মন ছুঁয়েছে সে - পর্ব ৩৮ - মৌরিন আহমেদ - ধারাবাহিক গল্প

মন ছুঁয়েছে সে 
পর্ব ৩৮ 
মৌরিন আহমেদ 
.
.
.
পরদিন বেশ সকাল সকালই ধ্রুবকে দেখা যায় অনন্যাদের কটেজের সামনে। ও এসেই অনন্যাকে ডাকলো। অনন্যা তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। স্বপ্নের ধোঁয়াশায় দেখছে ধ্রুব নামের প্রেমিক পুরুষের সুদর্শন চেহারা! দরজা খুলে বেরিয়ে এলো কানিজ। ধ্রুবকে দেখেই কুঁচকে গেল তার সুন্দর ভ্রু জোড়া। বিরক্ত হয়ে বললো,

 - "আপনি এখানে? এই সাতসকালে? কী মনে করে?"

- "আপনার বান্ধুবীর কাছে এসেছি, মিস. কানিজ। ওকে একটু ডেকে দিন তো!"

ধ্রুবের সহজ ভঙ্গিমার সহজ উত্তর শুনে আরও যেন বিরক্ত হলো কানিজ। ছেলের সাহস তো কম না! কাল রাতে ওর সাথে এতো বড় বাটপারি করে আজ কোন সাহসে এখানে এসেছে? মা গো, মা! কাল কী ভয়টাই না পেয়েছিল! অনন্যার আসতে আরেকটু দেরি হলেই তো বেচারি হার্ট এ্যাটাক করতো!

 - "কেন? ওকে আপনার কী দরকার?"

 - "একজন প্রেমিক তার প্রেমিকার সঙ্গে কেন দেখা করতে চায় তা কী জানেন না, মিস. শ্যালিকা? নাকি আরও ভেঙে ভেঙে শোনার ইচ্ছে?.. আপনি তো দুষ্টু কম না!"

ওর কথা শুনে রাগে গা চিড়বিড় করে উঠলো কানিজের। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

 - "খবরদার মি. ধ্রুব! আমার সাথে ফাজলামো করতে আসবেন না!.. আমি অনুর মতো বোকা নই যে আপনার ফাজলামো মার্কা কথা শুনে প্রেমে পড়ে যাবো।..."

কানিজ দাঁত কটমট করে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু ওকে থামিয়ে দিয়েই কথা বলে উঠলো ধ্রুব। ভ্রু নাচিয়ে নাচিয়ে ফাজলামোর মাত্রা যেন আরও একধাপ বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

 - "সে কী মিস. শ্যালিকা! আপনার বান্ধুবী যার প্রেমে পড়েছে তার প্রেমে কেন আপনি পড়বেন?.. আমি তো আপনাকে দুষ্টু ভেবেছিলাম কিন্তু আপনি তো দেখি মহা দুষ্টু!"

 - "জাস্ট শাট আপ! একদম উল্টাপাল্টা কথা বলবেন না, বলছি!.. আর কীসের শ্যালিকা হ্যাঁ? অনু কী আপনাকে বিয়ে করেছে? যে আপনি আমাকে শ্যালিকা বলছেন?.."

 - "করে নি কিন্তু করতে কতক্ষণ? আজ না হোক কাল তো বিয়ে করেই ফেলবো। তাহলে আগে থেকেই প্রাকটিস করে রাখা ভালো না?"

 -" ইসস, শখ কতো! শুনুন, মি... ওসব আলগা স্বপ্ন দেখা বাদ দিন! অনুর মাথা এখনও এতো খারাপ হয়ে যায় নি যে আপনার মতো ফাউল-ভ্যাগাবন্ড ছেলেকে বিয়ে করতে যাবে! আর আমি থাকতে ওর সে দুর্গতি হতেও দিচ্ছি না।.. সো গেট আউট ফ্রম হিয়ার!.. নেক্সট টাইম অনুর সামনেও আসার চেষ্টা করবেন না!"

বলেই হাত দেখিয়ে ওকে চলে যাওয়ার ইশারা করলো কানিজ। ধ্রুবর তাতে বিশেষ হেলদোল কিছু হলো না। ঠোঁট কামড়ে বাঁকা হাসি দিলো। স্পষ্টতই সেখানে ওকে তাচ্ছিল্যের প্রয়াস ছিল। কানিজ ব্যাপারটা পাত্তা দিলো না। ওর চলে যাওয়ার অপেক্ষা করতে লাগলো। ধ্রুব হাসি থামিয়ে বললো,

 - "আমাকে চলে যেতে বলছেন কিন্তু আপনি জানেন কী, আমি চলে গেলে মিস. অনামিকার কী হবে? সে কী থাকতে পারবে আমাকে ছাড়া?"

 - "কেন পারবে না? একবার চলে যান নি আপনি? তখন কী ও বেঁচে ছিল না? নাকি পাগল হয়ে গিয়েছিল? আর যদিও বা হয় তখন তো আপনি কোনো খোঁজ নেন নি, তাহলে এখন আবার দরদ উছলে পড়ছে কেন?"

হঠাৎ তেঁতে ওঠে কানিজ। চোখ মুখ খিঁচিয়ে তাকিয়ে থাকে ধ্রুবের দিকে। ও এখন শুনতে চায়, ওর কথার প্রতি উত্তরে এই অসহ্য ছেলেটা কী বলে! এতোদিন অনুর কোনো খোঁজ ছিল না, কোনরকম যোগাযোগ ছিল না। যেই না কাল ওর সাথে দেখা হলো অমনি পিরীত একেবারে উথলে উথলে উঠছে? এলো আমার রোমিও-জুলিয়েট রে!

 - "আপনি বোধ হয়, আমাকে খুব বেশিই অপছন্দ করেন, রাইট? সে জন্য প্রতিটা কথায় এমন চেতে চেতে উঠছেন!.. যাই হোক, শুনুন, কানিজ। এর আগে অনুর সাথে আমার কোনো রকমের সম্পর্ক কিংবা লেনাদেনা ছিল না। না ছিল প্রেম। ও হয় তো আমাকে পছন্দ করতো, আমিও হয় তো করতাম কিন্তু পরিস্থিতির কাছে দায়বদ্ধ ছিলাম আমি।..."

 -"এখন কী পরিস্থিতি বদলে গেছে?"

ভ্রু তুলে প্রশ্ন ছোঁড়ে কানিজ। ধ্রুব একটা শ্বাস ফেলে। এতক্ষণে কিছুটা সিরিয়াস লাগছে ওকে। সাথে খানিকটা বিরক্তও। বললো,

 - "মিথ্যে বলবো না। সত্যিই আমার বর্তমান পরিস্থিতি খুব একটা ভালো না। আর কখনো এরচেয়ে ভালো হবেও না। এখন যেমন আছি, সবসময়ই তেমন। তারপরও কাল অনার সাথে দেখা হওয়ার পর আমার মনে হয়েছে এখনই সবটা ঠিক করে নেয়া উচিত। নয় তো আর যদি সুযোগ না পাই?.. সে যাই হোক, আপনার সাথে এতোকথা বলে লাভ নেই। আপনি প্রচুর ঘাড়ত্যারা মেয়ে মানুষ.. যাক গে! অনাকে ডাকুন তো!"

 - "কী বললেন আপনি? আমি ঘাড়ত্যারা মেয়ে মানুষ? আপনি তো দেখি ভারী অসভ্য!.. অনুর মতো ভালো একটা মেয়ে কী করে আপনার মতো অসভ্য-অসহ্য ছেলেকে পছন্দ করে আমি তাই বুঝি না!.. উফ্!.."

কানিজের কথার প্রতি উত্তরে কোনো গা জ্বলানো টাইপ কথা ঠোঁটের ওপরে রেডি করে রেখেছিল ধ্রুব। টুপ করে বের করে যেই না ঝেড়ে দেবে অমনই সেখানে অনুপ্রবেশ ঘটলো অনন্যার। ঘুমঘুম শরীরে এলোমেলো পায়ে সে আসছে। এখনো চোখ খোলে নি। সেভাবে থেকেই কানিজের উদ্দেশ্যে বললো,

 - "কী হয়েছে রে কানিজ? সকাল সকাল কাকের মতো এতো কা কা শুরু করেছিস ক্যান? সমস্যা কী তোর?"

কণ্ঠ শুনেই ফিরে তাকালো ধ্রুব। তার ঠিক সামনেই কটেজের সিঁড়ির গোড়ায় দাড়িয়ে আছে অনন্যা। সকালের স্নিগ্ধ বাতাসে তার এলোকেশ উড়ছে, চোখ দুটো ঘুমে আচ্ছন্ন, আলুথালু চেহারা-- একেবারেই যেন কোনো আবেদনময়ী নারী! পরনে সাদা রঙের একটা সুতি সালোয়ার-কামিজ। সেই শুভ্রতায় আরো বেশি উজ্জ্বল আর সুন্দর লাগছে তাকে! ধ্রুব মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে। কী অদ্ভুত, অপরূপ সুন্দরী এই নারী। ওর মতো অতি নগণ্য এক ছেলেকে কী না এই মেয়ে ভালোবাসে? ওর জন্য পাগলামি করে? ভাবতেই অদ্ভুত এক শিহরণ বয়ে যায় সারা শরীর জুড়ে। কাঁপা কাঁপা গলায় ডাকে,

 - "অনা!.."

ডাকটা শুনেই কর্পূরের মতো করে ঘুমটা উড়ে যায় অনন্যার। ঝপ করে চোখ খুলে তাকিয়ে দেখে সামনে দাড়ানো ছেলেটাকে। ধ্রুব দাড়িয়ে আছে মেরুন রঙের একটা পাঞ্জাবি পরে। ফর্সা দেহে রঙটা মানিয়েছে বেশ! চোখ সরিয়ে ওর মুখের দিকে তাকায়। ছেলেটা এক মোহময় চাহনিতে তাকিয়ে আছে ওরই দিকে। কী সম্মোহনী সে দৃষ্টি! লজ্জায় অবনত হয়ে যায় তার মুখশ্রী। ভারী হয়ে আসে গাল দুটো। ধ্রুব খেয়াল করে ওর রক্তিম চেহারা। ওর লজ্জাটা আরও বাড়িয়ে দিতে বলে,

 - "তোমাকে খুব আবেদনময়ী লাগছে,অনা!.."

প্রতি উত্তরে আর কিছু বলতে পারে না অনন্যা। চরম লজ্জায় নুইয়ে যায় একেবারে। কান দুটো দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হতে থাকে যেন! ধ্রুব সেটা দেখেমনে মনে বেশ মজা পায়। ঠোঁট টিপে হাসতে থাকে। 

ওদের এই প্রেমলীলা দেখে রাগে ফুঁসছে থাকে কানিজ। কতবড় অসভ্য ছেলে! ওর সামনে দাড়িয়ে অনু কে কি বাজে বাজে কথা বলছে! আর অনু? পাল্টা কথা বলা বাদ দিয়ে লজ্জায় লাল নীল বেগুনী হয়ে যাচ্ছে। যত্তসব ন্যাকামো!

অনেক্ষণ পর কথা বলে উঠলো অনন্যা। ধীর গলায় বললো,

 - "আপনি এতো সকাল সকাল এসেছেন যে? কোনো দরকার ছিল...."

 - "তোমাকে দেখার পর থেকে আর একা একা ঘুম আসছিল না!.. তাই রাত পোহাতেই ছুটে এলাম।.."

বেশ সাবলীল ভঙ্গিতেই জবাব দেয় সে। কানিজ তাতে যেন আরো ক্ষেপে যায়। বিড়বিড় করে বলে,

 - "কী শেয়ানার শেয়ানা!.. সরাসরি বিছানায় চলে যাচ্ছে!. আল্লাহ, এ কোন ফাউলের পাল্লায় পড়লো অনু? রক্ষা করো!"

তবে ওর কথা এদের কারোরই কানে যায় না। অনন্যাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ধ্রুব আবারও বলে ওঠে,

 - "তোমরা তো এখনো ব্রেকফাস্ট করো নি, তাই না? এসো তাহলে... একসাথে করে নেই?"

 - "আমি তো এখনো রেডি হই নি.. একটু অপেক্ষা করুন। আমি আসছি!"

বলেই দ্রুত পায়ে ঘরের ভেতর ঢুকে যায় অনন্যা। ও চলে যেতেই কানিজের দিকে তাকালো ধ্রুব। মুখে বিশ্বজয়ের হাসি ফুটিয়ে বললো,

 - "কী মিস. শ্যালিকা বিশ্বাস হলো তো? আপনার বান্ধুবী যে আমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে বুঝতে পারছেন? এখন কী আর সে আমাকে ছেড়ে দিতে পারবে?.."

কানিজ দাঁত কটমট করে তাকায়। ধ্রুব মুচকি হাসে। ওকে আরও ক্ষেপিয়ে দিতে বললো,

 - "চিন্তা করবেন না। দু' একদিনের মধ্যেই অনাকে বিয়ে করে ঘরে তুলছি আমি। লুকিয়ে চুপিয়ে নয়, আপনার নাগের ডগা দিয়েই। সো দাওয়াত দিলাম না। ও আপনি এমনই আসবেন!.. হা হা হা।"
____________________

একসাথে খেতে বসেছে অনন্যারা। তিন চেয়ারের একটা টেবিলে একপাশে ধ্রুব আর অন্য পাশে অনন্যা-কানিজ। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে কী কী সব কথা বলছে ধ্রুব, আর তাতে লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে অনন্যা। ওদের এতসব দেখে মনে মনে চরম বিরক্ত হচ্ছে কানিজ। ইচ্ছে করছে উঠে চলে যাক। কিন্তু মিস. অনন্যা সেটাও হতে দিচ্ছে না। চলে যেতে চাইলেই হাত আঁকড়ে ধরে করুন চোখে তাকাচ্ছে। একসময় ধ্রুব বললো,

 - "তুমি কি এখনো আমাকে হিমু ভেবেই বসে আছো, অনা? আমি কিন্তু হিমু না, আমি ধ্রুব। ধ্রুবের মতোই সত্য আমার প্রেম। তাই আমার কাজ-কর্মকে হিমুর সাথে মিলিয়ে ফেল না।.."

 - "জানি। আর... আমি সেই ধ্রুবেরই প্রেমে পড়েছি!"

 - "আচ্ছা?"

ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করে ধ্রুব। অনন্যা দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। ধীরে ধীরে মাথা নাড়িয়ে সে কথার সায় জানায়। ধ্রুব নিঃশব্দে হাসে। ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ কী যেন ভাবে। তারপর কানিজের দিকে তাকিয়ে বলে,

 - "মিস. শ্যালিকা, আপনি কী আপনার চোখ দুটো কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ করতে পারবেন?"

এহেন প্রশ্নে খানিকটা অবাক হয় অনন্যা। ও কানিজকে কেন চোখ বন্ধ করতে বলছে? জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ধ্রুবের মুখপানে। কানিজ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করে,

 - "কেন? চোখ বন্ধ করতে হবে কেন?"

 - "আহ্ হা। বন্ধ করুনই না।"

যেন বিরক্ত হয়েছে সে। কানিজের কুঞ্চিত ভ্রূ দ্বয় আরো কুঞ্চিত হয়। চোখ পাকিয়ে বললো,

 - "কেন? চোখ খোলা রাখলেই বা সমস্যা কী?"

 - "বেশ। তবে চেয়ে চেয়ে নিজের বেস্ট ফ্রেন্ডের রোমান্স দেখুন!"

চরম বিরক্ত হয়ে জবাব দেয় ধ্রুব। তবে সে বিরক্ত ভাব বেশিক্ষণ থাকে না। মুখ বাড়িয়ে অনন্যার কাছে আগায়। অনন্যা বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে ফেলে। আর কানিজ? লজ্জায় তৎক্ষণাৎ চোখ খিঁচে বন্ধ করে দৌড় দেয় উল্টো পাশে। ছি ছি! এ ও কী দেখতে যাচ্ছিল?

হঠাৎ ধ্রুব খুব কাছে চলে আসে অনন্যার। ওর বিস্ময়ের সীমা ছাড়িয়ে কোমড় ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। টুপ করে চুমু এঁকে দেয় ওর নরম-কোমল গাল দুটোতে। অনন্যা কী বলবে ভেবে পায় না। কাল বিকেল থেকেই ও এমন ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছে। ধ্রুব হঠাৎ করে কেন যেন খুব বেশিই রোমান্টিক হয়ে গেছে! ব্যাপারটা সামলাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে তাকে!

 - "আপনি এমন কেন?..."

কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে প্রশ্ন করে অনন্যা। ধ্রুব খেয়াল করলো তার প্রেয়সীর গাল দুখানা লজ্জায় কাশ্মিরী আপেল বর্ণ ধারণ করেছে। ইচ্ছে করছে আরেকবার চুমু খেয়ে দিতে! কিন্তু তাতে এই লজ্জাবতী লতিকা আর ঠিক থাকবে কী না কে জানে! দুষ্টু হেসে বললো,

 - "কেমন?"

 - "ওই যে কেমন লজ্জাহীন!.. এভাবে পাবলিক প্লেসে... কানিজের সামনে.. ও যে কী ভাববে!.. আর লোকজনই বা..."

 - "তোমার সমস্যা হচ্ছে? ঠিক আছে। তাহলে চলো বিয়ে করে ফেলি!. তাহলে আর পাবলিক প্লেসে কিচ্ছু করবো না! যা করবো সব বন্ধ দরজার ভেতরে.. আই প্রমিস!"

বলেই ঠোঁট প্রসারিত করে হাসে। অনন্যা তাকায়। এই প্রথম বারের মতো ধ্রুব নামের ছেলেটার মুগ্ধ করা হাসি সে চোখ তুলে দেখে না। সম্পূর্ন উপেক্ষা করে মাথা নামিয়ে নেয়। লোকটা যে এত অসভ্য তা তো জানা ছিল না ওর! 

ধীর কণ্ঠে জানান দেয়,

 - "আপনি একটু বেশিই নির্লজ্জ!"

 - "শুধু তোমারই জন্য!"

ধ্রুবের একেবারেরই সহজ উত্তর! অনন্যা পারে তো দৌড়ে পালিয়ে যায় এখান থেকে। এই ছেলেটা তাকে ক্রমাগত লজ্জায় ফেলে দিচ্ছে! তার কল্পনায় ধ্রুব নামের যে ছেলেটিকে সে ভালোবাসতো, যাকে নিয়ে সে কল্পনার পসরা সাজাতো, তার থেকেও অনেক বেশি রোমান্টিক বাস্তবের এই ধ্রুব! একেবারেই অনেক বেশি!

হঠাৎ গুনগুন করে গান গেয়ে ওঠে ধ্রুব,

 - "দোহাই লাগে মুখটি তোমার একটু আঁচলে ঢাকো!
   আমি জ্ঞান হারাবো, মরেই যাবো, বাঁচাতে পারবে না কো!"

এবার অনন্যা শেষ! লজ্জার মাথা খেয়ে শেষ পর্যন্ত ধ্রুবকেই দু' হাতে আঁকড়ে ধরে। ধ্রুব হাসে। বিশ্ব জয়ের হাসি হাসে! সে তো এতোক্ষণ এটাই চাইছিল। তার প্রেয়সী যেন তাকে জড়িয়ে ধরে। সেজন্যই তো এতো এতো বাহানা! অবশেষে জয় হলো তার!

ওকে জড়িয়ে রেখেই অস্পষ্ট স্বরে কথা বললো অনন্যা,

 - "দোহাই লাগে আপনার, এইবার চুপ করুন!"

 - "ওহ্, অনা! তুমি এতসুন্দর করে লজ্জা পাও কীভাবে? আ'ম লসিং কন্ট্রোল!"

অনন্যা নিরুপায়। কী করা উচিত ভেবে পায় না। চট করে ওর মুখের উপর হাত রেখে বলে,

 - "প্লিজ, চুপ করুন?"

প্রতি উত্তরে কিছু বলে না ধ্রুব। চট করে চুমু খেয়ে দেয় ওর হাতের তালুতে। চকিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাত সরিয়ে নেয় অনন্যা। দৌড়ে বেরিয়ে যায় ওখান থেকে। ধ্রুব ছেলেটা সত্যিই অনেক বেশি ফাজিল! হিমুও ফেল মারবে এর কাছে!

ওর প্রস্থানে শব্দ করে হেসে উঠলো ধ্রুব। চেয়ার টেনে উঠে দাড়িয়ে পিছু নিলো অনন্যার।
__________________________

কয়েকটা দিন পেরিয়ে যায়। 

লেবু মামার বিষয়ে ধ্রুব ইনভেস্টিগেশন করছে। খুব সুক্ষতার সাথে চালিয়ে যাচ্ছে তদন্ত। কিন্তু কোনো উন্নতি হচ্ছে না। লেবু মামার নামে কুষ্টিয়া যাওয়ার দুটো টিকেট কাটা হয়েছিল সে খবর অবধি পাওয়া গেছে। কিন্তু ওনারা শেষ পর্যন্ত ওই বাসে উঠেছিলেন কী না না সে খবর এক্সজ্যাক্টলি কেউ দিতে পারছে না। আরো একটা কনফিউজিং ব্যাপার হচ্ছে লেবু মামারা একইসাথে দু' জায়গার টিকেট কেটেছিলেন। একটা ছিল নিজেদের শহরে ফেরার অন্যটা কুষ্টিয়ার। এবং দু' টো টিকেটই ছিল একই দিনের, একই সময়ের। শুধু মাত্র বাস ছাড়ার টাইমিংয়ে ছিল একটু পরিবর্তন। দুটো ট্রিপের মাঝে ডিসটেন্স ছিল আধঘন্টার। ধ্রুবের ধারণা এই আধঘন্টায়ই কিছু একটা হয়েছে মামার। নয় তো একসাথে দুটো বাসের টিকেট তারা কেন কিনলেন? আর কিনলেন যখন গেলেনই

অনন্যার দিন গুলো যাচ্ছিল ধ্রুবের সাথে প্রেম করেই। ওরা চুটিয়ে প্রেম করছে আর কানিজ সেটা দেখে চরম বিরক্ত হচ্ছে। ধ্রুব যখন ছিল না তখন একটু হলেও কানিজ চাইতো সে ফিরে আসুক। ফিরে আসুক অনন্যা কে স্বাভাবিক করতে। ওর জীবনটাকে রঙিন করে দিতে! কিন্তু ছেলেটা যখন সত্যি সত্যিই ফিরে এলো তখন চরম বিরক্ত সে। মহা বিরক্ত! যদিও ধ্রুব কী করে, কেন করে সে ব্যাপারে মোটামুটি সব কথাই ওর সাথে শেয়ার করেছে অনন্যা। সবটা শুনেছে, কিন্তু তারপরও ওর বিরক্ত ভাবটা যায় নি। সিক্রেটলি থাকবে বলেই ওকে অমন ঢং করতে হবে? অমন হিমু মার্কা চালচলন দিয়ে চলতে হবে? যত্তসব গাঁজাখুরি গল্প!

এ কয়দিনে আরো অনেক বেশি গভীর হয়েছে অনন্যা আর ধ্রুবের সম্পর্ক। ধ্রুবকে নতুন করে জানতে পেরেছে সে, নতুন করে প্রেমে পড়েছে! ভালোবেসেছে। ধ্রুব অবশ্য চাইছে এখানেই বিয়েটা সেরে ফেলতে। কারণ ওর তো আত্মীয়স্বজন বলতে তেমন কেউই নেই! তাই কারো জন্য দেরি করার দরকারও নেই। ব্যাপারটা কিছুতেই মানতে পারে নি কানিজ। ধ্রুবের কেউ না থাকতে পারে, কিন্তু অনুর তো আছে? ওর মা-বাবা, সবাই আছে। তাদের না জানিয়ে বিয়ে করাটা কেমন হবে? 

এটা নিয়ে জোহরা বেগমকে কল করে জানিয়েছিল অনন্যা। ও নিজেও চায় এখানেই বিয়ে করে নিতে। কারণ ও আর কোনোভাবেই জয়নাল আবেদীনের মুখোমুখি হতে চায় না। তার বাড়িতে বিয়ে করা তো দূর! জোহরা বেগম সবটা শুনে অনেক্ষণ চুপ করে ছিলেন। তারপর একসময় বলেছেন,

 - "ঠিক আছে। তুই যা ভালো বুঝিস কর। আমি আপত্তি করবো না। কিন্তু তাই বলে আমাকে এতো পর করে দিস না মা! একবার এখানে আয়!.."

 - "আমি তো তোমাকে বলেছি মা, আমি আর ও বাড়িতে ফিরবো না!.. তাহলে কেন সে কথা বলছো?"

 - "ঠিক আছে। আর বলবো না।... কই দে দেখি ধ্রুবকে.. একটু কথা বলি!"

এরপর ধ্রুবের সাথে কথা হয় তার। কানিজ ভেবেছিল ওর মতো বদ ছেলের সাথে কথা বলার পর কোনোভাবেই ওকে নিজের মেয়ে জামাই হিসেবে মেনে নিবেন না জোহরা। কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে খুব সুন্দর করে সবটা মেনে নিলেন উনি। অবশ্য উনি খুব ভালো করেই জানেন ধ্রুব কে মেনে না নিয়েও কোনো উপায় ছিল না। ছেলেটা যে কী জাদু করেছে তার মেয়েকে!

তবে ধ্রুবের সাথে কথা বলে তাকে খারাপ মনে হয় নি তার। যথেষ্ট ভদ্রই মনে হয়েছে। কথা বার্তায় কোনো প্যাঁচগোছের আভাস পান নি। অথচ কানিজ বলেছিল ছেলেটা অদ্ভুদ টাইপের, কথা বার্তার নাকি আগামাথা নেই। সেই হিসেবে যথেষ্ট ভালোই মনে হয়েছে তার। 

কথা শেষ করলেন। চাইলেন আরেকবারের মতো অনন্যাকে বাড়ি ফিরে আসার কথা বলবেন কিন্তু কী যেন ভেবে আর বললেন না। মেয়েটা আনন্দে আছে থাক। কী দরকার তার মন খারাপ করার? যদিও এদিককার একটা খবর তাকে না দিলেই নয়! তবুও তিনি সে কথা বললেন না। "খবরটা হচ্ছে, অনন্যার বাবা জয়নাল আবেদীন সাহেবের নামে একটা কেস হয়েছে। কেসে বলা হয়েছে, জয়নাল আবেদীন সাহেব তার অফিস থেকে বেশ মোটা অংকের টাকা আত্মসাৎ করেছেন। মোটা অঙ্ক মানে আসলেই টাকার পরিমাণ খুব বেশি! একেবারে পাঁচ কোটি টাকা!

কেস করা হয়েছে আরও সাত আটদিন আগে। কিন্তু তবুও ব্যাপারটা বাড়ির কাউকে জানান নি তিনি। নিজের মধ্যেই চেপে গেছেন। চেষ্টা করেছেন টাকা ফেরত দেয়ার। কিন্তু পারেন নি। আর উকিলও কিছু করতে পারেন নি। আজকে তার লাস্ট ডেট ছিল। সকাল থেকে লোকটা ছটফট করেছে, কিন্তু জোহরাকে কিছুই বলেন নি। বিকেলের দিকে হঠাৎ করে তার বুকে ব্যাথা শুরু হলো। প্রচণ্ড ব্যাথা, মুহূর্তেই যায় যায় দশা! জোহরা কালবিলম্ব না করে হসপিটালে আনলেন। ডাক্তার জানালো স্ট্রোক করেছে!"

ভেবেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন জোহরা বেগম। তার পরিবারের কী দশা! স্বামী হসপিটালে, ছোট ভাই নিখোঁজ, আর ওদিকে মেয়ের বিয়ে! উনি চাইলেই অনুকে ব্যাপারটা খুলে বলতে পারতেন। কিন্তু বললেন না। বললে হয় তো নিজের মনটাকে একটু হালকা করতে পারতেন কিন্তু তাতে সমস্যা বাড়ত বৈ কমতো না! কারণ উনি নিজেও এখনও পুরো ঘটনা জানেন না। জয়নাল আবেদীন নিজে এখনও কিছু বলেন নি। বলবেনই বা কী করে? তার তো এখনও জ্ঞানই ফিরে নি! উনি যা শুনেছেন সব জয়নাল সাহেবের পিএর কাছ থেকে। আর সবটা না জেনেই যদি অনুকে বলতেন ব্যাপারটা তখন আরো বেশি ঘোলাটে হয়ে যেত। এমনিতেই মেয়েটা তার বাবার উপর রেগে আছে, অভিমান করেছে। তারমধ্যে এ খবর শুনলে তো আর কখনোই সে ফিরবে না। বাবার প্রতি তার যে সামান্য ভালোবাসা ছিল তাও তো ধুলিস্যাৎ হয়ে যাবে! তাই বলেন নি। আগে সবটা ঠিক হোক, তারপর বলবেন। 
.
.
.
চলবে.........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp