উন্মুক্ত লাইব্রেরী
পর্ব ২৪
আয্যাহ সূচনা
“নারী তার স্পর্শ সহ্য করতে পারে যে তাকে ভালোবাসে।ভালোবাসা বিহীন যেকোনো স্পর্শ নারী হৃদয়ে কাটার মতো বিধে……”
বলতে বলতে থেমে গেলো অন্বেষা।অনেক বেশি বলে ফেলতে চলেছিলো। কোন স্থিতি? কোন অবস্থানে?এবং কার সম্মুখে কি বলছে মস্তিষ্কে সেটি ধরা দিতে বাঁধ সাধছে।হুট করে এরূপ প্রতিক্রিয়াতে বর্ণের পাশাপাশি অন্বেষা নিজে বিমূর্ত হয়ে দাঁড়ালো।অনিমেষ চেয়ে বর্ণ হিম শীতল কণ্ঠে বলে,
“আমিতো তোমার লগে শয়তানি করতাছিলাম….আর..আমি ভাবলাম তোমারে ছোঁয়ার অধিকার আমার আছে…. এতটুক বিষয়ে কান্দাকাটি করা লাগবো কেন আজব?”
বর্ণের এরূপ সরল অভিব্যক্তি আর কন্ঠ অন্তরে গিয়ে বিধলো।সাথে তার প্রতিক্রিয়া দিতে ব্যর্থ মুখমণ্ডল।অবুঝের ন্যায় এলোমেলো দৃষ্টি ফেলা এই বর্ণ নতুন।বোধহয় লজ্জাবোধ করছে।বুকে কম্পন ধরে অন্বেষার বর্ণের চেহারার দিকে তাকিয়ে।উপলব্ধিবোধটা বর্ণকে বাক্যদ্বয় বলার পূর্বে ভাবা উচিৎ ছিলো।নিজেকে ঠাটিয়ে দুটো চড় দিলেও বোধহয়।
অপরাধবোধে দগ্ধ হয়ে বর্ণের দিকে এগিয়ে যায় অন্বেষা।তার রুক্ষ হাতজোড়া আঁকড়ে ধরতেও দ্বিধা।সে নিজেইতো বর্ণকে সামান্য একটু স্পর্শের কারণে সরিয়ে দিয়েছিল। জানতো সে,অধিকার আছে।বর্ণের স্বভাব সম্পর্কেও অজানা নয়।তাহলে কেনো মস্তিষ্ক কাজ করলো উল্টোপাল্টা?
বর্ণের দিকে চেয়ে বললো,
“কষ্ট পেয়েছো?...আমাকে ক্ষমা করে দাও।”
বর্ণ কোনো জবাব দেয়নি।অবোধ এর মত চেয়ে আছে অন্বেষার দিকে।অন্বেষা কাতর কন্ঠে আবার বলে উঠলো,
“তুমি যখন আমার গালে স্পর্শ করলে তখন আমার মনে হচ্ছিলো তুমিতো আমায় ভালবাসো না,তোমার কোনো অনুভূতি নেই।তাহলে?......মাথাটা টগবগ করে উঠেছিল বর্ণ।…..আমি…আমি ক্ষমা চাইছি!হাত জোড় করছি।মানুষের মধ্যে হুট করে এমন কিছু চিন্তা চলে আসে যা আমাদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না।তখনই ভুলটা হয়।…..আমিও কেমন নির্বোধ!আমি জানি….”
“তুমি কি আমারে ভালোবাসো?”
অনবরত নিজের ভাবনাকে ব্যাখ্যা করতে থাকা অন্বেষাকে থামিয়ে প্রশ্ন করে বসে বর্ণ। অন্বেষা ক্ষণিকের জন্য থমকে যায়।কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে। চোখ খিঁচে বন্ধ করে লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বর্ণকে জড়িয়ে ধরলো। মুহূর্তের মধ্যে বর্ণের অভ্যন্তরে চাপা পড়ে থাকা হৃদয়ে তোলপাড় শুরু হয়।ঝংকার তুলে বাড়তে শুরু করে অস্থিরতা। অন্বেষা অপরিষ্কার কণ্ঠে জবাব দেয়,
“বাসছি…বাসতে শুরু করেছি…ধীরে ধীরে তোমাকে বুঝতে চাইছি।আমাদের মাঝে অনেককিছু অগোছালো।গুছিয়ে নিবো সময়ের সাথে সাথে।বীজ বপনের সাথে সাথে ফলের আশা করা যায়?ধীরেধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
বিনিময়ে বর্ণের বুক ভরা দীর্ঘশ্বাস পেলো অন্বেষা।তবে মুখ ফুটে কোনো জবাব আসেনি। অন্বেষা আবার বলে উঠে,
“তুমি আমাকে ভালোবাসবে বর্ণ?”
“আমি অনুভূতিহীন…”
“ভুল!”
“সত্য”
“আমার জন্য আলাদাভাবে অনুভূতির জায়গা তৈরি করা যায় না?”
“ভাইবা দেখমু…”
“হতে হবে”
বর্ণ অন্বেষার কাছ থেকে সরে আসে।হাত ধরে টেনে এনে চুলোর সামনে বসিয়ে দিলো।পরপর নিজের কোমরে হাত রেখে তার পুরোনো ভঙ্গিতে বললো,
“পিরিতের চেয়ে বড় পেট।তোমার পিরিতে পেট ভরে নাই। ক্ষিদা লাগছে ভাত দাও কালনাগিনী”
অন্বেষা কিছু সময় চেয়ে রইলো বর্ণের দিকে।নিজেকে কাবু করে ফেলতে জানে বোধহয়।ক্ষণিক সময় পূর্বের সবটাই আড়াল করে নতুনত্ব এনে ফেলে।সে কি পালিয়ে বেড়ায়?নাকি ভনিতা করে? অন্বেষা স্পষ্ট দেখেছে বর্ণের সেই ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া ভার মুখ।
অন্বেষা ক্লান্তি উধাও।দ্রুত খাবার গরম করলো।নতুন প্লেটে সুন্দর করে খাবার সাজিয়ে রাখলো বর্ণের সামনে।উঠে চলে যেতে চাইলে বর্ণ বলে উঠে,
“খাওয়ায় দাও”
এরূপ আবদারে ঘুরে তাকালো অন্বেষা।শীতল মুখে আকস্মিক শয়তানি হাসি ফুটায় বর্ণ।বলে,
“এটা তোমার শাস্তি!আমার লগে ঘাউরামি করার শাস্তি।আজকে থিকা তিনবেলা খাওয়ায় দিবা আমারে।”
অন্বেষা হাসি মুখে এগিয়ে আসলো।এতে করে যদি তাদের সম্পর্কের জোট মজবুত হয়।একদিন সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে উঠবে তাদের মধ্যে এই প্রত্যাশাটাও জন্মেছে আজকাল।বর্ণের মুখে খাবার তুলে দিলো নিজ হাতে।ছোট বাচ্চাদের ন্যায় মুখভর্তি করে খাচ্ছে।
অস্পষ্ট গলায় বললো,
“তোমার লগে থাকার একটা জিনিস ভালো হইছে মজায় মজায় খাইতে পারতাছি।নইলে চানখাঁরপুল মোড়ের খাওয়ন এত বিশ্রী!ছিঃ! ডাইলরে পানি মনে হইতো।আর সবজির নামে খালি আলু।”
অন্বেষা বললো,
“তাহলে বলতে চাইছো আমার হাতের খাবার ভালো?”
বর্ণ কপাল কুঁচকে ফেলে। সরাসরি প্রশংসা তার সাথে যাচ্ছে না। ইনিয়ে বিনিয়ে বললো,
“আছে মোটামুটি।চলার মতো…”
অন্বেষা হাসলো।বললো,
“আমিও শুরুর কিছু বছর এসব খাবার খেয়েই পাড় করেছি।তারপর মনে বল এলো।এখন এই জীবনটা আমার।আমার একার।আমি আমার সেই প্রত্যেকটা ইচ্ছা পূরণ করবো।দিনরাত পরিশ্রম করতে হলে করবো।যেনো আমার এতটুকু সামর্থ্য থাকে আমি যখন যেটা খেতে চাই খেতে পারি।”
বর্ণ নত সুরে জবাব দিলো, “হুম…”
অন্বেষা বর্ণের মুখে ভাতের শেষ লোকমা পুরে দিয়ে বললো,
“আচ্ছা বর্ণ তোমার কোন খাবার সবচেয়ে বেশি পছন্দ বলোতো?”
পছন্দের খাবারের কথা শুনে বর্ণ ঢেঁকুর তুলে বললো,
“গরুর কালা ভুনা আর ঝাল ঝাল ভুনা খিচুড়ি। আহা!কত্ত বছর আগে খাইছি….পুরাই অমৃত।”
“সত্যিই?”
“তো কি মজা করমু তোমার লগে…..ধুর ছেমড়ি দিলাতো লোভ লাগায়া।বাদ দাও আমি এই শুক্রবারে একটা বিয়েবাড়িতে ঢু মাইরা আমু।”
অন্বেষা শাসিয়ে বলে উঠে,
“একদম না!এসব কাজ করবে না।আমি তোমার জন্য শুক্রবারে রান্না করবো।”
বর্ণ তীর্যক দৃষ্টিতে চায় অন্বেষার দিকে।পরপর তার ওড়না টেনে মুখ মুছে দিলো।মাথার পেছনে হাত রেখে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বললো,
“তোমার আব্বায় মনে হয় যাওয়ার আগে ট্যাকার গাছ লাগায় গেছিলো। পাড়বা আর খাইবা না?”
“সেসব নিয়ে আপনার ভাবার দরকার নেই জনাব।আপনি আরাম করে খাবেন আপনার কাজ এতটুকুই।”
বর্ণের অধরের এক কোণে ম্লান হাসি। অন্বেষার অদেখা হাসি।যার অর্থ বর্ণ নিজে নিজেই অনুধাবন করতে পারছে।এক ভিন্ন অনুভব তাড়না দিয়ে উঠলো।তার পেছনে খরচ করা অন্বেষার সময়,তার প্রয়াস।তার সাথে সাথে নিজেকেও সুখে রাখার।
অন্বেষা বারান্দা থেকে কাপড় তুলতে ভুলে গিয়েছিল।কাপড় নামিয়ে হাতের আঙুলে হিসেব করতে লাগলো।শুক্রবারে স্পেশাল রান্নার জন্য কত টাকা খরচ হবে।গণনার মাঝেও অনুভব করলো কেউ তার পেছনে দাঁড়িয়ে।ঘুরে তাকালো তাড়াতাড়ি।ছোট স্থান।হাত ভাঁজ করে দেয়ালের সাথে বর্ণকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চমকে উঠে।বর্ণ আকস্মিক গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করে উঠলো,
“তুমি তোমার জীবনে কি চাও?”
জবাব দেওয়ার পূর্বে বর্ণের মুখপানে চোখ যায়।তারার ন্যায় জ্বলজ্বল করতে থাকা দুচোখ বলছে ভিন্ন ভাষা।সর্বদা ছটফটে বর্ণের মাঝে আজ গভীর শান্তি।জবাব দিলো,
“বাবা মা তো চলে গেছেন।আমি সবসময় চাইতাম আমার জীবনসঙ্গীকে নিয়ে আমার এক অগাধ সুখের সংসার হবে।……আমি সুখে থাকতে চাই বর্ণ….আমার একান্ত ব্যক্তিগত মানুষটাকে নিয়ে।যার কাছে আমার হৃদয় থাকবে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত”
বর্ণ বারান্দায় এগিয়ে এলো।হাত বসে পড়লো জমিনে।মেরুদণ্ড সোজা করে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসেছে।মাথা তুলে অন্বেষার দিকে চেয়ে বলে,
“বও এদিকে।হাত টানলে কইবা ‘ ভালোবাসা ছাড়া স্পর্শ বেডি মানুষ সহ্য করতে পারেনা’।” শেষ কথাটি মুখ ভেঙিয়ে বললো বর্ণ।
অন্বেষা কাপড়গুলো রেলিংয়ে ঝুলিয়ে পাশে বসলো। বিনীত সুরে বললো,
“আর কখনও বলবো না ওসব।ভুল হয়েছে”
“থাক থাক!আর ঢং করা লাগবো না।”
অন্বেষা মাথা নুয়ে ফেলে।এই ভুলের ঘানি কতদিন টানতে হবে কে জানে?বর্ণ অন্বেষার চুপসে যাওয়া মুখ দেখে হেসে ফেলে।আড়চোখে দেখলো অন্বেষাও।
কিছুসময় নিশ্চুপ আকাশপানে তাকিয়ে রয়ে বর্ণ প্রশ্ন করে,
“চাইলে একটা রাঘব বোয়াল ধরতে পারতা।বিয়া শাদী কইরা রাজরানীর মতো দিন কাটাইতে পারতা।সুখ খুঁজতে আইলা তাও আবার ফকিরনীর ঘরে।যার তোমারে না খাওয়ান পিন্দানের ওকাদ আছে না ভালোবাসার মত মন।নিজের পায়ে নিজে কুড়াল তোমরা মাইয়ারা নিজেরাই মারো।পড়ে ভেটকায় কান্দো।”
অন্বেষা চরম অধিকারবোধ খাটিয়ে বর্ণের হাত তার দুহাতে পেঁচিয়ে ধরলো।কাঁধে মাথা রেখে বললো,
“এতো লোভ করতে নেই বাপু….আমার ভাগ্যে যেটা ছিলো আমি সেটা পেয়ে গেছি।”
“বেয়াহা মাইয়ালোকের মতো ঘেষাঘেষি করো কেন?”
“ওমা!তুমি বুঝি পর পুরুষ?”
বর্ণ কপাল কুঁচকে জবাব দিলো,
“ন্যাকা!এই ঢং কইরা কয় পেরেম ভালোবাসা ছাড়া কাছে আহন যায় না।আর এহন নিজেই গায়ে ঢুইলা পড়তাছে।তোমরা মাইয়ারা আসলেই দুই মুইখা সাপ।”
“আমার অধিকার আছে বুঝেছো।আমি তোমার মত জল্লাদ ব্যাটালোককে ভালোবাসার চেষ্টাতো করছি।তুমিতো সেটাও করছো না।তো আমার অধিকার খাটানো জায়েজ”
“তুমি একটা ডায়নী বুড়ি!রক্ত চোষা জোঁক”
অন্বেষা ঠোঁট টিপে হেসে উঠলো। পরক্ষণেই জবাব দেয়,
“উহু!বিষধর সাপ।ছোবল খেলে বাঁচবে না।তো সাবধানে থেকো।”
শীতকাল কড়া নাড়ছে দুয়ারে।প্রকৃতি নিঃস্তব্ধ। শীতল শিহরণ প্রতিটি নিঃশ্বাসে।নিসর্গে নিঃসীম শূন্যতা। নিশির হিমেল হাওয়ায় স্নায়ু নীরব।নীরব একজোড়া কায়া।মনে হলো উভয় প্রাণে বিরাজ করছে প্রশান্তি।নিঃস্তরঙ্গ বায়ুপ্রবাহে ছুঁয়ে কম্পিত করলো অঙ্গ কয়েকবার।লেপ্টে রইলো অন্বেষা।বর্ণের বাহুতে খুঁজছে উষ্ণতা।
“বর্ণ?”
“হুম?”
“শীত আসছে…”
“হুম”
“আমার ভীষণ প্রিয় ঋতু”
বর্ণ আকাশ আঁধারের ঘোরে নিমগ্ন।শুনছে,বুঝছে,জবাব দিচ্ছে।সম্পূর্ণ স্থবির দেহ, নিষ্ক্রিয়তা অঙ্গে অঙ্গে।কুড়েমিতে ভুগছে সে।জবাব দিতেই আলসেমি করলো।শুধু বললো,
“হুম”
“শীতে নতুন প্রেমের সূচনা হয় জানো?”
এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘাড় ঘুরায় অন্বেষার দিকে।কি আরাম!কি শান্তিতেই না মাথা এলিয়ে রেখেছে তার কাঁধে।হিংসে হলো বর্ণের।তারও চাই এই আরাম।হাত ছাড়িয়ে নিলো তৎক্ষনাৎ।ঝড়ের গতিতে অন্বেষার কোলে মাথা রাখে।জায়গা হচ্ছে না তার এই বিশাল দেহের এই দেড় ফুট এর মতো বারান্দায় তারপরও মানিয়ে নিলো।হাত পা গুটিয়ে শুয়ে বললো,
“চুল টাইনা দাও। ঘুম পাড়াও আমারে।”
বর্ণের এমন আবদারে মন অভ্যন্তর প্রফুল্ল হয়ে উঠে। স্বেচ্ছায় তার আবদারগুলো পূরণ করার জন্য উৎকণ্ঠা হয়ে উঠে। অন্বেষা ঝাঁকড়া চুল গভীরে হাত রাখলো। ধীর হাতে চুল টেনে দিতে থাকে।পনেরো মিনিটের মধ্যে বর্ণকে লক্ষ্য করে দেখলো ঠোঁট চেপে কাত হয়ে বিভোর তন্দ্রায়। পা ঝিমঝিম করছে।তবে সরে যাওয়ার উপায় নেই।
চুল থেকে হাত সরিয়ে সাহস সঞ্চয় করে অন্বেষা।ভয় হচ্ছে।তবে প্রবল ইচ্ছেরা উড়তে শুরু করলো।খুব সাবধানে হাত এগোলো বর্ণের ঘুমন্ত মুখে। বিড়বিড় করে বলে উঠে,
“তোমার মুখ কতটা মায়াময় জানো?অযথা কেনো মিথ্যে ভনিতা করো?”
বর্ণ ঘুমিয়ে।নয়তো এতক্ষণে উঠে অন্বেষাকে দু চারটে কথা শুনিয়ে দিতো। শিউর হয়ে নিলো অন্বেষা।সাহস দ্বিগুণ হয়।কপাল থেকে চুল সরিয়ে চট করে অধর ছুঁয়ে সরে গেলো।নিজের এমন কর্মকাণ্ডে লজ্জায় কুঁকড়ে যেতেও বেশি সময় নেয়নি।লাজে একাকী চোখ মুখ খিচে আছে।নিজেকে মনে মনে ‘ বেহায়া’ বলে শায়েস্তা করে।
নিঃশ্বাস ফেলে আবারও বর্ণের দিকে চায়।সত্যিই ঘুমিয়েতো?নাহয় তাকে এখানে টিকতে দিবে না।খোটা আর লজ্জা দিতে দিতে ঘরছাড়া করবে।
বর্ণ নড়েচড়ে উঠে।ঘুমের ভান ধরে থাকা বর্ণ মুখ নুয়ে অন্বেষার দৃষ্টির আড়ালে আলগোছে হাসলো।
_________
“কেমন আছো? তোমারেতো আজকাল দেহাই যায় না এই গলিতে। ঘর পাল্টাইছো নাকি?”
পুরোনো বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় পথিমধ্যে জনির সঙ্গে দেখা।ছেলেটার মতলব আগেই বুঝেছে অন্বেষা।আজ মুখ কুচকে ফেললো।জবাব দিলো,
“সেটা কি আপনার জানার বিষয়?”
জনি ভ্যাবাচ্যাকা খেলো।জোরপূর্বক হেসে বললো,
“আরেহ রাগ করতাছো ক্যালা?আমিতো এমনেই জিগাইলাম”
“আমি রাগ করিনি” কাটকাট জবাব দেয় অন্বেষা।
জনি বলে উঠে,
“আমরা হইলাম এই এলাকার স্থানীয় বুঝলা।আমরা এলাকার মানুষের খোঁজ খবর রাখমু নাতো কেঠা রাখবো কও?তুমি নতুন এলাকায়।”
অন্বেষার অজান্তে তাকে চোখে চোখে রাখা বর্ণ ঘাড় বাঁকা দাঁড়িয়ে আছে চায়ের দোকানের পাশে।দেখছে দুজনকে।হাত বাড়িয়ে অনুমতি ছাড়াই দুটো সুপারি হাতে তুলে নিলো।সেগুলো মুখে পুরে চিবুতে শুরু করে।
অন্বেষা এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে জবাব দেয়,
“আমার স্বামীও এখানকার স্থানীয়।”
“আচ্ছা? কি নাম তোমার জামাইর?”
