মন ছুঁয়েছে সে - পর্ব ০৯ - মৌরিন আহমেদ - ধারাবাহিক গল্প

মন ছুঁয়েছে সে 
পর্ব ০৯ 
মৌরিন আহমেদ 
.
.
.
একটা টিনের ঘরের ভিতর বসে আছে ধ্রুব। ঘরটা মালেকের। ওকে এখানে রেখে খালি ঘরের খোঁজে গেছে সে। ঘরে একটা মাত্র চৌকি। তার ওপর এলোমেলো তোষকের উপর ও বসে আছে। তার ঠিক পাশেই একটা কাঠের টেবিল। টেবিলটা ভর্তি কি কি যেন হিজিবিজি জিনিস দিয়ে। ম্যাচ, মোম, সিরিঞ্জ, কিছু আলগা কাগজ আর প্যাঁচানো তার-হোল্ডার। মাঝারি সাইজের ঘরটার ছাদের ঠিক মাঝখান থেকে এসেছে একহাত ঝুলন্ত হোল্ডার। তাতে জ্বলছে হলুদ রঙের ১০০ওয়াটের বিজলী বাতি। 

পুরো ঘর জুড়ে একটা বিশ্রী গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। ধ্রুব খেয়াল করে দেখলো ঘরের প্রায় সব জায়গাতেই বাঁশের সাথে পেরেক লাগানো। তাতে ঝুলছে কিছু ময়লা শার্ট-প্যান্ট, শপিং ব্যাগ ইত্যাদি। টেবিলের এক সাইডে টিনের দেয়ালে বেশ কিছু পোস্টারও চোখে পড়ছে। তার মধ্যে সম্পূর্ন নগ্ন এক তরুণীর ছবিই সবার আগে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ছবিটা চোখে পড়ার সাথে সাথেই ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো দ্রুত মুখ ফিরিয়ে নিলো ধ্রুব। উফ্! কী বিশ্রী! 

আধঘন্টা পর দরজা খোলার শব্দ হলো। টিনের দরজাটা 'ক্যাচ ক্যাচ' শব্দ করে খুলতেই মালেককে ঘরে ঢুকতে দেখা গেল। সে বেশ খুশি খুশি মুখ করে এগিয়ে এলো ওর দিকে। 

- ভাই খুশির সংবাদ শুনেন... আপনি যেমন ঘর চাইছিলেন ঠিক তেমনই একখান ঘর পাইছি! বস্তির পুব দিকের ঘরটা মাস খানেক ধইরা খালি। আপনে চাইলে ঘরডা নিতে পারেন... 

আচমকা ওকে দেখে অপ্রস্তুত হয় ধ্রুব। তবে সে ভাবটা মুহুর্তেই কাটিয়ে উঠে বললো, 

- আশেপাশে ফাঁকা আছে তো?.. দেখেন, ঘিঞ্জি এলাকায় কিন্তু সমস্যা আছে, আমি আপনাকে তো বলেছি.... 

- আরে ভাই, টেনশন নিয়েন না। সব ঠিকই আছে। ওই দিকে বেশ কয়ডা ঘর আছে, তয় সবগুলানই ফাঁকা। আপনে কানির ঘরডা নিলে সমস্যা হইবো না।... 

- ঠিক আছে, চলেন। ঘরটা দেখে আসি... 

- চলেন। 

মালেক মিথ্যে বলে নি। আসলেই বস্তির পূর্ব দিকের ঘরটা ফাঁকা। টিনের ঘর আছে কয়েকটা কিন্তু সবগুলোতেই তালা মেরে রাখা। ধ্রুবের জন্য যে ঘরটা দেখানো হলো সেটাও তালাবদ্ধ। মালেক চাবি হাতে দরজা খুলতেই 'ক্যাচ' করে সেটা খুলে গেল। 

মালেক আগে আগে ঢুকে আলো জ্বালতেই আঁধার ঘরটায় আলোর অস্তিত্ব পাওয়া গেল। যদিও পুরোপুরি আলোকিত হয় নি কারণ ঘরের হলুদ বাতির পাওয়ার খুবই ক্ষীণ। ঘরে ঢোকা মাত্রই নাকে একটা ভ্যাপসা-ভ্যাপসা, গুমোট গন্ধ এলো ধ্রুবের। ভালো করে চেয়ে দেখলো এ ঘরেও একটা মাত্র চৌকির ঠাঁই হয়েছে। তার পাশে কাঠের একটা টুল দেখা যাচ্ছে। যার তলটার পুরোটাই ধূলোয় আচ্ছাদিত। চৌকির ওপর ক্যালেন্ডারের কয়েকটা ছেড়া পাতা আর ঘরের কোণায় কোণায় ঝুলে থাকা মাকড়সার জাল। ও আরও খেয়াল করে দেখলো যে ঘরটার চার দেয়াল মিলিয়ে একটা মাত্র জানালা! তাও ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র! মালেক এগিয়ে এসে টুলের উপর ধুলোটা হাত দিয়ে ঝেড়ে দিয়ে বললো, 

- দেখেন তো, ঘর ঠিক আছে কি না?.. 

ধ্রুব নিজের চারপাশ পর্যবেক্ষণ করতে করতে বললো, 

- পার্ফেক্ট! শুধু একটু ময়লা সবকিছু।.. আমার আবার ডাস্ট এলার্জি আছে... 

- বস্তিতে ঘর নিলে এমন একটু হইবোই.. তয় চিন্তা কইরেন না। আমার কাছে মাইয়া আছে, সব ঝারপোচ কইরা দিব.. 

- ঠিক আছে, তাহলে তাকে ডাকুন। 

- আইচ্ছা। 

বলেই চলে যেতে উদ্যত হলো মালেক। কিন্তু পরক্ষণেই ফিরে এলো। ওকে আবার ঘুরে আসতে দেখে ধ্রুব বললো, 

- কী হলো চলে আসলেন যে? 

- না... মানে... ট্যাকা-পয়সা যদি কিছু... 

মাথা চুলকাতে চুলকাতে জবাব দেয় মালেক। তা দেখে ও মুচকি হেসে পকেটে হাত ঢুকায়। পাঞ্জাবির পকেট থেকে কচকচে দু'টো হাজার টাকার নোট বাড়িয়ে বলে, 

- এটা রাখেন, অ্যাডভান্স দিলাম... 

মালেক দু'হাতে টাকাটা লুফে নিলো। নিজের কটকটে হলুদ রঙের দাঁতগুলো বেড় করে হেসে দিয়েই দ্রুত প্রস্থান করলো। 

__________________________ 

নিজের ঘরে বসে আছেন লেবু মামা। ইজি চেয়ারে পা দুলিয়ে কোলের ওপর একটা বালিশ রেখেছেন। তার উপর একটা ক্লিপ বোর্ড এ কিছু কাগজ রাখা। আর পাশেই কনুই ঠেকিয়ে গালে হাত দিয়ে আছেন। অন্যহাতে একটা কলম ধরে রেখে অনবরত নাচাচ্ছেন। মাঝে মাঝে কলমের ক্যাপ কামড়ে ধরে কী যেন ভাবছেন। 

এমন সময়ে হুট করেই অনন্যাকে দেখা গেল। ও ঘরের ভিতর মুখ বাড়িয়ে বললো, 

- মামু, আসবো? 

মামা তাকালেন না। কাগজের দিকে তাকিয়ে কবি কবি ভাব ধরে বললেন, 

- আসবি?.. আয়... 

অনুমতি পেয়ে সানন্দে ঘরে প্রবেশ করলো অনন্যা। ইজি চেয়ারের হাতলটার ওপর বসতে বসতে আহ্লাদী গলায় বললো, 

- কী করছো লেবু মামা? 

প্রশ্ন শুনেই থেমে গেল কলম নাচুনি। বাম হাত তুলে বোর্ডের উপর 'ঠাস' করে শব্দ করে ওর দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকালেন মামা। রূঢ় গলায় বললেন, 

- কাজের সময় বিরক্ত না করলে হয় না তোর? সবসময় 'লেবু মামা, লেবু মামা' বলে পঁচাস কেন? 

মামার রাগ দেখে বিশেষ কোনো ভাবাবেগ হলো না অনন্যার। কাগজের উপর থেকে মামার হাতটা তুলে দিতে দিতে বললো, 

- তা কী এমন রাজকার্য করছিলে তুমি?.. দাও, দাও.. আমিও একটু দেখি... 

বলে দেখতে নিলেই চট করে হাত দিয়ে বোর্ডটা ঢেকে ধরলেন উনি। এক হাতে ওর ধরে রাখা হাতটা ছাড়িয়ে নিতে নিতে বললো, 

- তুই কি মনে করিস, আমি কোনো কাজ করতে পারি না? আমি অকর্মণ্য, অকাজের লোক? 

- আহ্ হা, সেটা কখন বললাম? তুমি বলছিলে কাজ করছো তাই... 

- তাই বলে এভাবে ঠেস মেরে কথা বলবি?.. জানিস, আমি কেমন অসাধারণ আইডিয়া বের করেছি? 

মামার কথা শুনে মনে মনে বেশ মজা পেল অনন্যা। ও জানে এমন অসাধারণ আইডিয়া মামা প্রায়ই বের করেন। বিশাল কর্মযজ্ঞের আয়োজন করেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়ে ওঠে না। তবে মামা এখন ঠিক কি নিয়ে মেতেছেন সেটা জানতে খুবই আগ্রহ হচ্ছে ওর। তাই বললো, 

- ঠেস মেরে কথা বললাম কই? আমি তো শুধু মজা করলাম.. 

তারপর আহ্লাদী সুরে মামার গলা জড়িয়ে ধরে বললো, 

- তা বলো না মামু, তুমি কি আইডিয়া বের করেছ? 

- সর, সর। একদম আল্লাদি করবি না।.. আমি তোকে বলবো না... 

- বলো না মামা, প্লিজ? প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ? 

ওর এমন আদুরে ভঙ্গি দেখে আর না করলেন না মামা। খুশি হয়ে বললেন, 

- শুনবি? 

- হুম, বলো। 

- শোন। আমি একটা দারুন আইডিয়া বের করেছি। বাংলাদেশ ট্যুরিজম নিয়ে... 

- ট্যুরিজম নিয়ে?.. 

- হুম। আমি ফার্স্ট এ একটা জায়গা নিয়ে গবেষণা করবো, ট্যুরিস্ট স্পট গুলো নোট করে নিজে গিয়ে জায়গাগুলো দেখবো। ছবি তুলবো। লাইভে এসে জায়গাটা ফেসবুকে দেখাবো। ভিডিওটা অনলাইনে শেয়ার করবো।... বলতে পারিস আর্কিওলোজিস্টের মতো কাজ। গ্লোব ট্রটার বন্ধুও বলা যায়... 

- কিন্তু ওরা তো অনেক দেশে ঘোরে, তুমি এতো দেশে যাবে কী করে? 

- আরে পাগলা, শুরুটা তো করতে দে। আর সারা দুনিয়ায় কেন যাবো? আমাদের বাংলাদেশেরই তো কতো কতো জায়গা.. 

-ঠিক বলেছ। আগে বাংলাদেশ। তবে তারও আগে এই শহরটা।... আমার তো ধারণা তুমি এই শহরের কিছুই জানো না!... শুধু চেন তাতারপুর আর এই বাড়ি! 

অনন্যা ভেংচি কেটে কথাটা বলতেই প্রতিবাদ করলেন মামা। যদিও জোড়ালো কিছু বললেন না কারণ কথাটা আসলেই সত্যি! শুধু বললেন, 

- তোর ধারণা ভুল।... আমি ঠিকই এ শহর পুরোটাই আমার নখদর্পণে.. শুধু বেরোই না তাই... 

- বলেছে!.. তুমি বাসা থেকে বেরোও না হারিয়ে যাবার ভয়ে!... মনে নেই, গত বছর রেলস্টেশন থেকে এ পর্যন্ত আসতেই হারিয়ে গেলে? মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, গরু খোঁজা খুঁজেছি তোমায়... 

- আহ্ হা। সেটা তো একটা মিসটেক! মাঝে মাঝে তুই ভুল করিস না? বাড়ি না এসে রাস্তা পেরিয়ে চলে যাস না? 

- সব ভুল এক না, মামু! আমি তোমাকে বলছি প্রথমে এ শহরটা আগে ভালো করে চিনে নাও তারপর অন্যটা ভেব.. দরকার হয় একা না যাও, কাউকে সাথে নিয়ে নাও... 

- কে যাবে? তুই? 

- আমার অতো সময় নেই! 

- তাহলে? 

এবারে কি যেন ভাবলো অনন্যা। কিছুক্ষণ পর বললো, 

- ধ্রুবের সাথে বেরোলেই তো পার! ও ছেলে তো একা একা হেঁটে বেড়ায়। 

- কোন ধ্রুব? 

ভ্রূকুটি করলেন মামা। 

- আরে আমাদের বাড়ির দুটো বাড়ি সামনেই যে বাড়িটা! ছয় তলা বিল্ডিং। ওটাতে থাকে... 

- ও, ওই পাঞ্জাবিওয়ালা? কাঁধে সারাক্ষণ মান্ধাত্তা-আমলের পাটের ব্যাগ? ওই ছোকরা? 

- এমন করে বলছো কেন, মামু? ছেলেটা তো ভালোই!.. 

- বলেছে তোকে!.. কাম নেই, কাজ নেই সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো।.. আমার কী মনে হয় জানিস? এই ছেলে আসলে সারাদিন লেডিস কলেজ, হোস্টেলের সামনে ঘুরে বেড়ায়। সিনেমা হলে যায়। সব মেয়ে দেখার ধান্ধা! ওই সব ফালতু ছেলের সাথে আমাকে যেতে বলিস তুই? 

- মামা, না বলে কথা বলবে না একদম!.. তুমি তো বাসা থেকেই বেরোও না। ওর সম্পর্কে তুমি জানবে কি করে? 

- জানি, জানি। আমি সব জানি! ওসব ফালতু ছেলেরা.... 

- কচু জানো! 

মামার কথা শেষ করার আগেই ঘর থেকে বেরিয়ে যায় অনন্যা। রাগে তার গা জ্বলে যাচ্ছে। তার সামনে ধ্রুবকে নিয়ে কেউ উলটো পাল্টা কিছু বলবে এটা সে একদম মেনে নিবে না। কিছুতেই না। ওর চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। সাথে মামার প্রতি প্রচণ্ড অভিমান কাজ করছে! মামা এভাবে বলতে পারলো? ধ্রুবকে সে ভালোবাসে এটা না হয় নাই জানুক, তাই বলে ওকে নিয়ে এভাবে বলবে? 
.
.
.
চলবে...........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন