অন্ধবাড়ি
পর্ব ০২
আতিয়া আদিবা
.
.
.
রাইসা পতিতালয়ের সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মুখে হালকা মেক'আপ। পড়নে মখমলের শাড়ি। দেহের প্রতিটি ভাঁজ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। বেশ কয়েকটি লোক বিপরীতের টং এর দোকানে বসে চা খাচ্ছে আর একটু পর পর রাইসার দিকে তাঁকিয়ে কুৎসিত হাসি দিচ্ছে। প্রথম দিকে এসব রাইসা একদম সহ্য করতে পারতো না। এখন সয়ে গেছে। হঠাৎ একটি দামী গাড়ী এসে পতিতালয়ের সামনে থামলো। ভেতোরে কে আছে তা দেখা যাচ্ছে না। গাড়িতে কালো গ্লাস লাগানো। গাড়ির সামনের দরজা খুলে একজন অল্প বয়স্ক ছেলে বের হয়ে এলো। শরীর একদম কাঠির মতন চিকন। যেনো বাতাসে উড়ে যাবে। একথা মনে হতেই রাইসা মুখ চাপিয়ে বেশ কিছুক্ষণ হেসে নিলো। চিকন ছেলেটি এদিক ওদিক তাঁকিয়ে কাকে যেনো খুঁজতে লাগলো। তারপর নিরূপায় হয়ে রাইসার সামনে এসে জিজ্ঞাসা করলো,
" মিস জরিনা কি এখানে থাকেন?"
রাইসা উদাস কন্ঠে বললো,
" মিস নয়। মিসেস জরিনা। উনি বিবাহিত। এ পর্যন্ত তিনটি বিয়ে করেছেন।"
ছেলেটি অপ্রস্তুত হয়ে বললো,
" দুঃখিত। আমি বুঝতে পারিনি।"
রাইসা আবার হেসে ফেললো।
"জ্বি এখানেই থাকে। ভেতোরে যান।"
ছেলেটি পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছলো। রাইসার দিকে তাঁকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করে হনহন করে পতিতালয়ের ভেতর ঢুকলো। ছেলেটি ভেতোরে চলে যাওয়ার পর রাইসা আবার মুখ চেপে হাসতে শুরু করলো।
জরিনা মুখভর্তি পান চিবোচ্ছে। তার সামনে রাজু দাঁড়িয়ে আছে। জরিনা ইশারায় বসতে বললো। রাজু অস্বস্তি নিয়ে জরিনার সামনে বসলো। পানের পিচকি ফেলে জরিনা বললো,
" তুমি আফজাল স্যার পিএ না?"
" জ্বি আপা।"
" হুম চিনছি। তা স্যার কেমন আছেন?"
" শরীরের অবস্থা খুব একটা ভালো না।"
" এখন কি স্যারের বডি ম্যাসাজ এর মেয়ে লাগবে?"
" না আসলে বিষয়টা তা নয়। স্যারের ভয়ংকর একটি রোগ ধরা পরেছে।"
" কি রোগ?"
রাজু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জরিনাকে সব খুলে বললো। সবকিছু শুনে জরিনা কপাল কুঁচকে বসে রইলো। পানের ডালা থেকে নতুন একটি বানানো পান মুখে পুরতে পুরতে বললো,
" দেখো বাছা! আমি খারাপ। বহুত খারাপ। কিন্তু অমানুষ না। আমি জেনে বুঝে আমার মেয়েদের সাথে এই অন্যায় করতে পারবো না। তুমি অন্য কোথাও দেখো গিয়া।"
রাজু অনুনয়ের সুরে বললো,
" কিন্তু স্যার অনেক আশা করে আপনার কাছে পাঠিয়েছে। উনার বিশ্বাস আপনি উনার শেষ ইচ্ছা পূরণ করবেন।"
" এতদিন আফজাল স্যারের কোনো কথা আমি ফেলি নাই। যখন যারে চাইছে তার খেদমতের জন্য পাঠায়ে দিছি। কিন্তু এখন আর সম্ভব না। এই অবিচার আমি করতে পারতাম না।"
" আপনি যত টাকা চাইবেন। স্যার দিবে। প্রয়োজনে খালি চেক আপনার হাতে দেওয়া হবে। আপনি তাতে টাকার অংক বসিয়ে নিবেন।"
জরিনা আঙুলে লেগে থাকা চুন দাঁতে লাগাতে লাগাতে বললো,
" ঠিকাছে। আমি চিন্তা করে দেখি। কেউ যদি রাজি হয় তাহলে জানাবো।"
রাজু ইতস্তত করে বললো,
" আসলে স্যারের বিশেষ পচ্ছন্দ আছে।"
জরিনা ভ্রু কুঁচকে বললো,
" মানে?"
" আপনাদের এখানে রাইসা নামের যে মেয়েটা আছে স্যারের সেই মেয়েটাকে পচ্ছন্দ।"
জরিনা পান চাবানো বাদ দিয়ে হা করে রাজুর দিকে তাঁকিয়ে রইলো। উত্তরে সে কি বলবে বুঝতে পারলো না। রাজু মাথা নিচু করে বসে রইলো। চারিদিক থেকে অদ্ভুত অদ্ভুত সব আওয়াজ আসছে। মেয়েদের হাসির শব্দ। কেউ কেউ আবার গলা ছেড়ে অশ্লীল গান গাইছে। চাপা আর্তনাদও শোনা যাচ্ছে। এই আর্তনাদ কষ্টের নয়। রাজুর মনে হচ্ছে সে আর কিছুক্ষণ এই জায়গায় থাকলে দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে।
রুপসা রাইসার ঘরে বসে আছে। সারারাত তার ঘুম হয়নি। ডুকরে ডুকরে কেঁদেছে। রাইসার কোনো কথাতেই তার মনে হয় নি এই জায়গা থেকে ছাড়া পাওয়ার কোনো উপায় আছে। কিছুক্ষণ আগে মোরসালিন এসেছিলো। খুবই অশ্লীল ধরনের একটি পোশাক দিয়ে গিয়েছে। এই পোশাক পরে তাকে জরিনার ঘরে যেতে বলা হয়েছে। রুপসার পোশাকটি ছুঁয়েও দেখছে না। সে একমনে আকাশের দিকে তাঁকিয়ে আছে। হঠাৎ কারো বাজখাঁই গলার স্বরে রুপসা চমকে উঠলো। পেছোন ফিরে তাঁকাতেই দেখে জরিনা দাঁড়িয়ে আছে। রুপসা ভয়ার্ত চোখে তাঁকিয়ে রইলো।
"মোরসালিন জামা দিয়ে গেছে কখন?"
কাঁপা গলায় রুপসা বললো,
"আধ ঘন্টা আগে।"
" জামা পইড়া আমার ঘরে আসার কথা ছিলো না?"
রুপসা চুপ করে রইলো। জরিনা এগিয়ে এসে হ্যাঁচকা টান দিয়ে রুপসাকে বসা থেকে দাঁড়া করালো। বিছানা থেকে পোশাকটি হাতে নিয়ে রুপসার হাতে দিয়ে বললো,
"এটা পরে আমার ঘরে আসবি। দশ মিনিট সময় দিলাম। নইলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।"
জরিনা রাইসার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। রুপসার চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে। সে জামা পালটে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তাকে অন্যরকম লাগছে। একদম অন্যরকম। অন্য সব মেয়েদের মতো লাগছে না। তাকে সেই মেয়েদের মতো লাগছে যারা সমাজে ঘৃণিত। যাদের পেশা সমাজের কলঙ্ক। যাদের আলাদা কোনো নাম নেই, সবাই একটা নামেই চিনে। আর সেই নাম অত্যন্ত জনপ্রিয় গালির তালিকায়!
.
.
.
চলবে........................