা তানজুমের হাতে একটা শাড়ি তুলে দিলেন এবং নীলকে শাড়িটা পরতে বললেন। কাজল শাড়ি পরাতে জানে, সে শাড়িটা পরিয়ে দিল। তানজুম নীলের চুল বেঁধেছে আর তানিয়া একটু সাজিয়ে দিল।

অতিথিদের আপ্যায়ন করে বৈঠকখানায় বসানো হয়েছে। খাবারের সরঞ্জাম টেবিলে সাজানো আছে। রায়হান সরকার ওদের খেতে বললেন। রাজীব চৌধুরী প্রথমে ঠাণ্ডা শরবত হাতে নিলেন। ঠাণ্ডা পানির শরবত খেয়ে আগে শরীর ঠাণ্ডা করবেন। এরপর অন্য কিছু খাবেন। অভ্র কিছুই নেয়নি। তোয়া হঠাৎ বলে উঠল, ' নতুন ভাবীর কাছে যাব।'
আছিয়া বললেন, ' চুপচাপ বসে থাকো। ওরা মেয়েকে নিয়ে আসবে।'
' কখন আনবে?'
' সময় হোক।'

রাহেলা খাতুন সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে। ছেলে এবং পরিবারকে ওনার পছন্দ হয়েছে। রায়হান নীলকে নিয়ে আসার জন্য অনুমতি দেয়। রোজা উপরের তলায় খবর পাঠায়। কিছুক্ষণ পর নীল নেমে এলো। তানজুম নীলের ঠিক পেছনে দাঁড়াল। তানিয়া নীলের কানে কানে বলল, ' আমরা সবাই আছি ভয় পাস না।'

নীলের হাত কাঁপছে অসম্ভব রকমের। একটু ঘামতে লাগল। তারা প্রথম দর্শনেই নীলকে পছন্দ করল। আছিয়া চৌধুরী ব্যাগ থেকে আংটিটা বের করে নীলের আঙুলে পরিয়ে দিলেন। হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন, ' মা, তোমার নাম কী?'
নীল বলল,
' নীলাঞ্জনা।'

খুব ধীরে বললেও বাক্যটা অভ্রর কানে ধরে। অভ্র মাথা তুলে নীলকে দেখে অবাক চোখে আকাশের দিকে তাকায়। আকাশ বাঁকা করে হাসল। ঠোঁট চেপে বলল, ' এই সব আঙ্কেল ব্যবস্থা করেছেন।'
অভ্র মাথা নিচু করে মুচকি হাসল।

চলতি মাসেই বিয়ের তারিখ ঠিক করতে চান রাজীব চৌধুরী। রায়হান সরকার কিছুক্ষণ ভাবলেন, মায়ের সঙ্গে পরামর্শ করে রাজি হলেন।

অভ্র আর নীলকে কিছুক্ষণ আলাদা করে কথা বলার জন্য সময় দেওয়া হলো। নীল অভ্রর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, ' আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারব না। দয়া করে বিয়ে ভেঙ্গে দিন।'
' রিলেশন করো?'
' না।'
' তো সমস্যা কী?'
' আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই না।'
' কিন্তু আমি চাই।'
রাগে ও ক্ষোভে চোয়াল শক্ত করল নীল।

নীল সারা রাত ঘুমাতে পারেনি চিন্তায়। ভোরবেলা স্নান সেরে বিছানায় বসল। আজ কলেজে যেতে ইচ্ছে করছে না। তবুও যেতে হবে। কাল রাতে আম্মু বলেছিল, বিয়ের পর থেকে শ্বশুরবাড়ি থেকে কলেজে যাবা। কথাটা মাথায় গেঁথে আছে।

নীলাঞ্জনার আজ বিয়ে। 
ওঁর বিয়ের আয়োজন চোখে পড়ার মতো। সরকার বাড়িটা নতুন রূপে সেজে উঠেছে। সন্ধ্যার দিকে তারাবাতি ঝিলমিল করছে। লোকজন বিয়ের আসরে বসে গসিপ করছে। রায়হান সরকার পাত্রর বাবা রাজীব চৌধুরীর সঙ্গে দাঁড়িয়ে বিয়ে দেখছেন। নীল কবুল বললে তিনি বুকভর্তি স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলেন।

হঠাৎ তানজুম এসে হাজির। তার চোখ-মুখ ফ্যাকাশে একটানা কান্না করার ফল। তানজুম একটা বাক্স নীলের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, 'নে ধর।'
' এটা কি?'
' তোর জন্য চকলেট। নতুন জায়গায় যাচ্ছিস। প্রয়োজনে লাগবে।'
নীল বাক্সটা নিল।

কনে বিদায়ের সময় কনের সঙ্গে কুলধারা যেতে হয়। তার সঙ্গে যাবেন রাহেলা খাতুন। নিয়ম শেষ করেই বর ও কনেকে গাড়িতে বসানো হয়েছে। কিছুক্ষণ পর গাড়ি চলতে শুরু করে।

নতুন বউ। লোকজন ঘরভর্তি অসংখ্য মানুষের মাঝে ইতস্তত লাগছে নীলের। আছিয়া চৌধুরী ওঁর মুখখানা দেখে বুঝতে পারল, সাদাসিধা মেয়েটা এসবে ওঁ অভস্ত্য নয়। আছিয়া চৌধুরী উঁচু গলায় কথা বলে ঘরটা খালি করে গেলেন। একটা পাতলা শাড়ি তোয়ার হাতে পাঠিয়েছেন। তোয়া শাড়িটা বাড়িয়ে দিতে দিতে বলল, ' মা দিল, বলল, এসব চেঞ্জ করে শাড়িটা পরার জন্য।'
নীল শাড়ি নিল। বলল,
' আমি শাড়ি পরতে জানি না।'

আছিয়া চৌধুরী শাড়ি পরিয়ে দিল। নীলকে মেয়ের মতন আদর যত্ন করেই নিজ হাতে খাবার খাইয়ে দিল আছিয়া। এরপর মাথায় হাত বুলিয়ে চলে যান।

ঘরের দরজা বন্ধ। ছোট বোনেরা দরজা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। বকসিস না পেলে ওঁরা দরজা খুলবে না। বোনদের হাতে টাকা গুঁজে ওদের খুশি করে রুমে এলো অভ্র। নীল বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে গেছে। ঘুমন্ত অবস্থায় মেয়েটাকে ভীষণ স্নিগ্ধ লাগছে। অভ্র আর তাকে ডাকল না। ঘুমাতে দিল।

সকাল বেলা তোয়া হাজির। নীল স্নান সেরে রুমে পা রাখতেই দরজায় টোকা পড়ল। শাড়ির আঁচল দিয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে দরজা খুলল ওঁ। তোয়া বলল, ' মা, তোমাকে ডাকছেন। তুমি তো নতুন বউ। আজ তোমার বউভাত, সেজন্য রান্নাঘরে তুমিই প্রথম আগুন জ্বালিয়ে পায়েস বানাবে। তুমি নিশ্চয়ই রান্না জানো না? আর যদি না জানো তাহলে চিন্তা কোরো না, মা সব দেখিয়ে দেবেন।' তোয়া কথাগুলো বলা শেষ করে নীলের হাত ধরে সিঁড়ির দিকে নিয়ে গেল।

সকল আনুষ্ঠানিকতা সুন্দর ভাবেই মিটে যায়। আগামীকাল থেকে সে নীল কলেজ যাবে। অভ্র তাকে জানায়, রোজ সে ওঁকে কলেজে নামিয়ে দিবে। অভ্র নীলের সঙ্গে কথা বলা শেষ করে বাবা রাজীব চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলতে লাগল। দুই সপ্তাহের মধ্যে তাকে আমেরিকা যেতে হবে। ব্যক্তিগত প্রয়োজন। 

শ্বশুর ও শ্বাশুড়ির জন্য আপেল কাটছে নীল। সহসা ছুরিটা আঙুলে লাগল গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। নীল চেঁচিয়ে উঠল। অভ্র দ্রুত হাত দিয়ে কাঁটা স্থান চেপে ধরে রক্ত বন্ধ করল। উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, ' বাবা, ডাক্তার আঙ্কেলকে কল দাও। অ্যাম্বুলেন্স খবর দাও।'
নীল বলল,
' তেমন কিছু হয়নি। আপনি শান্ত হন।'
আছিয়া আঙুলটা ব্যান্ডেজ করে দিলেন।

নীল বসারঘর ত্যাগ করে। একা ভালো লাগছে না। তোয়া বাড়িতেই আছে। ওঁর সাথে গল্প করার জন্য তার রুমে এলো। দরজা ভেজানো ছিল। তোয়া বারান্দায় আছে। ক্ষীণ স্বরে ফোনে কথা বলছে। ফোনের ওপাশ থেকে কিছু বলছে, তোয়া খিলখিল হাসিতে ফেটে পড়ে। তোয়া বলল, ' তুমি যখন তখন কল দিও না। মা আশেপাশে থাকে ধরতে পারলে ভীষণ বকবে। আমি ফ্রী হয়ে তোমাকে কল দিবো। ঠিক আছে?'
তোয়া কল কাটল।
নীল গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ' কে ছিল?'

তোয়ার থেকে বিস্তারিত শুনে অবাক হলো নীল। বিস্ফোরিত হলো রূঢ় গলায় বলল, ' তোমার বয়স কম। এই সময়টা প্রেম ভালোবাসার না। মন দিয়ে পড়াশোনা করো।'
তোয়া বলল,
' ভাবী, তুমি বাবা-মাকে কিছু বলবে না তো?'
' বলব না।' একপলক চেয়ে বলল নীল।
' তুমি অনেক ভাল।'

রাত ১১টা। নীল শুয়ে ঘুমিয়ে গেছে। বার বার এপাশ ওপাশ করার জন্য শাড়ির কুঁচি খুলে গেছে। অভ্র এলো কিছুক্ষণ পর সে রুমে প্রবেশ করে লাইট জ্বালাল। নীল ঘুমঘুম চোখে উঠে দাঁড়াল। খেয়াল করল শাড়ি খুলে গেছে। লজ্জিত মুখে শাড়িটা শরীরে পেঁচিয়ে নিল। অভ্র বলল, ' আমি যদি পরিয়ে দেই। আপত্তি করবে না তো।'
' মা-কে ডেকে দিন।'
' বর আছে তবু শ্বাশুড়িকে ডাকছ মানুষ কি ভাববে?' 
নীল কথা বলল না। অভ্র শাড়ি ধরল তার প্রতিটা স্পর্শে নীল কেঁপে উঠল। অভ্রর হাত নীলের পেটে লাগতে নীলের শরীর শিরশির করে উঠল। নীল চোখ বন্ধ করে নেয় অভ্র তাড়াতাড়ি শাড়ি পরিয়ে দেয়। অভ্র বলল,
' এইবার আমার মনে হয় তোমার শাড়ি পরা শেখা উচিত।'

নীলা দূরে সরে গেল। অভ্র মৃদু হাসল। মলিন হাসি তারপর বারান্দার দিকে এগিয়ে গেল। জোরে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, 
' আমি তোমাকে সুখ ভেবে ভালবাসি।
তুমি দুঃখ ভেবে দূরে সরাও!'
.
.
.
চলবে..........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন