রোদরঞ্জন - পর্ব ৩৫ - আশফি শেহরীন চিত্রা - ধারাবাহিক গল্প


অসময়ে বৃষ্টি নামাটা ইনান সবসময় পছন্দ করলেও আজকে ভালো লাগছে না। খুব দরকারে শহরে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি তাকে আটকে দিলো। শীত প্রায় শেষ হবে হবে ভাব। হয়তো শীতের শেষটা জানান দিতেই বর্ষার আগমন। ইনান হতাশ শ্বাস ফেলে রুমের দিকে পা বাড়ায়। কারেন্ট নেই। বিকেল হলেও ঢালা বৃষ্টির কারণে মনে হয় এখন মাঝরাত। 

মোম হাতে রুমে ঢুকে দেখল জেহফিল অন্ধকারে টুলে বসে হাতে কিছু একটা নিয়ে গভীর মনোযোগে কিছু একটা দেখছে। ইনান এগিয়ে যায় কাছে। জেহফিলের ঘাড় অবধি সিল্কি চুলগুলো বাহির থেকে আসা হিমশীতল বাতাসে কপালে এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে, ঠোঁট হালকা চেপে মনোযোগী চাহনিতে হাতের দিকে তাকিয়ে আছে, বিজলি চমকানো আলোয় দেখার চেষ্টা করছে কিছু একটা। ইনানের মন চাইল সারাজীবন যদি জেহফিলকে এভাবে তাকিয়ে দেখা যেত। জেহফিলের অতুলনীয় সৌন্দর্য এত মনকাড়া, যে ইনানের মাঝে মাঝে ভয় হয় জেহফিলকে বাইরে নিয়ে যেতে। যদিও সে জানে, জেহফিল তাকে ছাড়া কখনো দ্বিতীয় নারীর দিকে চোখ তুলে চাইবে না, কিন্তু অন্যান্য নারী তো ঠিকই তাকাবে। নিজের এমন অচিন্তনীয় ভাবনায় নিজেই চমকালো ইনান। সে কবে থেকে জেহফিলের মতো এত পজেসিভ হওয়া শুরু করেছে? এত জ্বেলাস হলো কবে থেকে? সে তো দেখছি এখন জেহফিলের ফিমেল ভার্সন হওয়া শুরু করে দিয়েছে!! 

ইনান মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করল তার এই আজগুবি ভাবনা। মোম হাতে জেহফিলের কাছে গিয়ে হালকা কেশে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করল।

হাত থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পাশে দাঁড়ানো ইনানের দিকে তাকালো জেহফিল। ইনানকে দেখে স্নিগ্ধ হাসলো জেহফিল।

বিনিময়ে হাসি প্রদান করে ইনান বলল, ‘কী করছেন?’

হাতে থাকা মোমবাতি জেহফিলের হাতের কাছে নিয়ে দেখল একটা চিকন তুলি। ইনান ভ্রু কুঁচকে বলল, 

‘স্পেশাল কিছু আছে নাকি তুলিতে?’

‘অভিশাপ।’ শীতল গলায় বলল জেহফিল। তুলির দিকে নজর নিবদ্ধ।

‘বুঝলাম না?’

দীর্ঘ সময় নিয়ে শ্বাস টেনে সটান হয়ে বসল জেহফিল। চোখের চশমাটা টেবিলের উপর রেখে একহাতে ইনানের কোমর জড়িয়ে তার বুকে মাথা রাখল। কম্পিত ইনান জেহফিলের চুলগুলো এলোমেলো করে দিতে লাগল। 

‘মনে আছে বাটারফ্লাই…’

থামল জেহফিল। ইনানের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে চিবুক ইনানের বুকে ঠেকিয়ে চোখে চোখ রাখল জেহফিল। এই মুহূর্তে জেহফিলকে কতটা আদুরে দেখাচ্ছিল ইনান যদি বর্ণনা করতে পারতো! ক্যামেরা সাথে থাকলে সঙ্গে সঙ্গেই ক্যাপচার করে নিতো দৃশ্যটা। 

‘আমি তোমাকে একটা শাস্তি দিয়েছিলাম।’

সম্বিৎ ফিরল ইনানের, ‘কী শাস্তি?’

‘রক্ত দিয়ে আমার নাম লেখতে বাধ্য করেছিলাম তোমাকে।’

ইনানের মনে পড়ল সেই নিকৃষ্ট দিনের কথা। গা কেঁপে উঠল তার। শুকনো ঢোঁক গিলে বলল,

‘এখন এসব কথা কেন? বাদ দিন না!’

জেহফিল ইনানের বুকে মুখ গুঁজল,

‘আ’ম সরি বাটারফ্লাই, রিয়েলি রিয়েলি সরি। আমার…আমার এসব করা উচিত হয়নি…প্লিজ, মাফ করে দাও সোনা, প্লিজ পাখি…’

জেহফিলের কথা শ্রবণমাত্রই হতভম্ব হয়ে যায় ইনান। জেহফিল যে এসবের জন্য সরি বলবে সে কল্পনাতেও আনেনি। সত্যিই, সে কখনো জেহফিলের থেকে সরি আশা করেনি। জেহফিল সরি না বললে সে বুঝতেও পারত না যে মনের এক কোণে ঠিকই চাইছিল জেহফিল যাতে অনুতপ্ত হয়। বিয়ের আগে নিজের ভবিষ্যৎ পার্টনারকে নিয়ে যেসব আশা করতো তা যেন এই মুহূর্তে জেহফিলই পূরণ করছে। তার কল্প পুরুষের মতো হয়ে উঠছে জেহফিল, ধীরে ধীরে।

পরিতৃপ্ত মনে ইনান জেহফিলের কপালে ছোট্ট করে চুমু খেল, 

‘আপনি যে অনুতপ্ত তাতেই আমি খুশি জেহফিল। এতবার সরি বলতে হবে না।’

জেহফিল হাতের তুলিটাকে দুমড়েমুচড়ে চুরমার করে দিলো। এই তুলি দিয়ে সে বাটারফ্লাইকে কষ্ট দিয়েছিল…

বৃষ্টির তোড়ে ইনানের ঠিকই নজরে আসলো ঐ পাশের বাড়ির বারান্দা থেকে তাকিয়ে থাকা সেই অবয়বটাকে। 

ইনান বাঁকা চোখে চেয়ে রইল সেদিকে। তার মুখাবয়ব কঠোর। ঐ পাশের মানুষটির কোনো হেলদোল দেখা দিলো না তাতে। সে অদ্ভুত চোখে ইনানের দিকে চেয়ে রইল, কেমন যেন সেই অদ্ভুত দৃষ্টি! চাহনিটা ইনানের ভালো লাগলো না, গা ছমছম করে উঠল তার। সে দ্রুত বারান্দা আর রুমের মাঝের পর্দাটা টেনে দিলো। এতে অপরপক্ষ অপমানবোধ করলে করুন গে…

.

.

রাত আটটা। জেহফিলকে রেখে ইনান নিচে এসে অপেক্ষা করছিল তার বাবার জন্য। গেটের কাছে ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে আছে সে। বাবার চলে আসার কথা এক্ষুনি। ছাতার মাথাটা ফ্লোরের সাথে ঠকঠক করে আওয়াজ তুলে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইনান, হাতে ফ্ল্যাশ লাইট। তার বাবা সপ্তাহে কমপক্ষে তিন চারদিন এসে দেখা করে তার সাথে। কখনো তার পছন্দের খাবার নিয়ে আসে, কখনো সাথে পরিচিত এক ডাক্তার আঙ্কেলকে নিয়ে এসে চেকাপ করায়। ইনানের বাবা কোনো কমতিই রাখতে চান না তার মেয়ের জীবনে।

বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগছে ইনানের গায়ে। শীত লাগছে অনেক। জ্যাকেট টেনে আরো ভালো করে পরে নিলো।আকাশ পাতাল এক করে দেয়ার মতো ঝড় বইছে। ইনান দোয়া করছে বাবা যাতে এই ঝড়ে না আসে। রাস্তাঘাট ভালো না। কখন কী হয়! ইনানের ভাবনাকে প্রমাণ করে দিয়ে তার সেল ফোন বেজে উঠল ক্রিং ক্রিং শব্দে। 

‘সরি আম্মু, আজকে আসতে পারছি না। মন খারাপ করিও না কেমন?’

‘সমস্যা নেই বাবা। এই ঝড়ে আসার দরকার নেই। অবস্থা ভালো না।’

বাবার সাথে কথা বলে ইনান ভেতরে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। ঠিক সেই সময়ে পুরুষালী গম্ভীর কণ্ঠের আওয়াজ শুনতে পায় সে,

‘কেমন আছো ইনান?’

তড়িৎ পেছনে ফিরে সে। এই নির্জন জায়গায় সে সে আর জেহফিল ছাড়াও যে অন্য একজন থাকে, তাই বুঝতে অসুবিধা হলো না কে সে।

মোবাইলের ফ্ল্যাশ সরাসরি ছাতা মাথায় ধরে থাকা ব্যক্তির দিকে তাক করলো। লোকটি হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে নিলো আচানক আলো চোখে লাগায়। তার পরনে কালো রঙের গলা ঢাকা লং কোট, চুলগুলো হালকা ভেজা। গালে সেই টোল পড়া হাসি। 

ইনান মোবাইলটা সাইডে সরিয়ে নিয়ে বললো,

‘কী চাই?’

‘চিনেছো আমাকে?’ 

‘না চেনার কিছু নেই মিঃ তাজবীর।’

‘বাহ! নামটাও মনে আছে দেখছি! তা কেমন আছো?’

‘আপনি আমার ফ্রেন্ড? আপনাকে আমি ভালো করে চিনি?’ ইনানের দায়সারা কণ্ঠ।

‘সরি?’

‘যা বলছি তার উত্তর দিন।’

‘ওয়েল, নাহ, চিনো না।’ 

‘তাহলে কোন সাহসে আপনি আমাকে তুমি তুমি করে বলছেন?’

তাজবীর হাসলো। বৃষ্টির তোড় বাড়ছে। সে কয়েক পা এগিয়ে এসে বলল,

‘প্রথম আসলাম। ভেতরে আসার জন্য বলবে না? এভাবে গেস্টকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখছো বৃষ্টি দিয়ে, এই তোমার ম্যানার?’ কপট বিরক্তি সুরে বলল তাজবীর। যেন তাকে দাঁড় করিয়ে ইনান অনেক বড় অভদ্রতামি করেছে।

ইনান গেটের কাছে হাত পা ছড়িয়ে দাঁড়ালো এবার। যেন সে তাজবীরকে ভেতরে না ঢোকানোর পণ নিয়েছে। 

তাজবীর উচ্চশব্দে হেসে ফেলল ইনানের কাণ্ড দেখে। বৃষ্টির পানিতে আছড়ে আছড়ে পা ফেলে ইনানের কাঁধে কাঁধ দিয়ে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল তাজবীর। তার এহেন দুঃসাহসিকতায় ইনানের মুখ হা হয়ে গেল।

‘উফফ, ভিজে গেলাম, ভেতরে ঢুকে চা খাওয়ার জন্য বলবে না?’

‘আশ্চর্য মানুষ আপনি!’

‘আই নো।’ বুক ফুলিয়ে বলল তাজবীর।

‘কী চাই সেটা বলেন।’

‘উপরে যাই চলো।’ তাজবীর সিঁড়িতে পা দেওয়া মাত্রই ইনান তার শার্ট টেনে আগের জায়গায় নিয়ে আসলো।

‘প্রবলেমটা কী আপনার? এত সেধে সেধে কথা বলতে আসার মানেটা কী?’

‘আমার প্রবলেম এই যে…’ কথায় বিরতি দিয়ে হঠাৎ বলল, ‘ আমার প্রবলেমটা পরে বলছি। আগে বলো তোমার মাথার কী স্ক্রু ঢিলা?’ তার কণ্ঠে কৌতুক।

‘কীহহ!’ তাজবীরের কথার আগামাথা বোধগম্য হলো না ইনানের। রাগ বেড়ে যাচ্ছে তার।

‘ওকে বাদ দাও, তোমার মানসিক সমস্যা জানা আমার জন্য এক সেকেন্ডের ব্যাপার। তোমারটা বাদ দেই। আমার প্রবলেমটা বলি।’ 

বলে সিরিয়াস ভঙ্গিতে ইনানের চোখের দিকে তাকালো সে, ‘প্রবলেমটা হচ্ছে, জেহফিলের সাথে তোমাকে দেখতে পারছি না আমি।’

‘আজব! দেখতে বলেছে কে আপনাকে? চোখ বন্ধ করে থাকেন, তাহলেই তো হয়!’ 

‘পারবো না, সিরিয়াসলি ইনান। তোমাকে একটা কথা বলি। জেহফিল ভালো ছেলে নয়। ওর..ওর মাথায় না, কোনো প্রবলেম আছে আই গেস। সিরিয়াস মেন্টাল প্রবলেম। ওর থেকে যত দূরে থাকবে ততই তোমার জন্য মঙ্গল।’

***

‘আপনার সাথে জেহফিলের কী শত্রুতা?’

তাজবীর জবাব দেয়, ‘কী শত্রুতা আবার? আমি ভালো মানুষ ভাই, কারো সাথে সাপে নেউলে সম্পর্ক নেই আমার।’

‘নইলে জেহফিলের সম্পর্কে বাজে কথা বলছেন কেন?’

হতাশ শ্বাস ফেলে বাইরে তাকায় তাজবীর। ঝুমঝুম শব্দে ধরণীর বুকে বৃষ্টি আছড়ে পড়ছে। ইনানদের দোতলার বাসা অন্ধকার। কারেন্ট চলে গেছে। ক্ষণে ক্ষণে বিজলি চমকানোর আলোতে রাস্তার ধারের জঙ্গল গুলোকে দানবদের বাসস্থানের মতো দেখায়, দেখলেই গা ছমছম করে। যেন এক্ষুনি ভয়ানক আকৃতির বিদঘুটে দানব এসে খুবলে খাবে। এরকম একটা ভয়ানক জায়গায় জেহফিল একা কীভাবে থাকতো? ভয় লাগতো না? আশেপাশে কোনো পাড়া প্রতিবেশীও নেই। ম’রে পড়ে থাকলেও তো কেউ জানবে না। এখন এই মেয়েটাও কীভাবে পারে থাকতে!!‌ এদের কি একটুও ডরভয় নেই??

‘লিসেন ইনান। তোমার লাইফে ইন্টারফেয়ার কোনো ইচ্ছা আমার ছিলো না, আর নেইও। কিন্তু পরিস্থিতি এমন যে আমার না চাইতেও তোমার উপর পাহারাদারি করতে হচ্ছে।’

‘পাহারাদারি?’ কিছুটা বিস্মিত হলেও কণ্ঠে প্রকাশ করল না ইনান, ‘তা জেহফিল কি আপনাকে আমার পাহারাদার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে নাকি?'

'আশ্চর্য! তুমি কীভাবে জানলে?' অবাক হওয়ার ভান ধরল তাজবীর। মুখ চেপে হাসছে সে।

ইনান চোখ উল্টিয়ে বলল, 'ওহ ওয়েট, জেহফিল কেন দিবে, আপনারা কেউ কাউকে তো দেখতেই পারেন না। তাহলে আপনি কার কথায় আমার উপর নজর রাখছেন?’ হাত বুকের কাছে নিয়ে ভাঁজ করে বলল সে‌। 

রহস্য নিয়ে হাসলো তাজবীর। ইনানের কাছে এক পা এগিয়ে আসে, পিছু হটে ইনান। তার এখানে দাঁড়াতে ইচ্ছা করছে না আর। এমনিতেই গত কাল এই ছেলের চাহনি তার ভালো লাগেনি, তার উপর এখন অদ্ভুত ধরনের কথা। তাজবীর হাঁটুতে হাত রেখে ইনানের মুখ বরাবর ঝুঁকল, মেয়েটা এতো ছোটো! 

‘এই, দূরে। দূরে যান, দূরে যেতে বলেছি। খ্যাক করে উঠে ইনান। বুকে সাহস জোগাড় করার চেষ্টা করতে লাগল সে। ভয় পাবে না, কিছুতেই না।

কিছুটা বিরক্ত হয় তাজবীর,

‘তুমি নিজেকে কী ভাবো বলো তো?’

‘পরী।’

‘আজব একটা মেয়ে!’ বিড়বিড় করে বলে সোজা হয়ে দাঁড়ায় সে, ‘যাইহোক। এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই ইনান। আমি তোমার ক্ষতি করবো না। বিনা বেতনের কামলা খাটতে আসছি। তা-ই খেটে চলে যাব সময় আসলে। সুতরাং আজাইরা ভয় পাওয়ার নাটক করবা না আমার সামনে।’

অপমানিত বোধ করল ইনান, ‘নাটক করলাম কখন? অচেনা মানুষ এমন অদ্ভুত বিহেভ করলে যে কারোরই ভয় লাগবে।’

‘আর একটা অচেনা মানুষের কাছে নিজেকে যে স্বেচ্ছায় সারাজীবনের জন্য বিলিয়ে দিলে তাতে ভয় লাগল না?’

‘জেহফিল অচেনা নয়। ওনার সম্পর্কে সবই জানি আমি।’

‘শুধু পারিবারিক, আর্থিক অবস্থা জানলেই চলে না। একটা মানুষের সাথে সারা জীবন কাটাবে আর তার সম্পর্কে ভালো মতো না জেনেই বিয়ে বসবে?’

ইনান ধারণা করল, তাজবীর জানে না যে সে কী অবস্থায় বিয়ে করেছে। মেবি তাজবীর মনে করেছে ইনান পারিবারিকভাবে জেহফিলকে বিয়ে করেছে। যদি জানতো তাহলে এই কথা বলতো না। তাও সে বলল,
‘কী জানার কথা বলছেন বলেন তো?’

‘জেহফিল তোমার সাথে যেই বিহেভ করে, মানে যেমনটা একাডেমিতে দেখলাম, তার সম্পূর্ণ বিপরীত সে। ও অ্যাগ্রেসিভ। লাইক, নিজের পছন্দ মতো কোনো জিনিস না হলে ও খুব হিংস্র হয়ে যায়, আমার অনেকগুলো স্কাল্পচার ভেঙেছে ও, সামান্য ত্রুটি থাকলেও। স্যার বলে কিছু বলতে পারি না। আর ওকে দেখে যা মনে হয়, ওর আর কোনো হিংস্র জন্তুর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।’

‘জানি।’ নির্বিকার জবাব।

‘জানো!’ যেন আকাশ থেকে পড়ল তাজবীর, ‘জেনেবুঝেও কীভাবে ওর মতো একটা মানুষকে বিয়ে করলে।’

‘শুনেন ভাই, কীভাবে বিয়ে হয়েছে না হয়েছে, সেটা বড় কথা না। বড় কথা হচ্ছে আমাদের অলরেডি বিয়ে হয়ে গেছে। যা হয়েছে তা আপনি কিংবা আমি তো আর চেঞ্জ করতে পারবেন না, তাই না? সো ওসব নিয়ে কথা বলারও কোনো দরকার নেই। জেহফিল হিংস্র পশু তা প্রথম থেকেই জানি, তাও আমি তাকে ভালোবাসি। আপনার বলা না বলায় কিচ্ছু যায় আসবে না। তাই বলছি, এসব আবোলতাবোল না বকে ভাগেন, ফুটেন এখান থেকে। এমনিতেই অনেক টাইম নষ্ট করেছেন আমার। আর না। জেহফিল অপেক্ষা করছে।’

ইনান ছাতার মাথা দিয়ে তাজবীরের পেটে ঠেলতে ঠেলতে তাকে গেটের বাইরে বের করে দিলো। তাজবীর দ্রুত ইনানের ছাতাটা কেড়ে নিয়ে মেলে ধরল। এই মেয়ে এত নিষ্ঠুর। সে আরো অনেক কিছুই বলতো। তার মনে অনেক খটকা আছে ইনানকে দেখে। কিন্তু এই বৃষ্টির মাঝে আর থাকাটা সম্ভব না। বাতাসে ছাতা ভেঙে যাওয়ার যোগাড়।

ইনানকে উদ্দেশ্য করে শেষ কথা বলল,

'ইউ গাইজ আর সিক, রিয়েলি ভেরী সিক। তুমিও কম না, মানসিক সমস্যা আছে তোমার। সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাও। ঠিক হয়ে যাবে।'

সে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। তখনই পিছন থেকে ইনানের ডাক শোনা গেল।

‘ওয়েট, বললেন না তো কে আপনাকে বিনা বেতনে হায়ার করেছে আমাকে পাহাড়া দেয়ার জন্য?’

তাজবীর পেছনে না ঘুরে শুধু মাথাটা ঘুরিয়ে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলল,

‘আছে একজন। একটা হিন্ট দেই। তাকে কিন্তু তুমি চিনো।'

এই বলে দাঁড়ালো না। গটগট পায়ে বিজলির আলোয় হেঁটে চলে গেল। 

ইনান যেন বাঁচল। কারেন্ট চলে যাওয়ায় মোবাইলের লাইট অন করে উপরের সিঁড়িতে পা বাড়াতেই কেউ একজন তার কোমর শক্ত করে চেপে ধরে মুখ চেপে ধরল। 

অতর্কিত আক্রমণে ইনানের হাত থেকে মোবাইল পড়ে যায়। আগন্তুক তাকে টেনে হিঁচড়ে নিচ তলার গোডাউনে নিয়ে গিয়ে নোংড়া মেঝেতে আছড়ে ফেলে দেয়‌। ইনান চিৎকারের সুযোগটুকুও পায় না, তার আগেই আগন্তুক চেপে বসে ইনানের পেটের উপর। এক হাতে ইনানের হাতদুটো ধরে আরেক হাতে ইনানের পরনের টপ ছিঁড়তে শুরু করে। মুখ ছাড়া পেয়ে ইনান আকাশ পাতাল কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠে, কিন্তু হায়! গগণ কাঁপানো বজ্রপাতের আড়ালে তার চিৎকার চাপা পড়ে যায়। যেন আকাশটাও ইনানকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ইনানের চিৎকারের সাথে পাঞ্জা লড়ছে।

সেই মুহূর্তে গোডাউনের ভাঙা জানালা দিয়ে বিজলির আলোয় হামলাকারীর মুখ দেখতে পায় ইনান। আত্মা কেঁপে উঠে তার। শরৎ! তার ফ্রেন্ডদের একজন।

ইনান জেহফিলের নাম ধরে জোরে জোরে চিৎকার করে ডাকে। শরৎএর থাবার মধ্য থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য মোচড়ামুচড়ি শুরু করে দেয়। ইনানের বৃথা চেষ্টা দেখে শরৎ কুৎসিত হাসলো।

‘অনেক দিন পর পাইছি তোরে মা*। এত সহজে ছাইড়া দিমু ভাবছোস? তোর কোন নাগররে ডাকবি ডাক, দেখি আসে কিনা। শুয়োরের বাচ্চা, কম জ্বালাস না আমারে। তোর বাপ আর তুই আমার জীবনটারে নরক বানায় ফেলছোস। আজকে সব শোধ তুলমু। এমন অবস্থা করমু না, তোর অবস্থা দেইখা তোর বাপ ফাঁ’সি দিবো মিলায় নিস‌।’

শরৎতের চোখ চকচক করছে, জিভ দিয়ে এমন আওয়াজ করছে যেন কোনো সুস্বাদু খাবার তার সামনে। ভয়ে ইনানের চেহেরার রং সরে গেল। চিৎকার চেঁচামেচি করলে কেউ তো আসবেই না বরং তার শক্তি লস হবে। শরৎতের লালসার শিকার থেকে বাঁচতে শেষবারের মতো বলল,

‘শরৎ, ভাই আমার প্লিজ, মাফ করে দে আমাকে। তোর পায়ে পড়ি দোস্ত, প্লিজ কিছু করিস না।’ ইনান আকুতি মিনতি করে বলল। 

শরৎ অট্টহাস্যে ফেটে পড়ল, যেন ইনান কোনো মজার জোকস বলেছে, ‘ওরে শালি, এখন বিপদে পইড়া তোর ভাই, দোস্ত হইয়া গেলাম!’ ইনানের গাল চেপে ধরল দুই আঙ্গুলে, ‘কিন্তু এখন তো আমি ভাইয়ের মতো কোনো কাজ করতাম না ইনান সোনা, এখন করব তোমার হাজব্যান্ডের মতো কাজ।’

ইনানের গালে হাত বুলিয়ে বলল। গা যেন ঘিনঘিন করে উঠল ইনানের। শরৎ ইনানের থেকে হাত সরিয়ে তার শার্ট খুলে ফেলল। ইনানের টপের বুকের অগ্রভাগ টেনে ছিঁড়ে ফেলল সহসা। বক্ষবন্ধনী স্পষ্ট দেখা গেল তার। ইনান ডুকরে কেঁদে উঠল। জেহফিল ছাড়া অন্য পুরুষের ছোঁয়া তার শরীর স্পর্শ করবে ভাবতেই গা গুলিয়ে গেল। শরৎ তার মোবাইলের ফ্ল্যাশ অন করে ইনানের বুকের সামনে ধরল, ঠোঁট দিয়ে জিভ ভিজিয়ে লোভাতুর চাহনি মেলে ধরল ইনানের বক্ষভাঁজে।

ইনান ক্রন্দনরত গলায় একাধারে মিনতি করেই যাচ্ছে। এর চেয়ে ম’রে যাওয়াই ভালো আছে। 

‘নাহ, এমনে মজা পাইতেছি না। ভালো কইরা দেখতে হইব।’

এই বলে ইনানের ইনার খোলার জন্য কাঁধে হাত দিতেই শরৎ তার মাথায়। উহ্ শব্দ তুলে মাথার পেছনে চেপে ধরল সে। ফ্ল্যাশ অফ হয়ে গেছে‌। সেই সময় পেছন থেকে কেউ একজন শরৎএর চুলের গোড়া মুঠোয় বন্দী করে তাকে উপড়ে ফেলল ইনানের উপর থেকে। শরৎ কুঁকড়ে গেল ব্যথায়। মাথায় হাত দিয়ে দেখল তার চেপে ধরা চুলগুলো নেই, তার জায়গায় লাল রঙের তরল গড়িয়ে পড়ছে।

'কোন কুত্তা'র বাচ্চা...' তার গলার স্বর চাপা পড়ে গেল লোকটি যখন পা দিয়ে তার গলা চেপে ধরল শক্ত করে। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে লাগল তার। হাঁপরের মতো হাঁসফাঁস করতে লাগল সে। বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় আবছা চোখে চেয়ে দেখল তার যমদূতকে...
.
.
.
চলবে…........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন