পর্ব ০৮
শারমিন আক্তার সাথী
.
.
.
৮!!
মুখে পানির ছিটা পেয়ে চোখ খুললাম। আশেপাশে অচেনা কিছু লোক উৎসুক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার হাত-পা-শরীর তখনও নব্বই বছরের বৃদ্ধ রোগীর ন্যায় থরথর করে কাঁপছে। এক লোক বললেন,
'ভাই, আপনি তো ভয়ই পাইয়ে দিয়েছিলেন। হঠাৎ বেহুশ হয়ে পড়লেন কেন?'
আমি তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললাম,
'আমাকে একগ্লাস চিনির পানি কিংবা লেবুর শরবত দেওয়া যাবে অথবা সেভেন আপ জাতীয় কিছু? আমার প্রেসার খুব লো হয়ে গেছে।'
চা দোকানী একগ্লাস চিনির শরবত গুলে দিলেন, তারপর ঠান্ডা একটা কোকাকোলা দিলেন। চিনির পানিটা এবং কোকাকোলা খেয়ে সবাইকে বললাম,
'আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ আমাকে সাহায্য করার জন্য। আমার মামাতো ভাইকে বলেছি সে কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবে।'
আমার কথাশুনে অনেকে চলে গেলেন। এক বৃদ্ধ বললেন,
'এই ছেলে এত কম বয়সে প্রেসার লো হয় কেমনে?'
আমি হেসে বললাম,
'চাচা, আমার বয়স অতটাও কম না। চল্লিশ পেরিয়েছে আমার।'
চাচা হেসে বললেন,
'তা-ও অত বেশি না যে প্রেসার লো হবে। প্রেসার লো হবে ষাট বছরের বৃদ্ধদের। তুমি তো সে তুলনায় খোকা।'
আমি হাসলাম। তিনি বললেন,
'যদিও তোমার চেহারা দেখলে বুঝা যায় না, তোমার বয়স চল্লিশ।'
'কী বলেন, চাচা? মাথার তিনভাগের দুইভাগ চুল পাকা। হেয়ার কালার করাই প্রতি সপ্তাহে একবার।'
চাচা হেসে বললেন,
'চেহারায় বয়স বুঝাটা বড়ো ব্যাপার না। চুল বয়সেও পাকে না। তবে তোমার মতো জোয়ান মানুষ যদি রাস্তাঘাটে বেহুশ হয়ে পড়ে সেটা চিন্তার ব্যাপার। আমি অনেকক্ষণ যাবত এখানে আছি। তোমাকে শুরু থেকেই দেখছিলাম। তোমাকে দেখেছিলাম কারও সাথে কথা বলছিলে। তারপর কী হলো যে প্রেশার লো হয়ে বেহুশ হয়ে পড়লে? চিন্তার কিছু?'
আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম,
'জীবন থেকে চৌদ্দটা বছর হারিয়ে গেছে। চৌদ্দ বছর যা করেছি সবই যেন বৃথা। কাছের মানুষগুলোর এত জঘণ্য রূপ জানলাম যা আসলে মানতে পারছি না। নিজেকে কিছুতেই স্বাভাবিক করতে পারছি না। যাদের জন্য নিজের জীবনের সবকিছু ত্যাগ করলাম, তারা বলছে কিছুই করিনি। আমার নিজের মা-ও আমার থেকে কেবল স্বার্থটাই দেখলেন। তার মমতার আঁচল খুঁজে পাচ্ছি না আমি। আচ্ছা মানুষ সত্যি এত স্বার্থপর হয়? কেন হয়? এত স্বার্থ খুঁজে নিজের আপন মানুষগুলোকে কষ্ট দিয়ে কী অর্জন করতে পারে?'
চাচা আমার কথা মন দিয়ে শুনে বললেন,
'মানুষ আদিম যুগ থেকেই স্বার্থপর ছিল, বাবা। যে দায়িত্বপালন করে তাকেই কষ্ট বেশি দেয়। যে কোনো দায়িত্ব পালন করে না সে জ্ঞান বেশি দেয়। যে দায়িত্ব এড়িয়ে বাতেলাবাজি বেশি করে সমাজ তাকে বাহবা দেয়। আর যে সবটা দিয়ে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করে সে সবার কাছ থেকে কেবল ঠকেই যায়।'
'তাহলে কী দায়িত্ব পালন করা উচিত না, চাচা?'
'একদিক দিয়ে ভাবলে উচিত না। স্বার্থের দুনিয়ায় বর্তমানে কেবল নিজের কথা ভাবাই বোধ হয় সবচেয়ে শ্রেয়, কিন্তু আমরা যারা সৃষ্টিকর্তা বিশ্বাস করি; তাদের দায়িত্ব পালন করা উচিত। নিজের কাছের মানুষদের জন্য না হোক, সৃষ্টিকর্তার কথা ভেবে নিজের পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালন করা উচিত। কখনো ভেবে দেখেছো, এই যে আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করলেন; এ জগতে এত ভালো রেখে তার দায়িত্ব পালন করলেন তাহলে আমাদেরও উচিৎ তার প্রতি দায়িত্ব পালন করা। তার প্রতি সন্তুষ্টি আদায় করা।'
'আমি আমার পরিবারের জন্য যা করেছি তাতে কী তিনি সন্তুষ্ট হয়েছেন?'
'যদি তুমি সৎ উদ্দেশ্যে সৎভাবে পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালন করো, তাহলে অবশ্যই তিনি সন্তুষ্ট হয়েছে। তবে বাবা, দুনিয়ার মানুষকে সন্তুষ্ট করার ইচ্ছা তুমি ছেড়ে দাও। আমরা মানুষ নাশোকর জাতি। আমাদের শরীরের প্রতিটি লোমকূপ হীরা, জোহরত দিয়ে ঢেকে দিলেও আমাদের আরও পাবার ইচ্ছা জাগবে, কিন্তু নিজের যা আছে তা নিয়ে খুশি থেকে শুকরিয়া আদায় করবে না। তা-ই এতদিন যা করেছো তা করেছো; এখন থেকে দুনিয়ার ক্ষুদ্র দায়িত্ব পালনের সাথে সাথে সবচেয়ে বড়ো দায়িত্ব সৃষ্টিকর্তা দায়িত্ব পালন করো। দেখব মনে শান্তি পাবে, জীবনের সমস্যাও তিনি দূর করে দিবে। আর স্বার্থপর মানুষের সাথে আপোশ কম করো। তাদেরকে তাদের স্থান দেখিয়ে দাও। সুযোগ পেলে তাদের বুঝিয়ে দিবে তুমি তাদের জন্য কী করেছিলে আর তারা কতটা নিমকহারাম ছিল। কতটা না শোকর ছিল।'
চাচার কথাগুলোতে অদ্ভুত কিছুতো ছিল যা আমার মনে বেশ সাহস সঞ্চায় করল। আমি চাচাকে কৃতজ্ঞতা জানালাম। কিছুক্ষণ পর মাসুদ আসল। তবে ততক্ষণে আমার শরীরটা ভালো লাগতে শুরু করেছে। নিজেই রিকশা করে হোটেলে ফিরলাম।
৯!!
সারা দুপুর ঘুমিয়ে বিকালে সবুজ খান সাহেবর সাথে দেখা করে, তার মালগুলো ঠিকমতো পৌঁছে দিলাম। সন্ধ্যার পর অফিস যেতে হলো। না গিয়ে উপায় নেই। ব্যবসার কাজ কতদিন আর ফোনে ফোনে করা যায়। অফিসে গিয়ে দেখলাম তিনদিনে ভালোই কাজ জমেছে। কর্মচারীরাও বেশ গা ছাড়া ভাব দিয়েছেন। কর্মচারী বলতে কয়েকজন সহকারি মাত্র। একজন কম্পিউটার টাইপিস্ট, একজন পিওন, একজন টাকা পয়সার হিসাব দেখেন, আরেকজন মাল জিনিসের হিসাব দেখেন।
অফিসের মধ্যে ঢুকেই বুঝলাম, ওরা দুদিন এখানে বসে মদ, সিগারেট খেয়েছে হয়তো, কিন্তু মাথাটা তখন গরম হলো যখন টাকা পয়সার হিসাব রক্ষককারী শোয়েব চাচা বললেন টাইপিস্ট মিলন নাকি গতকাল রাতে অফিসে একটি মেয়ে নিয়ে এসে রাত কাটিয়েছে। কথাটা শুনেই মাথাটা চট করে গরম হয়ে গেল। নোংরামি আমার একদম পছন্দ না। রাগে গা রি রি করছে, কিন্তু অনেকসময় চেয়েও কিছু বলা যায় না। মিলন কাজে ভালো। ভালো হলেওবা কী? দুর্জন বিদ্বান হলেও তার সঙ্গ পরিত্যাজ্য। এখন সাথে সাথে ওকে বের করতে না পারলেও ওর কাজের মেয়াদ যে শেষ সেটা ওকে বেশ ভালোভাবেই বুঝিয়ে দিলাম।
অফিসের কাজ করছি। রাতের খাবারও খাইনি। তবে দ্রুত খাওয়া দরকার। নয়তো সকালের মতো শরীরটা খারাপ হবে। রাত দশটার দিকে রাতের খাবার এল। ভাত, গরুর গোস্ত ভূনা আর মুগের ঘন ডাল। রাতে আমি ভাত খাই না, রুটি খাই, তবে আজ ভাত খেতে ইচ্ছা করছে। ভাত প্লেটে নিয়ে এক লোকমা খেতেই দেখলাম শফিক আসছে। আমাকে দেখে বলল,
'কেমন আছো, দাদা।'
'ভালো তুই?'
'ভালো।'
'ভাত খাবি? প্লেট দিতে বলব?'
'না, খেয়েছি।'
'আচ্ছা।'
আমি আবার খাওয়ায় মনোনিবেশ করলাম। শফিক বাটিভর্তি গরুর মাংসের দিকে তাকিয়ে বলল,
'বাড়ি না গিয়ে তোমার সুবিধাই হচ্ছে। একা একা ভালোমন্দ খেতে পারছো। বাড়তি খরচ হচ্ছে না।'
খোঁচা মারা কথা বলা শফিককে অভ্যাস। আমি হেসে বললাম,
'এত বছর সবার কথা ভেবে দিনের পর দিন ভালো না খেয়ে কেবল মন্দটা খেয়েছি; তাতে কী লাভ হয়েছে? সেই তো দিনশেষে শুনতে হচ্ছে আমি নাকি কিছুই করিনি। বাবা মারা যাবার পর যখন চাকরি করতাম, তখন অধিকাংশ সময় দুপুরে কেবল সস্তার হোটেলের ভাত, পাতলা ডাল, আলুভর্তা খেয়েছি। অথবা সবজি ভাত। মাছ কিংবা মাংস বাড়িরত বসে তোদের সাথে-ই যা খেতাম।
তুই তো প্রায়ই কলেজে বন্ধুদের সাথে রেস্ট্রুরেন্টে গিয়ে চাইনিজ, থাই, বিরিয়ানিসহ বহু দেশী খাবার খেতি। কারণ তোর মাথার উপর বড়ো ভাই এর ছায়া ছিল। তার কাছে যখন যেটা চাইতি সেটা তখন দিত, তাতে তার যত কষ্ট হোক না কেন? সে নিজে রিকশায় করে না গিয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে অফিসে গিয়েছে। লোকাল বাসে বাদরের মতো ঝুলে ঝুলে অফিসে গিয়েছে। চাকরি করা সত্ত্বেও তোদের বাড়তি চাহিদা পূরণে সকাল ছয়টায় উঠে টিউশনি করাতো, রাতে অফিস শেষে আবার টিউশনি করাতো। তোর পড়ালেখায় যাতে সমস্যা না হয়, সে কারণে তোকে টিউশনি পড়াতে দেয়নি। তুই-ও তার ফায়দা কম লুটিসনি। নিজে প্রাইভেট দুটো পড়তি, কিন্তু টাকা নিতি তিনটার। ফরমফিলাপে টাকা তিন হাজার লাগলে পাঁচ হাজার নিতি। তোর ভাই সব জানত। তা-ও তোর খুশির কথা ভেবে না জানার ভান করত।
ঐ যে একটা মেয়ে ছিল নাম অন্তরা না জানি কী তার জন্মদিনে দামি গিফ্ট দিতি। আর এত বছরে বড়ো ভাইকে দুইশো টাকা দামের শার্ট দিয়েছিস? নিজেও তো চাকরি পেলি বছর খানিক হলো। চাকরির টাকা কী করছিস? সংসারে তো চার পয়সাও দিস না। নিজের খাবার খরচও না। তাহলে প্রতি মাসে যে চব্বিশ হাজার টাকা বেতন পাস তা কী করিস? কখনো মনে হয়নি যে ভাই এত করল, আমাদের জন্য নিজের জীবন যৌবন বিসর্জন দিল তার জন্য কিছু অন্তত কিনি? আর আজ বড়ো ভাই নিজের টাকায় একবাটি গরুর মাংস খাচ্ছে তা চোখে খুব লাগছে?'
আমার কথা শুনে শফিক আর বসল না। উঠে চলে গেল। হয়তো কিছু বলতে এসেছিল, কিন্তু ভাবেনি আজ খোঁচা মেরে মোচা শুনতে হবে। জানি, বাড়ি গিয়ে মাকে বানিয়ে এখন তিলতে তরমুজ বানিয়ে বলবে। আমি সেদিকে মন দিলাম না। পুরো বাটির মাংসটা একাই খেয়ে শেষ করলাম। ঝালঝাল কষা মাংসটা সত্যি দারুণ ছিল।
হোটেলে ফিরে ফোন চেক করতেই দেখলাম ঐশীর মেজেস,
"এরকম পাগলামি কেউ করে? আর কখনো এমন করবেন না। আমার ব্যাংকে খবরদার আপনি আর আসবেন না। আজ আমার কলিগরা আমাকে অনেক লজ্জা দিয়েছে। পুরো ব্যাংক জুরে কেবল আজ রঙ বেরঙের গোলাপের চর্চা। লজ্জায় আমি কারও সাথে ঠিকমতো কথা বলতে পারিনি। খবরদার এমন আর করবেন না। তাহলে খবর আছে বলে দিলাম।"
আমি মেসেজ করলাম,
"ঠিক আছে করব না। তাহলে বলো তো না কত পারসেন্ট হ্যাঁ হয়েছে।"
ঐশী মেসেজ করল,
"কোনো হ্যাঁ হয়নি। উল্টা না মাইস (-১০%) হয়েছে।"
"এটা অন্যায়।"
"তো?"
"কাল তো শুক্রবার দেখা করি?"
"না।"
"প্লিজ।"
"কখন?"
"বিকালে।"
"আচ্ছা।"
.
.
.
চলবে..........................