পর্ব ২৯
মৌরিন আহমেদ
.
.
.
চোখ খুলেই সবকিছু ঝাপসা দেখতে পায় অনন্যা। আচমকা এমন চোখ ধাঁধানো আলো সইতে পারে না, মুদে নেয় নেত্র। কিছুক্ষণ পর আবারও চোখ পিটপিট করতে করতে তাকায়। শিউরের কাছে বসে থাকা নিজের মা জোহরাকে দেখতে পায়। উনি চিন্তিত মুখে তাকিয়ে আছেন। অনন্যা মৃদু গলায় ডাকে,
- মা.. মা..
বলেই ওঠার চেষ্টা করে। মেয়ের কণ্ঠ কানে পৌঁছনোর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে তাকান জোহরা। ওকে উঠতে দেখে উদ্বেগে বলেন,
- ও কী করছিস?.. উঠছিস কেন?.. শুয়ে থাক, বলছি!
ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়া শুরু করেন। মায়ের আদেশে আবারও বালিশে মাথা এলিয়ে দেয় অনন্যা। এদিক ওদিক তাকিয়ে কী যেন বলার চেষ্টা করে,
- ম..মা.. আ.. আমার ফোন.. আমি..কল..দি..য়ে..
- জানি মা। ফোনটা হাত থেকে পড়ে গেছে। চিন্তা করিস না। তোর বাবা আজই আরেকটা কিনে এনে দেবে।.. তুই এখন চুপ করে শুয়ে থাক তো!.. আমার সোনা মা!
বলেই ওর মাথায় অনবরত হাত বুলিয়ে দিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করেন। অনন্যা কথাটা বলি বলি করেও বলতে পারলো না। মনের ভেতর চরম উৎকণ্ঠা কাজ করে। ধ্রুবের কথা মাকে জানাতে হবে। সব বলতে হবে। নয় তো ও কিছুতেই শান্তি পাবে না। আর এখন একমাত্র মাই পারেন ওকে শান্তি দিতে! মা কে সবটা বলে তার কোলে মাথা রেখে শান্তিতে ঘুমাতে চায় সে। কতো রাত ঘুমায় না, সেই অতৃপ্ত ঘুমটা ঘুমাতে চায়!
মাকে বলতে হবে, বলতেই হবে! অনন্যার উসখুস করা মুখখানি দেখে জোহরা কিছুটা আন্দাজ করে ফেললেন। কোমল কণ্ঠে বললেন,
- কী হয়েছে অনু? কিছু বলবি?
- মা!..
ভীষণ আবেগী কণ্ঠে ডাক দেয় সে। গা সরিয়ে মায়ের কোল ঘেঁষে মাথা রাখে। মা আহ্লাদী করে বলেন,
- কী মা?.. কী হয়েছে?... বল্, আমাকে...
- আ.. আমি.. একটা ছেলেকে.. ভা.. ভালোবাসি, মা।... খু.. খুব ভালোবাসি... ওর নাম...
- ধ্রুব!
ওর কথা শেষ করার আগেই বলে ওঠেন জোহরা। অনন্যা অবাক চোখে তাকাতেই আবারও বললেন,
- আমি জানি, অনু। কানিজ আমায় বলেছে...
অনন্যা নিস্পলক চোখে তাকায়। উদ্বেগে মুখ থেকে কথা সরে না। খুব ধীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
- তুমি রাগ করেছো?
- করলে করেছি সামান্য। এখন সেটা ভেবে লাভ আছে?
লজ্জিত ভঙ্গিতে চোখ ফিরিয়ে নেয় অনন্যা। উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভারী হয়ে আসা কন্ঠে উচ্চারন করেন,
- প্রেম ভালোবাসা অপরাধ নয়, অনু। কাউকে ভালোলাগতেই পারে। ভালোবাসতেও পারিস। কিন্তু অপাত্রে প্রেম ঢেলে দেয়ার পরিণতি কী হয় জানিস?... কানিজ আমাকে সবকিছু বলেছে। আমিই কায়দা করে শুনে নিয়েছি।.. তুই ধ্রুবকে ভালোবাসি, খুব ভালো কথা। কিন্তু মা, ও কী তোকে ভালোবাসে?.. তুই তো জানিস না। তাহলে...
- না মা, তুমি ভুল ভাবছো। ধ্রুব আমায় ভালোবাস। আর ভালবাসে বলেই আমাকে ওর নাম্বারটা দিয়ে গেছে!.. যেন আমি যোগাযোগ করি!..
- নাম্বার? কীসের নাম্বার?
- ওর সেলফোন নাম্বার। আমি কল করেছিলাম সেখানে.. কিন্তু..কিন্তু..
বলতে বলতেই গলা ধরে আসে ওর। জোহরা বিস্ময়ে মেয়ের দিকে তাকান। এ খবর তো কানিজ তাকে দেয় নি! অস্পষ্ট স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন,
- ও কলটা রিসিভ করেছিল?
দু' দিকে ঘন ঘন মাথা নাড়ায় অনন্যা। হঠাৎ উঠে বসে মায়ের কোমড় জড়িয়ে ধরে। কোলে মুখ গুঁজে দিতে দিতে বললো,
- নাম্বারটা বন্ধ! ও আমায় ভালোবাসলেও বোধ হয় কিছুই হবে না মা। আমি কখনো ওর খোঁজ পাবো না।
বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়ে অনন্যা। জোহরা ঠোঁট কামড়ে ওর দিকে তাকান। মেয়ের এমন কষ্ট তার সহ্য হয় না। তবুও তার কিছুই করার নেই! এটাই হয় তো অনুর নিয়তি! মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। খুব ধীর গলায় বললেন,
- যদি ও ফিরে না আসে, তাহলে ওকে ভুলে যা না, অনু!.. ওকে মনে রেখে কষ্ট কেন পাবি? ভুলে যা ওকে!
- আমি পারবো না মা। আমি পারবো না!.. ভালোবাসার পাঁচটি নীলপদ্মের পাঁচটিই তো তার হাতে! আমি কী করে ভুলবো তারে?
জোহরা যেন ভাষা হারিয়ে ফেলেন। কী বলবেন ভেবে পান না। শুধু অস্থির চিত্তে নিজের কোলের দিকে তাকালেন। মেয়েটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কান্নার দমকে দমকে কেঁপে উঠছে তার শরীর। তবুও থামছে না। ক্রমশ কেঁদেই চলেছে। ও একসময় মাথা তুলে জোহরার দিকে তাকিয়ে বললো,
- আমাকে তুমি ধ্রুবের কাছে পাঠিয়ে দাও না, মা। দাও না?.. আমি ওর কাছে যাবো। ওকে ছাড়া আমি বাঁচবো না। মা, প্লিজ! ওর কাছে যাবো!
সস্নেহে ওর মাথাটা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরেন জোহরা। কোমল গলায় বললেন,
- যাবো মা। নিশ্চয় যাবো। তুই শান্ত হ!.. শান্ত হ মা, প্লিজ!
মায়ের বুকে মাথা রেখে হিচকি তুলে কাঁদতে থাকে অনন্যা। মা শান্ত করার চেষ্টা করেন। ক্রমাগত সান্ত্বনার বাণী শোনাতে থাকেন। তবুও যদি কন্যা শান্তি পায়। স্বস্তি পায় একটু!
"আকাশের হাজার তারার ভীড়ে,
আমি খুঁজে ফিরি যারে,
হৃদয় হরণ করেছে আমার যে
মন ছুঁয়েছে সে আমার,
মন ছুঁয়েছে সে..."
[শব্দগুচ্ছ: মৌরিন আহমেদ]
_____________________________
বাইরে থেকে ফিরে আসা মাত্রই কটেজে ঢুকলো বর্ষণ। রুমে এসেই ফ্যানটা চালিয়ে দিলো ফুল স্পিডে। গা থেকে পাঞ্জাবিটা খুলে ছড়িয়ে দিলো বিছানার হেড সাইডে। তারপর ফ্যানের ঠিক নিচে এসে বিছানায় বসলো। দু' হাত দু' দিকে প্রসারিত করে চিৎপটাং হয়ে শুয়ে পড়লো সেখানে। উফ্! অনেক পরিশ্রম হয়েছে আজ! অনেক বেশি হাঁটা অনেক বেশি দৌড়াদৌড়ি! কিছুক্ষণ চুপ করে শুয়ে থাকতে হবে নয় তো ক্লান্ত শরীরে কিচ্ছুটি করতে পারবে না।
- মে আই কামিং স্যার?
কোনো পুরুষালি কন্ঠ শুনে দরজার দিকে তাকায় বর্ষণ। দেখতে পায় রিসোর্টের একটা লোক এসেছে। হাতে একটা ট্রে। সম্ভবত স্ন্যাকস। কিন্তু এ ভরদুপুর বেলায় স্ন্যাকস কেন? কিছুটা অবাক হয়েই ডাক দেয়,
- ইয়েস। কামিং...
ও উঠে বসতে বসতেই রুমে ঢোকে সার্ভিস ম্যান। ট্রে টা টেবিলের উপরে নামিয়ে রাখতে রাখতে বলে,
- স্যার, আপনার স্ন্যাকস।
- আপনাদের কী দুপুরবেলায় স্ন্যাকস দেয়ার রুলস আছে? এ দু'দিনে তো পেলাম না!
কথাটা শুনে কিছুটা থতমত খেয়ে যায় লোকটা। আমতা আমতা করে বললো,
- না.. নিয়ম.. না। কিন্তু আপনারাই তো অর্ডার করলেন। আমাকে তো সেটাই বলা হলো।..
- আমরা? মানে আমি? ভ্রু কুঁচকে যায় বর্ষণের।
- হ্যাঁ। আপনাদের কটেজে থেকেই তো ডাকা হলো।
হয় তো প্রদোষ ডেকেছে। ভাবলো বর্ষণ। ভ্রু জোড়া পুনরায় স্বাভাবিক করে বললো,
- ঠিক আছে। আপনি তাহলে রেখে যান।
- ওকে স্যার।
মাথা হেলিয়ে সায় জানায় লোকটা। তারপর খুব দ্রুতই চলে যায় সেখান থেকে। গায়ে একটা টিশার্ট জড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় বর্ষণ। প্রদোষের রুমে উঁকি দিয়ে বলে,
- কী রে, করছিস কী?
প্রদোষ ঢেকুর তুলতে তুলতে শোয়ার আয়োজন করছিল। ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
- একটু ঘুমাবো। তুই যে খাটানো টাই খাটালি!
- ঘুমাবি ভালো কথা। কিন্তু খাবার যে অর্ডার দিয়েছিস তার কী হবে? কে খাবে ওগুলো?
- খাবার? সে তো আমি মাত্রই খেলাম। আবার কীসের?
- খেয়েছিস?.. তাহলে...
- আবার দিয়ে গেছে?..
- হ্যাঁ।
- তা বেশ, খেয়ে নে। নয় তো আমার কাছে দিয়ে যা!..
প্রদোষের কথা শেষ করার আগেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় বর্ষণ। চিন্তায় কপালে ভাঁজ পড়ে আছে। ছুটে গিয়ে খাবারের কাছে এসে দাড়ায়। ঢাকনা তুলে দেখে নেয় কী কী দেয়া আছে। দুই বাটি চিকেন স্যুপ। প্রদোষ বলেছে ও খেয়েছে, মানে শুধু ওর জন্যই যদি পাঠায় তবে একবাটি পাঠাবে। দু' বাটি কেন?
সন্দেহের ভাঁজ কপালে আরও প্রগাঢ় হয়ে আসে। সচল মস্তিষ্কে তড়িৎ গতিতে খেলে যায় চিন্তাপ্রবাহ। আর কিছু ভাবতে পারে না ও। চটপট ওয়াসরুমে গিয়ে বাটি দুটো উপুড় করে। দুই বাটির স্যুপই ফেলে দেয়। নাহ্, এগুলো খাওয়ার রিস্ক নেয়া যাবে না কোনোভাবেই! বলা যায় না কখন কি হয়। বিপদ কোন দিক দিয়ে আসবে তা সে জানে না। তাই হুঁশিয়ার থাকতে হবে প্রতি মুহূর্তে!
_____________________________
আজও সাইট সিইংয়ে বেরিয়েছেন লেবু মামা আর লতা ফুপিন। একটা নৃ গোষ্ঠী গ্রামে ঘুরছেন। চারপাশে সব নৃ গোষ্ঠীর লোকেরা। বেশিরভাগই চাকমা। তাদের কাছ থেকে একসেট 'পিনোন-হাদি' কিনলেন লতা। আর মামা তাকে উপহার দিলেন নৃ গোষ্ঠীর লোকেদের তৈরি ছাতা। লাল রঙের ছাউনি দিয়ে তৈরি ভীষণ সুন্দর একটা ছাতা। বাঁশের তৈরি হাতল। ওটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিলেন লতা। মুখটা তার খুশির আমেজে ভরা। চোখের চাহনিতে উৎসুকতা। মামা প্রফুল্ল চিত্তে প্রশ্ন করলেন,
- জিনিসটা পছন্দ হয়েছে তো?
- হ্যাঁ, ভীষণ!
মাথা নাড়েন লতা। মামার দিকে তাকিয়ে বললেন,
- এর ডিজাইনটা খুব সুন্দর! পাহাড়ি পাহাড়ি একটা ভাব আছে। আর ওই ড্রেসটাও অন্যরকম। সত্যিই এদের কালচার খুব অ্যাট্রাক্টিভ!..
- ঠিকই বলেছেন আপনি। নৃ গোষ্ঠীর লোকেরা আছে বলেই বাংলা সংস্কৃতি আরও বেশি বৈচিত্র্যময়! আকর্ষণীয়... আচ্ছা, বেশ কিছুদিন তো হলো রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ঘুরলাম। এবার কোথায় যাবেন?
- ট্যাগোরের বাড়িটা আই মিন 'কুঠিবাড়ি' টা কোথায়? ওখানে কী যাওয়া যায়?
- শিলাইদহ কুঠিবাড়ি? ওটা তো কুষ্টিয়ায়। এখান থেকে অনেকদূরে। তবুও...
- যাওয়া যাবে না?
কেমন করুণ স্বরে জিজ্ঞাসা করেন লতা। মামা তাতে কিছুটা ভরকে গেলেন। ইনি এতো ট্যাগোর ট্যাগোর করেন কেন? আমতা আমতা করে বললেন,
- না মানে ওখানে গেলে কুয়াকাটা আর সুন্দরবন প্রজেক্ট তো মিস হয়ে যাবে! ওদিকে ঘুরতেও তো কম সে কম সাত আটদিন লাগবেই!..
- সুন্দরবন? ইউ মিন 'মানগ্রোভ ফরেস্ট'? ওখানে তো আমি না গেলেও হবে! আমি তো বন পছন্দ করি না।.. তারচেয়ে চলুন না কুষ্টিয়া যাই?
- কিন্তু.. কুয়াকাটা.. ওদিকটায় যাবেন না?
- না হয় নাই গেলাম। চলুন না?
অনেকটা বাচ্চাদের মতোই আবদার করে বসেন লতা। মামা না করার
চেষ্টা করেন, অনেক কথা ভাবেন। অথচ না করা আর হয়ে ওঠে না। মেয়েটা অনেকদিন পর দেশে এসেছেন। আবার কিছুদিন থেকে চলেও যাবেন। কিন্তু তার যে জায়গাগুলো দেখার ইচ্ছে ছিল সেগুলো না দেখতে পারলে সে আপসোস থাকবে সারাজীবন! লতার জেদ দেখে হার মেনে বললেন,
- তাহলে কবে যেতে চান আপনি?
- কাল অথবা পরশু? যাওয়া যাবে?
আগ্রহ ভরা চোখে প্রশ্ন করেন লতা। মামা কী যেন ভেবে নিয়ে বললেন,
- ঠিক আছে। বাস কাউন্টারে খোঁজ নিতে হবে কবেকার টিকেট পাই...
- ঠিক আছে, আমি রেডি হয়ে থাকবো!
সানন্দে সায় জানান লতা।
.
.
.
চলবে......................