মন ছুঁয়েছে সে - পর্ব ৩৬ - মৌরিন আহমেদ - ধারাবাহিক গল্প

মন ছুঁয়েছে সে 
পর্ব ৩৬ 
মৌরিন আহমেদ 
.
.
.
দুপুরের খাওয়ার পর হালকা রেস্ট নিয়ে বাইরে বেরনোর সিদ্ধান্ত নিলো ধ্রুব। কতদিন হলো এ এলাকায় এসেছেও। অথচ নির্দিষ্ট কাজ ছাড়া ঠিক মতো বেরোতেই পারে নি। আর প্রকৃতির কাছে এসে কী প্রকৃতি না দেখে থাকা যায়? ভেতরে ভেতরে একটা আফসোস থেকে যায় না? 

মনের সেই অতৃপ্ত খায়েশ মেটাতেই এখানে থেকে যেতে হলো ওকে। সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবারের ছুটিটা এখানেই কাটিয়ে দেবে। গতবার অনুদের এলাকা ছেড়ে আসার পর একটা ছুটি পাওনাই ছিল। কিন্তু জরুরি নোটিশে অফিসে গিয়ে হাজিরা দিতে হয়েছিল, ছুটি আর পাওয়া হয়ে ওঠে নি। এবারে সেজন্য ডাবল ছুটি একেবারে উশুল করে নেবে। আর সে ছুটি কাটাবে এই খাগড়াছড়ি তে!

ধ্রুব তার ডিপার্টমেন্টের কাছে দুই ছুটি মিলিয়ে মোট একমাসের ছুটি চেয়ে দরখাস্ত পাঠিয়েছে। চিফ স্যার অনিচ্ছা সত্ত্বেও সাইন করেছেন বটে তবে ও জানে তার মতলব কী! দেখা যাবে একপক্ষ যেতে না যেতেই উনি পাল্টা চিঠি দিবেন, "জরুরি দরকারে অফিসে আসতে হবে।"- এই মর্মে। তারপর যতই রাগ হোক, বিরক্ত হোক ওকে বাধ্য হয়েই যেতে হবে সেখানে। কারণ চিফ স্যার টা এমনই, কারো সুখ তার সহ্যই হয় না!

অবশ্য এজন্য ধ্রুবও আগাম ব্যবস্থা করে ফেলেছে, যোগাযোগের জন্য কোনো ক্ষুদ্র মাধ্যমও এবার রাখে নি। সিমসহ ফোনটা পাহাড় থেকে পড়ার পর আর সেটার বিকল্প ব্যবস্থা নেয়নি, চিঠি কিংবা স্বশরীরে এসে যেন ওর খোঁজ না নিতে পারে তাই থাকার জায়গাও বদলিয়েছে। নতুন উঠা রিসোর্টের নামটাও জানায় নি কাউকে, ইভেন প্রদোষকেও না! এবং সুযোগ পেলে ছুটিটা কে বাড়িয়ে নিতেও চিন্তা করবে না সে। শান্তিমত ঘুরে, মাইন্ড নামক বস্তুটাকে ফ্রেশ করে, তবেই কাজে ফিরবে! সব মিলিয়ে এবারের ছুটিটা জমবে ভালোই! 

রিসোর্টের প্রবেশপথেই রিসেপশন। আর তার পাশেই বসেন রিসোর্ট ম্যানেজার। রিসেপশনের পাশে তার জন্য সেপারেট কেবিন। পাশ দিয়ে গেস্টদের যাতায়াতের রাস্তা। ধ্রুব সে পথে হেঁটে হেঁটে বাইরের দিকটায় যাচ্ছিল। রিসেপশনের সামনে এখন কীসের যেন জটলা। চার-পাঁচজন লোক দাড়িয়ে আছে। ওদের দিকে একপলক তাকিয়েই নিজের মতো করে হাঁটতে থাকে ও। যেন ওসবে ওর কোনো আগ্রহই নেই! 

হেঁটে হেঁটে সবে গেটের সামনে এসেছে হঠাৎই ডাক পড়লো পেছন থেকে,

 - ধ্রুব সাহেব!

পরিচিত কণ্ঠ কিন্তু অনেকদিন পর শুনছে। কণ্ঠের মালকিন কে সেটা ভাবতে গিয়েই হঠাৎ কি যেন হলো ওর। মস্তিষ্কের নার্ভ গুলো যেন নড়াচড়া করে উঠলো। সে এসেছে? চকিত দৃষ্টিতে চট করে মাথা ঘুরিয়ে ফিরে তাকালো। না, ভুল নয়। সেই দাড়িয়ে আছে! অবাকের চরম সীমায় পৌঁছে গিয়ে অটোমেটিক হা হয়ে গেল তার মুখমণ্ডল। মস্তিষ্ক যেন হ্যাং খেয়ে কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। কণ্ঠে রা নেই। এ কী করে সম্ভব? দিনে দুপুরে স্বপ্ন দেখছে না কী সে!
__________________________

রিসোর্টের রিসেপশনে দাড়িয়ে আছে অনন্যা। তার ঠিক পাশেই দাড়ানো ম্যানেজার। অপর পাশে রিসেপশনিস্ট। জোহরার দেয়া ইনফরমেশন অনুযায়ী এই রিসোর্টেই উঠেছিল লেবু-লতা। তাই সবার আগে এখানেই খোঁজ লাগাতে এসেছে অনু। সাথে অবশ্য কানিজও আছে কিন্তু লং জার্নির ক্লান্তি মেটাতে রুমেই ঘুমাচ্ছে সে। তাই ওকে আর ডাকে নি। নিজে নিজেই করতে পারবে ভেবে চলে এসেছে। কিন্তু এখানে এসেই ঘটলো বিপত্তি!

ম্যানেজার সাহেব কিছুতেই তাদের গেস্ট লিস্ট দেখাবেন না। বহিরাগত কাউকে দেখানোর নাকি নিয়ম নেই। পাওয়ারফুল লোক থাকলে একটা কথা ছিল কিন্তু ওদের তো তেমন কেউই নেই। যতই বলছে, দুজন মানুষ এখানে এসে নিখোঁজ হয়ে গেছে, তাদের থাকার ইনফরমেশন টা লাগবে, ততই আরও বেশি জট পাকাচ্ছেন কর্তৃপক্ষের লোক!

অনন্যা জানে ও সাধারণ, কোনো পাওয়ার নেই বলেই এই ঝামেলা, বড় কোনো পাওয়ার ওয়ালা লোক হলে কোনো কথাই হতো না, সুড়সুড় করে খাতাটা বের করে দিতো!

অনেক কথা কাটাকাটি, রিকোয়েস্টের পরও যখন তারা তাদের গেস্ট লিস্ট দেখাতে রাজি হলেন না, তখন বাধ্য হয়েই হাল ছেড়ে দিল। রিসেপশন থেকে খানিকটা দূরে সরে বিরস মুখে দাড়িয়ে রইলো। কোমরে হাত রেখে, ছোট ছোট শ্বাস ফেলে চিন্তা করতে শুরু করলো এরপর কী করা যায়! যাই হোক, যেভাবেই হোক, মামুর লাস্ট লোকেশনটা বের করতে পারলে!.. ওদের কাজটা অনেক সহজ হয়ে যেত। অথচ... ভেবেই একটা হতাশ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।

ও যখন অম্লান বদনে সামনের শান বাঁধানো রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে আছে তখন হঠাৎ করেই কী যেন নজর কাড়ে ওর। টকটকে হলুদ রঙের পাঞ্জাবি পরনে কাঁধে ঝোলা ব্যাগ নিয়ে একটা ছেলে। হিমু হিমু ভঙ্গি নিয়ে রাস্তার অপর পাশ দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। তাকে দেখেই একমুহূর্তের জন্য কী যেন হয়ে গেল ওর। একটা হিমশীতল স্রোত বয়ে গেল সারা শরীর বেয়ে। কী অদ্ভুত, কী সুন্দর তার হেঁটে চলার ভঙ্গিমা, পোশাকের ধরন! আহা! মাথা থেকে তখন বিরক্তের পোকারা সব পিলপিল করে চলে গেল। আর তার বদলে ঠাঁই পেল একরাশ মুগ্ধতা! 

কতকাল পরে ও এই ছেলেটাকে দেখছে! কত প্রতীক্ষার পর! একমুহূর্তের জন্য নিজের বর্তমান অবস্থান ভুলে গেল অনন্যা। ও এখানে কেন এসেছে, এতোক্ষণ কী করছিল, কেন-- সব! শুধু মনে হলো এই হিমুকেই সে খুঁজছিল। জনম জনম অপেক্ষা করছিল শুধু এরইজন্য! তৃষিত নয়নে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে ডাক দিলো জোর গলায়,

 - ধ্রুব সাহেব!

কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে তাকালো ছেলেটা। চোখে মুখে বিস্ময়, নির্বাক, অনড় চাহনি। হ্যাঁ, অনন্যাকে দেখে সেও অবাক হয়েছে! বিস্ময়ে কিংবা আনন্দে হঠাৎ হাঁটতে ভুলে গেল মেয়েটা। হেঁটে গিয়ে কাছে না দাড়িয়ে আগের জায়গাটায় ঠাঁই করে নিল। কিন্তু সদয় হলো অপর পক্ষ। দ্রুত পায়ে হেঁটে দুরত্ব ঘুঁচালো। উদ্বেগ কিংবা উত্তেজনায় তার বুকেও উথাল-পাথাল ঝড় উঠেছে! শরীরটা যেন হালকা কাঁপুনি দিয়ে উঠছে, সেই সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঠোঁট দু'টোও! উত্তেজনায় কী করলো নিজেও বুঝতে পারলো না। মেয়েটার কোমল দু' হাত নিজের শক্ত হাতের মুঠোয় চেপে ধরে শুধোলো,

 - " অনা, তুমি?"

আবারও অবাক হওয়ার পালা! সম্বোধন আর ডাকনাম দুটোতেই চমকে উঠলো অনন্যা। চকিত দৃষ্টিতে ছেলেটার মুখের দিকে তাকালো। কে ও?-- ধ্রুব না?-- হ্যাঁ, তাই তো! কিন্তু-- বিস্ময়ে অনেক প্রশ্নই ছুটে আসে মুখ বিবরে তবে সেসব সামাল দিয়ে একটা প্রশ্নই করলো,

 -" আপনি এখানে?"

 -" প্রশ্নটা কিন্তু আমি আগে করেছি-- তুমি এখানে কি করছো?"

বলেই সম্বিৎ ফিরে পাওয়ার মতো করে হাত ছেড়ে দিলো ওর। নিজের বোকামিতা বেশ বুঝতে পারলো। হুট করেই আবেগটা দেখানো ঠিক হয় নি। অনন্যা না জানি কী ভাবছে! তারমধ্যেই হঠাৎ গলা শোনা যায় ওর। ধীরে কিন্তু শান্ত ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে জানায়,

 -" একটা বিশেষ কাজে এসেছি।.. আমার মামু হঠাৎ..."

 - "কী হয়েছে?"

 ভ্রু কুটি করে ধ্রুব। অনন্যা একপলক ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আবারও বললো,

 -"জানি না কী হয়েছে.. এই এলাকায় এসেছিল কয়েকদিন আগে, বেড়ানোর জন্য।.. হঠাৎ কী হলো কে জানে! যোগাযোগ বন্ধ, সিম অফ,.. কী খবর কিছুই জানি না! "

ও এমন ভঙ্গিতে বললো যেন ধ্রুবের সাথে ওর রোজই দেখা হয়, কথা হয়। ছেলেটার সাথে যে আজ বহুদিন পর দেখা হলো এই মুহূর্তে সেটা ওর মাথাতেই নেই! 

ধ্রুবও আর ও কথা তুললো না। অনুর বর্তমান সমস্যা নিয়েই কথা হলো। পুরো ব্যাপারটাই ওকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বর্ণনা করলো অনন্যা। সবটা শুনে কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে গেল ধ্রুব। ভ্রু জোড়া কুঁচকে অন্য দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবলো। মাথায় তখন ঘুরছে,

 -" লেবু মিয়া হারাইছে? ক্যামনে কী? ওই বুড়া-হাবড়ালোক হারায় ক্যামনে?"

কিন্তু মনের ভাব বাইরে প্রকাশ করলো না। আড়চোখে অনন্যার মুখের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলো, মামার শোকে মেয়েটা কাতর! চিন্তিত মুখটা কেমন যেন মলিন! আবারও দৃষ্টি সরিয়ে নিল। দ্রুতবেগে ভাবনার পসরা সাজালো মস্তিষ্কে। এখন ওকে কী করতে হবে সেটাই মূল চিন্তা। নিজের পরবর্তী কর্ণপদক্ষেপটা ঠিক হলো খুব দ্রুতই। তারপর অনুর দিকে তাকিয়ে আশ্বস্ত করে বললো,

 - "ঠিক আছে। চলো আমার সাথে।"

বলেই হাত দুটো মুঠোয় পুরে নেয় ওর। এবার সজ্ঞানে, ইচ্ছে করেই। অনু তাতে কিছু মনে করে না। বিশ্বাসযোগ্য ভঙ্গিতে তাকায়। ও সেভাবেই হেঁটে চলে সামনে, রিসেপশনে। অনুও আর কথা বাড়ালো না, চুপচাপ হেঁটে চলে পিছু পিছু।

ভিড় কমে গেলেই কথা বলে ধ্রুব। ম্যানেজারকে প্রথমে তার রেজিস্ট্রি বুকটা দেখাতে বলে। উনি প্রথমে দেখাতে চাইলেন না, কিন্তু ধ্রুব যখন তার ঝোলা ব্যাগ থেকে একখানা কার্ড বের করে দেখালো, মুহূর্তেই চেহারার রং বদলে গেল তার চেহারার। শঙ্কিত মুখে খাতাটা বাড়িয়ে দিলো ধ্রুবের দিকে। 

ধ্রুব কিছু বললো না। গম্ভীর হয়ে লেবু মামার আসার দিন, যাওয়ার দিনটা দেখলো। কোন কটেজে, কতদিন, কে কে ছিল সব শুনলো। সবকিছু শোনার পর চুপচাপ অনুকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে গেল।

মাথায় তখন অনেক জট। লেবু মামা একটা মেয়েকে সাথে করে এনেছিলেন। দিন কয়েক ছিলেন। আবার সুন্দর করে চলেও গেছেন। মানে এখানে কিছুই হয় নি। এখানে আসার পর কেউ অসুস্থ হয়েছিলেন কী না, এ জাতীয়ও কোনো খবর পেল না। মানে খুব সম্ভবত সুস্থ সবল ভাবেই রিসোর্ট এরিয়া ত্যাগ করেছেন। তাহলে? হঠাৎ এভাবে লাপাত্তা হলেন কী করে?

 ধ্রুব ওই কটেজটায় গেল। লেবু মামারা যে দুটো রুম বুক করেছিলেন সেই কটেজটায়। দুটো রুমই পরিষ্কার, একেবারে ঝকঝকে তকতকে! কোথাও কোনো অস্বাভাবিকতা পরিলক্ষিত হলো না। ও বুঝতে পারলো এখানে কিছুই নেই! থাকলেও লাভ নেই। কারণ এখানে কেউ বেড়াতে আসার আগে এবং পরে রুমগুলো সুন্দর করে সাজিয়ে-গুছিয়ে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে ফেলে কর্তৃপক্ষ। সেখানে কোনরকম অস্বাভাবিকতা থাকলেও সেটা ওর চোখে ধরা পড়বে না, তাদের চোখেই পড়বে যারা প্রথমে এখানে এসেছিল। তবুও রুম দুটোকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো, কিছু পাবে না জেনেও!

ধ্রুব আপনমনে হাঁটছে। নিজের জন্য বরাদ্দকৃত কটেজের দিকে যাচ্ছে। পেছনে কেউ আছে কী না খেয়াল নেই। সে আপন খেয়ালে মগ্ন। এদিকে অনু পড়েছে দ্বিধায়। ধ্রুব ছেলেটা পাল্টা কিছু বলছে না। কী করবে ও এখন? ধ্রুবের পিছু পিছু যাবে? নাকি কটেজে ফিরে যাবে? কিন্তু ধ্রুব যদি আবারও হারিয়ে যায়? নাহ, ওর পিছন পিছনই যাবে। ওর সাথে অনেক কথা আছে, অনেক!
.
.
.
চলবে..........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন