উন্মুক্ত লাইব্রেরী
পর্ব ২৯
আয্যাহ সূচনা
আদিমকালের ঘরটায় মোটা দেয়ালের গায়ে লেগে আছে কালচে দাগ।যেখানে নিস্তব্ধতা আর স্নিগ্ধতার মিশ্রণে গাঁথা হয়েছে নতুন একটি সুখের মুহূর্ত। পুরনো কাঠের জানালা দিয়ে আসা হিমেল বাতাসের মৃদু প্রবাহে প্রয়োজনের প্রয়োজনে টাঙানো কমদামী পর্দার নাচন।সূর্যের মৃদু কিরণ সোনালি আভায় ভাসিয়ে দিয়েছে গোটা ঘর।
“ধ্যাত!”
শব্দ উচ্চারণ করলো বর্ণ।দুপুর একটা বাজতে চলেছে।চায়ের তলব সেই সকাল থেকে।কম্বল মুড়িয়ে ঘুমানো অন্বেষার দিকে চেয়েও তাকে জাগাতে ইচ্ছে হয়নি।আনমনে হেসেছে।এখন বিরক্ত হচ্ছে।বিড়বিড় করে বললো,
“শালার কি দিন আইলো আমার? বউ ঘুমায় আর আমি চা বানানের লেইগা কসরত করতাছি। শ্যাহ্!”
এক প্রকার যুদ্ধ করে চা বানিয়েছে কোনো রকম।হাতে নিয়ে দাঁড়ালো ধোঁয়া ওঠা চায়ের পেয়ালা।একবার দৃষ্টি দিলো বিড়াল ছানার মত গুটিয়ে শুয়ে থাকা অন্বেষার দিকে।ঠোঁট প্রসারিত হলো আরেকদফা হাসিতে।উষ্ণ কোমল স্পর্শে রূপ পেয়েছে তাদের সম্পর্কের অলিখিত অধ্যায়।ধীরে ধীরে রচনা হচ্ছে এক অসীম সুখের কাব্য।
বিশ্রী স্বাদের চা গিলে অন্বেষার পাশে গিয়ে বসলো বর্ণ। ঝুঁকে ডাকার চেষ্টা করে বললো,
“এই ছেমড়ি এই উঠো!”
তড়িৎ গতিতে কপাল কুঁচকে ফেলে অন্বেষা।হাত ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দিলো।
“এই ছেড়ি দুপুর বাজে একটা!তুমি দিন দুনিয়া আন্ধার কইরা ঘুমাইতাছো? রানবো কে?”
ভারী ঘুম ঘুম কণ্ঠে অন্বেষা জবাব দেয়,
“বিরক্ত করো নাতো।”
আশ্চর্যের সপ্তম আসমানে চলে গেলো যেনো বর্ণ। একটু বেশিই অবাক হয়ে বললো,
“আমি বিরক্ত করতাছি?”
কাঁদো স্বরে অন্বেষা বলে উঠে,
“মাথাটা ব্যথা করছে…ঘুম পুরো হয়নি….”
“হ সররাইত তুমি একলা কুস্তি খেলছো।আমি আম্পায়ার আছিলাম না?....তোমার ঘুম ঘুম।আমার ঘুম ঘুম না?আমিওতো ঘুমাই নাই ঠিকমতো।”
বর্ণের হাত আবার ঝাড়া দিয়ে ফেলে দেয় অন্বেষা।চরম বিরক্ত সে।মাথা কাজ করছে না ঘুমের ঘোরে।কম্বল আরো ভালোভাবে টেনে বিড়বিড় করে গালি দিতে লাগলো,
“নোংরা!... নোংরা লোক”
“ক্ষিদা লাগছে কইলাম!”
কে শুনে কার কথা। অন্বেষাও নাছোড়বান্দা। উঠবে না সে কোনোভাবেই। ভঙ্গুর অবস্থা তার।আরো কয়েক ঘণ্টা না ঘুমোলে শক্তি পাবে না কোনো রূপেই।
দুপুর তিনটে,
সদ্য জাগ্রত অন্বেষা।ঘুমঘোর কেটে উঠে এলো বেলা করে।চোখ খুলতেই বর্ণকে ঠিক তার পাশে আধ শোয়া থাকতে দেখা গেলো।হাতের পিঠ কপালে ঠেকিয়ে আছে।আকস্মিক একে অপরের চোখে চোখ পড়তেই মুখমণ্ডলে লাজুক রক্তিমার আভা ছড়িয়ে পড়লো অন্বেষার। তার সেই লজ্জার আভাস যেন প্রকৃতির নিকষিত রত্ন।মুহূর্তের মাঝেই বর্ণের চোখে অদ্ভুত এক জাদুময় রূপ ধারণ করলো। বর্ণ এমন অভূতপূর্ব সৌন্দর্যের সম্মুখীন আগে কখনও হয়নি; হৃদয়ের অন্তস্থলে যেন তুফান শুরু হলো,এক অমোঘ আবেগের ঘূর্ণি।
ঝুঁকে এসে কপালে চুমু খেয়ে বললো অদ্ভুত এক বাক্য,
“ঘুম হইছে মহারানী?”
উত্তরের বিনিময়ে চোখ বুঁজে ফেলে অন্বেষা।বর্ণের দৃষ্টি স্থির হয়ে গেলো তার মুখশ্রীর প্রতি।যেখানে লালিত্য আর কোমলতার এক অপার্থিব মেলবন্ধনের দেখা মেলে।তার লাজুক মুখখানি যেন প্রভাতের প্রথম সূর্যরশ্মির মতোই উজ্জ্বল।কাঁপিয়ে দিলো বর্ণের হৃদয়ের অন্তরতম কোণ।
“উঠবা নাকি আরো আদর সোহাগ লাগবো?”
বর্ণের কথাগুলো যেনো হৃদয়ে বয়ে আনল এক প্রলয়ংকরী বায়ুপ্রবাহ। বুকের ভিতরে সেই আবেগের ঝড় যেন সমস্ত অস্তিত্বকে দোলা দিয়ে উঠে।যেন এক দহনজ্বালায় পুড়তে লাগল তার হৃদয়। প্রতিটি ধ্বনি প্রতিটি নিঃশ্বাসে অনুভব করল সেই অজানা আকর্ষণের তীব্রতা।
একলাফে উঠে দৌঁড় লাগায় অন্বেষা গোসলখানার দিকে।বর্ণ চেঁচিয়ে বললো,
“কাপড় নিয়া যাও নাই।চাইলেও আমি দিমু না”
অন্বেষার হুশ ফিরলো।জ্বিভ কামড়ে ধরলো। গোসল সেরে পড়বে কি?কাপড় গামছা কোনোটাই আনা হয়নি।যেই একটা লোক বাহিরে আছে সে দিবে বলেও মনে হয়না।তারপরও একবার চেষ্টা করলো। উঁকি দিয়ে বললো,
“গামছা আর কাপড় দিবে?”
বর্ণ সরাসরি জবাব দেয়, “জ্বি নাহ”
অন্বেষা অসহায় সুরে বললো,
“দেখো অনেক ঠান্ডা।দাও না?প্লিজ….”
মায়া হলো বর্ণের।অন্তত এই বিষয়ে বাড়াবাড়ি করা উচিত হবেনা।কোনো রকম কাপড় নিয়ে দিলো।দুষ্টু হেসে প্রশ্ন করলো,
“আমি আহি?”
অন্বেষা কাপড় কেড়ে নেয়।তেজি গলায় বলে উঠে,
“থাপ্পড় দিবো!”
বলেই মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলো।
আধ ঘন্টা পর বেরিয়েছে অন্বেষা।অন্বেষা শীতের বরফবর্ণ তাপমাত্রায় কাঁপছে।শরীর জুড়ে শীতের অবিরাম খচখচ।তাছাড়াও লাজের আবরণে মুড়ানো তার সমগ্র অস্তিত্ব।মুখে অদ্ভুত স্নিগ্ধ মেঘের আচ্ছাদন। বর্ণের চোখে চাহনি নেওয়ার মতো সাহস নেই।লজ্জার শীতল দোলায় দোদুল্যমান।
বর্ণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে।কোনো বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেললো না তাকে।এগিয়ে এসে টেনে নিয়ে গেলো বিছানার দিকে।কম্পিত সত্তাকে মোটা কম্বলে পেঁচিয়ে দিলো। বললো,
“হোটেল থিকা ভাত আর সবজি আনছি।”
অন্বেষার জিজ্ঞাসু চোখ বর্ণের দিকে তুলে দিলো।বর্ণ ভ্রু নাচিয়ে বলে,
“কি?তুমি কি আশা করছো মরার মত ঘুমাইবা আমি রানমু?.....ওই কপাল নিয়া দুনিয়াতে আহো নাই।”
মুখ নুয়ে ফেললো অন্বেষা। পেটে ক্ষুদার জ্বালা।বলতেও বাঁধা প্রদান করছে অন্তরের দ্বিধা। বর্ণ নিজেই উঠে গেলো।অদ্ভুত ভঙ্গিতে প্লেটে খাবার তুলে নিয়ে এসে অন্বেষার সামনে এসে বসলো।
“খাইতে পারবা না খাওয়ায় দিতে হইবো?”
অন্বেষা মিনমিনে সুরে জবাব দেয়, “পারবো।”
বলে হাত এগিয়ে দেয় প্লেট তোলার উদ্দেশ্যে।হাত কাপছে।বলহীন মনে হচ্ছে সম্পূর্ণ দেহ।বর্ণ হতাশায় মাথা দোলায় দুদিকে। কেড়ে নিলো প্লেটটি।বললো,
“হইসে!বুঝছি।”
বর্ণের মুখে তুলে খাইয়ে দেওয়ার বিষয়টা অন্বেষার মনে ধরেছে।কল্পনা রাজ্যে ডুবুরি হয়ে ভাসমান।শুরু থেকে শুরু করলো সবটা। এই বর্ণ আর সেই বর্ণে তুমুল তফাৎ।সে কি নিজেকে পরিবর্তন করেছে?করেছে এবং করেনি।এই দুইয়ে ব্যাপক সংঘাত।তার সুখী সংসার পাওয়ার সেই অভিলাষ পূরণের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে নিজেকে মনে হলো রাজ্যের সুখী নারী।আবার কান্নারা এলো চোখের কোল জুড়ে।
______
দুটোদিন কিছুটা অসস্তিতে কেঁটেছে অন্বেষার।অদ্ভুত শঙ্কা আর লাজে জর্জরিত ছিলো।অন্যদিকে বর্ণ ছিলো ততটাই স্বাভাবিক।তার মাঝে তেমন কোনো পরিবর্তনের রেশ দেখা যায়নি।কিছুটা সাহায্য করেছে অন্বেষাকে।আড়ালে থেকে।তাকে অসস্তিতে পড়তে দেয়নি একেবারেই।
আজকাল তার প্রিয় কাজ ফোনে গেম খেলা। আগামীমাস থেকে কাজে যোগ দিবে। অন্বেষা ধীর গতিতে পাশে এসে বসলো।কিছুসময় নীরব রইলো মাথা নুইয়ে।
হুট করে বর্ণ বলে উঠে,
“কি কইতে চাও?কইয়া ফালাও”
অন্বেষা বিছানার লালচে রঙের চাদরে আঙ্গুল চালাচ্ছে মাথা নুইয়ে।বারবার ভাবছে বলতে।বর্ণ ফোন থেকে মনোযোগ সরিয়ে অন্বেষার সামনে এসে বসে।কপালে তর্জনী আঙ্গুল চেপে মাথা সোজা করে বললো,
“সমস্যা কি?”
অন্বেষা কুণ্ঠিত স্বরে জবাব দিলো, “একটা কথা বলতাম….. মানে একটা আবদার করতাম আরকি?”
“আবার আবদার?শাড়ি না কিনা দিলাম?” খানিক বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করে বর্ণ।
অন্বেষা মুখ তুলে বলে, “না শাড়ি না।এবার অন্যকিছু…”
“জিবলা বড় হইয়া যাইতাছে তোমার বুঝলা!”
ম্লান মুখে অন্বেষা বলে উঠে, “এমন করো কেনো?আমি একটা দরকারি বিষয়ে কথা বলতে চাইছিলাম।তোমার বিষয়েই।”
বর্ণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে।এই সংসার আর অন্বেষা তার অদ্ভুত অনুভূতি।কখনো ফুলের ন্যায় সুবাসিত।আবার কখনও অসস্তিকর।মেনে নিয়েছে।মানতে সায় দিচ্ছে মন।ঠান্ডা মাথায় জানতে চেয়ে প্রশ্ন করে,
“কি আমার বিষয়ে?কও?”
অন্বেষা লম্বাটে নিঃশ্বাস ফেলে।চোখে চোখ রেখে বলতে লাগলো,
“সেদিন দেখেছি।কত আগ্রহ নিয়ে চেয়ে ছিলে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টদের দিকে।আমি আগে ভাবতাম মুখের ভঙ্গি আর চোখ দেখে কি মানুষের অন্তরে ঝেঁকে দেখা যায়? অবিশ্বাস করতাম কথাটাকে।কিন্তু আমি ভুল।আমি তোমার মধ্যে ওই হাহাকার দেখেছি বর্ণ।”
বর্ণ উদ্ভট হেসে উঠলো।মাথা দুলিয়ে হাসলো কয়েক সেকেন্ড। অন্বেষার মাথায় চাপড় মারলো আলতো করে।বললো,
“এই পিশাচিনী!আবার জ্ঞান বিতরণ ভান্ডার খুইলা বইছো। কেঠা শিখাইছে তোমারে এত কথা?”
“চুপ!ভালো কথা বলি গায়ে লাগেনা।এসব জ্ঞান না।আমার অনুভব।”
বর্ণের মস্তিষ্কে শয়তানি বুদ্ধি খেলে গেল। একহাতের আঙুলের সাহায্যে অন্বেষার গাল চেপে ধরে বললো,
“তাইলে কও ওইদিন যে আদর করলাম?ওই বিষয়ে তোমার অনুভূতি কি?”
গাল ছাড়িয়ে কপাল কুঁচকে তাকায় অন্বেষা।রাগী সুরে বললো,
“অসভ্যের মত কথা বলে টপিক চেঞ্জ করবে না।”
“ওইটাও একটা ইম্পর্ট্যান্ট টপিক। বউ জামাইর মধ্যে আদর সোহাগ তাগো মধ্যে একটা ভেরি গুরুত্বপূর্ণ টপিক।’
কপালে হাত রেখে মাথা ঝুঁকিয়ে নেয় অন্বেষা।এতে করে ফালতু কথা শুনে লজ্জাটাও আড়াল করা সম্ভব।এক ঢিলে দুই পাখি।
বর্ণ সেটি হতে দেয়নি।তার বাহু দুহাতে ঝাঁকিয়ে বিরক্ত করছে তাকে। অন্বেষা আবার ঘাড় তোলে।বলে,
“আমার কথাটা শুনো প্লিজ।”
অপ্রত্যাশিতভাবে অন্বেষার দুহাত ধরে কোলে টেনে নিলো বর্ণ।এত দ্রুত ঘটেছে ঘটনাটি সে কোনো প্রতিক্রিয়া দেওয়ার সুযোগটুকু পায়নি। অন্বেষার কোমরে দুহাত পেঁচিয়ে বললো,
“এবার কও সব কথা হুনমু।”
“এসব ফাত্রামির মানে কি?”
“কেন সোনা তুমি জানো না? একবার কাছে আইয়া পড়ছি এহন দূরে থাকাটা মুশকিল।পোলা মানুষের এইতো দুর্বলতা।”
বর্ণের এরূপ আচরনে হতাশার চরম সীমায় চলে যায় অন্বেষা মধ্যে মধ্যেই।আবার ফিরে আসে তারই দেখানো অদ্ভুত মায়ার টানে।এভাবেই থাকতে বাধ্য।অসহায় হয়ে বলে উঠে,
“আমি চাই তুমি পড়ালেখা করো।ভার্সিটিতে ভর্তি হও।”
আরেকদফা বিকট হাসে বর্ণ।প্রশ্ন করে,
“তাই নাকি?এই বুইড়া কালানে আমারে কেঠা ভর্তি নিবো?”
“উন্মুক্ত লাইব্রেরীর মত উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ও আছে।সেখানে যেকোনো বয়স আর পেশার মানুষ পড়তে পারে।সময়ের ধরা বাঁধা নিয়ম নেই। পরীক্ষা ঠিকঠাকমতো এট্যান্ড করলেই চলে যাবে।বেশি খরচ হবে বলে মনে হয়না। স্টাডি সেন্টারে চলে যাবে যেদিন ক্লাস থাকবে।আমি সব খবর নিয়েছি।তোমার কাজেও তেমন প্রভাব পড়বে না।”
অনর্গল কথা বলে থামলো অন্বেষা।নিজেকে বেশি সময় দিলো না। আহ্লাদী চোখে বর্ণের দিকে চেয়ে বললো,
“বলো রাখবে আমার এই কথা?প্লিজ না করো না।আমি প্রমিজ আর তোমার কাছে কোনো আবদার করবো না।”
বর্ণ মনোযোগ সহকারে শুনলো বটে।তবে জবাব দেয় নিজের মতো করে,
“তোমার মাথায় এসব আজাইরা আজাইরা বুদ্ধি কেন আহে কওতো? হেইদিন লম্বা স্পিচ দিলা আমার দায়িত্ব নিবা।আজকে আবার কও পড়ালেখা করতে। মানে জীবন ভালোমত চলতাছে তোমার ভাল্লাগে না?”
“না লাগেনা।আমি তোমাকে তোমার ইচ্ছা পূরণ করতে দেখতে চাই…..তাছাড়াও আমি ইন্টার পাশ জামাই নিয়ে সন্তুষ্ট না।আমি চাই সেও আমার মতই শিক্ষিত হোক।মানি না!মানবো না!” বলে হাসি আটকাতে ঠোঁট কামড়ে ধরলো অন্বেষা।
এক শান্ত নীরব চাহনি ছুঁড়ে বর্ণ। অন্বেষার মুখের দিকে চেয়ে ভাবছে।সবকিছুর অন্তে মায়ের কথা মনে পড়ে।কতই বা বয়স ছিলো তার?এভাবেই না বলা কথাগুলো বুঝে যেতো মা।একহাত বুকে অন্যহাত মাথায় রেখে চাওয়া পাওয়াগুলো বুঝে ফেলতো।
বর্ণকে চমকে দিয়ে অন্বেষা বলে উঠে,
“মায়ের কথা মনে পড়ছে?”
বর্ণ আচমকাই কপাল কুঁচকে ফেলে।আশ্চর্য গিয়ে তাকিয়ে রইলো অন্বেষার মুখপানে। অন্বেষা যেনো মন পড়তে জানে।আরো অনেকটা অবাক করে বর্ণের কপালে চুমু খেয়ে বুকে মাথা ঠেকালো অন্বেষা। বললো,
“দেখো চারিদিকে কত পরিপূর্ণতা।সেখানে অতীতের মিষ্টি অনুভুতি থাকুক। পোড়া কোনো স্মৃতি যেনো ধরা না দেয়।”
বর্ণ অবলীলায় জবাব দিলো, “পোড়া স্মৃতিই বেশি ধরা দেয়।”
“তুমি অনেক স্ট্রং বর্ণ।তুমি ভালোবাসা নামক পবিত্র অনুভুতি,কষ্ট নামক যন্ত্রণাদায়ক অনুভুতিকে নিজের থেকে দূরে ঠেলে রেখেছো বছরের পর বছর।এটা পারবে না?তুমি মনে করো তোমার মা শুধু তোমার মা ছিলেন না।তোমার বাবাও ছিলেন।ভুলে যাও মোকলেস মাতবর নামক লোকটাকে।তার সাথে তোমার কোনো সম্পর্ক নেই।না ওই খারাপ জনির সাথে।তোমার সম্পর্ক শুধু তোমার মায়ের সাথে।তোমার মায়ের পবিত্র রক্ত বইছে তোমার শরীরে।”
বর্ণ হুটহাট চুপ হয়ে যায়।এই তীব্র ঠান্ডায় দেহ গরম তার।অনুভব করছে অন্বেষা। অন্যকে সান্ত্বনা দিতে দিতে তার নিজেরই যে বাবা মায়ের কথা মনে পড়ছে।বর্ণ প্রশ্ন করে,
“আর তোমার লগে?”
অন্বেষা স্মিত হেসে বললো, “আত্মার গভীর সম্পর্ক।”
“হুম”
“আমিও আমার বাবা মাকে মিস করি।কিন্তু তোমার সাথে থাকলে ভালো অনুভব করি।শান্তি লাগে।কষ্ট আসতে চেয়েও পারে না।”
বর্ণ জবাবে বলে,
“আমিতো ভালো পোলা না।তারপরও?”
“উম!হতে পারো সবার জন্য খারাপ আমার জন্য না।আমার ইচ্ছে ছিলো পড়ালেখা শেষ করে বাবা মায়ের দায়িত্ব নিবো।তাদের রাজার হালে রাখবো।সেটা হলো কই আর?এখন তুমি একান্ত তুমিই আছো।তোমার সব শখ আহ্লাদ পূরণ করি নাহয়।”
“তুমি পারোও আল্লাহর বান্দি!”
“তোমারও পারতে হবে।আমার ইচ্ছে পূরণ না করে যদি মরে যাই তাহলে আমার সারাজীবনের অপূর্ণ ইচ্ছের দায় কিন্তু তোমার বিবর্ণ।”
বর্ণ ক্লান্ত নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
“পুরাপুরি ফাঁসায় ফালাইছো আমারে।”
বর্ণের এলোমেলো কথাও বিশেষ ভাবার্থ বহন করে। উদ্ভট শব্দ ব্যবহার করে জাহির করে নিজেকে।ভাবে হয়তো তার শব্দের এই ধোঁকা অন্বেষা বুঝে না।সে ঠিকই বুঝে।জোর করেনা তাকে।লজ্জায় ফেলেনা প্রকাশ করে।যদি বর্ণের এই চরিত্র হারিয়ে যায়?ভয় হয় তার খুব।
“ফাঁসাই নি।”
বর্ণ শান্ত কন্ঠেই বললো,
“ছেড়ি মানুষ নিজের দোষ স্বীকার যায় না।”
অন্বেষা নত চোখে জবাব দেয়,
“এই ঠেলাগাড়ি ঠেলতে ঠেলতে আমি একটা দ্বারপ্রান্তে নিয়ে দাঁড় করাবো।”
বর্ণ বুঝতে অক্ষম।নির্বোধ এর মত প্রশ্ন করলো,
“মতলব?”
“মানে হচ্ছে তোমাকে তোমার সঠিক স্থানে নিয়ে দাঁড় করিয়ে আমি আরামের ঘুম দিবো”
নীরবে আতঙ্কিত হয়ে উঠে বর্ণ।চোখে মুখে একরাশ বিস্ময়।অজানা ভয় বুকে চাপ সৃষ্টি করছে।কেমন অদ্ভুত যেনো এই শিহরণ।সীমিত বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করে,
“ঘুমাইবা মানে?কাব্যিক কথা বুঝি নাতো আমি।”
অন্বেষা স্বাভাবিক সুরে জবাব দেয়, “ছুটি নিবো।”
বর্ণের কণ্ঠের বিচলন যেনো বৃদ্ধি পায়।বলে উঠে,
“তুমি কি আমারে ফালায় থুইয়া যাওয়ার প্ল্যান করতাছো?”
বর্ণের প্রশ্ন অন্বেষা বিমূঢ় খানিক।তার কথার অর্থ এমন ছিলো না।ভুল বুঝে নিয়েছে বর্ণ। অন্বেষা মাথা দোলায় দুদিকে।জবাবে বলে,
“ছেড়ে যাবো কেনো?”
গলার স্বর কিছুটা উচ্চ হয় বর্ণের।চেপে ধরে আছে অন্বেষাকে।বললো,
“আম্মাও যাওয়ার আগে কইছিলো তোর একটা গতি কইরা আমি শান্তির ঘুম দিমু।তুমিও কি একই ফাইজলামি শুরু করলা!আমি কোনো উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হমু না।এত লায়েক আমি হইতে চাই না। নাটকবাজ বেডি জাতি!”
“তুমি উত্তেজিত হচ্ছো কেনো আশ্চর্য!আমি কোথাও যাবো না”
অন্বেষাকে ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে ফেললো বর্ণ।সরে গেলো তার কাছ থেকে।অন্বেষা গোলগোল চোখে চেয়ে আছে।মুহূর্তেই রেগে গেছে। অন্বেষা এগিয়ে আসে।বর্ণের বাহু চেপে বললো,
“আমি কথার কথা বলেছি বর্ণ….ভুল বুঝছো!”
“আমি ঠিকই বুঝছি….তোমার মতলব খারাপ!”
“বোকা ছেলে তুমি।ছেড়ে যাওয়ার হলে তোমার জন্য এতকিছু করতাম?”
বর্ণ রেগে গেছে। অন্বেষার হাত সরানোর চেষ্টা করে জবাব দেয়,
“তোমরা সবাই এক। ধান্দাবাজ!”
অন্বেষা বর্ণের দুহাত চেপে ধরে শক্ত করে।অস্থির দেখাচ্ছে তাকে।চোখে মুখে বেজায় আঁধার তার।শান্ত করার উদ্দেশ্যে বলে,
“ঠান্ডা হও।আমি কোথাও যাবো না তোমাকে ছেড়ে।কক্ষনো না।”
“সরো”
“তুমি একটা পাগল।আমি বলতে চেয়েছি তোমার জীবনের সব অপূর্ণতা কেটে গেলে আমি শান্তি।তারপর তুমি স্বামীর দায়িত্ব পালন করবে।আমি বসে বসে খাবো।…. বর্ণ?তুমি এতটা নির্বোধ?”
শান্ত হলো সময় নিয়ে।নিজের মতো করেই।মুখ থমথমে থাকে কিছু মুহূর্ত।ধীরেধীরে স্বাভাবিক হয় বর্ণ।ঠোঁট চেপে মাথা নুয়ে আছে। অন্বেষা হেসে প্রশ্ন করে,
“ভাত দিবো?”
“দাও”
________
মোকলেস মাতবর এর দোকান থেকে কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে অন্বেষা।পরনে বর্ণের দেওয়া কালো বোরকা। কাঁধে ব্যাগ চেপে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে।বর্ণ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে।আলাপ করছে মোকলেস মাতবর এর সাথে। অন্বেষার উপর কঠোর আদেশ কোনোভাবেই সীমানা পেরিয়ে দোকানের সামনে দাঁড়াতে পারবে না।
অন্যদিকে বর্ণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মোকলেস মাতবরের দিকে চেয়ে বললো,
“দক্ষিণের ঘরের স্টিলের আলমারির ড্রয়ারে আমার সার্টিফিকেটসহ দরকারি কাগজপত্র আছে।বাইর কইরা আইন্না দেন”
এক আদেশপূর্ণ কন্ঠ। মোকলেস সাহেব নমনীয় দৃষ্টিতে তাকান।ঠান্ডা সুরেই প্রশ্ন করলেন,
“ঐটি দিয়া কি করবি?”
বর্ণ স্পষ্ট গলায় জানায়,
“এত কৈফিয়ততো দিতে পারুম না”
মোকলেস মাতবর চোখ নামান।এক লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।আবার প্রশ্ন করেন,
“কেন লাগবো হুনি?”
বর্ণ কপাল কুঁচকে বিরক্তির ভঙ্গিতে বলে উঠে,
“শ্মশানে নিয়া জ্বালামু।শান্তি?জলদি করেন হাতে সময় নাই।”
মোকলেস সাহেব উঠে আসলেন দোকানের বাহিরে।এক পলক বর্ণের দিকে তাকিয়ে আবার অন্বেষাকেও চেয়ে দেখলেন। চাবির গোছা নিয়ে চলে গেলেন উপরে।
পুরোনো আলমারি।পুরোনো ঘর।তেমন কিছুই নেই সেখানে। স্টোর রুম বলে গণ্য সেটা।বর্ণের মায়ের সেলাই মেশিনটাও পড়ে পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে।স্মৃতি বলতে কিছুই রাখেনি মোকলেস সাহেবের দ্বিতীয় স্ত্রী।পুরোনো কাগজের ভিড়ে বর্ণের জন্ম থেকে উচ্চ মাধ্যমিক অব্দি সব কাগজ অক্ষত।ফাইল ঝেড়ে নিয়ে নিচে নামলেন।বর্ণের দিকে এগিয়ে দিতে সে ছো মেরে নিলো।কোনো রকম কোনো কথা না বলে উল্টো ঘুরে হাঁটতে শুরু করে।
অন্বেষা প্রশ্ন করে, “দিলো?”
দুজনে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বর্ণ জবাব দেয়,
“দিবো না কেন?না দিলে আবার কেয়ামত ঘটায় দিতাম।হেয় আমারে ডরায় বুঝলা!”
বলে হাসে বর্ণ।ফাইলের ময়লা ঝাড়ছে নিজ হাতে।তার হাসিতে অন্বেষাও স্মিত হাসলো।হুট করে মন বললো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্তগুলো কাটাচ্ছে তারা একে অপরের সাথে।
ভর্তি কার্যক্রম শেষ করতে তেমন বেগ পেতে হয়নি। অন্বেষা কাজের পাশাপাশি বর্ণের মুখপানে চেয়েছিলো বারবার।একটা সুখী মুখ।যেনো আড়ালে নিজের খুশি উৎযাপন করেছে।কখনো একটু টেনশনে,কখনো নিস্তব্ধ থাকতেও দেখা গেছে তাকে।আশপাশের মানুষগুলোর দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে ছিলো।কাজ শেষ করতে করতে বিকেল পেরোলো।
হুট করে বর্ণ বলে উঠলো,
“আহো ফুচকা খাই।”
ঠোঁট প্রসারিত করে হাসে অন্বেষা।কোনো কথা না বলেই সম্মতি জানালো তার সাথে।ফুচকার স্টলে পাশাপাশি বসে দুজনে।দুজনার জন্যেই বেশি ঝাল দিয়ে ফুচকা অর্ডার করেছে।বর্ণ সামনে বসে হাত ঘষতে ঘষতে বললো,
“আজকে বাড়িত গিয়া হিসাব করমু বুঝছো। আমারতো সামনের মাস থিকা কাম শুরু।আবার বই খাতা কিনা লাগবো।হাতে কিছু ট্যাকা আছে।হইয়া যাইবো।তারপর ঐ ভার্সিটির বেতনের লেইগা টাকা রাখতে হইবো।ঘরের খরচা পাতি আছে না?একটা হিসাব করলে মাস শেষে আর ঝামেলায় পড়তে হইবো না।”
ছোট্ট একটি ছেলে এসে ফুচকা দিয়ে গেছে ইতিমধ্যে। অন্বেষা একটি ফুচকা নিয়ে বর্ণের মুখে পুড়ে দিলো হুট করে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় বর্ণের চোখ বিশাল আকৃতি ধারণ করে মুহূর্তেই। অন্বেষা হেসে বললো,
“হয়েছে হিসাবী পুরুষ!আপনি এবার থামুন।সামনে যা হবে আমরা দুজনে মিলে সামলে নিবো।আপনি অস্থির হবেন না।”
কোলাহলপূর্ণ এক শীতের সন্ধ্যা নামছে শহরে।মাথার উপরে হলুদ রঙের ল্যাম্পপোস্ট প্রজ্জ্বলিত।মুখ আলোকিত করে রেখেছে বর্ণ অন্বেষা উভয়ের।চারিদিকে যানবাহনের আনাগোনা।মানুষ এবং গাড়ির হর্নে ব্যস্ততা।
কোনরকম ফুচকা গিললো বর্ণ।বললো,
“আমি আমার বাপের জন্মেও ভাবি নাই আমি বর্ণ এসব করমু।এত চিন্তা করমু। সব তোমার দোষ।”
অন্বেষা অবাক সুরে প্রশ্ন করে, “দোষ?আমি যে এই ছন্নছাড়া বাউন্ডুলে ছেলেটাকে মানুষ করেছি সেটা বলো।”
“ওই জীবন বহুত ভালো আছিলো।”
“ওহ!তাই নাকি?”
ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করলো অন্বেষা।সরাসরি বর্ণের চোখে চোখ রেখে।বর্ণ ঠোঁট কামড়ে চোখ নামায়।মিথ্যে বললেই ধরা পড়ে যাবে। অন্বেষাকে এড়িয়ে ফুচকার দিকে মনোযোগ দিয়ে বলতে লাগলো,
“এরপর কফি খামু নে।ট্যাকা থাকলে খালি উড়াইবার মন চায়।”
অন্বেষা কানেই তুললো না তার এই কথা। সে বর্ণের দিকে চেয়ে বললো,
“গতরাতে আমাকে হারিয়ে ফেলার ভয় তোমাকে ঘিরে ধরেছিলো তাই না?”
প্রশ্নটি মস্তিষ্কে গিয়ে লাগে তৎক্ষনাৎ।দুচোখ তুলে তাকায় অন্বেষার সুশ্রী মুখমন্ডলের দিকে।এখানে এক রাজ্যের সুখ খুঁজে নিয়েছে বর্ণ। অথচ অন্বেষাকে আচ করতে দেয়নি।
আকস্মিক বর্ণ মুখ তুলে অন্বেষার দিকে এগিয়ে আসে।স্থান,পরিস্থিতি তোয়াক্কা করলো না। সরাসরি কানের কাছে উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
“কি ঠাডা পড়া নসিব আমার!তোমার পিরিতের জালে আটকা পইড়া আমিও এহন প্রেমে ডুব দিবার শুরু করছি….”
চলবে…........................