বর্ণ হন্তদন্ত পায়ে এগিয়ে আসে। ঘাড় কাত করে জনির মুখের কাছাকাছি এসে চেয়ে বললো,
“বর্ণ”
জনি কপাল কুঁচকে ফেললো।এতক্ষণ যাবত অন্বেষাকে দেখে যে ফুরফুরে মেজাজ ছিলো সেটি উধাও।বললো,
“কিহ!”
বর্ণ অন্বেষার পাশে দাঁড়িয়ে তার বাহু চেপে ধরে কাছে টেনে নেয়।হেসে বললো,
“ওর জামাইর নাম বর্ণ”
ভরা রাস্তায় এভাবে নিজের সাথে মিশিয়ে রাখায় লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছে অন্বেষা।আশপাশের মানুষ চেয়ে আছে।কেউ মিটিমিটি হাসতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে। অন্বেষা নতজানু হয়ে রইলো।
জনি উত্তেজিত গলায় বলে উঠে,
“কুত্তার বাচ্চা তুই ওর জামাই?তোর মত কুলাঙ্গার।”
অন্বেষা ফট করে মাথা তুলে। রাগান্বিত স্বরে বলে উঠলো,
“মুখ সামলে কথা বলবেন।কে আপনি?রাস্তায় মেয়েদের পথ আটকে বিরক্ত করেন।”
জবাবে বর্ণ বলে,
“ওয় হইলো বাপের হেডামে চলা একটা ছিলা মুরগি।যার নিজের বাল গজায় না অন্যের বাল হাওলাত কইরা লইয়া চলে”
বর্ণ আর জনির মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখতে এলাকাবাসী একটু বেশীই উপভোগ করে।এবার সাথে মেয়েও আছে।আরো উৎসাহ নিয়ে তাদের আলোচনা শুনছে।বর্ণ আশপাশ চেয়ে দেখলো। অন্বেষাকে ছেড়ে সবার উদ্দেশ্যে বললো,
“দেখছেন নিহি কারবার? মোকলেস মাতবরের পোলা আমার লগে পারেনাই এহন আমার বউটার দিকে নজর দেয়। রাস্তাঘাটে পথ আটকায় রাখে।এই হইলো মহল্লার গন্যমান্য বেডার ঘরের আউলাদ”
সকলে কানাঘুষা শুরু করে।এবারে আঙ্গুল উঠেছে জনির উপরেই।রক্ত টগবগ করে উঠছে জনির। লাঞ্ছিত হচ্ছে।রাগে কাঁপতে লাগলো।বর্ণ এগিয়ে আসলো।জনিকে একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে অন্বেষা থেকে দূরে সরিয়ে নেয়।জনির গাল একহাতে চেপে ধরে নিজের মুখোমুখি এনে চোয়াল শক্ত করে ধীর কণ্ঠে বললো,
“তুই প্রতিশোধ নিতে উথাল পাথাল করবি আমি জানি।কিন্তু আমার বউয়ের কোনো সম্মানহানী হইবো?কোনো তাফাল্লিং করবি? ওরে মোহরা বানায় চাল চালবি?কসম খোদার কলিজা টাইনা বাইর কইরা কুত্তারে খাওয়ায় দিমু। বাপের ব্যাটা হইলে আমার লগে গ্যাঞ্জামে সীমাবদ্ধ থাকিস।ওই ছেড়িরে আমগো মামলায় টানবি পরিণতি বহুত খারাপ হইবো”
ছুঁড়ে ফেলে দিলো জনিকে আবর্জনার ন্যায়।আরেকটু হলে দাঁতের মাড়ি ভেঙে যেতো।বর্ণ অন্বেষার হাত চেপে নিয়ে বেরিয়ে গেলো মহল্লা থেকে।রিকশা ডেকে উঠলো দুজনেই।এখনও ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে বর্ণ।রক্ত গরম বোঝাই যাচ্ছে। অন্বেষা আর কোনো কথা বললো না।কিন্তু বর্ণ হুংকার ছেড়ে বলে উঠে,
“আর কতগুলি আশিক আছে তোমার?ওই ভোটকা,তারপর আবার এই জইন্না!লিস্ট দিও সবটিরে এক এক কইরা ডোজ দিমু নে।”
“আমি কি বলেছি ওদের আমার পিছু নিতে?”
“কওয়া লাগবো কেন?এই থোবড়াটা প্রদর্শন কইরা ঘুরলে সবাই পিছে লাগবো।”
“এখন কি করবো এই থোবড়ার জনাব বলে দিন আপনিই?একটা কাজ করি?প্লাস্টার করে ফেলি।তারপর মমি সেজে ঘুরবো ওকে?”
বর্ণ বাঁকা চোখে চাইলো একবার। অন্বেষা ভনিতা করে বোকা চোখে চেয়ে আছে।বর্ণ মুখ ঘুরিয়ে ফেললো। রাশভারী গলায় বললো,
“কি সাইজা ঘুরবা ঐটার ব্যবস্থা আমিই করমু।”
অন্বেষা ভেংচি কাটলো।বিড়বিড় করে বললো,
“যার আশিক হওয়ার দরকার তার খবর নেই। পাড়া পড়শীর ঘুম নেই”
_____
জীবনের সাথে নতুন চাকরির জন্য গিয়েছিলো বর্ণ।তারা বলেছেন জানাবেন।কোনো প্রকার আশা না রেখেই টিউশন শেষ করে দাঁড়িয়ে আছে ফুটপাতের এক দোকানের সামনে।পকেটে এক হাজার টাকা।কপালে ঘাম।অনেকটা পথ হেঁটে এসে হাঁপিয়ে উঠেছে। দর কষাকষি করে প্রয়োজনমত পণ্য কিনে বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলো।
অপেক্ষায় পায়চারি করছে অন্বেষা। ফোন করেছে বর্ণের নাম্বারে অনেকবার।ফোন বন্ধ বলায় আরো চিন্তা হচ্ছে।নিচ তলায় যাওয়া বারণ।বারান্দায় ঘুরাফেরা করতে করতে দেখলো বর্ণ আসছে।হাতে শপিং ব্যাগ।সেটি আঙুলের সাহায্যে ঘুরাতে ঘুরাতে উপরে অন্বেষার দিকে চাইলো।পায়ের গতি বাড়িয়ে উপরে উঠে আসে।
অন্বেষা দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে সরাসরি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,
“কোথায় ছিলে?ফোন বন্ধ কেনো?আমি কত টেনশনে ছিলাম জানো?”
বর্ণ নির্বাক।হাতের শপিং ব্যাগটা ছুঁড়ে দিলো অন্বেষার হাতে।হতভম্ব অন্বেষা প্রশ্ন করে,
“এটা কি?”
অর্ধ বিছানায় শুয়ে পড়লো বর্ণ। পা জোড়া নিচে ঝোলানো। খ্যাঁক খ্যাঁক করে বলে উঠলো,
“আল্লাহ দুইটা চোখ তো দিছে।দেখতে পারো না?”
অন্বেষা ব্যাগ থেকে বের করে দেখলো কালো রংয়ের একটি বোরকা।সাথে নেকাব আছে।ব্যাগ হাতড়ে আরো একটি ছোট্ট প্যাকেট খুঁজে পেলো।খুলে দেখলো সেটিও।একটি ছোট সাদা পাথরের কানের দুল।
অন্বেষা অবাক দৃষ্টিতে প্রশ্ন করে, “এগুলো আমার?”
বিরক্তির সুরে বর্ণ বলে উঠে, “না আমার।আমি পিন্দুম।”
বর্ণের কথার ধরনে হেসে ফেলে অন্বেষা। বোরকা দেখতে দেখতে পাশে এসে বসলো।প্রশ্ন করলো,
“টাকা কোথায় পেলে?”
“চুরি করছি”
“তাহলে তুমি বখাটে বাউন্ডুলের পাশাপাশি চোরও?”
“হ।খানদানি চোর!”
“আর এই কানের দুল?”
“ফ্রি দিছে বোরকার লগে”
অন্বেষা বর্ণের বুঁজে থাকা চোখের দিকে চাইলো।স্পষ্ট মিথ্যে বলছে।হেসে বললো,
“ভন্ড বর্ণ!সে সত্য আর অনুভূতি থেকে পালিয়ে বেরায়।পুরোটাই মিথ্যেবাদী,নকল”
চলবে…........................