শ্যামকন্যার মায়াবী চোখ - পর্ব ০২ - আবিদা সুলতানা - ধারাবাহিক গল্প


ঘোর আঁধারে ঢাকা চারিদিক, চোখের সামনে মোহের অন্ধকার। অগাধ গহ্বরে পতিত সে, হাতড়ে চলেছে কিছু একটির সন্ধানে, যাতে করে সে উপরে উঠতে পারে। কিন্তু তার প্রার্থনায় সাড়া মেলে না। সে কিসে আসা খুঁজবে? এক ভয়াবহ অনুভূতিতে সে বুঝতে পারছে, তার জীবন সায়াহ্নে পৌঁছেছে। অসহায় আর্তনাদে সে চিৎকার করে বলছে

-——— "বাঁচাও আমাকে, কেউ বাঁচাও! আমি মরতে চাই না, দয়া করে আমাকে বাঁচাও। আমি শ্বাস নিতে পারছি না।"

হঠাৎ করেই অন্ধকারে আলোর কিরণ প্রতিফলিত হলো; হ্যাঁ, এই তো আলোর রশ্মি! জীবন প্রদীপ জ্বালাবার প্রত্যাশায় তার দৃষ্টি সেখানেই নিবদ্ধ। কিন্তু কোথায় সে? কেন আসছে না? হাত কেন বাড়িয়ে দিচ্ছে না? তাকে তো তুলে উঠাতে হবে। 

সে কাতর স্বরে আর্তি জানায়, 

-——— "প্লিজ, আমাকে বাঁচান, আপনার হাতটা দিন, প্লিজ, আমাকে এই গহ্বর থেকে উঠতে সাহায্য করুন।" 

কিছু একটা আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে, কিন্তু সেটা কী? হ্যাঁ, ওটা এক জোড়া চোখ! আগুনের শিখা বের হচ্ছে তার দৃষ্টি থেকে, মনে হচ্ছে সেই আগুনেই তাকে দগ্ধ করে দেবে। কিন্তু ওটা কি? চোখের পাশ দিয়ে রক্ত ঝরছে না? সে তো বাঁচাতে আসেনি, তাকে মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এই ভয়াবহ দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। ধীরে ধীরে সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে।

________________

চারটি দীর্ঘ বছর অজ্ঞাত কোমা অবস্থায় থাকা আলোর আঙুলের মৃদু নড়াচড়ায় প্রকম্পিত হলো পুরো হাসপাতাল। নার্স এই আশ্চর্য দৃশ্য দেখে দৌড়ে ডাক্তারকে ডাকার জন্য ছুটল। আলোর জ্ঞান ফিরেছে শুনে ত্বরিত পদক্ষেপে কেবিনে প্রবেশ করল ডাক্তার আদিত্য । দ্রুততার সাথে আলোর পালস্ পরীক্ষা করল সে, আর এক পলকের জন্য তাকিয়ে রইল আলোর ঘামভেজা মুখের দিকে। অতিরিক্ত শ্বেতবর্ণের কারণে সম্পূর্ণ মুখমণ্ডল লাল হয়ে আছে। মায়াবী চোখ দুটি তাকিয়েই আছে কারো অপেক্ষায়। এমন চোখের মায়ায় বিভোর হয়েই হয়তো ভাবতে বাধ্য সে; কি সৌন্দর্য! ভয় ও আশঙ্কায় গোলাপি ঠোঁট দুটি কাঁপছে অবিরাম। বয়স খুব বেশি হলে আঠারো কিংবা ঊনিশ। এত বছর কোমায় থাকার পরও তার সৌন্দর্যে একটুও কমতি নেই। সে নিথর হয়ে শুয়ে আছে, চোখ মিটমিট করে তাকানোর চেষ্টা করছে। পুরো শরীর ঘেমে ভিজে যাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে কিছু একটা দেখে ভীত হয়ে আছে। ডাক্তার মনে মনে ভাবছে, কে এই মেয়ে? কোথা থেকে এসেছে? কোথায় তার ঠিকানা? কিন্তু না.! এই মুহূর্তে এসব কিছুই তাকে জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে না।

-——— " স্যার, এখন মেয়েটিকে কী করবেন?"

নার্সের কথায় ধ্যান ভাঙল আদিত্যর। একবার আলোর দিকে তাকিয়ে, সে নার্সকে বলল,

———-" যতক্ষণ না পর্যন্ত মেয়েটির পরিবারের কোনো খবর না পাচ্ছি, ততক্ষণ ওকে এখানেই রাখতে হবে। তাছাড়া ওর এখন অনেক মানসিক সাপোর্ট প্রয়োজন। আমি চাই না, এভাবে অজানা এই শহরে ওকে একা ছেড়ে দিতে।"

এরপর আদিত্য আলোর দিকে তাকালে, দেখতে পায় তার চোখ কিছু একটা খুঁজছে। আলোকে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে কিছু বলতে চাইছে। সে উঠে যেতে চাচ্ছে, কিন্তু অনেক বছর কোমায় থাকায় তার শরীর যেন অবশ প্রাণীর মতো হয়ে গেছে, হাত পা এখনো ভালোভাবে নাড়াতে পারছে না। আলো বুঝতে পারছে না কেন এমন অনুভূতি হচ্ছে, কেন মনে হচ্ছে বহুদিন ঘুম থেকে ওঠেনি সে। এ মুহূর্তে কিছুই সে ভাবতে পারছে না, মাথা ভারি হয়ে আছে। আলো হঠাৎ এক গম্ভীর পুরুষ কণ্ঠ শুনতে পায়,

-—— "এই যে, আপনি কি আমার কথা শুনতে পারছেন?"

আলো কিছু বলল না, শুধু তাকিয়ে রইল সামনে থাকা পুরুষটির পানে। সুঠাম দেহের অধিকারী এক সুদর্শন পুরুষ। পরনে সাদা এপ্রোন, চোখে চশমা, কিন্তু চশমার পেছনে তার চোখের সৌন্দর্য আড়াল হয়নি। হাতে রোলেক্স ব্র্যান্ডের কালো ঘড়ি, হাতের কুনুই পর্যন্ত হাতা গোটানো, গলায় ঝুলছে স্টেথোস্কোপ। কপালে সূক্ষ্ম চিন্তার ভাঁজ। যে এই মুহূর্তে তার দিকে গভীর চিন্তান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করছে,

-——— "এই যে, শুনছেন? আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন? ভয় পাবেন না।"

আলো শুধু তাকিয়ে রইল, কিছু বলল না। আদিত্য আর জোর করল না। নার্সকে বলল,

-——— "তুমি ওর দিকে খেয়াল রাখো, আমি একজনকে ফোন করে আসছি"

———- "জ্বি স্যার। স্যার, একটা প্রশ্ন করব?"

আদিত্য তাড়াহুড়ো দেখিয়ে, না তাকিয়ে বলল,

-———" যা বলার তাড়াতাড়ি বলো।"

———-" আসলে, স্যার, একটা অজানা অচেনা মেয়ের জন্য এতকিছু করছেন, আপনি কি... আসলে অনেকে অনেক কথাই বলছে তো, তাই..."

আদিত্য একবার আলোর দিকে তাকিয়ে বলল,

-——— "কারো কথায় কান দেওয়ার সময় আমার নেই।"

_______________

ফ্ল্যাশব্যাক

-——— ওহ, শিট!!!

———- স্যার, এখন কি করব?

আদিত্য বিরক্ত হয়ে বলল,

———-" কি করবে মানে! আগে দেখো মেয়েটা বেঁচে আছে কিনা।"

গাড়ির সামনে একটি মেয়ে এসে পড়ায়, ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায় মেয়েটি। রাত এখন ১২:৩৪। চারিদিকে ঘন কালো অন্ধকার, কিছু দেখা যাচ্ছে না। ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, মাঝে মাঝে শেয়ালের ডাক ভেসে আসছে। জায়গাটি লোকালয় থেকে বেশ দূরে, আশেপাশে ঘরবাড়ি নেই বললেই চলে। হালকা ঠাণ্ডা বাতাসে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। ভূতুরে এক পরিবেশ তৈরি হয়ে আছে। এত রাতে এই মেয়ে এখানে কি করছে? এই মেয়ে আবার ভূত নয় তো? মুভিতে দেখেছে ভূতেরা এমনভাবে অসহায় মানুষদের ফাঁদে ফেলে, পরে ঘাড় মটকে মেরে ফেলে। ভাবতে ভাবতে ড্রাইভার মেয়েটির কাছে গিয়ে ভয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে সোজা করে দেখলে, আদিত্য আবার তাড়া দিয়ে বলে কিছু বলবে, তার আগেই ড্রাইভার বলে উঠলো,

———- "স্যার, বাচ্চা মেয়ে!"

-——— "নিশ্বাস চলছে?"

———-" স্যার, মেয়েটা নিশ্বাস নিতে পারছে না, মেয়েটা মারা যাবে মনে হচ্ছে। আমাদের এখানে থাকা ঠিক হবে না, স্যার। পুলিশ কেস হতে পারে। শুধু শুধু ঝামেলায় জড়ানো ঠিক হবে না, তাছাড়া আপনি তো তাড়ায় আছেন।"

ড্রাইভার ভূতের হাত থেকে বাঁচার জন্য কথাটা বলল। আদিত্য কিছু একটা ভেবে বলল,

-———" গাড়িতে এসে, গাড়ি চালাও।"

-———" আর মেয়েটা?"

আদিত্য বিরক্ত হয়ে বলল,

-———" ইডিয়ট! ওকে ওখানে ফেলে আসো।"

ড্রাইভার খুশি হয়ে বলল,

———- "জ্বি স্যার।"

এই বলে ড্রাইভার মেয়েটিকে পাশ কাটিয়ে ফেলে দৌড়ে গাড়িতে গিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো। গাড়ি মেয়েটির পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে আদিত্যর বুকটা কেমন হাহাকার করতে লাগল। কিছু একটার অপরাধবোধ তার মনে চাড়া দিতে শুরু করল। বারবার কানের কাছে কেউ বলে যাচ্ছে, "তুমি একজন ডাক্তার, মানুষের শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত তার জীবন বাঁচানোর চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। তুমি একজন ডাক্তার।" আর সহ্য করতে পারল না আদিত্য। হঠাৎই ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলল। ড্রাইভার কিছু বলার আগেই আদিত্য দৌড়ে গেল মেয়েটির দিকে। গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে মেয়েটিকে তার দিকে ফিরিয়ে নিল। মেয়েটি দেখেই আদিত্যর বুকটা ধক করে উঠল। সদ্য কৈশোরে পদার্পণকারী একটি কিশোরী, বয়স পনেরোর বেশি হবে না। গোলাকৃতি জামা পরিহিতা, দুইপাশে বিন্যস্ত লম্বা চুল, ধবল মুখমণ্ডল, গোলাপি ঠোঁট। পুরো দেহটি কর্দমাক্ত। মনে হয়, যেন কোনো রূপকথার রাজ্য থেকে পালিয়ে এসেছে সে। ক্ষুদ্র দেহটি ক্লান্ত, এক দুঃসহ পালানোর ধকল সয়ে এসেছে।

———- "স্যার, আপনি কেন এই মেয়েটির কাছে গেলেন? আপনার তো কাজ আছে, আপনি কি ভুলে গেছেন? তাকে এখানে থাকতে দিন। চলুন স্যার, নয়তো আপনি যে কাজে এসেছেন..."

ড্রাইভারের কথায় আদিত্যর চিন্তা ভাঙল। মুহূর্তেই তার জরুরি কাজের কথা ভুলে গিয়ে সে কেবলমাত্র মেয়েটিকে বাঁচাতে চাইল। মেয়েটিকে কোলে তুলে দাঁড়াল। ড্রাইভারকে বলল,

-——— "দরজা খোল! "

ড্রাইভার কোনো কথা না বলেই দ্রুত গাড়ির দরজা খুলে দিল। আদিত্য মেয়েটিকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসে বলল,

-——— "স্টার্ট দাও কুয়িক। "

------

ফোনের ওপাশ থেকে কারো কথা শুনে আদিত্যর মনোযোগ ভাঙল। ফোনের অপর প্রান্তে ব্যক্তিকে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি নিয়ে বলল,

————"মেয়েটির জ্ঞান ফিরেছে।"

--------

হঠাৎ পকেটে থাকা ফোন অনবরত বাজতে লাগলে পরিচিত নম্বর দেখে রিসিভ করল আরাফ,

-———" কোনো খবর আছে?"

ওপাশ থেকে কিছু শোনা গেল না, কিন্তু আরাফের ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি ফুটে উঠল।
.
.
.
চলমান.................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন