পর্ব ০৯
শারমিন আক্তার সাথী
.
.
.
শুক্রবার বিকালে চারটা,
অনেক্ষণ যাবত পার্কের একটা বেঞ্চে বসে আছি। ঐশী বলেছিল সাড়ে চারটায় আসবে, আমি যে কেন সাড়ে তিনটায় এসে বসে আছি নিজেই জানি না। যখন পার্কের সামনে এসেছি তখন পার্কের গেট পর্যন্ত খোলেনি। গেট নাকি চারটার পর খোলে। আমি চারটা পর্যন্ত আশে পাশে হাঁটাহাঁটি করলাম। পর পে তিন কাপ চা খেলাম। এত বিচ্ছিরি চা তা-ও যে কেন তিন কাপ খেলাম আল্লাহ মা'বূত জানেন।
চারটার পর গেট খোলা হলে তখন থেকে ভিতরে ঢুকে একটা বেঞ্চে বসে আছি। দশটাকার বাদাম কিনে তা-ও হাতে নিয়ে রেখেছি। বাদাম আমার অনেক অপছন্দের খাবার, তা-ও কেন কিনলাম জানি না! সেমাই, ফিরনী বা পিঠাতে বাদাম দিলে, বা বাদাম আমার মুখে পড়লে আমার মেজাজ গরম হয়ে যায়। বিরিয়ানি খেতে গিয়ে মুখে এলাচ পড়লে যেমন বিরক্ত লাগে, বাদাম আমার তেমন বিরক্ত লাগে। ঐশী তার বিপরীত। ও বাদাম ভীষণ পছন্দ করে। আমাদের বিয়ে ঠিক হওয়ার পর একবার ওদের বাসায় আমাদের পরিবারসহ দাওয়াত ছিল, তখন দেখেছিলাম, ফিরনীতে প্রচুর বাদাম থাকা সত্ত্বেও ও মুঠো ভরে বাড়তি ভাজা চিনা বাদাম ফিরনীতে নিয়ে খেয়েছিল।
গরম গরম চিনা বাদাম ভাজা, ভেজানো পেস্তা বাদাম ওর খুব পছন্দ। ওর সবচেয়ে পছন্দ নাকি কাজু বাদাম। ও বলেছিল কাজু বাদাম কড়াইতে হালকা ভেজে বা টেলে খেতে নাকি সবচেয়ে মজা। কখনো খাইনি, সে কারণে জানি না কেমন খেতে। ও নাকি বাদামের হালুয়াও বানায়। কেমন লাগে কে জানে? যদি ঐশী জীবনে আসে তবে ওকে বলব ওর সকল পছন্দের জিনিস বানিয়ে খাওয়াতে। টেস্ট করে দেখব কেমন লাগে।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম চারটা এগারো। আজ সময় এত ধীরে যাচ্ছে কেন? হয়তো অপেক্ষার সময় বলেই ধীরে যাচ্ছে। আচ্ছা ঐশী কি কিছুক্ষণ আগে আসতে পারত না? তাহলে কী ওর ব্যাংকের চাকরি চলে যেত না কী? এই বাঙালীর মুদ্রাদোষ, সময়ের আগে আসবে না বরং সময়ের চেয়ে অনেক লেইট করে আসবে। যেন লেইটে আসলে মান বাড়ে। বাঙালীর যদি সময় জ্ঞান থাকত তাহলে আমেরিকার মতো বাঙালীও চাঁদে থাকত।
আরে আমি এসব কী ভাবছি? কেন ভাবছি? বুড়ো বয়সে মাথাটা কী গেছে? যেতেও পারে। এই মাথায় তো কম পরিশ্রম করেনি। কদিন যাবত তো মাথার উপর একটার পর একটা বাজ পড়েই যাচ্ছে। মাথার-ই-বা কী দোষ? দূর থেকে ঠান্ডা গলার একটা হিন্দি গান ভেসে আসছে, 'কাল হো না হো'। গানের কথাগুলো সুন্দর। কলেজ জীবনে মুভি দেখার জন্য বন্ধুদের সাথে সাথে হিন্দি শিখেছিলাম। এই গানটা চেনা চেনা লাগছে, মুভিটা কী দেখেছিলাম? হয়তো দেখেছিলাম, আজকাল মনেও থাকে না কিছু। জীবন এত পেইন দিয়েছে যে আনন্দ করা ভুলে গেছি। একটা খবরের কাগজ পেলে ভালো হতো। কদিন যাবত খবরের কাগজ পড়া হয় না।
পার্কে লোক আসা শুরু করছে। কিছু ছেলেরা ভিতরে ঢুকে বেশ জোরে জোরে কথা বলছে। তাদের হাতে গিটার, ক্যামেরা। হয়তো কোনো ভিডিও করবে। প্রযুক্তির যুগে বাচ্চারা প্রযুক্তির ব্যবহার বেশ ভালোই জানে। অনলাইনেও নাকি বেশ ভালো ইনকাম করা যায়। ছেলেগুলোর হই হুল্লোর দেখে নিজের কলেজ জীবনের কথা মনে পড়ল। বাবার কথা খুব মনে পড়ল। বাবা থাকতে জীবনটা সত্যি সুন্দর ছিল। তারপর ঘরে বাবার দায়িত্বটা আমার কাঁধে করল।
আচ্ছা এখন সামিহা, সামিয়া, শফিক যা করছে তা কি আমি বাবার সাথে করতাম না? আমিও নিজের প্রয়োজনটা কেবল বাবাকে বলতাম। বাবা কোথা থেকে কী করতেন তা জানার প্রয়োজন বোধ করতাম না। আমার ভাই বোন মা-ও কি সেটা করছেন না আমার সাথে? তাহলে তারা কী ভুল নয়? নাকি আমার চিন্তায় ভুল? তারা হয়তো ভুল না, তবে আমার সাথে তারা অন্যায় করেছেন বৈকি। যেটা দাদা-দাদি, বাবার সাথে করেননি।
বাবার সঠিক বয়সে বিয়ে হয়েছিল, তার চারটা সন্তানও হয়েছে। অথচ বাবার পরিবার তখন ততটাও স্বচ্ছল ছিল না। খেয়ে পরে ঠিকঠাক চলে যেত কোনোরকম, কিন্তু আমি আমার পরিবারকে স্বচ্ছলতা দেওয়ার পরও তারা আমার কথা ভাবেননি। আমার পরিবারের কথা শুনে আপনারা সবার পরিবারকে এক ভাববেন না।
আমার ছোটো মামা মামির কথা বলি। তার ছোটো ছেলে মাসুদকে যখন বিয়ে করিয়েছে তখন ওর বয়স মাত্র একুশ বছর। ও একটা মেয়েকে পছন্দ করেছে বলে, তারা বিয়ে করিয়ে দিয়েছিল। মাসুদের বর্তমান বয়স পঁচিশ বছর। ও এখনও পড়ালেখা শেষ করেনি। ওর এবং ওর বউ এর সকল খরচ ছোটো মামা বহন করেন। এমনকি ওদের কখনো এমন কোনো কথা বলে না, যাতে ওরা কষ্ট পায়। বুঝতে পারছেন মাসুদ আমার কত ছোটো! অথচ আমার মা, ভাই, বোনের কাছে কেবল তাদের প্রয়োজন হয়ে রইলাম।
হাতে কারও স্পর্শ পেয়ে পাশে তাকিয়ে দেখলাম ঐশী আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। আমার হাত থেকে বাদামের ঠোঙাটা নিয়ে বাদাম ছিলতে ছিলতে বলল,
'সায়ন সাহেব, আপনি কবে থেকে বাদাম খাওয়া শুরু করলেন?'
আমি স্মিত হেসে বললাম,
'শুরু করিনি, তবে করব বলে ভাবছি।'
'ওহ। ভালো।'
আমি ঐশীর দিকে তাকিয়ে এত খুশি হলাম যা বলার বাইরে। আজ সকালে ওর জন্য নীল রঙের একটা শাড়ি পাঠিয়েছিলাম, সেটাই পরে আসছে ঐশী। আমার এত ভালো লাগল। ঐশীকে দারুণ লাগছে দেখতে। নীল শাড়ি, খোলা চুল, কপালে ছোট্ট একটা নীল টিপ। যেন ঝলমলে চাঁদনী রাতের উজ্জ্বল আকাশে নীল রঙের চাঁদ। আমি ওর দিকে তাকিয়ে ওর কোনো প্রশংসা না করে বললাম,
'ঐশী, চলো বিয়ে করে ফেলি। আজ তোমাকে এত স্নিগ্ধ লাগছে যেন সদ্য ফোটা গোলাপ। এত সুন্দর রূপে বিয়ে না করাটা অন্যায় হয়ে যাবে।'
ঐশী কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
'দেখা করতে কেন চেয়েছিলেন?'
'আমার প্রশ্নের উত্তর কিন্তু এটা না।'
'প্রশ্নের উত্তর তো পরে দিব।'
'কখন?'
'সেটা আমার সময় মতো।'
'ওহ।'
'তো বলুন দেখা করতে কেন চেয়েছিলেন?'
'তোমাকে দেখতে। তোমার না কে হ্যাঁ বানাতে।'
'তো না কে হ্যাঁ কীভাবে বানাবেন?'
'জানি না। কী খাবে?'
'কিছু না। দুপুরের খাবার খেয়েই বের হয়ে এসেছি।'
'এত দেরীতে কেন খেয়েছো?'
'এমনি। আজ ছুটির দিন, অলস সময় কাটছিল। ঘুমিয়েছি অনেকবেলা পর্যন্ত, তারপর নিজের রুমটা একটু গুছিয়েছি। একটু সবজি বাগানে কাজ করেছি।'
'ব্যাংকের কাজের সাথে সাথে কৃষি কাজও করা হয়?'
'এই একটু আধটু। আপনি করেন না? আপনি তো গাছ লাগাতে, বাগান করতে ভীষণ পছন্দ করতেন।'
'করতাম। এখন সব শখ শেষ হয়ে গেছে। শেষ কবে গাছ লাগিয়েছি মনে নেই। যখন জব করতাম তখন ছুটির দিন মানে আমার কাছে সারাদিন ঘুম ছিল। তারপর নিজের ব্যবসা হওয়ার পর ছুটির দিন বলে কোনো দিন নেই। সব দিনই কোনো না কোনো কাজ থাকে।'
'ওহ। তাহলে তো আপনাকে বিয়ে করা ঠিক হবে না।'
'কেন?'
'যার ছুটির দিন নেই সে তার বউকে মোটেও সময় দিতে পারে না। ছুটির থাকলে তা-ও যা একটু সময় দিতাম।'
'ব্যবসা যেহেতু নিজের, সেহেতু ছুটি যখন তখন নিতে পারব। কিন্তু যারা চাকরিজীবি তারা কিন্তু সেটা পারে না। তুমি পারবে?'
ঐশী মলিন হেসে বলল,
'আপনি হয়তো ভুলে গেছেন, চাকরি করার শখ আমার কোনো কালেও ছিল না। শখ ছিল সুন্দর সাজানো একটা সংসারের, কিন্ত পরিস্থিতি আজও আমাকে সেটা দেয়নি।'
আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে অনেক সাহস যুগিয়ে ঐশীর হাতেটা আমার হাতের মুঠোয় নিয়ে বললাম,
'এখন আমি সে সংসার দিতে চাই? যে সংসার কেবল তোমার হবে। নিজের মতো যা খুশি করবে। যে সংসারে কোনো ভাগাভাগি থাকবে না। সে সংসারে আমাকে সারাজীবনের সঙ্গী করবে?'
ঐশী চুপ করে রইল। আমি ওর কপালের টিপটা একটু ছুঁয়ে দিলাম। হাত দিয়ে নয়, ঠোঁট দিয়ে। মেয়েটা তাতে এত ভয়াবহ কেঁপে উঠল, যেন প্রচণ্ড শীতে আমার অসম্ভব ঠান্ডা হাত ওর গালে স্পর্শ করিয়েছি। এরকম ঐদ্ধতা কেন করলাম জানি না, তবে মনে হচ্ছিল, এটা না করলে তৃষ্ণায় আমি মরে যেতাম। ঐশী উঠে যেতে চাইলে আমি হাতটা শক্ত করে ধরে বললাম,
'আগামী শুক্রবার তুমি সারাজীবনের জন্য আমার হবে। যদি তুমি চাও ধুমধাম করে সারা পৃথিবীকে জানাবে, তাহলে তেমন হবে। যদি তুমি চাও একদম নিরিবিলি আমার হবে তবে তেমন হবে। তবে তোমাকে আমার হতেই হবে।'
'জোর করে করবেন নাকি?'
'যদি তেমন করতে হয়, তবে তেমন করব।'
'ভালোবাসেন আমাকে?'
'তোমাকে যদি জড়িয়ে ধরতে পারতাম তাহলে হয়ত বুঝতে।'
ঐশী আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
'তাহলে জড়িয়ে ধরার ব্যবস্থা করেন। পারিবারিকভাবে আবার সবকিছু হোক। শুরু থেকে শুরু হোক। নিরিবিলি নয় আমি ধুমধাম করে আপনার হতে চাই। সবাই যেমন জানে আমি আপনার ডিভোর্সি, তেমনি সবার জানা দরকার আমি আপনার বউ হচ্ছি।'
.
.
.
চলবে..........................