অন্তিম পর্ব ০৮
শারমিন আক্তার বর্ষা
.
.
.
অভ্র আর নীলের বিয়ের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। সে মা হতে যাচ্ছে। নয় মাস চলছে। শরীরে অনেক পরিবর্তন আসছে। এই সময় না কি মেয়েদের হাত পায়ে পানি আসে। ফুলে ফেঁপে টইটম্বুর হয়ে গেছে। হাঁটাচলা করতেও কষ্ট হয়। চার মাস আগে শেষ ডাক্তার দেখিয়েছিল, তখন ডাক্তার বাঁ পাশে ঘুমাতে নিষেধ করেন। বাঁ পাশে না-কি সন্তানের মাথা থাকে যা প্রসবের সময় কাছাকাছি আসলে আস্তে আস্তে ডান দিকে ঘুরে চলে আসে। একপাশ হয়ে কতক্ষণ শুয়ে থাকা যায়? সন্তানের জন্য এতটুকু কষ্ট মা করতেই পারে। অভ্র অফিসের কাজের জন্য সিলেট গেছে। সে কয়েক দিনের ভেতর ফিরে আসবে। রাত এখন এগারোটা। ঘুম আসছে না দ্বিধায় নীল বিছানায় হেলান দিয়ে বসে বই পড়তে লাগল। মাথাটা হঠাৎ ঘোরাচ্ছে। বইটা হাত থেকে রেখে আলগোছে শুয়ে পড়ল। গাঁ গুলাচ্ছে। বমি বমি ভাব। নীল একটু একটু করে বিছানা ছেড়ে উঠে বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেল। দশ মিনিট পর হাতমুখ ধুয়ে বেরিয়ে এলো। মাথায় হাত রেখে বিছানার উপর বসল। ঘুমানোর চেষ্টা করল।
আশপাশের মসজিদে আজান দিচ্ছে। দূর থেকে ভেসে আসছে সে ধ্বনি। নীল উঠে বসল। একটু সময় নেয় তারপর ওজু ও নামাজের জন্য এগিয়ে গেল। সকাল সকাল উষ্ণ হাওয়ায় গাঁ ভাসিয়ে দিয়ে ছাঁদে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে নীল। তারপর রুমে এসে রেস্ট করে তারপর শ্বাশুড়ি মায়ের সঙ্গে রান্নাঘরে সময় দেয়। রাতে ঠিকমতো ঘুম হয়নি। তাই আজ রুমে এসে বিছানায় গাঁ এলিয়ে দিতে ঘুমিয়ে গেল। অভ্র কল করে সাতটা বাজে। নীল কল রিসিভ করে।
'গুড মর্নিং।'
' আজ এত দেরি করে কল দিয়েছ কেন?'
' ঘুম থেকে উঠতে লেট হয়ে গেছে। তুমি কি করছ? কণ্ঠ শুনে মনে হচ্ছে এখনও ঘুমিয়ে আছো। ডাক্তার তো বলেছ সকাল সকাল উঠার জন্য।'
' সকালে উঠেছি। রাতে ঘুম হয়নি৷ একটু আগে শুয়েছিলাম তখনই ঘুমিয়ে গেছি।'
' নামাজ পড়েছ?'
' হ্যাঁ।'
' ব্রেকফাস্ট করেছ?'
' না। এখনো হয়নি।'
' আচ্ছা নাস্তা করে সকালের ঔষধ খেয়ে নাও। আর শোন সম্ভাবনা আছে আমি আগামীকাল ফিরে আসব। এদিকে কাজ প্রায় শেষ।'
' সাবধানে এসো। আর নিজের খেয়াল রেখো।'
আছিয়া চৌধুরী নীলকে ডাকতে আসলেন দেখল নীল সজাগ৷ উনি মৃদু কণ্ঠে বললেন, ' নাস্তা বানিয়েছি আয়। একসাথে খেতে খেতে দুই একটা গল্প করা যাবে।'
নীল বলল, ' ঠিক আছে মা।'
অভ্র বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। সে কল কেটে রুমে চলে গেল। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পরবে নাস্তাটা হোটেলে করে তারপর অফিস যাবে। এমনিতে আজ দেরি হয়ে গেছে। আকাশ দরজায় নক করল। গলা তুলল, ' কিরে এখনো ঘুমচ্ছিস? আজ শেষদিন আর তুই আজই লেট করছিস।'
অভ্র দরজা খুলে দিল। আকাশকে বসতে দিয়ে বলল, ' গতকাল অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিলাম এজন্য আজ উঠতে দেরি হলো। তুই আমাকে একটু সময় দে আমি দশ মিনিটে রেডি হয়ে যাব।'
আকাশ বলল,
' ততক্ষণে শুভর একবার ব্রেকফাস্ট হয়ে যাবে। ওঁ অপেক্ষা করছে। দশ মিনিট না পাঁচ মিনিটে রেডি হবি।'
' আচ্ছা। ওয়েট কর।'
'অভ্র, আজ প্রেজেন্টেশন আমি করব।'
' ঠিক আছে।'
' রাতের মধ্যে গাজীপুর ফিরবি না কি আগামীকাল যাবি?'
' আগামীকাল। আজ রাতে ঘুমাব।'
' ওকে।'
নীল রান্নাঘরে আসলো। দুপুরের জন্য সবজি বের করে সেগুলো কাটতে নিল। নীলকে কাজ করতে দেখে আছিয়া চৌধুরী ভীষণ রাগ করলেন। উনি বললেন, 'বাড়িতে কাজ করার মানুষ কী কম? তোকে কে বলল এসব করার জন্য?'
নীল বলল, ' কেউ বলেনি, আমিই করছি। রোজ হাত গুটিয়ে বসে থাকতে আমার ভালো লাগে না। মনে হয় কিছু করি। একটু আধটু কাজ করলে কি ক্ষতি হবে?'
আছিয়া বললেন, ' তুই ঠিক আমার শ্বাশুড়ি মা-র মতন। উনি বেঁচে থাকতে প্রায় টুকটাক কাজ করতেন। নিষেধ করলে কখনও শুনত না। এই ঠিক তোর মতন কথা বলত।' বলে থামলেন তিনি। একটু পর আবার বললেন, ' তোর ফোন বাজছে ড্রয়িংরুমে। এখন তুই যা। দুপুরে রান্না আমি বা কাজের ভুয়া করে নিবো।'
তানজুম কল দিয়েছে। নীল ভিডিও কল রিসিভ করে সোফায় বসল। তানজুমের ছেলের বয়স তিনমাস নাম আহান সে ঘুমাচ্ছে। এই সুযোগে একটু গল্প করার জন্য তানজুম নীলকে কল দিয়েছে। নীল ওঁর সমস্যার কথাগুলো তানজুম কে জানালো। তানজুম ভারশীল কণ্ঠে বলল, ' এই সময় মেয়েদের এইরকম সমস্যা হয়। ডাক্তার বলেছেন, তোর টুইন বেবি। এজন্য তোর একটু বেশি কষ্ট করতে হচ্ছে।'
সেসময় আছিয়া ফলের জুস নিয়ে এসে নীলকে দিল। নীল খাবে না। এমন দৃষ্টিতে তাকাল। আছিয়া নীলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ' বাচ্চার জন্য খেতে হয় মা।'
নীল হঠাৎ পুরোনো দিনের কথা ভাবতে লাগল। রোজকার মতোই সে ওদিন কলেজ যেতে রেডি হচ্ছিল। অভ্র ওঁর ট্টাই বাঁধতে বাঁধতে নীলের ঠিক পেছনে এসে দাঁড়ায়। এরপর নীলকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে সে কপালে চুমু দেয়। তারপর অভ্র নীলকে কলেজে ড্রপ করে অফিস চলে যায়। সেদিন ক্লাসে হঠাৎ নীলের শরীর অসুস্থ হয়ে যায়। ওইদিন ওঁর বন্ধুদের কেউ কলেজ আসেনি। শরীর খারাপ দেখে ম্যাম এগিয়ে আসেন। উনি নীলের চোখমুখ দেখে কিছুটা আন্দাজ করেন। তারপর বললেন, ' নীল তোমার কি হয়েছে?'
' জানি না ম্যাম, সকাল থেকে মাথা ঘুরছে আর বমি আসছে।'
' প্রেগন্যান্সি টেস্ট করিয়েছ?'
নীল চমকে উঠল,
' না, ম্যাম। আমি তো প্রেগন্যান্ট নই।'
' তাহলে শিওর বলছ কিভাবে? আমি দুই বাচ্চার মা। আমার মনে হচ্ছে তুমি প্রেগন্যান্ট। আর শিওর হওয়ার জন্য একবার প্রেগন্যান্সি টেস্ট করো৷'
নীল সেদিন বাড়ি ফেরার পথে ফার্মেসী থেকে একটা কিট নিয়ে আসে। পরের দিন নিয়ম করে টেস্ট করে সে দেখল লাল রঙের দু'টো দাগ অর্থাৎ পজিটিভ। আরও শিওর হওয়ার জন্য সেদিন হাসপাতালে এলো নীল। ডায়াগনস্টিক আফিয়া পারভীন কিছু টেস্ট করতে দিল। রিপোর্ট দেখে তিনি খুশির খবরটাই শোনান। নীল বাড়ি এসে খবরটা সবাইকে দিল। সবার খুশি ও আনন্দ দেখে নীল ভীষণ খুশি হলো। চৌধুরী বাড়ির আঙিনায় ছোট্ট ছোট্ট পায়ে কেউ হেঁটে বেড়াবে। ভাবতেই সকলের মন-প্রাণ প্রফুল্লে ভরে উঠছে। অভ্র প্রথম খবরটা শুনে সেই বেশি আনন্দ করে। আস্তে আস্তে সে আনন্দ যেন মলিন হতে লাগল। একজন মেয়ে মা হওয়ার জন্য কত কষ্ট করে সে তা নিজ চোখে দেখছে, নীলের জন্য তার কষ্ট হয়। ভীষণ কষ্ট। অভ্রর চোখ ভেজা সিলেট যাওয়ার আগে অনেকক্ষণ নীলকে জড়িয়ে ধরে রাখে সে৷
◩
হাসপাতালের বেডে শুয়ে ছটফট করছে নীল। এত যন্ত্রণা সে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছে, রাত বারোটা নাগাদ জন্ম নিল দুজন ফুটফুটে জমজ মেয়ে। পরিবারের সবাই ও-টির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। একটু পর দুজন নার্স দু'টো বাচ্চা কোলে নিয়ে ও-টি থেকে বেরিয়ে আসলেন। বকসিস নিয়ে দু'জন বাচ্চাকে তার দাদী ও নানীর কোলে দিয়ে নার্সরা চলে যান। রাতে হাসপাতাল থেকে বাচ্চাদের নিয়ে বাড়ি যাওয়া ঠিক মনে করলেন না আছিয়া চৌধুরী ও মিসেস রোজা। রাতটা হাসপাতালে কাটিয়ে আগামীকাল সকালে বাড়ি যাবেন। নীলকে কেবিনে দেওয়া হয়েছে। সবাই দেখা করে আসলো। কেবিন নাম্বার ২০২। অভ্র এলো সবার পরে সে নীলের মাথার কাছে চেয়ার নিয়ে বসল। এরপর মাথায় হাত রেখে ক্ষীণ গলায় ডাকল, ' নীল, নীলাঞ্জনা।'
নীল পিটপিট করে চোখ খুলল। তারপর জিজ্ঞেস করল,
'আমার মেয়েরা ঠিক আছে তো? ওঁরা কোথায়? আমি একটু দেখব।'
'একটু অপেক্ষা করো। মা, ওদের নিয়ে আসছেন।'
একে একে সবাই কেবিনে আসলেন। এরপর বাচ্চাদের ওদের বাবা মা-র কোলে দিল। অভ্র মুগ্ধ চোখে এতক্ষণে মেয়েদের দেখল। অভ্র একজনকে কোলে নিল। ও অন্যজনকে নীলের কোলে দেওয়া হয়। নীল মেয়ের কপালে আলতোভাবে ঠোঁট ছোঁয়াল। অভ্রর চোখ ছলছল করছে। একজন পাঁচ মিনিট বড় ও দ্বিতীয় জন পাঁচ মিনিট ছোট। বড় জনা বাবার কোলে।
মুচকি হেসে অভ্র বলল, ' মাইশা।'
নীল বলল,
' মাইরা।'
.
.
.
সমাপ্ত..........................