পূর্ণিমা সন্ধ্যা - পর্ব ০৫ - নবনীতা শেখ - ধারাবাহিক গল্প


পৃথিবীটা বিষে ভরা। তার মধ্যে যারা জন্মেছে পবিত্র আত্মা নিয়ে, তাদের প্রায় শতভাগ পেয়েছে বিষাক্ততা। অন্যথায় যারা মন্দলোক, তাদের বেলায় ওই নীতিটা খেটেছিল—বিষে বিষক্ষয়। 

ইফতি পর পর দু'বার ঠকেছে দুটো নারীর কাছে। প্রথমজন তার জন্মদাত্রী জননী, দ্বিতীয়জন তার সাড়ে চার বছরের ভালোবাসা। ইফতির যখন সাড়ে পাঁচ বছর বয়স, তখন তার প্রতি তার মায়ের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার প্রকাশ স্বরূপ বাজে কিছু ঘটে। ক্ষুব্ধ হয় তার বাবা। অতঃপর ভীষণ শান্ত হয়ে তার মা-কে জব আর বাচ্চার মধ্যে যে-কোনো একজনকে বেছে নিতে বলে। অবিলম্বে তার মা নিজের ক্যারিয়ারকে বেছে নেয়। অতঃপর বিচ্ছেদ। আলাদা হয়ে যায় তার বাবা-মা। ব্রোকেন ফ্যামিলিতেই ইফতির শৈশব কাটে।

ইফতির বেড়ে ওঠা তার বাবার কাছেই। বাবা, দাদি, ইফতি! ছোট্ট সংসার। ইঞ্জিনিয়ারিং করার সময়, ইফতির সাথে তার ব্যাচমেট রাফার পরিচয় হয়। পরিচয়টা এত জলদি যে একটা প্রণয়ের সম্পর্কে রূপ নেয়, তা বিস্ময়কর ছিল বটে। সাড়ে চার বছরের সম্পর্ক। হঠাৎ জানতে পারে তার এক বন্ধু বিয়ে করেছে। ছবিতে দেখতে পেল বন্ধুর বিবাহিত স্ত্রী হিসেবে তারই প্রেমিকা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে পাশে। সামাজিক মাধ্যমে বিয়ের ছবি ছেড়েছে। ক্যাপশনে ছিল, “প্রণয় থেকে পরিণয়।”

অবিশ্বাস্য লেগেছিল বিষয়টা ইফতির কাছে। পরদিনই রাফা তাকে টেক্সট করে,
-“ইফতি, ইফ ইউ ওয়ান্ট টু হেইট মি, ইউ ক্যান। বাট ফার্স্ট আই নিডেড টু সিকিউর মাই ফিউচার, এজন্য বিয়ে করে ফেললাম আর হাজব্যান্ড হিসেবে তোমাকে চ্যুজ করলাম না। যেহেতু তুমি আমার বয়ফ্রেন্ড ছিলে, সো একটু এক্সপ্লেনেশন দিচ্ছি।
নিঃসন্দেহে তুমি মানুষ হিসেবে চমৎকার। কিন্তু শুধু একজন চমৎকার মানুষ দিয়ে সারাটা জীবন চলানো যায় না। দায়িত্ববোধ লাগে, পার্টনারকে বোঝা লাগে। তুমি অসম্ভব পজেসিভ একজন মানুষ। আমার সাফোকেটেড লাগত, ইফতি। এত ভালোবাসা নেওয়া যাচ্ছিল না আর। রাদিফকে দেখে তখন মনে হলো, ওর সাথে আমি হ্যাপি থাকব। তাই একটু স্বার্থপর ও সুবিধাবাদীর মতো কাজ করলাম। ইচ্ছে করলে মাফ করে দিয়ো আমায়, নয়তো যা খুশি কোরো। শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলো না, আর অভিশাপটা দিয়ো না। এগেইন আই সাউন্ড লাইক আ সেলফিশ। বাট কিচ্ছু করার নেই। একটাই লাইফ, কোনোকিছুর সাথে কম্প্রোমাইজ করতে পারব না। সরি, অ্যান্ড থ্যাংকস ফর লাভিং মি...”

ইফতি রিপ্লাই করতে পুরো আড়াইদিন সময় নিয়েছিল। তারপর ছোট্ট করে বলেছিল,
-“আমার ভালোবাসা যদি কারো গলার ফাঁসির দড়ির মতো লাগে, তবে তার মতো অযোগ্য আমার জন্য দ্বিতীয়টা হবে না। থ্যাংকস ফর লিভিং মি।”

তারপর ব্লক। রাফা ও রাদিফ, দুইজনকেই সবখান থেকে ব্লক করে রেখেছিল ইফতি। ভালোবাসা তেমন আহামরি কিছু না। শুধু হয় কি মাঝে মাঝে একা লাগে, মাঝে মাঝে সবকিছু বিষণ্ণ লাগে, মাঝে মাঝে গোটা দুনিয়াটাকেই অসহ্য লাগে। এভাবে আড়াই মাস কাটার পর ইফতি নিজেকে সামলে নিয়েছিল। বিচ্ছেদের আজ পাঁচ বছর পেরিয়েছে। ইফতির বয়স চব্বিশ থেকে ঊনত্রিশ হওয়ার মধ্যবর্তী এই পাঁচ বছরের জার্নিতে ইফতি অসম্ভব ম্যাচিউর হয়েছে। স্বভাব পরিবর্তনে ভীষণ গম্ভীর, পর্যবেক্ষণশীল আর দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন হয়েছে। সঙ্গে যেই জিনিসটা তার মধ্যে ভীষণ করে মিশে আছে, তা হলো একটা ভুল ধারণা, 'নারী মাত্রই ছলনাময়ী'।

ইফতি গতকালই কাজিপাড়ার বাসা থেকে তাদের গুলশানের এই বাসায় চলে এসেছে। এখন রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। বেডে হেলান দিয়ে শুয়ে সিগারেট টানছে ইফতি। পৃথিবীর সবচেয়ে মারাত্মক আসক্তি হলো নারী আসক্তি। নারীর প্রতি টান দমে এলে সিগারেটের প্রতি টানটা অদমনীয় হয়ে আসে। অন্য হাতে ফোন স্ক্রল করতে করতে সে ব্যাঙ্গাত্মক হাসল।

আচমকা দরজা খোলার সামান্য শব্দে ইফতি সচকিত হলো। ডানে তাকিয়ে দরজার কাছে সাদেক সাহেবকে দেখে ইফতি দ্রুত সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে ফেলল। সাদেক সাহেব তা দেখে বললেন,
-“ফেলার প্রয়োজন নেই। তুমি স্মোক করো, এটা আমার অজানা নয়।”

ইফতি তাতে হেসে বলল,
-“সে-তো তুমিও করো। তাই বলে যেমন বাপের পাশে বসে লাইটার চাইতে পারি না, তেমন বাপের সামনে ধোঁয়াও ওড়াতে পারি না। এটুকু কার্টেসি তো রাখতেই হয়!”

সাদেক সাহেব হেসে ইফতির পাশে এসে বসলেন। ইফতি জিজ্ঞেস করল,
-“কিছু বলবে, আব্বু?”
-“নাহ! এমনিই দেখে যাচ্ছিলাম, ঘুমিয়েছ কি না।”
-“তোমার মন খারাপ?”
-“নাহ, ব্যাটা! মন খারাপ-টারাপ হয় না।”
-“সত্যি বলছ, আব্বু?”

সাদেক সাহেব প্রত্যুত্তরে অল্পক্ষণের নিরবতা দিলেন। ইফতি লম্বা করে শ্বাস টেনে বলল,
-“গান শোনাব?”

সাদেক সাহেব গুমোট হতে হতেও হলেন না ইফতির এ কথাটি শুনে। প্রফুল্লচিত্তে বললেন,
-“নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই।”
-“দাঁড়াও, গিটারটা নিয়ে আসি।”

ইফতি গিটারটা এনে আরাম করে বসল। বাবার দিকে তাকিয়ে মিহি হেসে সুর তোলা শুরু করল। এরপর গলার আওয়াজও যোগ করল সে-সাথে—

আমার জন্য আলো জ্বেলো না কেউ,
আমি মানুষের সমুদ্রে গুনেছি ঢেউ।
এই স্টেশনের চত্বরে হারিয়ে গেছি,
শেষ ট্রেনে ঘরে ফিরব না না না....

পুরো গানটাই ইফতি গাইল। অনেক অনেকটা সময় ধরে। এক পর্যায়ে গিয়ে সাদেক সাহেব ফট করে ইফতির বিছানায় শুয়ে পড়ে বললেন,
-“এত জোস গাস রে বাবু, ঘুম পেয়ে গেছে। গাইতে থাক। শান্তিতে ঘুমাই।”

ইফতি থেমে গেল। কপালে আঙুল ডলে বলল,
-“নিজের রুমে যাও।”
-“কেন?”
-“জোয়ান ছেলের সাথে ঘুমাতে হয় না।”
-“তোর গার্লফ্রেন্ড রাগ করবে?”

ইফতি এ পর্যায়ে না হেসে পারল না,
-“হ্যাঁ।”

সাদেক সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,
-“গার্লফ্রেন্ডটা কি সিগারেট?”

ইফতি এবার শব্দ করে হেসে বলল,
-“হ্যাঁ।”
-“আমি ঘুমাচ্ছি। তোর গার্লফ্রেন্ড ব্রেকআপ করলে করুক। গুড নাইট।”

______

নতুন বাসায় মা'কে নিয়ে অরণীর সাড়ে তিনমাস কাটল। এই সাড়ে তিনমাসে বেশ কিছু সুন্দর সুন্দর ঘটনা ঘটেছে। মিস তনুজার সাথে আয়শা ও অরণী—দুইজনেরই দারুণ সখ্য গড়েছে। আয়শা নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিয়েছে। সেই সঙ্গে রোজ রোজ এটা-সেটা নতুন ধরনের খাবার রান্না করে অরণীকে খাওয়ানো যেন তার অভ্যেসে পরিণত হয়েছে। মেয়েটা আয়েশ করে খাবে, এরপর সুন্দর সুন্দর প্রশংসনীয় কিছু বাক্য বলবে। যেমন: মামনি, জাদু জানো? মামনি, সেরার সেরা। অতুলনীয়। মনে হচ্ছে জনম সার্থক! আরও নানান কথা!
এসব শুনে আয়শার খুশি ধরে না। রান্নাটা সে ভালো পারে, রান্না নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে পছন্দ করে। 

অরণীও নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। মাকে যতটা পারে সময় দেওয়ার চেষ্টা করে। ক্যাম্পাস, টিউশন, ক্লায়েন্ট! এসব সামলে উঠে মাকে যতটা সময় দেওয়া যায়, দিচ্ছে। এ থেকে সে রাতের ঘুম কমিয়ে নিয়েছে একদম। চার ঘন্টাও ঘুমাতে পারছে না গতমাস ধরে।

অরণীর প্রথমে প্রচুর দুশ্চিন্তা হলেও, এখন তা লাগছে না। এখন সে টের পাচ্ছে, মাকে নিয়ে সে অন্য কারো দয়া ছাড়াই চলতে পারবে। একটু কষ্ট করলে দুইজনে বেশ ভালোভাবেই চলতে পারবে।

এসব সুন্দর সুন্দর ঘটনার মধ্যে আরও কিছু ঘটেছে, তবে সেগুলোকে সুন্দর বলা যায় কি না—জানা নেই। হয়তো সুন্দর, হয়তো অন্য কিছু। তবে কুৎসিত মোটেও নয়।

ইফতি যতবার এ বাসায় আসছে, সম্পূর্ণ কাকতালীয়ভাবে অরণী নিজের প্রতি ইফতিকে আকর্ষিত করার জন্য কিছু তো করছেই। এই তো গতমাসের কথা। সাদা কুর্তা পরে ছাদে দাঁড়িয়েছিল অরণী। তখন সন্ধ্যা করে। আচমকা বৃষ্টি নামে। মেয়েটা ফ্ল্যাটে না ঢুকে সেখানে দাঁড়িয়েই পাখির ডানার মতো দু-হাত ছড়িয়ে মুখখানা আকাশের দিকে ঘুরিয়ে রাখে। ঠোঁটের ভাঁজে ভাঁজে জল আর কোণায় অপ্রশস্ত হাসি। 

ইফতি সিঁড়িঘরে থেকে আর ছাদে প্রবেশ করার দুঃসাহস দেখায়নি। উল্পটো ঘুরে ফিরে গেছিল নিজের ফ্ল্যাটে। তারপর এমন এক অবস্থা হলো, ইফতি ছাদে যাওয়াও বন্ধ করে রেখেছে। মেয়েটা তখন নিয়মিত যাওয়া-আসা শুরু করে বারান্দায়। রাতভর বারান্দায় বসে ল্যাপটপে ডুবে থাকে। একটা মানুষ না হেসে এতক্ষণ থাকতে পারে? এত বোরিং একটা লাইফ লিড করে এই মেয়েটা? ভাবতে গেলেই ইফতির চোখ-মুখ কুঁচকে আসে।

তারপর থেকে তো ওই বাসায় যাওয়াই বন্ধ করে রেখেছে। আজ এক জরুরি কাজ পরে গেল বিধায় আসতেই হলো এখানে। তার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার সময় অরণী তাড়াহুড়ো করে সিঁড়ি দিয়ে নামছিল। অসহ্য অসহ্য অসহ্য! মেয়েটা পিছু ছাড়বে না? না ভেবে ইফতি ফট করে বলে বসল,
-“স্টক করছেন কেন? কী সমস্যা?”

থতমত খেয়ে গেল অরণী। তাকাল ডানে-বায়ে। এরপর নিজের দিকে। সবশেষে ইফতির দিকে। চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-“আসার পথে ব্রেইন কি রাস্তায় ফেলে আসছেন? নাকি মলমপার্টিরা ‘দে দে’ বলে নিয়ে গেছে?”
.
.
.
চলবে.....................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন