উন্মুক্ত লাইব্রেরী - পর্ব ৩০ - আয্যাহ সূচনা - ধারাবাহিক গল্প


উন্মুক্ত লাইব্রেরী
পর্ব ৩০
আয্যাহ সূচনা



সময় মানুষ বদলায়,বদলায় আত্মার বর্ণ।ছন্নছাড়া ছেলেটি আজ মনোযোগে গঠন।পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা পাঠ করে সে নিঃশব্দে।আগ্রহে চরম।যেনো যেনো নতুন জগতে ভাসমান।বইয়ের পৃষ্ঠাগুলি চোখের কাছে তুলে ধরে রাখে।অন্ধকারের মাঝেও আলো খোঁজে প্রতিনিয়ত।কঠিন শব্দের ভাঁজে নতুন কিছু খোঁজে।কালো অক্ষরে লেখা প্রতিটি অক্ষর তার প্রিয় হয়ে উঠেছে।

“মশাই আমাকে হলুদের কৌটা দেওয়া যাবে?”

মেয়েলি কন্ঠ কর্নে এলো।তবে মস্তিষ্কে ঢুকলো না।বর্ণ এখন জ্ঞানের সঞ্চয়কূপ।ছন্নছাড়া থেকে নব্য গঠন। প্রাথমিক সমাজ বিজ্ঞানের বই মুখের কাছে নিয়ে বিছানায় বসে ছিলো। অন্বেষার কথার বিপরীতে অস্ফুট স্বরে বললো,

“হুম?.... হুউউউউম”

অন্বেষা গলা উঁচু করে বলে, “কি হুউউউউম?হলুদের কৌটা এগিয়ে দাও।রান্নায় দেরি হচ্ছে।”

বর্ণ অমনোযোগী ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ায়।বইয়ে মুখ গুঁজে হাঁটতে লাগলো তাকের দিকে।হাতড়ে হাতড়ে বোয়াম খুঁজছে।তবে দৃষ্টি সেখানে নেই। অন্বেষা নীরবে দেখছে তার কার্যকলাপ।হুট করে হাতে একটি বোয়াম তুলে নিয়ে অন্বেষার দিকে এগিয়ে দিলো।

বললো,

“উমমম…লও।”

অন্বেষা চেয়ে রইলো বর্ণের হাতের বোয়ামের দিকে।নিলো না।বর্ণ বিরক্ত হয়।বলে,

“লও না মিয়া”

অবশেষে অন্বেষা বোয়াম বর্ণের হাত থেকে নিয়ে জবাব বললো,

“আজ হলুদের পরিবর্তে চিনি দিয়ে তরকারি রান্না হবে।কি ভয়ানক মজার ব্যাপার।….যাক বাবা নতুন টেস্ট পাবো।”

কলম কামড়ে বর্ণ অপরিষ্কার স্বরে জবাব দেয়,

“হুম ভালো হইবো…”

অন্বেষা তড়াক করে উঠে দাঁড়ায়।ধ্যান হারিয়ে থাকা বর্ণকে টপকে নিজেই তাক থেকে হলুদের কৌটা নিয়ে আসে। তরকারিতে অল্প আঁচে বসিয়ে আবারো উঠে দাঁড়ালো।বর্ণের হাত থেকে বই কেড়ে নেয় তৎক্ষনাৎ। ক্ষুধার্ত বাঘের মত কলমটা চিবিয়ে খাচ্ছে।সেটিও অন্যহাতে সরিয়ে নিলো।

কপট তেরছা সুরে বললো,

“বর্ণ চন্দ্রবিদ্যাসাগর আপনি এবার থামুন।এমন চলতে থাকলে সংসার আর বউ দুটোই বানের জলে ভেসে যাবে।”

এবারে হুশ ফিরে বর্ণের।চরম বিরক্ত বই কেড়ে নেওয়ায়।সাথে কলমটাও।যেনো সবকিছু লুট করেছে কেউ তার।জবাব দিলো,

“তোমারে লইয়া আমার এমনেও মাথা ব্যাথা নাই।আপন সুখে ভাইসা যাইতে পারো।”

“ওহ তাই না? জ্ঞানের আলো ফুটার আগেই বউকে টাটা বায় বায়? নাহ!তোমাকে পড়ালেখা করানো যাবে না।”

“নিজের গর্ত নিজে খুঁড়ছো”

অন্বেষা বুঝতে পারছে না কি করবে?বর্ণকে পড়ালেখার দিকে আগ্রহী দেখে খুশি হবে নাকি অতি আগ্রহী বর্ণকে দেখে কপাল চাপড়াবে?বই নিজের কাছেই রেখে বসে পড়লো রান্না করতে।বললো,

“সব দোষ আমারই”

বর্ণও অন্বেষার পাশে বসে একটি বিস্কিটের প্যাকেট নিয়ে।হালকা পাতলা ভোজন করতে করতে বললো,

“পরশু ক্লাসে গেলাম না?ওদিকে একটা সুন্দরী ম্যাডাম দেখছি। পুরা মাক্ষনের মত।আমিতো এক দেহায় ফিট হইয়া গেলাম রে ছেমড়ি”

আচমকাই হাতে গরম অনুভব করে বর্ণ।সাথে অন্বেষার অগ্নিচক্ষু।হাতের দিকে চেয়ে দেখলো খুন্তির কিছুটা উপরের অংশ তার হাতে চেপে ধরেছে অন্বেষা।আঘাত করেছে সেটিও বুঝে শুনে।থমথমে গলায় বর্ণকে শাসিয়ে বলে উঠলো,

“আবার এসব বাজে কথা শুনলে হাত পোড়াতে দ্বিধাবোধ করবো না।”

বর্ণ আরো সুযোগ পেয়ে বসে।হাত এগিয়ে অন্বেষার মুখ টেনে আনে নিজের দিকে।ডান গালে শক্ত চুমু খেয়ে বললো,

“আদর তোমারে করতে চাই কিন্তু দিল ফাল পারে ওই ম্যাডামের লেইগা।কি করতাম?”

হাতের সাহায্যে নিজের গাল মুছতে মুছতে অন্বেষা চরম বিরক্তি আর হিংসা নিয়ে বললো,

“মনটা বের করে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়ে এসো।”

“এহনি যামু?”

অন্বেষা চোখ পাকিয়ে চেয়ে জবাব দিলো, “যাও!”

বর্ণ তোয়াক্কাহীন। আস্ত দুটো বিস্কিট মুখে পুরে বললো,

“থাক কালকেই যামুনে।ভালো মতো পানিতে ধুইয়া ভাসায় দিমু।”

তর্কে জড়ানো বেকার।বুদ্ধিমতী স্ত্রীর মতো চুপ করে গেলো।বর্ণ বাহানা খোঁজে তাকে জ্বালাতন করার।খুব আনন্দ পায় সেই কাজে।তার আনন্দ মাঝ পথে ধূলিসাৎ করে আবার আনন্দ পায় অন্বেষা।

বর্ণ বললো,

“কথা কও বউ।আমি কি ওই ম্যাডামরে বিয়ার প্রস্তাব দিমু?”

“দাও!তারপর তোমাকে গণধোলাই দেওয়ার ব্যবস্থা আমি করবো।”

বর্ণ হেসে ফেলে।রূপ বদল হয় তড়িৎ গতিতে।মাথায় হাত রাখলো পরম যত্নে।এক বুক ভরে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,

“এমনি থাইকো সবসময়।”

উজ্জ্বল দৃষ্টি ছুঁড়ে অন্বেষা জবাব দিলো,

“বর্ণের বহুরূপ।প্রতি রূপে আমার জীবনে আসা লোকটা সেরা।তুমিও সবসময় এমনি থেকো”

_______

“আমি ওই বর্ণরে সারাজীবন একটা কামের ছেড়া হিসাবেই দেখছি আমাগো বাড়িতে। ওরে ভাই বইলা দাম দিমু?অসম্ভব!”

মোটা ফ্রেমের কাঁচের চশমা মুছতে মুছতে হাত জোড়া থামে মোকলেস মাতবরের।আর কতই বা রাগ দেখাবেন?কত চেঁচামেচি করবেন তার এই সন্তানের সাথে?ক্লান্ত তিনি।

অনিমেষ চেয়ে বললেন, “মুখ দিয়া ভালা কথা বাইর না করবার পারলে খারাপ কথাও বাইর করবি না।দরকার পড়লে মুখে তালা মাইরা রাখ।”

বাবাকে তাচ্ছিল্য করে হাসলো জনি।বললো,

“আপনি এসব কথা কন?আপনের মুখে এসব মানায় না আব্বা।নিজে জুলুম করছেন।আবার নিজেই ভালো সাঁজেন।দুই মুইখা সাপ আপনে নিজে।”

মলিন মুখ রাগান্বিত হয়ে উঠে মোকলেস মাতবরের।ভারী গলায় বললেন,

“তুই আমারে কইবি আমি কেমন মানুষ?”

জনি যেনো নির্ভয়।সরাসরি বাবার সামনে এসে বসলো।উচ্ছন্নে গেছে বহু আগেই।বেয়াদবি তার চরম সীমায়।বললো,

“বর্ণ আমগো বাড়িতে একটা কামের পোলাই আছিলো।আমি,আম্মা, আপনে ওরে কামের পোলার মতই রাখছেন।খাওয়ার সময় খাওয়া দেন নাই।টাকা দেন নাই।আপনার থিকাই শিখছি।”

রুহ কেমন কেঁপে উঠে মোকলেস মাতবরের।তারপরও মানুষের মনের জেদ।জিততেই হবে যেকোনো রূপে। জনির কথার বিপরীতে বলে উঠলো,

“ওর পরীক্ষার আগে যে তুই ওর বই ছিঁড়া লাইতি?তোর মা ওরে খাওয়ন দিতে চাইতো না।আমি না।আমার ওরে শাস্তি দেওয়ার হইলে আমি ওর খাওয়া বন্ধ করতাম।”

জনি আবার হাসে।জবাব দেয়, “আপনারা কন না?বাপ মা থিকা পোলাপান শিখে।আমিও ছোটবেলা থিকা যা দেখছি যা হুনছি তাই করছি।”

“এতই যেহেতু বুঝোস তাইলে তো তোর ওর প্রতি মায়া হওয়ার কথা।জিদ কেন?”

“কারণ আপনার মনে ওর লেইগা এহনও মায়া। হাহ!প্রথম পোলা।প্রথম রক্ত! লুকায় ছাপায় রাখেন দরদ।ওয় ভুল করলে ওর ভুল আমার উপরে চাপান।এলাকার মাথারা জানে বর্ণ আপনার পোলা।এই কারণে কেউ সাহস পায় না ওরে কিছু কওয়ার।আমার উপরে থাকে ওয় সবসময়।আমি কেন ওর কাছে ঝুঁকমু?আমারও বরাবর হক! উল্টা আমার ওর চেয়ে বেশি ক্ষমতা।ওয় একটা বাটপার।ওর ত্যাজ্য করছেন আপনে।ওর এহনও এত কিয়ের দাপট?এই এলাকায় মোকলেস মাতবরের আসল পোলা জনির দাপট থাকবো।”

চোখ মুখ কঠিন রূপ ধারণ করেছে জনির।এক ঝাঁক আক্রোশ তার মধ্যে।কণ্ঠে চরম বিদ্বেষ। মোকলেস সাহেব কিছু সময় চেয়ে রইলেন এই অহংকারের অগ্নিমূর্তির দিকে।ঠান্ডা স্বরে প্রশ্ন করলেন,

“বর্ণ আমার নকল পোলা?”

জনি তৎক্ষনাৎ উত্তর দেয়, “বর্ণ বাতিল পোলা!”

“বর্ণ তোর আগে এই দুনিয়াতে আইছে।তোর মায়রে আমি লুকায় বিয়া করছি। কারো সম্মতি ছাড়া।কেউরে জানানি ছাড়া।তোর জন্মের খবর কেউ জানতো না।বর্ণের মায়রে আমি বিয়া করছি এলাকার মানুষরে জানাইয়া, খাওয়াইয়া।বর্ণের জন্মের সময় এলাকার একটা ফকিরও নাই যে মিষ্টি খাওয়া থিকা বাদ পড়ছে।”

জনি বাবার এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো শুনে চুপ হয়ে গেলো।একেবারেই নিস্তব্ধ।শুধু নিঃশ্বাস চলছে।এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে মোকলেস সাহেবের দিকে।

“বুঝছোস কি বুঝাইছি।”

সময় নিয়েছে জনি জবাব দেওয়ার জন্য।লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে।বলে উঠে,

“এই বুঝানের কোনো লাভ লোকসান আমি দেখতাছি না আব্বাজান।আমি দোষী হইলে আপনে পাপী।হিংসা আপনারা শিখাইছেন।জিদ আপনার।অহংকার আপনার।”

“আর তোর মায়ের?”

“আমার মায়ের দোষ!আপনার মত একটা ব্যাটার প্রেমে পইড়া বিয়া করছে।”

“আচ্ছা?তোর মা যে বর্ণরে খাওয়ার কষ্ট দিসে?মারছে?”

“আপন পেটের পোলা আপনাই হয়।এটা দুনিয়ার রীতি।পরের পোলা হয় বোঝা।আমার মায়ের দোষ থাকলেও নাই।”

মোকলেস মাতবরের শুষ্ক ঠোঁট ঘিরে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। মাথা দুলিয়ে বললেন,

“এই ঘর পাপীগো ঘর।পবিত্র আছিলো বর্ণের মা,আমার মা আর বর্ণ।আজকা আমার মা থাকলে তোর মা আর তুই এই বাড়ির ত্রিসীমানায় পাড়া দিতে পারতি না।”

জনি উঠে দাঁড়ায়।অহংকারে টইটুম্বুর হয়ে বললো,

“ভালা হইছে আপনার মা আর বর্ণের মা মইরা ভূত হইয়া গেছে।”

____

আফজাল মিয়ার কোমরে প্রচণ্ড ব্যথা।সাব্বিরকে পাঠিয়েছেন আফজাল মিয়ার স্ত্রী মালিশের জন্য তেল আনতে।সদর দরজায় হুট করে মোকলেস মাতবরকে দেখে কপাল কুঁচকে ফেললেন।

   মোকলেস মাতবর একটি অসস্তি নিয়েই এগিয়ে আসেন।হেসে সালাম দিলেন রোকেয়া বেগমকে,

“আসসালামু আলাইকুম আপা”

রোকেয়া বেগম কিছুটা বিস্মিত হয়ে জবাব দেন,

“ওয়ালাইকুম আসসালাম।”

“ভালো আছেন নিহি?”

“আমিতো ভালা আছি।আইজ আপনি হঠাত আমার আঙিনায়?”

সরাসরি এমন প্রশ্নে বিব্রত বোধ করেন মোকলেস মাতবর।দৃষ্টি তুলে বাড়ির দিকে তাকালেন একবার।রোকেয়া বেগম তাকে দেখে আবার প্রশ্ন করেন,

“কি হইছে ভাইজান?কেউরে খুঁজেন?”

মোকলেস মাতবর আমতা আমতা করে প্রশ্ন করেন,

“আপা…বর্ণ কি বাইত আছে?”

রোকেয়া বেগমের কপালের ভাঁজ আরো দৃঢ় হয়।তিনি এবং আফজাল মিয়া সবটাই জানেন বর্ণ আর তার অতীতের ব্যাপারে।এলাকায় কিছুই তেমন লুকায়িত নয়।মৃদু কঠিন স্বরে বললেন,

“না কামে গেছে।…..আর থাকলেও…”

রোকেয়া বেগমকে থামিয়ে মোকলেস সাহেব প্রশ্ন করেন,

“ওর বউ আছেনি?”

অন্বেষা বারান্দায় কাপড় শুকাতে দিচ্ছে।নিচে চোখ যেতেই মোকলেস সাহেবকে চিনতে এক বিন্দু ভুল করেনি।অবাক হলো তাকে দেখে।সে এখানে কি করছে সেই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।কাপড় দড়িতে টানাতে শুরু করলো দ্রুত হাতে।উদ্দেশ্য নিচে যাবে।

  অন্যদিকে রোকেয়া বেগম বললেন,

“আছে”

খানিক রূঢ় কণ্ঠে মোকলেস সাহেবের উদ্দেশ্যে রোকেয়া বেগম বললেন,

“দেহা করন যাইবো না।বর্ণ জানলে সমস্যা হইবো।বউয়ের কারো লগে দেহা করা নিষেধ।”

মোকলেস মাতবর ব্যাপারটি যদিও আগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন।তারপরও এসেছেন।সে নিজেও জানেন না কিসের টানে?আফজাল মিয়ার সাথে তার পরিচয় অনেকদিনেরই।দেখা সাক্ষাৎ হতো প্রতি জুম্মায়।কিন্তু বর্ণকে আশ্রয় দেওয়ার পর সেটিও কমে এসেছে।নীরব দূরত্ব হয়েছে আরো অনেকের সাথেই।চুপচাপ দাঁড়িয়ে মোকলেস সাহেব।হুট করে মেয়েলি কণ্ঠে কেউ এসে বললো,

“আসসালামু আলাইকুম।আপনি এখানে?”

মোকলেস সাহেব মুখ তুলে তাকান।মাথায় কাপড় টেনে দাঁড়িয়ে আছে অন্বেষা।নিচে নেমে এসেছে সে। রোকেয়া বেগম অন্বেষার উদ্দেশ্যে বললেন,

“এই বউ! ভরা সন্ধ্যায় বাইরে আইছো কেন?তোমার জামাই জানলে চেতবো।”

অন্বেষা ম্লান হেসে জবাব দেয়, “কোনো সমস্যা নেই চাচী।”

বলে মোকলেস সাহেবের দিকে চাইলেন।এতক্ষণ সুযোগ পাচ্ছিলেন না।অবশেষে সালামের জবাব নেন,

“ওয়ালাইকুম আসসালাম।আমি…. একটু কথা কইবার আইছিলাম আরকি।তোমার কি সময় হইবো?”

অন্বেষা চোখ নামিয়ে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে।জবাবে বলে,

“আসুন ঘরে আসুন।”

মোকলেস সাহেব একাধারে হাত নাড়িয়ে বারণ করার ভঙ্গিতে বলেন,

“না না।ঘরে আমু না।আমি এদিকেই ঠিক আছি।”

“আপনি মুরুব্বী।দরজায় দাঁড়িয়ে থাকবেন?খারাপ দেখায় সেটা।”

দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগে অন্বেষার আবদারে অবশেষে আসলেন ঘরে মোকলেস সাহেব।আজ অন্বেষা ছুটি নিয়েছিলো অফিস থেকে।এসাইনমেন্ট সাবমিট করতে হবে ইয়ার ফাইনাল এর আগে আগে।বর্ণ ফিরবে রাতে।

  মোকলেস সাহেব ঘরে এসেই আশপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলেন।পুরোনো ঘরটায় একটা শান্তি শান্তি ভাব।বর্ণের দুয়েকটা শার্ট ঝুলে আছে একদিকে।অন্যদিকে রান্নার সামগ্রী।চা করাই ছিলো। অন্বেষা দ্রুত এক কাপ এগিয়ে দিলো মোকলেস সাহেবের দিকে।তিনি বললেন,

“এত তামঝাম করার দরকার নাই।আমি কয়টা কথা কইয়া যামু গা”

অন্বেষা খাটের এক কোণে দাঁড়িয়ে স্মিত হেসে বললো,

“আমাদের ঘরে আপনি প্রথমবার এসেছেন।খালি মুখে কিভাবে ফিরিয়ে দেই?”

অন্বেষার হাসি নিষ্প্রাণ।বুঝতে অসুবিধে হলো না মোকলেস সাহেবের।প্রশ্ন করে বসলেন,

“তুমিতো মনে হয় সব জানো।তারপরও এতো সুন্দর ব্যবহার?”

“আমি একতরফা শুনেছি।তাই বিচার করছি না আপনাকে।”

মোকলেস সাহেব হাসলেন।চায়ের কাপ তুলে নিলেন।এক চুমুক দিয়ে বললেন,

“এক তরফা যাই হুনছো সত্যিই হুনছো।কোনো ভুল নাই।”

“হয়তো আপনাদের মধ্যকার অনেককিছুই আমার অজানা।”

মাথার টুপি খুলে হাতে নিলেন মোকলেস মাতবর।আরেক চুমুক দিলেন চায়ে।দুর্বল হচ্ছেন ধীরেধীরে। বয়সের সাথে সাথে মলিন হয়ে আসছে সবটাই।

“মাগো! ব্যাটালোকের শরীরে যতদিন শক্তি থাকে ততদিন তারা নিজেগো রাজা ভাবে।যা ইচ্ছা তাই কইরা যায়। মরার দিন ঘনায় আইলে নতুন, পুরান পাপের কথা মনে কইরা দুর্বল হইতে থাকে।আমিও হইছি। হইতাছি।এর লেইগাই আজকা এহানে আইলাম।”

অন্বেষা এর বিপরীতে কি জবাব দিবে বুঝে উঠতে পারলো না।মুখ অবয়ব প্রতিক্রিয়াহীন।নীরবতা কি বেয়াদবি হবে?কিন্তু কোনো উত্তরও যে খুঁজে পাচ্ছে না। মোকলেস সাহেব বলে উঠলেন,

“আমি জনিরে বিদেশ পাঠানের ব্যবস্থা প্রায় কইরা ফালাইছি।এতে কইরা ওয়ও মানুষ হইবো।তোমরাও শান্তিতে থাকবা।”

অন্বেষা সময় নিয়ে ধীরে জবাব দিলো,

“জ্বি তার ভবিষ্যতের জন্য ভালো হবে।”

আবার নীরবতায় ডুবে গেলেন মোকলেস সাহেব। ক্ষণে ক্ষণে কি যেনো ভাবেন।আবার কথা বলেন।আনমনে ঠান্ডা হচ্ছে চা।আধ পাকা চোখের পাঁপড়ি পিটপিট করছে।শুষ্ক ঠোঁট ভিজিয়ে বলে উঠেন,

“বাঁচা মরার কোনো ঠিক নাই।তাই তোমারে কয়টা সত্য কইবার আইছি।আমি জানি বর্ণরে আমি এগুলি কোনোদিন কইতে পারুম না।কেমনে কমু? আমারতো মুখ নাই।”

অন্বেষা স্বাভাবিক স্বরে বলে উঠলো,

“বাঁচা মরা খোদা তায়ালার হাতে।কিন্তু আপনি চাইলে মনের কথা বলে নিজেকে হালকা করতে পারেন।আমি শুনবো।আপনাকে বিচার করবো না।”

এক প্রকার স্বস্তি অনুভব করলেন মোকলেস মাতবর।বলতে লাগলেন,

“বর্ণের মায়রে অল্প বয়সে বিয়া করছিলাম। তহন বয়স ওর ষোলো।বর্ণের নানায় ভ্যান চালাইতো।মায়ের পছন্দে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়া করি।আমার চেয়ে বেশি আমার আম্মাজানে বর্ণের মা রত্নারে ভালোবাসতো।নিজের মাইয়ার মত।গরীব ঘরের মাইয়ার প্রতি আমার মায়ের অনেক টান আছিলো।কিন্তু আমি?সংসারে শান্তি পাইতাছিলাম না।আমার এক বন্ধু পরিচয় করায় দিছিলো জনির মার লগে।পরিচয়ের এক বছরে গোপনে বিয়া করছিলাম জনির মায়রে। তহন বর্ণের বয়স চাইর হইবো।কেউ জানতো না এই খবর।জনির মায়ের বাড়ির কেউ আছিলো না।একটা ছোট বইন আছিলো।একটা ভাড়া বাড়িতে থাকতো ওরা তিনজন।আমি যাইতাম মাঝেমধ্যে। রত্নার যহন রোগ হইলো ডাক্তার কইছে বেশিদিন বাঁচবো না।এটা জনির মায় জানতে পাইরা আমারে জোর দিতে থাকে।আমার ওই বন্ধুর লগে আবার জনির খালার বিয়া হইছে।আমার মা এক পরিচিত মানুষের কাছে জানতে পারে আমি আরেকটা বিয়া করছি।আমার মাও অস্থির হইয়া যায়। অশান্তি শুরু করে জনির মায়রে ছাড়ার লেইগা।কিন্তু ততদিনে আমার ওই ঘরেও একটা পোলা আছে।…এই সংসারের ঝামেলায় আমার মাও হার্ট এ্যাটাক কইরা মরলো।আমি আমার মায়েরও দোষী। খুনী!”

অন্বেষার চোখ ছলছল করছে। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে মোকলেস মাতবরের অনুশোচনায় ঘেরা মুখের দিকে। হৃদপিন্ড লাফাচ্ছে অবিরত।ঢোক গিলে মোকলেস মাতবর আবার বলতে শুরু করেন,

“সত্যি কইতে আমার রত্না আর বর্ণের লেইগা কোনো টান আছিলো না।আমি আছিলাম অমানুষ।ভালো মতো দুইটা কথা কই নাই মা পোলার লগে।কোনো আবদার পূরণ করি নাই।মা পোলা কোনার ঘরে পইড়া থাকতো সারাদিন। হাসতো, খেলতো।ঐটা আর বেশীদিন টিকে নাই।হুট কইরা রত্নাও মইরা গেলো।আমি ভাবছিলাম বর্ণ কানবো মায়ের লেইগা।ওয় উল্টা হাসছে।পাগলের মত হাসছে মায়ের লাশের সামনে।তহন পাঁচ বছরের পোলা ওয়।রত্না মরার তিনদিনের দিন বাধ্য হইয়া জনির মায়রে ঘরে তুললাম।বর্ণ সবার আগে বুকে জড়ায় গেলো।কিন্তু সৎ মা কি আপন হয়?খাইতে দিতো না।কাপড় দিতো না।ঘরের কাম কাজ করাইতো।হাড্ডি বাইর হইয়া গেছিলো শরীরের।আমিও একটা পশু আছিলাম।নতুন বউয়ের আঁচলে বান্ধা।আমিও জুলুম করছি।অনেক জুলুম করছি।আর ওই শাস্তি পাইছি আমি।এর লেইগাই তোমার কাছে মাফ চাইতে আইলাম।তুমিতো ওর বউ।”

বলে হাত জোড় করলেন মোকলেস মাতবর। অন্বেষা এক দৌঁড়ে এক গ্লাস পানি এনে এগিয়ে দিলো তার দিকে।তার চোখের এক কোণ বেয়ে পানি পড়ছে। অন্বেষা নিজেকে দমাতে পারেনি।বললো,

“আমি ওর স্ত্রী হয়ে বলছি আপনি আপনার ভুল বুঝতে পেরেছেন।নিজে থেকে ক্ষমা চাইতে এসেছেন এটাই অনেক।আসলে মানুষ মানুষের বাহ্যিক রূপ দেখেই বিচার করে ফেলে।ভালো মানুষ ভালো।খারাপ মানুষ কেনো খারাপ?কি কারণে?সেটা কেউ জানতে চায় না। বর্ণের ক্ষেত্রেও তাই।আর হ্যাঁ আপনি বর্ণের জন্য একদম চিন্তা করবেন না।আগের চেয়ে ও এখন অনেক ভালো আছে।অনেক।”

“আমার উপরে কি অনেক জিদ ওর?”

“ও এখন আর এসব নিয়ে ভাবেনা। ও সংসারে ব্যস্ত।আমি ওকে বুঝিয়ে বলবো।আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।নিজের যত্ন নিন।”

চা ঠান্ডা হয়ে গেছে। অন্বেষা গরম করে দিতে চাইলেও মোকলেস মাতবর বারণ করলেন।বর্ণ আসার সময় হচ্ছে।এখানে বেশিক্ষণ থাকা যাবেনা।তাই দ্রুত চলে গেলেন। অন্বেষা সাব্বিরকে ডেকে বললো,

“ওনাকে দেখে বাড়ি অব্দি পৌঁছে দিয়ে এসো।আর হ্যাঁ উনি যে এখানে এসেছিলেন তোমার ভাইজান যেনো না জানে।”

সাব্বির মাথা দোলায় এবং জবাবে বলে, “ঠিক আছে ভাবি।”

বর্ণ রাত আটটার কিছু আগে ফিরেছে।বাড়ি ফিরেই চোখ পড়লো আধ খাওয়া চায়ের কাপের দিকে। লক্ষ্য করেও কিছু বললো না। অন্বেষা কাগজ ছড়িয়ে এসাইনমেন্ট লিখছে।বর্ণকে দেখে উঠে চা দিলো চুলোয়। পলিথিনে মোড়ানো কাগজের প্যাকেট খুলে গরম গরম পুরি দেখতে পায়।প্লেটে নিয়ে বিছানার উপরে রাখতেই বর্ণ বেরিয়ে আসে হাত মুখ ধুয়ে।বিছানায় পা গুটিয়ে বসে প্রশ্ন করলো,

“কেউ আইছিলো নাকি?”

আচমকা আতংকিত হয়ে পড়লো অন্বেষা।ভয় তার। সাব্বির কি বলে দিলো তাহলে?তারপরও মাথা নাড়িয়ে বলে,

“নাতো”

“তো চায়ের কাপ?”

“কেনো আমি খেতে পারি না?”

বর্ণ পুরি মুখে দিয়ে বললো,

“তুমিতো তোমার সোয়ামীরে ছাড়া খাও না।”

“ওহ…. না আমিই খেয়েছি। এসাইনমেন্ট করতে করতে মাথা ধরেছিলো।”

বর্ণ তেমন ভ্রুক্ষেপ না করে জবাব দেয়,

“যহন যা খাইতে মন চাইবো খাইয়া লইবা।আমার লেইগা অপেক্ষা করার দরকার নাই।এই লও পুরি খাও।”

কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে অন্বেষা। বললো,

“তুমি খাও।আমি কাগজগুলো গুছিয়ে নেই।”

কাজ শেষে এসে বসলো বর্ণের পাশে।বর্ণ অন্বেষার ফোন পাশে রেখে অন্বেষার কোলে মাথা রেখে অকপটে।হাত টেনে নিজের মাথার উপরে রেখে বললো,

“কালনাগিনী আমার চুল টাইনা দাও।আজকা অনেক খাটাখাটনি গেছে।”

“তেল দিয়ে দেই?”

“না না।অস্থির লাগে।তুমি চুল টানো।”

অন্বেষা কথা না বাড়িয়ে চুল টেনে দিতে শুরু করে।আচমকা উঠে গেলো বর্ণ।এক মিনিট ঠাঁয় রইলো না নিজের জায়গায়।প্যান্টের পকেট থেকে একটি কাগজ বের করে বললো,

“এটা তোমার লেইগা আনছি। দেহো।আমারে একজন কইলো কম্পিউটার কোর্সের কথা।শিখা ফালাও।তোমার ভবিষ্যতের লেইগা ভালো।বেশি টাকা লাগবো না।আমি দিমু নে।তুমি আমার লেইগা রক্ত পানি করতাছো।আমি এট্টুক করতেই পারি।”

আজকাল বর্ণের ছোটখাটো চিন্তাগুলো বড্ড ভালো লাগে অন্বেষার।যেনো তার ভাবনার সমস্তটা ঘিরে শুধু অন্বেষার বসবাস। অন্বেষা বললো,

“আপনি শিখবেন না?শুধু আমি ভালো চাকরি করলেই হবে।”

“আরেহ ব্যাটা!এক ঢিলে দুই পাখি মারুম।তুমি শিখবা।আমারে শিখাইবা।”

“আচ্ছা আপনি সার্টিফিকেটটা কোথায় পাবেন শুনি?”

বর্ণ চোখ টিপে বললো, “জাল বানামু।”

বর্ণের কাঁধে চাপড় দিয়ে অন্বেষা বলে উঠে,

“শুধু বাটপারি করার চিন্তা!”

বর্ণ আবারো মাথা এলিয়ে দেয় অন্বেষার কোলে।চোখ বুঝলো অবলীলায়।ভারী নিঃশ্বাসে উঠা নামা করছে বক্ষ। যতনের দুহাত অগোছালো চুলের গভীরে।

“আমি ভালো কথা কওয়ার মানুষ না।কিন্ত আজকা মন চাইলো কয়টা কথা তোমারে কই। আজকা তুমি অনেক বড় একটা ভুল করছো।যেটা আমি জানি।কিন্তু তোমারে বকমু না।কি ভুল করছো? কারে চা খাওয়াইছো বুইঝা লও।দ্বিতীয়বার ভুলটা জানি না হয় সাবধান করলাম।”

অন্বেষা ঢোক গিলে।ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়।বর্ণ আবার বললো,

“আমি দুনিয়ার সব মানুষের মতো বড়লোক হইবার চিন্তা করিনা।করতে চাই না।আমি ফকির থাইকা আধিপত্য বিস্তার করতে চাই।এটা আমার জিন্দেগীর আজব শখ।আমার লগে যেহেতু চিপকায় গেছো তাইলে তোমারে কই।আমরা আজকা থিকা পাঁচ বছর পরও এই ঘরেই থাকুম।এমনেই জীবন কাটামু।প্রয়োজনের চেয়ে বেশি কোনো শখ আহ্লাদ আমগো থাকা চলবো না।বাইরের জগতের লগে আমগো কোনো মিল থাকবো না।আমারে বদলাইতে চাইবা না।আমি তোমার উপরে কোনো জুলুম করমু না।এতটা মাস যেমনে জীবন কাটছে ওমনেই কাটবো।মরার আগ পর্যন্ত।আমি নিজেরে রাজা ভাবি।তুমিও নিজেরে ভাবা শুরু করো রানী।”



চলবে…............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন