মন ছুঁয়েছে সে - পর্ব ১৭ - মৌরিন আহমেদ - ধারাবাহিক গল্প

মন ছুঁয়েছে সে 
পর্ব ১৭ 
মৌরিন আহমেদ 
.
.
.
স্যার চলে যেতেই ক্লাস ছেড়ে বেরিয়ে এলো অনন্যা। ওর পিছু পিছু ব্যাগ হাতে ছুটলো কানিজও। আজ ক্লাস করতে ভালো লাগছে না। ভিতরে ভিতরে কেমন যেন অস্থির একটা ভাব! কানিজ ব্যাপারটা আন্দাজ করে। তাই বন্ধুকে সঙ্গ দিতে নিজেও বেরিয়ে আসে।

ক্যান্টিনে বসে আছে ওরা। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে চলছে অন্যমনস্ক কথাবার্তা। গল্পগুলো এখন ছন্নছাড়া, তাল-লয়হীন। কারণ তাতে কারোরই বিশেষ মনোযোগ নেই। অনন্যা আপনমনে কি যেন ভাবছে। ওকে ফেখে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না আসল ব্যাপারটা কি। তবে ধারণা করছে আজ ওর কোনকিছুতেই মন নেই! টুকটাক কথা বলতে বলতে, আজ কথাও ফুরিয়ে এলো! মনে মনে অবাক হলো দুজনেই। কই আগে তো কখনো এমন হয় নি! দুজনে সামনাসামনি বসে চা খাচ্ছে, অথচ কারো মুখে কোনো কথা নেই? বন্ধু হৃদয়ের হাজারও কথামালা কী এতো তাড়াতাড়িই কখনো শেষ হয়ে যায়?

অনন্যা একদৃষ্টিতে কাপের দিকে তাকিয়ে আছে। কাপ থেকে লিকারের কড়া গন্ধ ভেসে ভেসে আসছে। গরম বাষ্প উড়ে যাচ্ছে কাপের মুখ থেকে। ওর দৃষ্টি ওখানেই নিবদ্ধ!

কানিজ তার ঠিক সামনের চেয়ারটায় চুপ করে বসে আছে। আশেপাশের গাছপালা দেখছে। গাছে গাছে সবুজ পাতা দেখে বড়োই বিমোহিত হচ্ছে সে। কতো সুন্দর এ নিসর্গ! আশ্চর্য তার জীবন চক্র! প্রতিটা পরতে পরতে মিশে আছে অপূর্ব সৌন্দর্য! কানিজ দৃষ্টি সরিয়ে আকাশ দেখে। আজ আকাশটা বড্ডো সুন্দর! নীল আকাশে কেমন পেজা তুলো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। প্রকৃতির প্রাণবন্ত- আকর্ষণীয় রূপে মন ছুঁয়ে যায় ওর! ভালো লেগে যায় সবকিছু!

ভার্সিটির সেই নীরব নিভৃত পরিবেশে হঠাৎ করেই সৃষ্টি হয় কোলাহলের। লোকজনের কথাবার্তায় সরব হয়ে উঠলো আশপাশ। ওরা চকিত দৃষ্টিতে চারপাশে তাকায়। হঠাৎ কী হলো বুঝতে চেষ্টা করে। দেখে ওদের ঠিক পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা চলে গেছে তা ধরে এগিয়ে আসছে একটা গাড়ি। কুচকুচে কালো রঙের। শুধু একটা নয়, বেশ কয়েকটা। 

দেখতে দেখতেই সাঁই সাঁই করে গাড়িগুলো অতিক্রম করে ফেলে ওদের। গিয়ে থামে আরেকটু দূরে, ক্যান্টিনের অন্য প্রান্তে। অনন্যা কৌতূহলী হয়ে চেয়ে থাকে। গাড়িগুলোর কুচকুচে কালো শরীরের মাঝে হলদেটে দাগ। হলদে ছাপের মধ্যে এক সাইডে বড় করে লেখা RAB-13। পাশেই সংস্থার একটা লোগোও চোখে পড়লো। 

গাড়ির পেছন থেকে নেমে আসে বেশ কয়েকজন স্বশস্ত্র সৈনিক। সারা শরীর যাদের কালো পোশাকে আবৃত। সেইফটি জ্যাকেটের বুকের দিকটায় সাদা অক্ষরে লেখা RAB। পোশাক-আশাক দেখেই তাদের পরিচয়টা মোটামুটি ধরে ফেলে সবাই। কেউ আর বাধা দেয় না তাদের। কিন্তু ভার্সিটিতে। তাদের কী কাজ, সেটা বুঝতে পারে না অনেকেই। অবাক চোখে দেখতে থাকে তাদের প্রত্যেকটি কার্যক্রম।

খট খট শব্দ তোলে অনেকগুলো বুট জুতো। RAB এর লোকেরা ছুটে গিয়ে হামলা চালায় ক্যান্টিনের অপর প্রান্তে। সেখানে বসে আয়েশ করে সিগারেট ফুঁকছিল ইফতি আর তার দলবল। হৈ হুল্লোর করে বিশৃঙ্খলাও সৃষ্টি করছিল। আশেপাশের খেয়াল নেই। তারা চলে নিজের মতো। তাদের কী আর কে কি করলো সেটা দেখার সময় আছে? তাই RAPID ACTION BATTALION এর রেপিড একশনের কথাও জানতো না তারা। হুট করে এসেই ধরে ফেলে ওরা। তাদের দেখে দলের অন্যরা ঘাবড়ে গেলেও একটুও ভয় পায় না ইফতি। বরং এই কালো পোশাকধারীরা যেন তার বন্ধু এমন ভঙ্গিতে কিছু একটা বলার চেষ্টা করে। সে মোটামুটি ভালোই জানতো তার গায়ে হাত দেয়ার সাহস কারো নেই। সে Rab-police যাই হোক! কিন্তু ওরা সুযোগ দেয় না। সব ক'টাকে সসম্মানে গাড়িতে নিয়ে গিয়ে তোলে। কেউ আর কিচ্ছুটি বলার সুযোগ পায় না!

প্রায় একইসাথে ওদিকে আরও একটা ঘটনা ঘটে যায়। অনন্যাদের ডিপার্টমেন্টের একজন প্রফেসরের উপরও হামলা চালায় RAB বাহিনী। লোকটা নাকি ভার্সিটি এরিয়ায় ড্রাগস সেল করতেন। স্টুডেন্টদের মধ্যে নাকি হেরোইন আর ইয়াবা ছড়াতেন তিনি! ব্যাপারটা শুনেই হতভম্ভ হয়ে যায় অনন্যা- কানিজ। নির্বাক দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে তাকায়। চারদিকে কি হচ্ছে বিষয়গুলো এখনো মাথায় ঢোকে না ওদের! ভার্সিটির একজন স্যার ইয়াবা সেল করতেন? তাও আবার ওদের ভার্সিটির, ওদের ডিপার্টমেন্টের?

দেখতে দেখতেই ইফতিদের আর ওই প্রফেসরকে ধরে এনে গাড়িতে তোলা হলো। হাতে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে চারপাশে র ্যাবেরলোকদের কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা দিয়ে তাদের নিয়ে যাওয়া হলো। আবারও আগের মতো সাঁই সাঁই করে মুহূর্তেই চোখের সামন থেকে বিলীন হয়ে গেল সেগুলো।

খানিকক্ষণের মধ্যেই পরিবেশটা আবারও আগের মত হয়ে উঠল। কিন্তু অনন্যার মনের অস্থিরতা আর কাটলো না। কাল থেকে কী যেন হয়েছে চারপাশে। সকাল সকাল হঠাৎ বস্তিতে রেট পড়া আর এখন ভার্সিটিতে.. সব কেমন যেন অস্বাভাবিক লাগছে ওর কাছে।

এরপর আর কোনো ক্লাস হলো না। অনু আর কানিজ দুজনেই বিরস মুখে বাড়ি ফিরে এলো।

____________________________________

ড্রইংরুমে বসে একটা ম্যাগাজিন পড়ছিল ধ্রুব। ওর চারপাশে কয়েকটা বই ছড়ানো। টি- টেবিলের উপরে গাদা করে রাখা কয়েকটা বই আর সোফার উপর কয়েকটা খুলে রাখা বই। সবেরই ছন্নছাড়া দশা! কিন্তু এ নিয়ে তার মাথাব্যাথা নেই। মন-মস্তিষ্ক এখন হাতের ম্যাগাজিনের ভেতর। গভীর মনোযোগের সাথে ওটা পড়ায় ব্যস্ত!

হঠাৎ তার নিবিষ্ট চিত্তে জ্ঞান অর্জনে ছেদ ঘটিয়ে দিলো ফ্ল্যাটের কলিংবেল। একবার, দু'বার, তিন বার। পরপর তিনবার বেল বেজে তবেই থামলো সেটা। প্রথমবার বেলের শব্দ শুনে বিরক্ত হয়েছিল ধ্রুব। ভ্রু কুটি করে দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখে নিল। রাত এগারোটা তেপ্পান। এতো রাতে হঠাৎ কে এলো সেটা বুঝতে খুব একটা সময় লাগলো না ওর। মাথা হেলিয়ে ড্রইংরুমের দিকে তাকিয়ে দেখলো করিম চাচার সাড়া পাওয়া যায় কি না। নাহ, কোনো টু শব্দটি নেই। চাচা নিশ্চয়ই ঘুমোচ্ছেন। 

ধ্রুব উঠে দিয়ে দরজার কাছে এলো। জানে ওপাশে কেউ নেই, তবুও একবার দরজাটা খুললো। কেউ নেই দেখে নিশ্চিন্ত মনে প্রয়োজনীয় জিনিসটা খুঁজলো। খুব দ্রুত পেয়েও গেল। আগের মতই ফটকের চিপায় স্থান পেয়েছে সেটা। কাগজটা হাতে তুলে নেয় সে।

চিঠিটা পড়ে হঠাৎ অনুভূতি শূন্য হয়ে যায় ও। কি করতে হবে সেটা ভাবতে পারে না। কিন্তু নিজের বিমূঢ়তা খুব দ্রুতই কাটিয়ে ওঠে। সংবিৎ ফিরে পেলেই বুঝতে পারে এখানকার কাজ শেষ হয়েছে তার। কাজের পাঠ চুকিয়ে দিয়ে চলে যেতে হবে আবার আগের জায়গায়। সেখান থেকে আবার নতুন কোনো স্থানে। এইভাবেই তো চলছে ওর জীবন! ও অবশ্য তাতে বিরক্ত হয় না। বরং নতুন নতুন জায়গায় গিয়ে আনন্দই পায়। তবুও মাঝে মাঝে হতাশা গ্রাস করে ওকে। কাছের কেউ নেই বলে কোথাও থিতু হতে পারে না ও। তাই চলছে তার গৎবাঁধা জীবন! বেদেদের মত এ ঘাট থেকে ও ঘাট যাতায়াত!

হঠাৎ কি যেন ভাবে ও। যতদ্রুত সম্ভব ফিরে যাওয়ার আদেশ আছে ওর ওপর। একবার চলে গেলে এখানে আর আসতে পারবে কি না সেটা জানে না ও। হয় তো কখনো আসবে, হয় তো না! হঠাৎ অনন্যার কথা মনে পড়ে যায় ওর। ওই পাগলী মেয়েটাকে কেন যেন হঠাৎ করেই দেখতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছেটাকে দমাতে চায় কিন্তু পারে না!

'পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ কে? যার কাছে ঘুম আনন্দময়!' কথাটা কোনো বিখ্যাত ব্যক্তি বলেছিলেন হয় তো। কারণ বিখ্যাত মানুষদের কথাগুলোই সাধারণত আমরা সাধারণ মানুষেরা মনে রাখি। সাধারণের কেউ রাখে না!

অনন্যা ঘুমিয়ে আছে। পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষের মতো করে ঘুমাচ্ছে। বাইরের জগতের কোনো কিছুই এখন তার মস্তিষ্কের ভেতর ঢুকছে না। তাই তার ঘরের ভিতর যে অন্য এক ব্যক্তির অনুপ্রবেশ ঘটেছে তা সে জানে না। বুঝতে পারছে না।

অনুপ্রবেশ কারী ব্যক্তিটি তার পাঁচতলার দুরত্বটা একটু বেশি হয়ে গেলেও তার কাছে এখন অনন্যার ঘুমন্ত মুখটা দেখার ইচ্ছে অনেক বেশি! তাই উঁচু থেকে পড়ে গিয়ে মরে যাবার চান্স থাকা সত্ত্বেও সে এখানে এসেছে। কারণ এরপর আর তার জীবনে এই ঘুমকুমারীর দেখা সে পাবে কি না সে জানে না!

ধ্রুবের অনুপস্থিতিতে অনন্যা ওকে কীভাবে খুঁজবে, খুঁজে না পেয়ে কী করবে সেটা জানার খুব ইচ্ছা ওর। আরও ক'টা দিন থাকতে পারলে বেশ হতো। এই মেয়েটার মনের খবর জানা যেত। কিন্তু তা আর হলো কই? চলেই তো যেতে হচ্ছে!
.
.
.
চলবে.........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন