নীরবে নিভৃতে - পর্ব ৩৬ - তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া - ধারাবাহিক গল্প


ঘটনার আকস্মিকতায় স্থির হয়ে গেছে রোশন। বেচারা রেসপন্স করতেও যেনো ভুলে গেছে। মেহেক পায়ে একটু জোরে চাপ দিতে নড়েচড়ে উঠলো রোশন। মেহেককে গভীর আলিঙ্গনে জড়িয়ে নিলো নিজের সাথে। 

দুপুরের তপ্ত রোদ চারদিকে। পাখিরা সারি বেঁধে উড়ছে। বর্ষা শেষে শরৎ- এর আকাশ দেখতে বেশ ভালো লাগছে মিষ্টির। দু'দিন হলো আহনাফের সাথে কক্সবাজার ঘুরতে এসেছে ও। জীবনে প্রথমবার সমুদ্রে ঘুরতে এসে ভীষণ খুশি মিষ্টি। বসে বসে বিচে বালির ওপর আঙুল দিয়ে আঁকিবুঁকি করছে মেয়েটা। সাদা রঙের থ্রিপিসে একেবারে শুভ্র পরীর মতো লাগছে ওকে। আশেপাশে অনেক পর্যটকদের ভীড়। যে যার মতো সময় কাটাচ্ছে। আহনাফ একটু দূরে ডাব কিনতে গেছে। 

" কী করছো? "
আহনাফ হাতে ডাব নিয়ে মিষ্টির পাশে দাঁড়িয়ে শুধালো। মিষ্টি বসা থেকে দাঁড়াল। ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা বজায় রেখেই উত্তর দিলো, 
" দেখো। "
আহনাফ বালির উপর দৃষ্টিপাত করলো। আহনাফ প্লাস মিষ্টি লেখা লাভের মধ্যে। মুচকি হাসলো আহনাফ। মিষ্টির সাথে ওর সম্পর্কটা একেবারে স্বাভাবিক হয়ে গেছে এখন। অবশ্য এক্ষেত্রে আহনাফের অবদান বেশি। সব সময় পুতুলের মতো আগলে রাখে মেয়েটাকে, সমস্যা হলে শান্তভাবে বোঝায়। 
" বাহ! সুন্দর লাগছে তো।"
" হুম বুঝতে পেরেছি। হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে? না-কি খেতেও দিবে?"
মিষ্টি হেসে বলাতে আহনাফ যেনো বুকে সুক্ষ্ম প্রেমের ব্যথা অনুভব করলো। প্রিয়তমার হাসি যে মারাত্মক! 
" এই নাও। "
আহনাফ মিষ্টির দিকে একটা ডাব এগিয়ে দিয়ে নিজেও ডাবের পানি পাইপ দিয়ে খেতে লাগলো। খেতে দু'জন পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে সময় উপভোগ করছে। পৃথিবীতে কোনো মানুষই মূল্যহীন নয়। যে মানুষটা একজনের কাছে জাস্ট কিচ্ছু না,আবার সেই মানুষটাই অন্য কারো কাছে তার পৃথিবী! সঠিক স্থানে না যাওয়া পর্যন্ত তারা তাদের প্রাপ্য মূল্য পায় না এটাই বিষয়। 

" শুনছো? ইদানীং ভয় লাগছে খুব। কী যে হবে রোশনদের! "

রাতের খাবার খেতে খেতে আনজুম বেগমকে উদ্দেশ্য করে বললেন সিদ্দিক। আনজুম বেগম ঠিক বুঝতে পারলেন না বলে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন। 
" কেনো? রোশনদের কী হয়েছে? "
" বাজারে টিভিতে খবর দেখলাম, প্রশাসন দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ডাকাতদের আঁটক করছে। সবাই বলাবলি করছিল, দেশে ডাকাতদের উপদ্রব বেড়েছে। সেজন্য এতটা তৎপরতা। "
" তাহলে তো চিন্তার বিষয়। ফোন দিয়ে যে কথা বলবো তা-ও তো পারবোনা! দশবার কল দিলে একবার ঢুকবে হয়তো। "
আনজুম নিজেও খেতে বসেছেন। সিদ্দিক এরমধ্যে হাত ধুয়ে তোয়ালে দিয়ে মুখ,হাত মুছে বসে আছেন। মেয়ে,জামাইয়ের জন্য চিন্তায় খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করতে পারছেন না। মেহেক এখন ওদের সাথে থাকে তাই সমস্যা মেহেকের জন্যও সমান। 
" আমি তো কতবার কল দিলাম! ঢুকছে না। মেহেক কখন কল করে তার ভরসায় থাকতে হবে এখন। "
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন সিদ্দিক। আনজুম কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বলেন,
" মেহেকের উচিত ছিলো ওই ডাকাত ছেলেকে ছেড়ে দেওয়া। যতই হোক, ওভাবে থাকাকে কি জীবন বলে? আজীবন জঙ্গলে! মেয়েটা সংসারের সুখ পাচ্ছে না, বাইরের জীবনযাপন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। মিষ্টিকে দেখো, বর নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আলহামদুলিল্লাহ সুখে আছে। কিন্তু মেহেক? ওর কী হবে বলো? "
আনজুম বেগমের প্রশ্নের উত্তর সিদ্দিক আহমেদের কাছে নেই। কঠিন বাস্তবতা এটাই যে মেহেকের জীবন আর কখনো স্বাভাবিক হবে না। এখন শুধু অনাকাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যতের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এছাড়া কিচ্ছু করার নেই। 

ঘুম ঘুম চোখে কিছু স্মৃতি মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে সবুরের। একটা এক্সিডেন্ট, একটা ছেলে, তারপর গুলির আওয়াজ! তারপর..... তারপর অস্থিরতায় ঘুম ভেঙে হাঁপাতে হাঁপাতে শোয়া থেকে উঠে বসলেন সবুর। আশেপাশে নজর বুলিয়ে দেখে নিলেন একবার। স্বপ্ন ছিলো? নাহ স্মৃতি! সবকিছুই সত্যি ছিলো। এত বছর যেসব ভুলে ছিলো আজকাল কেনো সেসব জ্বালাতন করে? তাহলে কি সময় এসে গেছে রোশনের সবকিছু জানার? নাহ! নাহ... সবুর হোসেন শোয়া থেকে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন নিমিষেই। 

" উফ! রোশন থাক না। আমি করে নিবো। "
" চুপ করো সুন্দরী। আমিই চুলে তেল দিয়ে দিবো। একটা মাত্র বউ আমার! "
মেহেক চুপ করে গেলো। তখন থেকে না করে যাচ্ছে কিন্তু রোশন নাছোড়বান্দা। চুলে তেল দিয়ে বিনুনি করে দিবে মানে দিবেই। মেহেক বসে আছে খাটে, রোশন পেছনে বসে চুলে তেল লাগাচ্ছে। 
" সব তেল এক জায়গায় দিলে হবে? "
" সব জায়গায় দিচ্ছি। প্রথম প্রথম একটু-আধটু ভুল হয়, বুঝলে সুন্দরী? "
" হ্যাঁ খুব বুঝেছি। "
" আচ্ছা তুমি আমাকে এখনো আপনি আপনি বলে ডাকো কেনো? তুমি সম্মোধন করলে কী হয়?"
রোশন কিছুটা অভিমান নিয়ে বললো কথাটা। মেহেক মৃদু হেসে বললো, 
" কিছু সম্পর্ক আপনিতেই সুন্দর। ভালোবাসতে পারলে তুমি, আপনি কোনো বিষয় না। বরং প্রতিটা ডাকই স্পেশাল। "
" এতো কথা বুঝি না। "
" আমি আপনাকে আপনি বলেই ডাকবো। "
রোশন তেলের বোতল পাশে রেখে চিরুনি হাতে নিলো। 
" আসলে বউটা আমার মোটামুটি ত্যাড়া। "
" ঘাড়ত্যাড়া হবে। "
রোশন শব্দ করে হেসে উঠলো। মেহেক চুপচাপ বরের চুল আঁচড়ানো উপভোগ করছে। মাঝে মধ্যে মনে হয় একজীবনে এতো সুখ কপালে লেখা ছিলো? হ্যাঁ এই ভালোবাসাটুকুই সুখ। প্রিয় মানুষ পাশে থাকলে, আগলে রাখলে মেয়েদের জন্য সব জায়গাই স্বর্গ। মেহেকের কাছেও এই জঙ্গলই এখন সবকিছু। 
" আউচ!"
মেহেকের শব্দে নড়েচড়ে উঠলো রোশন। 
" কী হয়েছে? লাগলো?"
" আস্তে আস্তে। "
" আর হবে না। তুমি নিজেই আঁচড়ে নাও। আমি মনে হয় ব্যথা দিচ্ছি। "
রোশন কিছুটা মন খারাপ করে বললো। মেহেক চুলগুলো না আঁচড়ে খোঁপা করে নিলো। রোশনের মুখোমুখি বসে শুধালো, 
" ভালোবাসেন?"
" সন্দেহ হচ্ছে? "
" প্রশ্ন করেছি উত্তর দিবেন। পাল্টা প্রশ্ন নয় হটসট ডাকাত বর। "
" আহহ! কী কিউট লাগে কথাটা! হটসট! "
মেহেক হেসে রোশনের বুকে মৃদু কয়েকটা ঘুষি মারলো। 
" ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি সুন্দরী! "
" ব্যাস! আর থাক। বেশি ভালোবাসা আবার বেশিদিন টেকে না। "
রোশন বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো, ঘরের এক পাশে গেলো। কথা বলতে বলতে ফের এগিয়ে এলো মেহেকের কাছে। 
" শেষ নিঃশ্বাস অবধি টিকবে এই ভালোবাসা। "
" চুপ করুন। এসব আর বলবেন না। "
মেহেক বসা থেকে উঠে রোশনের ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরে বলে। রোশন হেসে হুট করে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। মেহেক চমকাল, থমকাল।  
" ডু ইউ লাভ মি মাই সুন্দরী? "
একগুচ্ছ গোলাপের মাঝে একটা হলুদ খাম এগিয়ে দিলো রোশন। মেহেক খুশিতে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাত বাড়িয়ে যে ফুলগুলো নিবে তা-ও পারছে না। ঠোঁটগুলি থরথর করে কাঁপছে। রোশন মেহেকের অবস্থা অবলোকন করে ফের বলে, 
" ডু ইউ?"
এবার ঘোর কাটে মেহেকের। ছলছল নয়নে মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে ফুলগুলো গ্রহণ করে প্রত্যুত্তরে বলে,
" ইয়েস! আই লাভ ইউ রোশন। আই লাভ ইউ! "

" রোশন? রোশন? "
আচমকা বাবার ডাকে কিছুটা অবাক হলো দু'জন। রোশন বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। 
" বাবা এই সময়! "
" যান আগে দরজা খুলে দিন। কোনো সমস্যা হলো কি-না! "
মেহেকের কথামতো রোশন তড়িঘড়ি করে গিয়ে দরজা খুলতেই সবুর হোসেন কিছু না বলেকয়ে পাগলের মতো রোশনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেছে মেহেক। রোশনের অবস্থাও তেমনই। কিছু বলার মতো বোধশক্তিও এখন নেই যেনো। মেহেক এগিয়ে গেলো বাবা, ছেলের দিকে। 
" বাবা আপনি ঠিক আছেন? কিছু হয়েছে? "
মেহেকের বলা কথায় রোশনও হুঁশে এলো। 
" হ্যাঁ বাবা তুমি ঠিক আছো? কী হয়েছে বলো? বাবা? "
ছেলে ও ছেলের বউয়ের কথাবার্তায় সংবিৎ ফিরলো সবুরের। কী করেছে ভাবতেই রোশনকে ছেড়ে দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে আবারো নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন তিনি। ওরা দু'জন পাথরের মতোই ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। 

পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে। পাখির কলরবে মুখরিত চারদিক। সকালের শান্ত পরিবেশটা বেশ ভালো লাগে মেহেকের। তাই সকাল সকাল একটু-আধটু হাঁটতে বের হয়। রোশন গেছে সবুর হোসেনের সাথে কথা বলতে। রাতেও গিয়েছিল কিন্তু তখন দরজা খোলেননি সবুর। বলেছিলেন,সকালে কথা বলবে। সেই মতো রোশন সকাল হতেই বাবার সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছে। 



চলবে............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন