তুমি রবে নীরবে - পর্ব ০২ - নাদিয়া সাউদ - ধারাবাহিক গল্প


!!৩!!

রওনকের মুখের উপর কথাগুলো বলতে পেরে শান্তি লাগছে কুহুর।ফুরফুরে মেজাজে ডাইনিং রুমে আসলো সে।টেবিলে গরম গরম এক বাটি চিকেন বল রাখলেন শারমিন বেগম।একপাশে চেয়ারে বসে আছেন রাশেদ জামাল।কুহুকে দেখে হাসিমুখেই ডাকলেন।সালাম জানিয়ে চেয়ার টেনে বসলো কুহু।কেমন জড়তা আর ভয় কাজ করছে তার।কেবল দুটো চিকেন বলের বেশি খেতে পারলো না।হাসিমুখে কথা বললেও রাশেদ জামালের মুখে সবসময় গম্ভীরতার এক গাঢ় ছাপ থাকে'ই।শিক্ষক বলেই হয়তো।সানফ্লাওয়ার স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ তিনি।স্কুলে থাকাকালীন রাশেদ স্যার বলতেই ভীষণ ভয় পেত কুহু।শারমিন বেগমকে আন্টি ডাকলেও রাশেদ স্যারকে কখনো আংকেল সম্মোধন করা হয়নি।ভয় আর সম্মানের জায়গাটা এখনো আছে।স্বামীর পাতে রুটি আর তরকারি তুলে দিলেন শারমিন বেগম।পরক্ষণে কুহুর বাটির দিকে নজর পরতেই বললেন,
"খাচ্ছ না কেন কুহু?ঠান্ডা হয়ে যাবে তো!

কুহু একটুখানি হাসলো,তবে কিছু বলতে পারলো না।খাওয়ায় মনোযোগী রাশেদ জামাল পড়া সম্পর্কে এটা-ওটা জিগ্যেস করে যাচ্ছে কুহুকে।দৃষ্টি নিচে রেখে উত্তর দিচ্ছে কুহু।


কুহু'র অপেক্ষায় ধৈর্য্য হারা হয়ে গেল রওনক।উঠে ডায়নিং রুমে চলে আসলো।বাবার সঙ্গে কুহু'কে খোশগল্প করতে দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল!পড়ার সময়টুকু যে পেরিয়ে যাচ্ছে সেই বোধ আছে এই মেয়ের?ছেলেকে দেখতে পেয়ে ডাকলেন শারমিন বেগম।কিঞ্চিৎ রাগত্ব মুখে এগিয়ে গিয়ে বলল রওনক,
"সবকিছুর একটা নির্দিষ্ট সময় আছে।আমার অন্য কাজ থাকে।পড়ানোর জন্য হাতে অঢেল সময় নিয়ে বসে থাকি না।এমনিতে দূর্বল স্টুডেন্ট'দের সময় বেশি দিতে হয়।

রওনকের কথা শুনে পেছন ফিরে তাকালেন রাশেদ জামাল।পরক্ষণে চেয়ারে বসতে বললেন ছেলেকে।বাবার কথার উপর কিছু বলল না রওনক।নিশ্চুপ হেঁটে এসে কুহুর মুখোমুখি বসলো।তখনো দৃষ্টি নিচু করে রেখেছে কুহু।রাগে,অপমানে গা জ্বলে যাচ্ছে তার!কতবড়ো একটা খোঁটা দিয়ে বসলো লোকটা!তারউপর কুহুকে দূর্বল ছাত্রী বলল!কে বলেছিল পড়াতে শুনি?
কি হবে এমন হাবলা স্যারের কাছে না পড়লে?আজকেই বাড়িতে গিয়ে মাকে বলবে,রওনকের মতো হামবড়া স্যারের কাছে আর পড়বে না সে।রাশেদ জামাল গম্ভীর স্বরে ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন,
" তোমার মা খাবার তৈরি করে কুহুকে ডেকেছে।তাই ওর যেতে একটু দেরি হয়ে গেছে।সমস্যা নেই,এটা তো তোমার ক্লাসরুম নয়।কয়েক মিনিট মানিয়ে নিতে পারবে।

পাল্টা আর কোনো উত্তর দিল না রওনক।বসে রইল নিশ্চুপ।দূর থেকে উঁকি দিয়ে পরিস্থিতি দেখছে রিশা।খাওয়ার মাঝে ছেলের শিক্ষকতা নিয়ে জিগ্যেস করলেন রাশেদ জামাল।রওনক উত্তর দিচ্ছিল একের পর এক।মাঝে থেকে কথা টেনে নিয়ে কুহু বলল,তাদের একাউন্টিং ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট'রা ক্লাসে পড়া তেমন বোঝেই না।কমবেশি সবারই রেজাল্ট খারাপ হয়।স্যার অযথা রাগ দেখায় বলে কেউ অভিযোগ করার সাহস পায় না।

কুহু যে বাবার সামনে এরকম একটা কথা বলবে, কল্পনাও করেনি রওনক!মেয়েটা স্পষ্ট বুঝিয়ে দিল সে ভাল লেকচারার নয়,তাই ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার ফলাফল খারাপ হয়।অথচ ক্লাসে পুরো মনোযোগ নিয়ে পড়ায় রওনক।কুহু তাকে বিপাকে ফেলতে বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে বলছে!রাগে কপালের রগ ফুলে উঠলো রওনকের।সব জায়গায় ইয়ার্কি করা সাজে না।বাবার সামনে তর্ক করলো না সে।কুহুর কথা শুনে খুবই হতাশ হলেন রাশেদ জামাল।অবশ্য শতভাগ ছেলের দোষ দেওয়া যায় না।সবে প্রভাষক হিসেবে যোগ দিয়েছে সে।ঠিক-ভুল হতে হতেই সঠিকটা রপ্ত করে নেবে।ক্লাস সম্পর্কে অনেক ধারণা,জ্ঞান দিলেন রওনককে।দু'জনের অগোচরে ঠোঁট টিপে হাসছে কুহু।রওনক ভাইয়ের মুখটা দেখার মতো হয়েছে এমুহূর্তে!দূর থেকে এসব শুনে কপাল চাপড়াচ্ছে রিশা!রওনক যে ভয়ানক রেগে যাচ্ছে এটুকু বুঝতে বাকি নেই।নির্ঘাত কুহুটার কপালে আজ শনি আছে।রওনক ক্লাসে খুব গম্ভীর আর রাগী।প্রতিটা স্টুডেন্টের পড়ার বিষয়ে তদারকি করে সে।পড়ানো নিয়ে সবাই তার প্রশংশা করে।কিন্তু কুহু'র মুখে সাদুবাদ নেই!আর না সে কখনও রওনক'কে সমীহ করে!মাথা নিচু করে বাবার বেদবাক্য শুনলো রওনক।পরক্ষণে উঠে চলে গেল রিশার রুমের দিকে।মিনিট এক পরে কুহু উপস্থিত হলো।রওনকের হাতে হিসাববিজ্ঞান নীতিমালা বই দেখে শুকনো ঢোক গিলল খানিক।ম্যাথ বিষয়টা একটুও ভাল লাগে না তার।খানিকটা হাসার চেষ্টা করে নিজের বই এগিয়ে ধরে বলল,
"কিন্তু আমি তো ব্যাষ্টিক অর্থনীতি বই এনেছিলাম স্যার।

কুহুর কথা কানে তুলল না রওনক।কোনোমতে আজ থিওরি বিষয়ে যাবে না সে।উচিৎ শিক্ষা দিয়েই ছাড়বে।অসহায় দৃষ্টি ফেলে রিশার দিকে তাকাল কুহু।রিশা ঠোঁট উল্টে বুঝিয়ে দিল কিছুই করার নেই তার।বেশ মনোযোগ নিয়ে পড়া বোঝাতে লাগলো রওনক।রিশা ফটাফট উত্তর বের করে ফেললেও,কয়েক জায়গায় আঁটকে যাচ্ছে কুহু!ব্রেইনকে সর্বোচ্চ প্রেশার দিচ্ছে সে।একই পড়া বেশ কয়েকবার বুঝিয়ে দিল রওনক।পরক্ষণে কুহুকে বলল ম্যাথ সমাধান করতে।মাথায় ঘাম বিন্দু জমলো কুহুর।গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল!আজকে আর রক্ষে নেই!অনেক্ক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর ব্যর্থ হলো কুহু।হাত ভাজ করে নিয়ে কুহুর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল রওনক,
" তা ব্রিটেনের রানীকে এখন কি শাস্তি প্রদান করা যায়?

আমতাআমতা করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল কুহু,
"আব্ একদম খোঁচাবেন না।আপনি জানেন না রানী এলিজাবেথ সবচেয়ে ক্ষমতাশালী নারী।তার জন্য কোনো আইন নেই!সুতরাং আমার শাস্তি আমি নির্ধারণ করবো।

কুহুর পাগলাটে,অযৌক্তিক কথার কি জবাব দিবে বুঝতে পারল না রওনক!হতবুদ্ধি হয়ে কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে রইল।দাঁত দিয়ে নখ কেটে কিছু একটা ভাবলো কুহু।পরক্ষণে বলল,
"কোনো শাস্তিই তো মাথায় আসছে না এমুহূর্তে!আপনি বরং আমাকে আর একদিন সময় দিন।কালকে যদি পড়া ঠিকঠাক না পারি তাহলে যা শাস্তি দেবেন মেনে নিব।

পালানোর পায়তারা চলছে কুহুর ভেতরে।সেটুকু বুঝতে বাকি নেই রওনকের।তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল সে,
" ঠিক আছে দিলাম একদিন সময়।যতক্ষণ অংক সমাধান করতে না পারছো ততক্ষণ পর্যন্ত এই টেবিল ছেড়ে উঠবে না।কথামতো ২৪ ঘন্টা সময়-ই দিলাম।

রওনকের কথায় ভ্যাবাচ্যাকা খেল কুহু!রিশা মিটিমিটি হাসছে।কি দরকার ছিল ভাইয়াকে রাগিয়ে দেওয়ার?এখন বুঝুক!মুখটা বাংলার পাঁচের মতো করে ফের টেবিলে বসলো কুহু।রিশাকে ছুটি দিয়ে দিল রওনক।পরক্ষণে নিজের ফোনের ক্যামেরা অন করে টেবিলে রেখে বলল,
"আমি নিজের রুমে যাচ্ছি।যদি রিশা সাহায্য করে তোমাকে তাহলে এর পরিণাম ভাল হবে না।সব ভিডিয়ো রেকর্ড হচ্ছে ফোনে।

কথাটুকু বলে প্রস্থান করলো রওনক।কুহু হতভম্ব হয়ে গেল!এই লোক এত বুদ্ধি নিয়ে ঘুমায় কি করে?অবশ্য এগুলোকে কুটনৈতিক বুদ্ধি বলে।বেশ অনেক্ক্ষণ চেষ্টার পর দু'টো ম্যাথ সমাধান করলো কুহু।বাকি একটা নিয়ে রওনকের রুমে গেল।বেশ মনোযোগ নিয়ে একটা মোটা বই পড়ছে রওনক।খানিক গলা ঝেড়ে ডাকল কুহু।বইয়ের মাঝে দৃষ্টি রেখেই ভেতরে প্রবেশ করতে বলল রওনক।দ্রুত এগিয়ে এসে খাতা দেখাল কুহু।রওনক কিছু বলার পূর্বে মোবাইল বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
" ভিডিয়ো রেকর্ড দেখে নিন।আমি একাই সমাধান করেছি।

ভিডিয়ো টা দেখে নিয়ে খাতা দেখল রওনক।গম্ভীর স্বরে বলল,
"আরও একটা তো বাকি আছে!

"দেখুন আমি যতটা পারি তাতে পাশ করার জন্য যতেষ্ট।এর বেশি ব্রেইনে চাপ দিলে মাথার রগ ফেটে যাবে।

" আচ্ছা!তবে এই একটার শাস্তি তো অবশ্যই পাওনা তুমি!বাথরুমে আমার শার্ট'টা রাখা আছে।আজকে যেটা বৃষ্টিতে ভিজে গিয়েছিল।যাও কেঁচে দাও ওটা।নয়তো ছুটি নেই।

রওনকের কথায় মাথায় যেন বাজ পড়লো কুহুর!চোখমুখ কু্ঁচকে বলল,
"আজব!আমাকে কি আপনার বউ মনে হয়?পড়া না পারলে ছাত্রীকে এরকম শাস্তি দেয় কোন স্যার?

বইটা রেখে উঠে দাঁড়ায় রওনক।ট্রাউজারের পকেটে হাত পুরে নিয়ে বলে,
"তোমাকে বউ ভাবার প্রশ্নই আসে না!তোমার কথায় বোঝা যাচ্ছে আমি তোমাকে বউ করে নিয়ে না আসলে কাপড় কেঁচে দিবে না তুমি!কাজের মেয়েও তো বলতে পারতে!

রওনকের কথায় তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে কুহু!নাকের পাটা ফুলিয়ে বলল,
"দুঃস্বপ্নেও আপনার বউ হতে চাই না।এই বাড়ির কাজের লোক হওয়ারও ইচ্ছে নেই।

কথাটুকু বলে'ই হনহন করে চলে গেল কুহু।দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিরবির করে বলল রওনক,তোমাকে ঘরনি বানানোর আগ পর্যন্ত থামছি না নির্বোধ মেয়ে!তোমার উপর কেবল আমার একছত্র অধিপত্যে চলবে।তোমার জন্মই তো রওনক ওয়াসিফের জন্য!আপন মনে হেঁসে মোবাইলের ভিডিয়ো টা অন করলো রওনক।কুহু বেশ মনোযোগী হয়ে ম্যাথ করছে।মাঝে কয়েকবার কলম কামড়ে ধরছে।কি যেন ভাবছে।দৃশ্যটা চোখে পরতেই রওনকের ঠোঁটে খেলে গেল এক মিষ্ট হাসি!

!!৪!!

ঘড়িতে সময় রাত আটটা।তিক্ত মেজাজ নিয়ে বাড়িতে ফিরল কুহু।অন্যদিনের তুলনায় আজকে অনেকটা সময় দেরি হয়ে গেছে।বসার ঘরে সবার আলোচনা সভা বসেছে।কুহুর বিয়ের প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলছে ফুয়াদ।ছেলে কলেজের শিক্ষক।খুব নম্র,ভদ্র ধাঁচের।ভাইয়ের কথাটুকু শুনে থমকে দাঁড়াল কুহু।এখন বিয়ে করার মতো ইচ্ছে নেই তার।পড়াশোনা শেষ করে ছোট একটা চাকুরী করার স্বপ্ন দেখে কুহু।এই মুহূর্তে বিয়ের খরচা বহন করার মতো সাধ্য তার ভাইয়ের নেই।সামান্য ঔষধ কোম্পানিতে চাকরি করে সংসার চালাতেই হিমশিম খেতে হয় ফুয়াদকে।তবুও একটুকু অভিযোগ নেই তার।আফসানা বেগম ভীষণ খুশি হলেন প্রস্তাব খানা শুনে।তোহা হাতে ছবি নিয়ে কুহুর সামনে আসলো দেখাতে।গভীর এক ভাবনায় ডুবে রইল কুহু।চোখ ঝাপসা হলো তার।ছবিটা স্পষ্ট দেখতে পেল না।ফুয়াদ জানাল কুহু সম্মতি দিলে কাল,পরশু ছেলের পরিবার আসবে।মেয়ের হাতদুটো চেপে ধরে মতামত জানতে চাইলেন আফসানা বেগম।স্বামীর মৃত্যু'র পর দুই সন্তানকে বুকে আগলে নিয়ে মানুষ করেছেন।ফুয়াদ এখন সংসারী।এক বাচ্চার পিতা।বাকি আছে কুহু।মেয়েটাকে ভাল জায়গায় বিয়ে দিতে পারলে আর কোনো দুশ্চিন্তা থাকবে না আফসানা বেগমের।মায়ের খুশিমুখে তাকিয়ে দোটানায় পড়েছে কুহু।জানাল,আপাতত পরীক্ষার বিষয়টা নিয়ে ভাবতে চায় সে।পাশ থেকে তোহা বলল,
"ছেলেপক্ষ আসুক আগে।দেখলেই তো বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না।দু'পক্ষের পছন্দ হলে কথা বলে রাখা যাবে।কুহুর পরীক্ষার পর-ই না হয় বিয়ের বন্দোবস্ত হবে।

আফসানা বেগম ছেলের বউয়ের সঙ্গে সহমত পোষণ করলেন।ফুয়াদ উঠে এসে কুহুর মাথায় হাত বুলিয়ে নিয়ে বলল,
" কুহু যা চায় তাই হবে।কোনোরকম জোরজবরদস্তি করার দরকার নেই।

সবকিছু ঠিক আছে কিন্তু ছেলে টিচার শুনেই ভাল লাগছে না কুহুর।যদি স্বভাব চরিত্র ওই জল্লাদ,কলহপ্রিয় রওনক ভাইয়ের মতো হয়?তাহলে বেঁচে থেকেও মরার মতো জীবন অতিবাহিত হবে কুহুর!স্যার যেহেতু তাহলে একই ধাঁচের হবে নিশ্চয়ই?আচমকা আতঙ্ক স্বর নিয়ে বলে উঠলো কুহু,
"আমি কোনো টিচার ছেলে বিয়ে করবো না!

হঠাৎ কুহুর এমন কথায় উপস্থিত সবাই আশ্চর্যান্বিত হয়ে তাকাল!কথাটা ঠিক বোধগম্য হলো না কারো।অবাক কন্ঠে শুধাল তোহা,
" কেন কুহু?ছেলে টিচার হলে সমস্যা কোথায়?
·
·
·
চলবে...............................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন