নীলাঞ্জনা ভাবল লোকটা অভ্র, সে হতভম্ব চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল। আকাশ দাঁড়িয়ে আছে, ফুলটা সে তানজুমের জন্য পাঠিয়েছে। মেয়েটি ভুল করে নীলকে দিয়েছিল। নীল হাত বাড়িয়ে ফুলটাকে এগিয়ে দিল তানজুমের দিকে। তারপর কাঁপা কাঁপা পায়ে হাঁটতে লাগল।
আকাশ ও তানজুম একে অপরকে ভালোবাসে। ওঁরা বিয়ের পরিকল্পনা করছে। তানজুমের সাথে আকাশের আলোচনার সময় নীল নিশ্চুপ বসে আছে, এক সপ্তাহ পর আকাশ তার বাবাও মাকে তানজুমের বাড়িতে নিয়ে যাবে।
আকাশ হুট করে বলল,
'শুন নীল।'
নীল সন্দিহান চোখে তাকিয়ে। আকাশ বলল,
'অভ্রর খবর পাওয়া গেছে, অভ্র গেছে ক্রোয়েশিয়ায়। ব্যাস একবার ফোন করেছিল আর এতটুকুই বলে।'
নীল একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল,
'সে ভালো আছে?'
'কথা বলার সুযোগ হয়নি। এরপর থেকে সে নম্বর বন্ধ করে দেয়।'
নীল হাঁপাচ্ছে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে, বলল,
'আমি বাড়ি যাচ্ছি। বুকে ব্যথা, আজ হাসপাতালে যাব। গতকাল এক্স-রে করেছি, আজ রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তার দেখাব।'
সন্ধ্যা ছয়টা বাজে। সূর্য ডুবে যাচ্ছে। চারদিকের আলো নিভে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। শরীর ও মন খুব ক্লান্ত লাগছে। শ্বাস নিতে পারছে না। দম বন্ধ করে একটা বড় শ্বাস ছাড়ল নীল। দূর থেকে কোলাহলের আওয়াজ বধির করে দিচ্ছে। নীল শুনছে তাকানোর আগ্রহ পেল না। নীল একটু নিচে গিয়ে হাঁটু ভিজিয়ে পানিতে বসল। তারপর হাত বাড়িয়ে এক কুশ জল নিয়ে তার মুখে ছিটিয়ে দিল। ডাক্তার রিপোর্ট দেখেছেন, আলহামদুলিল্লাহ শরীরে কোনো রোগ নেই। রোগ মনের, মন ক্লান্ত বলে মস্তিষ্কে অশান্তি। রাতজাগা ও ঠিক মতো না খাওয়ার জন্য এই সমস্যা দেখা দিচ্ছে, এখনই এর প্রতিকার না করলে ভবিষ্যৎ এ আর বাড়তে পারে। নীল হঠাৎ ঘাসের উপর শুয়ে পড়ল। চোখের কার্নিশ বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল, এরপর দুই ফোঁটা এইভাবে অনেকগুলো।
◩
দুই মাস পর।
আকাশ আর তানজুমের বিয়ে উপলক্ষে জসিম খান তার দোতলা বাড়িটি আবার রং করে মরিচবাতি দিয়ে সাজিয়েছেন। বাড়িটা যেন তার নতুন রূপ ফিরে পেয়েছে। এতদিন এই বাড়ি অন্ধকারের মতো লাগত, আজ হঠাৎ বাড়িটা তরতাজা বৃক্ষের মত প্রফুল্ল হয়ে উঠেছে। নারকেল গাছের ডালে দুটো পাখি দেখছে আর মিষ্টি সুরে ডাকছে।
নীল বাহিরে। বিয়ের কোলাহল তার ভালো লাগে না তাই বাড়ির পেছনের বাগানে বসে আছে। বেশ কিছু ফুলের গাছ আছে এদিকে, নীল বসে ফুলের শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে রয়েছে হঠাৎ দুটি প্রজাপতি ভালোবেসে ফুলের উপর দিয়ে উড়তে শুরু করল। নীল খুব খুশি হলো।
তানিয়া হন্ন হয়ে নীলকে খুঁজছে। সুমাইয়া বলল,
'তানি আপু, তুমি কি কাউকে খুঁজছ?'
'হ্যাঁ রে। তুই কি কোথাও নীল দেখছিস?'
একটু ভাবুক স্বভাবের সুমাইয়া। সে কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
'হ্যাঁ, নীলাপুকে আমাদের বাড়ির পেছনে যেতে দেখেছি।'
তানিয়া আর দেরি করল না। দৌড়ে বাড়ির পেছনে চলে গেল। তানিয়া চিৎকার করে বলল, 'নীল! অভ্র ভাই আসছেন।'
নীল ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে। ধরা গলায় বলল,
'কি?'
তানিয়া মুখোমুখি এসে থমকে দাঁড়াল। সে একটু ঝুঁকে বলল, 'অভ্র ভাই আসছেন, স্টেজে আকাশ ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলছে।'
নীল তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল। এক নিঃশ্বাসে ছুটে এল। সে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে অভ্রকে খুঁজতে লাগল। বিয়ের আসর থেকে বিদায় নিয়েছে অভ্র। সে কোনোভাবেই নীলের সামনে আসতে চায় না। আকাশ বলল অভ্র এইমাত্র বেরিয়েছে। নীল তাড়াতাড়ি দৌৃড়ে বেরিয়ে গেল। তানজুম বলল,
'নীল কোথায় খুঁজবে অভ্র ভাইকে? সে এয়ারপোর্টে যাচ্ছে, নীল তো তাকে খুঁজে পাবে না।'
আকাশ বলল,
'চলো গিয়ে নীলকে থামাই।'
আকাশ, তানজুম আর তানিয়া আর শুভ হুট করে বাসা থেকে বের হয়। বিয়ের পর বর-কনে রওনা হয়েছে দেখে লোকজনকে কানাকানি করতে লাগল। তারা বুঝতে পারছে না ওঁরা কোথায় গেল? আর কেন?
রাস্তায় বেরিয়ে নীল অভ্রকে খুঁজছে। শত শত গাড়ি ছুটে যাচ্ছে, এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল, নীল সব আবছা দেখছে। কর্কশ গলায় বলল অভ্র,
'নীল।'
নীলা কিছুক্ষণের জন্য থামল। সে ঘুরে অভ্রকে দেখে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এল। সে অভ্রকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। বিড়বিড় করে বলল,
'আমাকে ছেড়ে চলে গেলে কেন? এত কষ্ট দিলে কেন? তুমি কি বোঝ না তোমার শূন্যতায় আমি সব সময় ডুকরে মরি?'
অভ্র গম্ভীর গলায় বলল,
'আমি তোমার জন্য দেশে আসিনি। আর দেশ ছেড়ে তোমার জন্য যাযইনি। আমার কাজ এটা নীল, কখনো এদেশে, কখনো সে দেশে। আমি এক জায়গায় থাকতে পারি না। আমার জীবনের নিশ্চয়তা নেই। আমি কখন কোথায় যাবো তা নিশ্চিত নয়। আমার এই অনিশ্চিত জীবনে আমি তোমাকে জড়াতে পারি না। আমাকে ভুলে যাও।'
অভ্র খুব শান্ত ভঙ্গিতে তার কথা শেষ করল। নীলের চোখ দুটো অস্পষ্ট এবং অশ্রুসজল। যেন তার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। নীল ব্যথিত গলায় বলল,
'হঠাৎ কি হলো তোমার? এভাবে কথা বলছ কেন? আমি দুই মাস ধরে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। আমি তোমার সবকিছুর সঙ্গী হব। আমি সবসময় তোমার পাশে থাকব। তুমি যে দেশে যাও আমি সেখানেই যাব।'
অভ্র পিছিয়ে গেল। এখান থেকে পাঁচ মিনিট হাঁটলেই তার গাড়ি পাওয়া যাবে। গাড়ির উদ্দেশ্য চলতে শুরু করল।
নীল উঁচু গলায় বলল।,
'আমি তোমাকে ভালোবাসি অভ্র।
তুমি আমাকে নিঃস্ব রেখে যেতে পারবে না।
অভ্র, ফিরে আসো।'
নীল হাতের পিঠে চোখের জল মুছতে মুছতে ফুটপাত থেকে রাস্তায় হাঁটতে শুরু করল। যেন তার চোখ দিয়ে বৃষ্টি বয়ে যাচ্ছে, সামনের কোনো কিছু সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না। নীলের ডাকের সঙ্গে অভ্রর কানে বাজছে গাড়ি আর চারপাশের আওয়াজ। কিন্তু সে এগিয়ে যেতে লাগল। তানজুম বিভ্রান্তিতে দাঁড়িয়ে রইল। গগন কাঁপানো আর্তচিৎকার করে উঠল,
'নীল।'
অভ্র থেমে গেল। সে পেছন ফিরে দেখল, রাস্তার সব মানুষ এক জায়গায় নেমে এসে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। সেখান থেকে তানজুমের চিৎকার ভেসে আসছে। সাথে তানিয়ার প্রাণবন্ত কণ্ঠ।
তানিয়া উচ্চস্বরে বলল আশেপাশের লোকজনকে,
'আপনারা কি মজা দেখছেন? দয়া করে অ্যাম্বুলেন্স কল করুন।'
তানজুম নীলের গালে আঘাত করতে থাকে আর ডাকতে থাকে,
'নীল, এই নীল চোখ খুল। তোর কিছুই হবে না। চোখ খোল।' তানজুম কাঁদছে। আকাশ আর শুভ একটা গাড়ি থামানোর চেষ্টা করছে। কোনো গাড়ি থামছে না।
অভ্র নিশ্চল পায়ে এগিয়ে এল। অভ্র দুই হাতে ভিড় ঠেলে সামনে এলো। হঠাৎ বুকের মাঝখানে কিছু একটা খুব জোরে আঘাত করল তার। অভ্র হাঁটু গেড়ে বসল। তারপর কাঁপা হাতে নীলের গালে স্পর্শ করে। অভ্র ক্ষীণ গলায় বলল,
'নীল।'
নীল চোখ খুলে তাকাল। অভ্রকে দেখে মৃদু হাসে নীল। মৃদু স্বরে বলল,
'অভ্র, আমি তোমাকে অসম্ভব ভালোবাসি। আমি হারিয়ে যাচ্ছি, আমাকে রাখবে তোমার বুকে একবার? ও, অভ্র!'
অভ্র কিছু বলল না। দুই হাতে নীলকে বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখল। তারপর একটু সময় পর বলল,'
'নীল তোমার কিছুই হবে না। আমরা এখন হাসপাতালে যাব।'
অভ্র নীলকে কোলে তুলে নিল। ফুটপাতে দৌঁড়াতে লাগল। নীল আগের চেয়ে নরম গলায় বলল,
'অভ্র আমাকে নিচে নামাও, তোমাকে একটু দেখি।'
নীল শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। অভ্র স্থির হয়ে গেছে। নীলকে কোলে নিয়ে মাটিতে বসল সে। তার লাল রক্তিম চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল।
___
তপু মায়ের দিকে তাকায়। তানজুম কাঁদছে, তার গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। তপু এক হাতে মায়ের গাল মুছে বলল,
'মা, কেঁদো না। আল্লাহ ওপারে আমার আন্টি নীলকে ভালো রাখছেন।'
ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদল তানজুম। তপু জিজ্ঞেস করল,
'মা, আঙ্কেল অভ্র এখন কোথায়?'
তানজুম জোরে নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর বলল,
'সে মারা গেছেন।'
'আঙ্কেল অভ্র মারা গেছেন? কিভাবে?'
'জানি না বাবা, একদিন খবর এল তিনি আর নেই।'
তানজুম তপুকে তার বাসার একটি বন্ধ ঘরে নিয়ে যায়। তপু ছোটবেলা থেকে এই ঘরটা বন্ধ দেখেছে, তানজুম কখনো কাউকে এই ঘরে ঢুকতে দেয়নি। তপু অবাক চোখে রুমের ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। চার তরুণী অনেক স্টাইলে ছবি তোলেন। ছবিগুলো দেখে তপু বুঝল, বেশিরভাগ ছবি তোলা হয়েছে ফটো স্টুডিওতে। ছবির তিন তরুণীকে চিনতে পেরেছে তপু। চতুর্থ তরুণীর ছবি সামনে আসতেই হঠাৎ তার পা থেমে যায়। তপু মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
'মা, উনি কে?'
তানজুম বলল,
'তোমার নীল আন্টি।'
'নীল আন্টি এত সুন্দর ছিল আম্মু? তুমি তো গল্পে তার সৌন্দর্য বর্ণনা করোনি।'
তানজুম দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনে এগিয়ে গেল। ছেলের মাথায় হাত রেখে বলল,
'প্রত্যেক মানুষের একটি নির্দিষ্ট ব্যক্তিগত ব্যক্তি থাকে যে তার রূপের বর্ণনা সত্যিই উদ্দীপিত করতে পারে। নীলের সৌন্দর্য বর্ণনা করার ভাষা আমার কাছে নেই। তার কথা বলার ধরণ, তার মায়াবী চোখ, তার হাসি কেবল একজন ব্যক্তিই বর্ণনা করতে পারে। সে অভ্র।'
'আম্মু, নীল আন্টি অসম্ভব সুন্দরী ছিল। তাহলে আঙ্কেল অভ্র কেন তাকে ছেড়ে দিতে চাইলেন?'
তপুর প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলো না তানজুম। বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এই প্রশ্নের উত্তর তার নিজের কাছে নেই।
.
.
.
সমাপ্ত........................................