পর্ব ৩৩
মৌরিন আহমেদ
.
.
.
ল্যাপটপের সামনে বসে আছে প্রদোষ। একটা মেইল আসার অপেক্ষায় আছে সে। মেইলটা আসবে চিফ স্যারের কাছ থেকে। একে এই চিফ স্যার ওকে দেখতেই পারে না তাতে যদি ফিরতি মেইল পাঠাতে দেরি করে তবে যে ওর খাড়াই মরণ তা বেশ ভালোই জানে!
কাল বিকেলের ওই অপারেশন নিয়েই কথা বলবেন স্যার। তার সব ডিটেইলস গুলো নিবেন হয় তো। ইনফরমেশনে একটু উলোট পালোট আর উপস্থাপনে একটু গড়মিল করলেই সোজা গর্দান! এ রিস্ক আর কেই বা নিতে চায়? সেধে সেধে গিয়ে গলায় ফাঁসি পরার আর ইচ্ছে থাকে?
ভাবতে ভাবতেই টুং করে নোটিফিকেশন আসে। তড়িঘড়ি করে চেক করার জন্য হাত বাড়ায়। প্রথমেই চিফ স্যারের মেইল। গভীর একাগ্রতার সাথে সেটা পড়ে নিয়েই ফিরতি মেইল টাইপ করতে বসে।
- হেই, বর্ষণ খবর কী তোর?
অনেকটা সময় পর ধ্রুবের ঘরের সামনে এসে দাড়াতে দেখা যায় প্রদোষকে। ধ্রুব পাঞ্জাবি পরে তৈরি হচ্ছিল, কোথায় যেন যাবে। প্রদোষকে দেখেই মৃদু হাসলো। বললো,
- কী রে, তোর খবর কী?
- খবর তো ঝাক্কাস!.. চিফ স্যার মেইল করেছিলেন, এবার মনে করে একটা অ্যাওয়ার্ড পেয়েই যাবো!.. তুই তো মেলা পেয়েছিস এবার আমিও পাবো!
ভীষণ খুশি খুশি লাগে ওকে। ধ্রুবের দিকে এগিয়ে উচ্ছ্বসিত গলায় আরও খবর দিতে থাকে,
- চিফ স্যারের কাছে ছুটি নিতে চেয়েছিলাম, জানিস?.. কিন্তু আমার চাওয়ার আগেই স্যার নিজেই খুশি হয়ে ছুটি দিয়ে দিলেন.. আমি তো ভাবছি আজই ফিরে যাবো। তুই কি বলিস?
- আজই? একটু তাড়াতাড়িই হয়ে যায় না?.. কী দরকার এমন...
- দরকার নেই মানে?.. এখানে থেকে আমার লাভ আছে কোনো?.. কোথায় ভেবেছিলাম খাগড়াছড়ির পাহাড়ি মেয়েদের মধ্যে থেকে একজনকে ধরবো, পটিয়ে বিয়ে-টিয়ে সেরে হানিমুনের জন্য যাবো কাশ্মীর!.. সেখানে না কী কিচ্ছুটি হলো না?.. আর কোন দুঃখে থাকবো আমি এখানে? এর চেয়ে তো বাসায় বসে স্যান্ডউইচ গেলা ভালো রে!..
- ভালো তো হবেই!.. যেখানে খাওয়া সেখানেই তো তুই, তাই না?
ফোড়ন কাটে ধ্রুব। ব্যাপারটা গায়ে মাখে না প্রদোষ। পকেট থেকে ফোনটা বের করতে করতে বলে,
- ছুটি তো পেলি... তা এবার বল্, কী করবি? ঢাকা ব্যাক করবি, না আবার কোথাও ডুব মারার প্ল্যানে আছিস?.. ফিরলে চল্, একসাথেই যাই, বিকেলে বাস আছে একটা। টিকেট বুক করি?
- না রে, যাবো না। নিসর্গকে পেয়েও উপভোগ না করলে রাগ করবে না মা-জননী? থাকি কয়েকটা দিন এখানে...
বাঁধ সাধে ধ্রুব। প্রদোষ মুখ বাঁকিয়ে বললো,
- ওরে আমার নিসর্গ প্রেমিক রে!.. সত্যি করে বল্ তো প্রকৃতি দেখা না মেয়ে পটানো? কোনটার জন্য এতো উতলা?
বলেই ভ্রু নাচায়। ধ্রুব বাম হাতে ঘাড় চুলকাতে চুলকাতে বললো,
- কী যে বলিস না তুই!.. কীসের মধ্যে কী, পান্তা ভাতে ঘি!...
- হয়েছে, হয়েছে!.. আর লজ্জা পেতে হবে না!.. এইসময় এমন পাঞ্জাবি পরে সেজেগুজে কোথায় যাচ্ছিস? মেয়ে পটানোর জন্য?
- আরে ধ্যাত! চুপ করতো তুই!.. আমি শুধু এমনই একটু বেরবো.. তাই আবার কি না কি...
- আচ্ছা, আচ্ছা। বুঝেছি! যা বেরিয়ে আয়। আমিও যাই প্যাকিং শুরু করতে হবে...
আর কোনো প্রতি উত্তর না করেই বেরিয়ে যায় ধ্রুব। প্রদোষ ও বেরিয়ে যাবে, হঠাৎ কী যেন মনে হতেই দাড়িয়ে গেল। ইতস্তত করে বললো,
- ইয়ে বর্ষণ?.. তুই আর অনা'র শহরে যাবি না?.. তোর মন ছুঁয়েছে যে, তার জন্য?
অনন্যার নামটা শুনতেই একমুহুর্তের জন্য কী যেন হয়ে যায় ধ্রুবের। ততক্ষনাত পা থামিয়ে মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। মলিন হেসে বললো,
- সে কী আমার অপেক্ষায় আছে যে আমি যাবো?.. যে আমার মন ছুঁয়েছে, সে কি জানে সে কথা? আর আমিই কী তার মন ছুঁতে পেরেছি?.. তাতো জানি না। তবে ফিরবো সেথায় কোন আশায়?
ছেলেটার মন খারাপ হয়ে গেছে সেটা বুঝতে পারে প্রদোষ। প্রতি উত্তরে যুক্তি দেখানোর জন্য জুতসই কিছু একটা খুঁজতে থাকে। কিন্তু খুঁজে পায় না। তবুও বৃথা সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করে বলে,
- ওখানে না গেলে কী করে জানবি সে খবর? এমনও তো হতে পারে মন ছোঁয়াছুঁয়ির খেলায় দুজনেই জিতেছিস, অথচ প্রতিপক্ষের আশায় কিছু বলছিস না?
- হতে পারতো, তবে হয় নি। হলে অবশ্যই...
বাকিটা বলতে আর ইচ্ছে করে না। কী দরকার সবকিছু বলার? আসার আগে করিম চাচার কাছে অনন্যার নামে একটা চিঠি রেখে আসে। যাতে সে খোঁজ করলে পায়। সেখানে ওর কন্ট্যাক্ট নাম্বার ছিল। যদিও সহজ ভাষায় না, একটু জটিল করে। তবুও সেটা ওর বের করে ফেলার কথা। অথচ অনন্যা নাকী ওর খোঁজেই আসে নি! আবার হতেও পারে এসেছে, কিন্তু ওকে পায় নি। পেলে নিশ্চয়ই একবারের জন্য হলেও কল করতো ওকে!
_________________________
নিজের সেলফোনটা হাতে নিয়ে অনন্যার ঘরের উদ্দেশ্যে ছুটছেন জোহরা বেগম। দরজার কাছে এসেই দেখতে পেলেন রিডিং টেবিলের সামনে বসে আছে অনন্যা। সামনে খোলা বইয়ে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ। একবার ভাবলেন ডাকবেন কী না। পড়ার সময় ডিস্টার্ব করা কী ভালো? আবার কী যেন ভেবে হাতের ফোনটার দিকে তাকালেন। না, ডাকতেই হবে। বড্ডো টেনসন লাগছে তার। উদ্বিগ্ন গলায় ডাকলেন,
- অনু!. ব্যস্ত না কি মা?
ডাক শুনেই ফিরে তাকালো অনন্যা। একপলক মাকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে নিলো। তার চেহারায় কেমন যেন উদ্বেগ প্রকাশ পাচ্ছে। কপালের কাছে বিন্দু বিন্দু ঘাম, ঠোঁট দু' খানা কাঁপছে। হঠাৎ কী হলো? অবাক কণ্ঠে বললো,
- কী হয়েছে মা?
- তোর মামার কোনো খোঁজ পাচ্ছি না রে..
কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে জবাব দিলেন উনি। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে বিছানায় বসলেন। তার কথাটা শুনেই যেন চমকে উঠলো ও। লাফ দিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাড়ালো। বললো,
- কীহ্? এসব কি বলছো মা?
