পর্ব ২৩
মৌরিন আহমেদ
.
.
.
নাস্তার ট্রে টা টেবিলের ওপর রাখলেন জোহরা বেগম। ট্রে থেকে পিরিচ আর হাফপ্লেট ক'টা টেবিলে রাখতে রাখতে আড়চোখে দেখতে লাগলেন সোফায় বসা মেয়েটাকে। সে একটা ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে পেজ উল্টাচ্ছিল। তাই হয় তো ওনাকে দেখে নি। উনি বেশ গভীর মনোযোগ দিয়ে ওর ম্যাগাজিন পড়ার ভঙ্গি লক্ষ্য করলেন। তার বসার ভঙ্গি। সর্বোপরি তার সৌন্দর্য্যে কোনো খুঁত আছে কি না সেটাই খুঁজে বের করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। মেয়েটার মুখাবয়ব, চেহারা সাধারণ বাংলাদেশিদের মতোন। কিন্তু গায়ের বর্ণ পুরোপুরি শেতাঙ্গ আমেরিকানদের মতো। চোখ দুটো টানাটানা, পাতলা ভ্রু। নাকটাও খাড়া। মুখে কোনো ব্রণের চিহ্ন নেই, একদম পরিষ্কার মুখশ্রী। তবে গাল দুটো লাল। চোখের মনি কালো, কিন্তু চুলগুলোতে হালকা খয়েরী রঙের ছোঁয়া আছে।
ভালো করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করলেন উনি। নাহ্, চোখে পড়ার মতো খুঁত নেই। এখন কথা বলে দেখতে হবে। মন-মানসিকতা, আচার-আচরণ, দৃষ্টি ভঙ্গি কী রকম। আর সবচেয়ে বড় কথা, এর বাংলা উচ্চারণ কেমন। বিদেশি মেয়ে বলে কথা! ভাষাই তো তার ক্ষেত্রে সব!
উনি ট্রে টা সাইডে রেখে মেয়েটার পাশে গিয়ে বসলেন। হাসি হাসি কন্ঠে প্রশ্ন করলেন,
- কেমন আছো তুমি?.. তুমি করে বললাম কিন্তু, কিছু মনে করো না...
মেয়েটা মিষ্টি করে হাসলো। হাতের ম্যাগাজিনটা বন্ধ করে মাথা নাড়লো,
- No, No. It's ok!.. আমি... ভালো... আছি। আপনি?
নাহ, উচ্চারণও খুব একটা খারাপ না। চলবে। তবে সমস্যা হলো 'ভালোর' 'ভ'কে উচ্চারণ করছে 'ব' দিয়ে। আর একটু খানি থেমে থেমে। উনি বললেন,
- ভালো আছি। তোমার নাম কি?
- আজমেরী খানম লতা।
মেয়েটা এই উচ্চারণ সম্পূর্ণ বাঙালিয়ানা ভাবে। তারমানে সে সবসময় এভাবেই বলে। শুধু বাংলা না বলার কারণে উচ্চারণ খারাপ। চেষ্টা করলেই ঠিক হয়ে যাবে। ভেবেই খুশি হয়ে উঠলেন। বললেন,
- তা তুমি কীসে পড়ছো?
- আমার লেখাপড়া শেষ।
যাক, আরও ভালো খবর! বিয়ে দিলে দেশেই রাখা যাবে। হঠাৎ কি যেন মনে পড়তেই বললেন,
- তোমার বাংলা ভালো লাগে? বাংলাদেশ?
- yea.. Bangladesh is a beautiful country. কানিজ আমাকে বলেছে এখানে অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে। আমি এখানে ঘুরতে চাই, কিছুদিন থাকতে চাই। I want to stay here for some days!
- সত্যিই এখানে এখানে থাকতে চাও? ঘুরতে চাও?
- Of course. I want to travel this country. I want to know about bangali culture. It's really attractive! I love this!
- তাহলে কোথায় কোথায় ঘুরেছ?
- এখনো কোথাও যাওয়া হয়ে ওঠে নি। কানিজ বলেছে.. তবে আগেরবার এসে ঢাকায় ঘুরে গিয়েছিলাম।
- ওহ্, আচ্ছা।
মাথা নাড়েন জোহরা। আগ্রহী সুরে বললেন,
- তুমি বিদেশে আছো ক' বছর? USA তে কোথায় থাকো?
- টেক্সাস। আমার জিজু টেক্সাস ইউনিভার্সিটি এর প্রফেসর। ওরা ওখানেই সেটেল। আর আমিও।.. দু' একবার দেশেও এসেছি..
- হুম।
মেয়েটা কফি খেতে থাকে। ওর সাথে বসে জোহরাও সঙ্গ দেন। কথায় কথায় জেনে নেন তার সম্পর্কে। এই মেয়েটাকে খুব পছন্দ হয়েছে তার! গত পাঁচবছরে তিনি এতো এতো মেয়ে দেখেছেন, এতো এতো খরচাপাতি করেছেন শুধু একটা ভালো পাত্রীর জন্য অথচ পান নি। আর আজ? যথেষ্ট সুন্দরী, শিক্ষিতা, বিদেশি একটা মেয়েকে বিনা খরচায় পেয়ে গেলেন? মেয়ে কি না নিজে এসে দর্শন দিয়ে গেল? ভেবেই খুশি খুশি লাগছে তার! কিন্তু সাথে ভয়ও হচ্ছে। মেয়েটা রাজি হবে তো? মেয়েটার বাবা-মা মানে কানিজের দাদা-দাদী নেই, গত হয়েছেন। ওদের দু' বোনের গার্ডিয়ান কানিজের বাবা। বিয়ের ব্যাপারে আলোচনা করতে হলে তার সাথেই কথা বলতে হবে। কিন্তু উনি রাজি হবেন তো?
আবার পাত্রী না হয় ঠিক করলেন, পাত্র ঠিক থাকবে তো? লেবুর যে মতিগতি, কী করে না করে কিছুই তো বোঝা যায় না। কাজ-টাজ না হয় নাই করলো, তার পিতার অগাধ সম্পত্তি তিন পুরুষ বসে খেতে পারবে কিন্তু বিয়ে? সেই যে লতিফা বানুর ভুত মাথায় চাপলো তারপর সে আর বিয়ের নামই নেয় না! ওদিকে লতিফা মেয়েটা তো দিব্যি বিয়ে-টিয়ে করে, ছেলেপুলে পালছে। তাহলে এর সমস্যা কোথায়?
যাক সেসব কথা! এই মেয়ে তার পছন্দ হয়েছে লেবু মানুক বা মানুক উনিই যথেষ্ট! মেয়ে আর মেয়ের পরিবার রাজি থাকলে বিয়ে উনি দিয়েই ছাড়বেন! হুঁ!
ভাবতে ভাবতেই ড্রইং রুমে কানিজকে আসতে দেখা গেল। ওর পিছে পিছে আসছে অনন্যা। ও এসেই হাসি মুখে লতাকে শুধালো,
- তা ফুপিন, কেমন দেখলে? আন্টির সাথে গল্প করেছ?.. উনি দারুন সব গল্প জানেন তাই না?
লতা নামের বিদেশিনী কন্যা প্রসন্ন হাসি হাসলেন। জোহরার দিকে তাকিয়ে বললেন,
- কানিজ, তোমার আন্টি কিন্তু অনেক ভালো। তাকে আমার খুবই ভালো লেগেছে!
- ওহ্, দ্যাটস গ্রেট!.. নাও, মিট মাই ফ্রেন্ড অনন্যা.. অনু, দিস ইজ মাই ফুপিন। লতা ফুপিন!
- আসসসালামু আলাইকুম।
মিষ্টি করে হেসে তাকে সালাম দিলো অনু। প্রতি উত্তরে উনিও খুব সুন্দর করে হাসলেন। সুন্দর শব্দ চয়নে জবাব দিলেন,
- ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছ?
তার কথা শুনে খানিকটা চমকে উঠলেন জোহরা। উনি তো ভেবেছিলেন বিদেশি কালচার রপ্তকৃত এই মেয়েটি ঠিক মতো সালামের জবাব দিতে জানে না। হয় তো অনুকে দেখে সৌজন্যতা রক্ষায় "হ্যালো" বা "হাই" বলবে। কিন্তু অনুর সালামের জবাব সে কতো চমৎকার করে দিলো! ধর্মজ্ঞান আছে নিশ্চয়!
চারজনে বসে গল্প করতে থাকে। সাথে খাবার হিসেবে থাকে জোহরা বেগমের হাতের স্বাদে গন্ধে অতুলনীয় পাঁকড়া!
নিজের ঘরে বসে বই পড়ছিলেন লেবু মামা। অনেক্ষণ ধরেই বাহিরের নানাবিধ শব্দ তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করছে, কাজে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। কয়েকটা নারী কণ্ঠস্বর ড্রইং রুম থেকে ভেসে আসছে। পরিচিত এবং অপরিচিত কণ্ঠের ভীড়! এ সময় আবার বাড়িতে কে এলো? কানিজ? হ্যাঁ, ওর কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে বটে তবে সাথে অপরিচিত আরেকটা স্বরও পাচ্ছে। এটা তবে কে?
- কী রে, কোনাচি বেগম কী খবর?
বলতে বলতেই এগিয়ে আসছিলেন উনি। হঠাৎ সেখানে বসে থাকা এক সুদর্শিনী কন্যাকে দেখে চোখ আটকে গেল তার। সে হাসি মুখে অনন্যার সাথে কি নিয়ে যেন কথা বলছে। অনুও বেশ গম্ভীর মনোযোগ দিয়ে সে কথা শুনছে। উনি যে কানিজকে কোনাচি বেগম বলে সম্বোধন করেছেন ব্যাপারটা বোধ হয় খেয়াল করলো না সে। বরং ওনাকে দেখে খুশিতে লাফিয়ে উঠলো,
- আরে মামু, তুমি?.. এসো.. এসো। এদিকে এসে বসো।..
উনি এগিয়ে এসে কানিজের পাশের সিঙ্গেল সোফাটায় গিয়ে বসলেন। তার মুখোমুখি অবস্হায় বসে আছেন জোহরা বেগম। কানিজের পাশে বিদেশিনী লতা আর পাশে অনন্যা।
লেবু মামাকে দেখে মনে মনে বেশ উচ্ছ্বাস বোধ করলেন জোহরা বেগম। লতাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
- পরিচিত হয়ে নাও।.. লেবু.. আমার ছোট ভাই।.. আর ও হচ্ছে লতা। কানিজের ছোট ফুপিন।
নিজের বড় বোনের কন্ঠে লেবু নামটা শুনে চমকে উঠলেন লেবু মামা। শেষমেষ তার নিজের বোনই তাকে এই নামে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে? এটা কেমন কথা? বিদেশী একটা মেয়ের সামনে এ কেমন সম্বোধন? মান ইজ্জতের ফালুদা হয়ে গেলো না?
- লেবু? ইউ মিন লেমন?
অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন লতা। কানিজ হঠাৎ লাফিয়ে উঠে বললো,
- ইয়া.. ইয়া.. শী মিনস দ্যাট!.. His actual name is Lebu but you can also call him "Lemon"!
- কোনাচি বেগম!
দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করে কানিজকে ডাকলেন লেবু মামা। কিন্তু সে পাত্তা দিলো না। বরং দাঁত কেলিয়ে সুন্দরী মেয়েটার সামনে তার নামে বানিয়ে বানিয়ে অনেক গল্প বলতে লাগলো। তার "লেবু" নামটা হওয়ার পেছনের গল্প এবং এ সম্বোধন করলে তার কী রিয়েকশন হয়, সেসব কথা মশলাপাতি মিশিয়ে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে হাস্যরসাত্মক করে উপস্থাপন করলো। সব শুনে মামা রেগেই আগুন! আর বিদেশিনী তো হেসেই খুন! ব্যাপারটায় ভীষণ অপমানিত বোধ করলেন উনি। ইচ্ছে করতে লাগলো এক চড়ে কানিজের কানের বাত্তি নাড়িয়ে দেন! কিন্তু সবার সামনে কিছু বলতে পারলেন না। শুধু বললেন,
- ওসব বাচ্চা-কাচ্চার কথা বিশ্বাস করবেন না! আপনি আমাকে লুৎফর বলেই ডাকবেন।
.
.
.
চলবে.......................