পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে। পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ ভেসে আসছে আশপাশ থেকে। নতুন এক সকালের আগমন মানেই আবারো কাজকর্মের শুরু। মেহেকেরও কাজ শুরু হয়ে গেছে। ফজরের নামাজ পড়ে কিছুক্ষণ বাইরে হাঁটাহাঁটি করেছে। তারপর বাসি থালাবাসন ধুয়েমুছে, ঘর ঝাড়ু দিয়েছে। বৃষ্টির ঋতু বলে উঠোন ঝাড়ু দেওয়ার বালাই নেই। বাইরে একটু-আধটু কাঁদা থাকে সবসময়। আজ বিকেলে মেলায় যাবে ওঁরা সবাই। আহনাফকে দুপুরেই খেতে আসতে বলেছেন আনজুম বেগম। খাওয়াদাওয়া শেষে একসাথেই চারজন মেলার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে।
" কোথায় ছিলে এতক্ষণ? "
মেহেককে ঘরে ঢুকতে দেখে ঘুম ঘুম চোখে শুধালো রোশন। মেহেক আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এলোমেলো চুলগুলো আঁচড়ে পরিপাটি করতে ব্যস্ত।
" ঘরের কাজ করেছি। আপনি উঠবেন এখন? তাহলে ভাত দেবো। "
রোশন হাই তুলে বিছানা থেকে উঠে বসলো। সেন্ডো গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরনে ওর। রাতে বৃষ্টি হলে কম্বল মুড়ি দিয়ে ফ্যান চালিয়ে ঘুমানো রোশনের অভ্যাস। কিন্তু তাতে আবার মেহেকের ঝামেলা হয়। অসময়ে কম্বল মুড়ি দেওয়া ভালো লাগে না ওর। আর বৃষ্টি হলে ঠান্ডা লাগে, ফ্যান চললে তো ঠান্ডা আরো বেশি লাগে!
" যা লাগবে তাই দাও। ভাত খেতে তো আসিনি শ্বশুরবাড়ি। "
রোশন ইতিমধ্যে খাট থেকে নেমে মেহেকের পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। হালকা গোলাপি রঙের থ্রিপিস পরনে মেহেকের। এতক্ষণ ধরে চুলগুলো খোঁপা করেছে কেবল। রোশন হুট করেই সেই খোঁপা খুলে দিয়ে কোলে তুলে নিলো ওকে। চমকাল মেহেক।
" এই কী করছেন সকালবেলা! "
" কোলে তুলে বিছানায় নিয়ে যাচ্ছি। "
" আমি এখন শোবো না। সাতটা বাজে, একটু পরই মা,বোন খেতে চাইবে। "
রোশন মিষ্টির কোনো আপত্তি শোনে না। আলতো করে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে নিজেও মেহেকের পাশে শুয়ে কম্বল মুড়ি দেয়।
" আটটার আগে কেউ খাবার খায় না। আর উনারা নিজেরাও তো খাবার খেতে পারেন! তোমাকে সব সময় দিতে হবে কেনো? এটা তোমার বাবার বাড়ি তবুও এতো কাজকর্ম কেন করো! মেলা থেকে ফিরেই বাড়ি চলে যাবো। মিষ্টির বিয়েতে অনেক দেরি। তখন আবার আসবো আমরা। "
রোশনের কথায় কিছু বলে না মেহেক। অভ্যস্ত হয়ে গেছে এসব কাজের সাথে। তাই আনজুম বেগম এখন কাজ করতে বারণ করলেও শোনে না।
" কী ভাবছো?"
" উম...কিছু না। "
রোশন মেহেককে জড়িয়ে ধরে দুষ্টমি করে চোখ টিপ্পনী কেটে বলে,
" কিছু ভাবতেও হবে না। "
" মানে...."
মেহেক কথা শেষ করতে পারলো না। রোশন তার আগেই মেহেকের ঠোঁটগুলি নিজের দখলে নিয়ে নিলো। আকস্মিক ঘটনায় চমকাল, থমকাল মেয়েটা। হাত দিয়ে সরাতে চাইলেও রোশন ছাড়লো না। সময় নিয়ে প্রেয়সীর ওষ্ঠের মোহে মোহাবিষ্ট হতে লাগলো। কিয়ৎক্ষণ বাদে রোশন থামলো। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে মেহেক। রোশন প্রিয়তমার বক্ষে মাথা রেখে আঙুল দিয়ে আঁকিবুঁকি করছে।
" এতটুকুই সহ্য করতে পারো না! কীভাবে বাকিটা সইবে সুন্দরী? "
মেহেক রোশনকে একপ্রকার ঠেলে সরিয়ে দিলো। দ্রুত শোয়া থেকে উঠে বসে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে বলে,
" ভালো হোন। ভালো হতে পয়সা লাগে না। "
" আদর লাগে.. বউদের আদর....."
মেহেক আর ছুটি পেলো না আজ। রোশনের ডাকে সাড়া না দিয়ে কী আর উপায় থাকে!
দুপুরের কড়া রোদে হাসফাস লাগছে সবার। সবুর হোসেন খাওয়াদাওয়া শেষে বাইরে চেয়ার পেতে বসেছেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এই রোদের মধ্যেও হুটহাট ঝিরিঝিরি বৃষ্টির আগমন ঘটছে। বর্ষাকাল সবুর হোসেনের জন্য বেদনাদায়ক। এই বর্ষায় এসেছিল কেউ তার জীবনে আবার এই বর্ষায়ই! সবুর হোসেন দূর আকাশে দৃষ্টিপাত করতেই সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল...
ঝুৃম বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। বন্ধুদের সাথে নৌকায় ঘুরতে বের হয়েছে রোজী। পলাশ, রোজী আর পায়েল ওঁরা তিনজন। সবাই অনার্স শেষ করেছে কেবল। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরি করা ওদের স্বভাব। সবাই রাজশাহীতে থাকে।
" ভাইয়া এই ছোটো নদীর ভেতরের রাস্তাটা কোথায় যায়? "
পলাশের প্রশ্নে কিছুটা ঘাবড়ে গেলো মাঝি কালাম। কিছুটা আমতা আমতা করে বললেন,
" ওইদিকে কেউ যায় না সচারাচর। শোনা যায় ওই জঙ্গলে ডাকাতদের বসবাস। "
ডাকাতের কথা শুনে ওরা তিনজন একসাথে হেসে উঠলো। রোজী কিছুটা হেসেই বললো,
" তাহলে চলুন তো, দেখি কেমন ডাকাতদের আস্তানা ওখানে! এই ছোটো জঙ্গলে আবার ডাকাত! "
কালাম প্রথম প্রথম রাজি না হলেও পরে মোটা টাকার কথা শুনে রাজি হয়ে যায়। বড়ো নদীর পথ রেখে সরু নদীর পথ ধরে মাঝি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা জঙ্গলে ঘেরা খালের মতো একটা জায়গায় এসে পৌঁছে। আচমকা গুলির আওয়াজে নড়েচড়ে ওঠে সবাই। কালাম কিছু না বলেই দ্রুত পানিতে ঝাপ দেয়। ওরা তিনজন ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে নৌকার ছাউনির নিচে বসে থাকে।
______________
" বস! বস!"
হঠাৎ শান্তর কণ্ঠস্বর শুনে নড়েচড়ে উঠেন সবুর হোসেন। কল্পনার জগতে হারিয়ে ছিলেন ভেবে নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি কথা বলতে লাগলেন।
" হ্যাঁ বল। "
" শুনলাম রোশন ভাই নাকি বিকেলে আশেপাশের কোনো গ্রামে মেলায় যাবে। "
" মেলা! কিন্তু যদি কোনো ঝামেলা হয়?"
" সেটাই তো ভাবছি।"
রোশনের বাবা একটু ভেবে শান্তকে বললেন,
" রোশন যখন যাবে ভেবেছে নিজের সেফটি বজায় রেখেই যাবে। তবুও লিমনকে নিয়ে তুইও চলে যাস না হয়। মেলাও দেখলি আর কোনো ঝামেলা হলেও সামলে নিবি।"
শান্ত মৃদু হেসে রাজি হলো সবুরের কথায়।
বিকেলের ম্লান রোদে মেহেক, রোশন, আহনাফ, মিষ্টি অটোরিকশায় করে মেলার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছে। উদ্দেশ্য সন্ধ্যার পরপর মেলায় ঢোকা। কারণ তখন আর কোনো দলের লোক কিংবা প্রশাসনের লোক রোশনকে খেয়াল করতে পারবে না। ড্রাইভারের সাথে বসেছে আহনাফ আর মিষ্টি, মেহেক আর রোশন পেছনের সিটে। দুপুরের খাওয়াদাওয়া মিষ্টিদের সাথে করেছিল আহনাফ। সত্যি বলতে এতবছর পর যে কাউকে বিয়ে করবে কখনো ভাবতেও পারেনি আহনাফ। কিন্তু সেই কাজটাই এখন করবে সে। এসব ভেবে একা একা মুচকি হাসছে সে।
" কী ব্যাপার আমাদের মিষ্টির আহনাফ স্যার? মুচকি মুচকি হাসছেন! তা-ও একা একা?"
রোশন হেসে হেসে বললো কথাটা। সামনের আয়নায় আহনাফের চেহারা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
" না মানে এমনি..."
মেহেক আর রোশন দু'জনেই আহনাফের অবস্থা দেখে হাসছে। মিষ্টিও লজ্জা পাচ্ছে। মাথা নিচু করে আছে সে।
" হ্যাঁ বুঝতে পেরেছি তো। সবই এ..ম..নি!"
রোশন লম্বা করে টেনে টেনে বললো শেষ কথাটা। এরমধ্যে গাড়ি থেমে গেলো। আশেপাশে নজর বুলিয়ে মেহেক বললো,
" আমরা এসে গেছি।"
সবাই একে একে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল। আহনাফ খুব করে চাইলেও রোশনই ভাড়া দিলো। মাগরিবের আজান হচ্ছে। মেলার গেটের মুখে দাঁড়িয়ে আছে সবাই।
" আমার বিশ্বাস হচ্ছে না আপু, এতগুলো বছর পর আবারো মেলায় এসেছি! "
মিষ্টির চোখেমুখে বিস্ময়ের ছিটে। আহনাফ আঁড়চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
" হ্যাঁ বোন। চল ভেতরে যাই। "
" হ্যাঁ চলো। "
চারজনে একসাথে মেলার ভেতর প্রবেশ করে। হাঁটতে হাঁটতে সিগারেট ফুঁকছে রোশন। আহনাফ আর মিষ্টি নিজেদের মধ্যে মেলার প্রসঙ্গে টুকটাক কথা বলছে। রোশন মেহেকের পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে সুযোগ বুঝে মেহেকের ডান হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে নিলো। মেহেক একবার ছাড়াতে চাইলেও ছাড়াতে পারছেনা।
" কী করছেন? ওরা আছে তো সাথে। "
" তাতে কী! আমার বউয়ের হাত আমি ধরেছি। তাছাড়া ওঁরা তো তোমার মতো আনরোমান্টিক না।"
রোশন সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বললো কথাটা। মেহেক চোখ পাকিয়ে তাকাতেই সিগারেটের অবশিষ্ট অংশটুকু মাটিতে ফেলে দিয়ে মিটিমিটি হেসে আবারো বলে রোশন,
" অমনি না তাকিয়ে বললেই তো হয়, আমার হট এন্ড হ্যান্ডসাম বর সিগারেট খেও না। "
" আপনি আপনার মুখটা বন্ধ করুন এবার। "
রোশন ঠোঁটে আঙুল চেপে হাঁটতে লাগলো। মেহেক ওর কাজকর্ম দেখে ফিক করে হেসে উঠতেই রোশনও হেসে উঠলো।
মেলায় ঢুকতেই মিষ্টি আর মেহেকের নজর পড়লো কাঁচের রঙবেরঙে চুড়ির দিকে। মিষ্টি একপ্রকার দৌড়ে গেলো দোকানের সামনে। আসলে একসাথে এতো চুড়ি এমনি বাজারের দোকানে দেখেনি কখনো।
" আপু এদিকে এসো। দেখো কী সুন্দর চুড়ি! "
মিষ্টির হাসি হাসি মুখখানার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আহনাফ। মেয়েটা কতটা প্রাণচঞ্চল। অথচ মাঝে মধ্যে আনমনে কীসব ভাবে। হয়তো পুরনো ক্ষত মনে পড়ে যায়! মেহেকও মিষ্টির পাশে গিয়ে বসলো। মাটিতেই হোগলা জাতীয় কিছুতে চুড়ি গুলো সাজিয়ে রাখা। দু'জনে চুড়ি দেখছে।
চলবে...........................