বলতে বলতেই এগিয়ে এসে মার কাছে দাড়ালো। জোহরা হাতের ফোনটা দেখিয়ে মাথা নেড়ে বললো,
- গত পরশু থেকে ট্রাই করছি, তোর মামার নাম্বারে, কল ঢুকছে না। ভাবলাম পার্বত্য জায়গা তো, নেটওয়ার্কে ঝামেলা। কাল সারাদিন করলাম, আজও করলাম। রিং হলো না। বলছে নাম্বার না কী সুইচড অফ! এসব কি কথা বল্ তো, মা? লেবুর নাম্বার কেন বন্ধ থাকবে?
কথাটা শুনে অনন্যার কাছেও কেমন যেন খটকা লাগলো। তিনদিন ধরে কোনো খোঁজ নেই, মোবাইল বন্ধ? মামা তো কখনো ফোন বন্ধ করে রাখেন না। তাহলে? কোনো বিপদ হলো না তো?
ভেবেই নিজের ফোনটার সন্ধান শুরু করলো। বালিশের পাশে সেটাকে দেখতে পেল। কল লাগালো লেবু মামার নাম্বারে। রিং হওয়ার আগেই জানিয়ে দেয়া হলো সংযোগ দেয়া সম্ভব না। ফোনটা যথারীতি বন্ধ!
ও বিরক্ত হয়ে আবারও কল লাগলো। একে একে বেশ কয়েকবার। লাভের লাভ কিছুই হলো না। কলটা মামার কাছে পৌঁছলই না! ব্যস্ত হয়ে লতার কাছে ফোন করলো। অবাক কান্ড! এটারও সেই একই কেস! এক সাথে দুজনেরই নাম্বার বন্ধ? তাজ্জব কী বাত্!
ওর ফোন করা দেখে আগ্রহী চোখে তাকিয়েছিলেন জোহরা। উদ্বিগ্ন গলায় শুধোলেন,
- রিং হয়েছিল?
হতাশায় মাথা নাড়ে অনু। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে বললো,
- কী জানি কী হলো!. একসাথে দুজনের নাম্বারই বন্ধ!. তিনদিন ধরে খোঁজ নেই!.. আচ্ছা, এর আগে লাস্ট কবে মামুর সাথে কথা হয়েছিল তোমার? কথা বলতে কেমন? নিয়মিত খোঁজ দিত মামু?
- প্রতিদিনই তো হতো। তোর মামু বলতো কোথায় কোথায় বেরোল, কী কী দেখলো.. হঠাৎ করেই...
- বাবাকে জানিয়েছ? বাবা কি বললেন?
- তোর বাবার আবার কথা! উনি সংসার নিয়ে কোনো মাথাব্যথা দেখিয়েছেন কখনো? তিনদিন ধরে বলছি, লেবুটার একটু খোঁজ নিয়ে দাও না... বলে কী না, নেট প্রবলেম! আরে বাবা, নেট প্রবলেম হলে ফোন কেন বন্ধ দেখাবে?..
জয়নাল আবেদীনের উপর নিজের সুপ্ত ক্ষোভ ঝাড়তে থাকেন। কথাগুলো শুনে চিন্তায় পড়ে যায় অনন্যা। তার মামু নিখোঁজ, অথচ তারপরও তার বাবা চুপ? নীরব দর্শক হয়ে বসে থাকবেন? পার্বত্য অঞ্চলগুলো ভালো না, অধিকাংশই নৃ গোষ্ঠীর দখলে, হরহামেশাই ডাকাতি হয়... আবার দলচুত্য হয়ে বনে হারিয়ে যাওয়া, পা পিছলে পাহাড় থেকে পড়ে যাওয়া, কতো রকমের বিপদই তো আছে! এসব কি একবারও ভেবে দেখবেন না উনি? তার একমাত্র মামুর প্রতি কী কোনো মমত্ববোধই নেই? না হয়, তিনি সংসার থেকে চিরকাল বিচ্ছিন্ন। কোনো খোঁজখবর রাখেন না, তাই বলে বাড়ির একটা সদস্য হারিয়ে যাবে, সেখানেও তার কোনো দায় থাকবে না? তাতো ঠিক না... অন্যায়!
হঠাৎ ডুকরে ওঠেন জোহরা। ওর হাত ধরে কেঁদে কেটে বললেন,
- আমার একমাত্র ভাইটা, কোথায় হারালো, বল্ তো?.. দুনিয়া দারির খোঁজ রাখে না.. ওখানে গিয়ে কী হয়ে গেল কে জানে!.. আমারই ভুল! ওকে কেন পাঠালাম আমি?.. ওদিকে লতা মেয়েটাও বিদেশি, এদেশের কিচ্ছুটি চেনে না!.. কোন বিপদে পড়ল আল্লাহই জানেন!.. অনু রে, কী হলো ওদের!
.
.
.
চলবে...........................