উন্মুক্ত লাইব্রেরী - পর্ব ২৭ - আয্যাহ সূচনা - ধারাবাহিক গল্প


উন্মুক্ত লাইব্রেরী
পর্ব ২৭
আয্যাহ সূচনা



সারাটা রাত ছটফট করেছে এই মানুষটা।যেনো কোনো জ্বরে আক্রান্ত অবোধ শিশু। তরপিয়ে উঠে প্রায়শই।কি জ্বালা তার?অনেক কষ্টে আছে বুঝি?বুক কেঁপে উঠছে বারবার অন্বেষার।কান্না পাচ্ছে ভীষণ।

   নির্ভয়ে বাহুতে মাথা পেতে শুয়ে থাকা মানুষটার শান্তির ঘুমটাও মনে হচ্ছে অনেকটা বিষাদ ঘেরা।নিজেকে ভীষণ শক্ত মনে হলো আজ।কতবার বর্ণকে বলেছে এই সময়টুকুতে,

“আমি আছি তোমার সাথে”

এই বাক্যে অন্বেষা নিজেও শক্তি পেয়েছে।কতটুকু সামর্থের প্রয়োজন হয় আপন কাউকে সুখে রাখতে?অনেক কম।

বর্ণ ঘুমায়।মুখ ফ্যাকাশে।কালচে আভা যুক্ত। অন্বেষা হাত বুলায় পরম যত্নে।হাসলো খানিক। বুঝলোও বটে।এই সত্তার পেছনে অনেককিছু লুকানো।হুট করে বর্ণ নড়েচড়ে উঠেছে।ঠিকভাবে শুতে পারছে না বোধহয়। ঘাড় পেছনে নিয়ে অর্ধ ঘুমে উঠে বসে।নিজের মতো করেই শুয়ে পড়লো নিজ জায়গায়। অন্বেষাও উঠে লাইট নিভিয়ে দেয়।বর্ণের ছড়িয়ে রাখা হাতে মাথা পেতেছে।

বর্ণ আন্দাজ করতে পারলে বিড়বিড় করে বলে উঠে,

“জ্বালাইও না”

অন্বেষার ঠোঁটে পুনর্বার হাসি ফুটলো।শীতল মৌসুমে উষ্ণতা খুঁজতে লাগলো বর্ণের বক্ষে।বর্ণের বিরক্তি তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি।কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললো,

“তুমি একাকীত্বকে বেছে নিয়েছো।আর আমি তোমাকে”

মস্তিষ্ক জ্বলে উঠলো বর্ণের।সে যেনো ঘুমিয়েও নির্ঘুম ছিলো।ঝটপট চোখ মেলে। আঁধারে আচ্ছন্ন চোখ চেয়ে রয় কিছুক্ষন।পাশেই অন্বেষা।জেগে আছে নিশ্চয়ই।তবে চুপচাপ।বর্ণ একহাত তাকে আকস্মিক শক্ত করে বুকে টেনে নিয়ে বললো,

“কি চাও কি?আমারে পাগল বানায় ছাড়বা?কেন অশান্তি করো?”

থতমত খেয়ে থাকা অন্বেষা চমকায় এরূপ প্রশ্নে।জবাব দিলো,

“আমি কোনো অশান্তি করিনা।”

যেমনভাবে টেনে নিয়েছিল একইভাবে সরিয়ে দিলো। কিছুসময়ের ব্যবধানে অনুভব করলো অন্বেষা।তার মুখোমুখি আরো একটি মুখ অবয়ব। নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে মুখে।আরো কিছু সময় ব্যয় করে কপালে কপাল ঠেকে। অন্বেষা সংকুচিত হলো। ভাগ্যিস তমাসাবৃত।নাহয় বর্ণের সহিত এরূপ ঘনিষ্ঠতায় নিশ্চিত অক্কা পেতো। আঁধারে চোখ নামায় অন্বেষা।একহাত বর্ণের বুকের বামদিকে ঠেকিয়ে দূরত্ব বজায় রেখেছে একে অপরের সাথে।

নিস্তব্ধ বর্ণের দিকে কম্পিত কণ্ঠে বলে উঠলো, 

“তোমার বুক কাপছে বর্ণ।কিসের ঝড় এটা?”

“হুউউম?......জানি না”

“বলো আমায়?”

“ভাল্লাগেনা”

“কি করলে ভালো লাগবে?”

ঘোরমিশ্রিত কন্ঠ বর্ণের।যেনো মাতাল সে।ধীরেধীরে জবাব দিচ্ছে।সময় নিয়ে।জবাব দিলো,

“তুমি জাইনা কি করবা?আমি তোমার কে?”

নিজের উপর সন্দেহ হয় মাঝেমধ্যে অন্বেষার।নিজেকেই গিরগিটি বলে আখ্যা দেয়।নিজেই কাছে চলে যায় আবার নিজেই লজ্জায় মরে।অদ্ভুত!লাজ শরমের মাথা খেয়ে আবারো মুচকি হাসলো।হেসে কোনো দ্বিধা ছাড়াই জবাব দিলো,

“আমি তোমার একমাত্র অর্ধাঙ্গিনী।যার সাথে তুমি তোমার মনের অজান্তেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যাচ্ছ।”

বর্ণ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।জবাব দেয়, 

“গেলাম নাহয়”

অন্বেষা কিছুটা অবাক হয়।চোখ গোল করে চাইলো।কিন্তু বর্ণের কৃষ্ণাভ মুখখানা অস্পষ্ট।কিছুটা নির্লজ্জ হয়ে হাত এগিয়ে জড়িয়ে ধরলো তাকে।বলে উঠলো,

“জানো বর্ণ তুমি একটা বাচ্চা।আমার মাঝেমধ্যে মনে হয় আমি তোমার গার্জিয়ান।”

মৃদু নিঃশ্বাসের শব্দে বোঝা গেলো বর্ণ হাসছে। অন্বেষা মাথা নামিয়ে বুকে মুখ গুঁজে।বর্ণ যেনো সায় দিলো তাকে।কোমর জড়িয়ে টেনে নেয় নিজের সঙ্গে।অনুভব করছে অন্বেষা। ধড়ফড় করতে থাকা বর্ণের হৃদপিণ্ড। নিঃশব্দের প্রহর পেরিয়ে বললো,

“অতীত ভুলে যাও।আমি তোমার বর্তমান সুন্দর করতে চাই।”

“কেমনে?”

“ভালোবেসে”

“আমারে ভালোবাসা লস প্রজেক্ট।”

“উহু!”

মধ্যে মধ্যে দুজনার মাঝে অদ্ভুত শীতল নিস্তব্ধতা বয়ে যাচ্ছে।অনুভবের নীরবতা।কিন্তু অন্বেষার মন আনচান করে।চাইছে বর্ণ কথা বলুক তার সাথে।এই নিশিরাত কাটুক একে অপরের সাথে অহেতুক আলাপনে। অন্বেষার না বলা কথাগুলো শুনুক বর্ণ।তার বুকের আর্তনাদ অন্বেষার কাছে হাজির করুক।

অন্বেষা আবদার করে বসলো,

“আমার লাল বেনারসিতে বউ সাজার শখ।তুমি চাকরি পেলে আমায় কিনে দিবে কিন্তু”

বর্ণ জবাব দিলো না। অন্বেষা অপেক্ষা করে কিয়ৎক্ষণ।তারপর বুকে ধাক্কা দিয়ে পূনরায় প্রশ্ন করে,

“দিবে না?”

“দিমু দিমু! ঘুমাও”

“আমার সাথে নীরবে কিছু সময় কথা বললে কি হয়?”

“শব্দের অপচয়”

অন্বেষা মুখ কুচকে নিলো।বারবার একই প্রশ্ন আসে মাথায়।লোকটা কি কোনোভাবে শুধরাবে না?পরপর আবার চিন্তা এলো না শুধরালেই ভালো।এই বর্ণের মাঝে অন্যরকম ভালো লাগা আছে।আপাতত বর্ণকে বদলানোর চিন্তা সম্পূর্ণ বয়কট।তবে কথা বন্ধ হবে না।কোনো না কোনো প্রশ্ন করে আলাপ দীর্ঘায়িত করবে অন্বেষা।

সামান্য মাথা উঁচু করে প্রশ্ন করলো,

“আমাকে ইগনোর করো কেনো?”

বর্ণ ভারী গলায় জবাব দেয়,

“ভাল্লাগে না তোমারে”

কপট রাগ দেখিয়ে নড়েচড়ে উঠে অন্বেষা।রীতিমতো রাগ দেখিয়ে বললো,

“তাহলে কাকে ভালো লাগে হ্যাঁ? ঐযে ওই মেয়েটাকে?”

বর্ণ আঁধারে মুচকি হাসে।কোন মেয়ের কথা বলছে সেটা বোধগম্যতার বাহিরে নয়।অনুভব করলো স্বস্তি পাচ্ছে।সেই সন্ধ্যায় যে তান্ডব ঘটিয়ে এসেছে?যে তুফান উঠেছিলো সেই তুফান পুরোটাই শান্ত এই মুহূর্তে।হালকা অনুভব করছে বর্ণ।

“ওই মাইয়াটারে আসলেই ভাল্লাগে। বিয়া করতে মন চায়।আদর করতেও মন চা…..”

বাক্য পূর্ণ করার আগেই অন্বেষার হাত সজোরে আঘাত হানে বর্ণের বুকে।সরে যেতে চেয়েও পারছে না।মাথা টগবগ করতে শুরু করলো। হিংসায় জ্বলে পুড়ে অন্বেষা বলে উঠে,

“হাত পা ভেঙে গুড়িয়ে দিবো তোমার।আমাকে অবলা ভেবেছো?সাহস কি করে হয় ঘরে বউ রেখে অন্য মেয়েকে বিয়ে করার কথা ভাবার?আদর করতে ইচ্ছে হয় তাই না?....চোখ দুটো উপড়ে ফেলবো।হাতের কব্জি কেটে দিবো।”

বর্ণ অন্বেষার উদ্দেশ্যে মেকি হাসি হেসে বলে উঠে,

“খুব ডরাইলাম!”

“তুমি ওই মেয়ের সাথে কথা বলবে না।”

“কমু”

রাগ এর পারদ ধীরে ধীরে উপরে উঠছে।তাকে ক্ষেপানো হচ্ছে জানা স্বত্বেও রেগে বারুদ হয়ে উঠছে অন্বেষা।

“তাহলে….তাহলে আমিও ওই জনির সাথে কথা বলবো।ওর হাতে হাত রেখে ঘুরে বেড়াবো।”

আলোহীন কক্ষেও বর্ণ হুট করে অন্বেষার গাল চেপে ধরলো।আচমকা আক্রমণে বিমূঢ় হয়ে পড়ে অন্বেষা।বর্ণ দাঁত চিবিয়ে বলে উঠলো,

“একবার বাইর করছো এই কথা মুখ দিয়া। দ্বিতীয়বার জানি না হুনি।কসম খোদার!জানে মাইরা ফালামু।”

ব্যথা অনুভব করতে থাকা অন্বেষা সেই অবস্থায় বলে উঠলো,

“আর তোমার বেলায়?”

গাল ছেড়ে দেয় বর্ণ।জ্বলজ্বল করা চোখ জোড়া কিছুটা দৃষ্টিগোচর হয় অন্বেষার।রাগী সুরে বর্ণ বলে,

“ওর বাপ দুই বাড়ির মালিক।আমারে এই মাইয়া বিয়ার প্রস্তাব দিছিলো।ওই সময় চাইলেই ওরে বিয়া করতে পারতাম।ঘর জামাই হইয়া থাকতাম এসির তলে। আরামে আয়েশে।আমার এত কুড়কুড়ানী থাকলে তোরে নিয়া এই খুপড়ি ঘরে অন্ধকারে পইড়া থাকতাম না।…..শেষ ওয়ার্নিং দিতাছি অন্বেষা। জনি অথবা অন্য কোনো পোলার ঘ্রাণও যদি আশপাশ থিকা পাই রামদা দিয়ে কোপামু!”

_______

একটি নতুন দিন।মায়া নগরে প্রাচুর্যপূর্ণ প্রভাত।সূর্যের দীপ্তিতে ঝলকিত পথপ্রান্তর।রুক্ষ বাতাসের স্রোতে উড়ে চলেছে ধূলিকণা।কর্মব্যস্ত মানুষ যেন প্রবাহিত নদীর বহমান ধারার মত।তাদের গল্প আছে।নগরীর প্রতিটি কোণ যেন এক মহাকাব্যের অমোঘ পঙক্তি।অথৈ সমুদ্রে ভাসমান নৌকার মতো জীবন।

 
      আজ অন্বেষার কিনে দেওয়া সোয়েটারটা গায়ে ছড়িয়েছে বর্ণ। অন্বেষা তার পূর্বেই বেরিয়েছে নিজের কাজে।নিজেকে দেখার সুযোগটাও হলো না।ঘরে আয়না নেই।ইচ্ছে হলো নিজেকে পরিপাটি করার।চুল আঁচড়ে নিলো সুন্দরভাবে। গোঁফে আঙ্গুল চালিয়ে দুদিকে সামান্য পেঁচিয়ে বেরিয়ে পড়লো।

“বুকে হাত রাইখা ক বর্ণ।বউয়ের প্রেমে পড়ছোস না?”

জীবনের সাহায্য আর বারবাবে অনুরোধে অবশেষে দুজনেই চাকরি হয়েছে।বেতন মোটামুটি চলার মতো একটি পর্যায়ে বর্ণ।তারপরও মেনে নিলো। ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো’ এই ভেবে।

টঙের দোকানে খানিক বিব্রত দেখালো বর্ণকে।চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে জীবনের প্রশ্নের জবাবে শুধু মাথা দোলায়।যার অর্থ দাঁড়ায়,

 “না”

জীবন হেসে উঠে।বর্ণ কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। আজ পরিপাটি নতুন কাপড়ে সাহেবের মত লাগছে তাকে। জীবন টিপ্পনী কেটে প্রশ্ন করে,

“তোরে তোর পুরান ঢাকার জমিনের কসম। ক বউরে ভাল্লাগে না?”

“হাঙ্গা একটা করছি।ভালা না লাগলেও কিছু করার নাই।”

“আছেতো!ছাইড়া দে।ধাক্কা দিয়া বাইর কইরা দে ঘর থিকা।শান্তিতে থাকবি”

আকস্মিক বর্ণের কণ্ঠে পরিবর্তন আসে।মুখের হাবভাব পরিবর্তন হয়।চরম বিরক্ত হয়ে তৎক্ষনাৎ উত্তর দিয়ে উঠলো,

“আজাইরা আজাইরা কথা কইবি না একদম।”

অকস্মাৎ হো হো করে হেসে উঠলো জীবন।বর্ণ স্বচ্ছ চায়ের কাপ হাতে ধরে জীবনের মুখপানে চাইলো।অর্থ বুঝতে পারছে না এই হাসির।অন্যদিকে জীবন,জায়গামতো আঘাত করায় বেজায় খুশি।বর্ণের বাহু চাপড়ে বললো,

“চালায় যা।তোর যন্ত্রপাতি সব ঠিক থাকলে দেরি করিস না।মিনি সাইজের বর্ণরে দুনিয়াতে আনার ব্যবস্থা কর।তারপর বাপ পোলা মিল্যা রংবাজী করবি। পুরান ঢাকা কাঁপাবি”

_______

বর্ণ গতরাতের বিষয়টা নিয়ে রেগে আছে কিছুটা।ঘরে এসে একটা শব্দও বের করেনি মুখ থেকে। অন্বেষার মনে প্রশ্ন ‘বোবা হয়ে গেলো নাতো?’। প্যাঁচার মতো মুখ করে বসে আছে বিছানার একপাশে।আজ অন্বেষার ফোনে হাত দেয় নি।নিজের বাটন ফোনটা নিয়েই গুতোগুতি শুরু করে।সেখানে কিছুই নেই।তারপরও।

অন্বেষা এগিয়ে এলো চায়ের কাপ নিয়ে।সাথে দুটো টোস্ট বিস্কুট।বর্ণের সামনে রেখে তার মুখ ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে বলে,

“দোষ কি শুধু আমার একার? তুমিওতো ওই মেয়ের কথা বলে আমাকে রাগিয়েছো”

বর্ণ তাকে থামিয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে হাত তুলে।চায়ের কাপ অন্যহাতে তুলে জবাবহীন বসে রইলো। অন্বেষা থামবার পাত্রী নয়।আবার বললো,

“ঢং করবে না।তোমাকে এসব মানায় না।নিজের বউয়ের সামনে অন্য মেয়ের কথা তুললে কোনো দোষ নেই।আমি বললেই দোষ!”

বর্ণ রাগী চোখজোড়া তুলে।কিছুক্ষন চেয়ে থেকে বলে উঠে,

“কোনটা ফাইজলামি আর কোনটা সিরিয়াস বুঝার মত জ্ঞান যদি তোমার না থাকে তাইলে তোমার পড়ালেখার কোনো দাম নাই।আমার মত অশিক্ষিত হওয়া ভালা”

বর্ণ দ্রুত চা শেষ করে উঠে দাঁড়ালো।গোসল করা উচিত।অস্থির লাগছে।শার্ট খুলতে উদ্যত হয়।অন্বেষার কি যেনো হলো।মত বদলে এক মুহুর্ত সময় নেয় না যেনো।

অনেকদিন যাবত চেপে রাখা কথাগুলো হুট করে আলোচনার বিপরীতে বলে উঠে,

“আমাকে তোমার ঢাল হতে দিবে?”

বর্ণ হাত চালানো থামিয়ে দিলো।জিজ্ঞাসু নয়ন তার। বুঝেনি অন্বেষার কথার মানে। পরনের শার্টের বোতাম আধ খোলা।বর্ণ প্রশ্ন করে,

“কথা বুঝি নাই। ড্রামাটিক কথাবার্তা কম বুঝি”

অন্বেষা এগিয়ে এলো।বর্ণকে চমকে দিয়ে সন্তর্পনে বুকে মাথা এলিয়ে দেয়।বর্ণ কিছুটা অবাক হলো।বরাবরের মতো ভালোবাসা জিনিসটা কমই হজম হয়।কিন্তু কিছু বললো না।অন্বেষা জবাব শীতল স্রোতের ন্যায় বলে উঠলো,

“এই পৃথিবীতে বিবাহিত সফল যত নারী আছে তাদের পেছনে কার হাত জানো?.... হুহ!তুমি জানবে কি করে?তুমিতো এই জগত সংসারের নও।সেই সকল নারীর সফলতার পেছনে একজন দায়িত্বশীল, সু-বিবেক সম্পন্ন পুরুষের হাত থাকে।”

“আবার জ্ঞান বিতরণ শুরু!হঠাৎ এসব বালের কথা কেন জুড়লা? গাঁজা খাইছো?”

অন্বেষা গুরত্বহীনভাবে নিজের কথা বলে যায়,

“আমি দেখতাম আর ভাবতাম”

অন্বেষার কথা কেটে বর্ণ প্রশ্ন করে, 

“কি ভাবতা হেডা?”

অর্ধ উন্মুক্ত বুকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে অন্বেষা বললো, 

“ভাবতাম যে এই পুরুষগুলোর পেছনে কে আছে? হ্যাঁ বাবা মায়ের অবদান আছে ঠিক।কিন্তু সেই নারীকে এগিয়ে যেতে যে সাহায্য করে তাকেও কি কেউ সাহায্য করে?”

ভারী প্রশ্ন করলো অন্বেষা।বর্ণের মস্তিষ্ক এর জবাব খুঁজতে তোড়জোড় শুরু করলো।উত্তর যদিও না বোধক আসছে তারপরও যুক্তি খুঁজতে চাইলো বর্ণ।পাচ্ছে না তবে। অন্বেষা হালকা মাথা তুলে বললো,

“কি?কোনো জবাব নেইতো?”

“উহু”

“জবাব হলো করেনা।কারণ এই সমাজে আয়ের দায়িত্বটা শুধু পুরুষের। নারী আয় করলেও সিংহভাগ যায় পুরুষের কামাই থেকে।”

“হ কি করমু তাইলে আমি?এসব কেন কইতাছো?”

“আমি চাই ঠিক আমার প্রথম কথাটাকে উল্টো করে দেখাতে।যদি পুরুষ নারীকে তার ঘরে এনে তার সমস্ত চাহিদা পূরণ করতে পারে?তার পড়ালেখা,তার দায়িত্ব,তার ইচ্ছা,তার স্বপ্ন,তার সফলতার ভাগীদার হতে পারে তাহলে নারী কেনো পারবে না তার শখের পুরুষের সব দায়িত্ব নিতে?”

মাথার উপর দিয়ে গেলো বর্ণের।প্রশ্ন করলো,

“কি কইতাছো এগুলি?আমি কি তোমার শখের পুরুষ?.....আমার মাথায় কিচ্ছু ঢুকেনা বাল!”

বর্ণ সবই বুঝে।তবে বুঝতে দিতে চায় না।অন্বেষা মুখ তুলে।বর্ণের দিকে চেয়ে বললো, 

“সহজ ভাষায় বুঝাই।একজন স্বামীর দায়িত্ব আমি পালন করবো।তোমার ইচ্ছে,স্বপ্ন আমার সাধ্যের মধ্যে আমি পূরণ করবো।যেদিন অব্দি তুমি সফল না হও সেইদিন অব্দি তোমার সব চাহিদা আর দায়িত্ব আমি পালন করবো।আবার বলছি সাধ্যের মধ্যে।কেনো শুধু স্বামীরাই? বউরা পারেনা তার স্বামীর ঢাল হতে?যদি তুমি কোনোদিনও না সফল হও তাহলে মৃত্যুর আগ অব্দি পালন করবো সব কর্তব্য।আমার কিছুই নেই বর্ণ।তুমি,আমি নিঃস্ব।শুধু একে অপরের ভরসার কাঁধ ছাড়া আর আমাদের ভালোবাসা ছাড়া।তোমাকে নিয়ে আমার যত আহ্লাদ আছে সব পূরণ করতে দাও।আমি তোমার চেয়ে বেশি আয় করি বলে কখনো তোমাকে কাপুরুষের খোটা দিবো না।কোনোদিন টাকার দাপট দেখাবো না।এই খুপড়ি দালান আমাদের আলাদা জগত।এই জগতে বাহিরের সমাজের সাথে কোনো সংযোগ নেই।ওরা জানবে যা কখনো আমাদের মধ্যকার কোনোকিছু।ওরা থাকুক ওদের চিরাচরিত নিয়মে।আমাদের সংসারে আমাদের আলাদা নিয়ম। কেউ ছোট কেউ বড় না।আমরা দুজন মিলেমিশে সমান”

অন্বেষা পূনরায় কাতর কন্ঠে বললো, 

“আমি অজান্তেই ভালোবাসি তোমাকে।অনেকদিন যাবত চাইছিলাম বলতে।পারিনি।ভয় ছিলো।নিজের মানুষের কাছেই প্রত্যাখানের ভয়।”

প্রথমবার অন্বেষার কথাগুলো মনোযোগ সহকারে শুনেছে।এক মুহূর্তের জন্য অন্যমনস্ক হয়নি বর্ণ।কেনো হৃদয় নিংড়ানো মনে হলো অন্বেষার শব্দ মেলা? অন্বেষার চোখের কোনে পানি জমেছে।বর্ণের রুক্ষ গালে দুহাত রেখে বললো,

“তোমার বুকের ভিতরের হাহাকার আমার অজানা নয়।আমি জানি এক উত্তাল ঝড় চেপে আছো অনেক বছর যাবত।চাইলেই শক্তিহীন করতে পারো এই ঝড়কে।”

বর্ণ বলে, “ঝড় আছিলো মনে হয়…”

“এখন?”

“জানি নাহ”

“এখনও আছে বর্ণ”

“ছাদে যাইবা?”

অবাক হয়েছিল অন্বেষা।কথার জবাব না দিয়ে ছাদে নিয়ে এলো। অদ্ভুত হওয়ার সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে বর্ণ আগেই।আবারো সেই সিঁড়ি চড়ার যুদ্ধ শেষে ছাদে এসে হাজির দুজনে।রেলিংয়ে উঠে বসেছে বর্ণ। 

গোলাকৃতির চাঁদের দিকে চেয়ে বলতে লাগলো,

“আম্মাতো মইরা গেছে অনেক আগেই। আব্বা!.....বাল!মানে আমার মায়ের জামাই তিনদিনের মাথায় আরেক বেটি ঘরে তুলছিলো।এই বেডিরে আমার আম্মা থাকাকালীনই বিয়া করছিলো।আম্মা জানতো।কিন্তু চুপ কইরা থাকতো।গরীব ঘরের মাইয়া আছিলো যে।ওই ঘরে একটা পোলাও আছিলো।আমারতো তহন বুঝার বয়স আছিলো না।দিন যায় আমিও মা পাইলাম।কিন্তু.....ওইসব বাদ!তেরো বছর বয়সে চুরি করছিলাম।নতুন মায়ের সোনার গয়না। মানে চুরিটা এমন যে আমি জানতাম না যে আমি চুরি করছি। হাইস্যকর না!কিন্তু সোনার গয়নাগুলি আমার ইস্কুলের ব্যাগ থিকা পাইলো।কেমনে পাইলো জানি না।এরপর ধীরে ধীরে আরো চুরি হইলো।আমার মায়ের জামাইর বেল্টের বারি খাইয়া জানতাম সব নাকি আমি চুরি করছি।তারপর একদিন জানলাম আমি নাকি নতুন মায়ের বইনের মাইয়ার লগে নোংরামি করবার চাইছি।তহন আমার উনিশ আঠারো।ইন্টার দিয়া ভার্সিটিতে ভর্তি হইছিলাম।”

অন্বেষা বর্ণের থেমে যাওয়া দেখে প্রশ্ন করলো,

 “তারপর?”

“আমার পিঠে দাগ আছে। রডের বারি পড়ছিলো।শালার ভাই জ্বালায় লাইছিলো পুরা পিঠটা আমার।এরপর বাড়ি থিকা বাইর করলো।এরপর থিকা ফিরা তাকায় দেহি নাই।ওরা আমারে বাঘের মত ডরায়।আমার সামনে এহনও গলা উঁচা করার সাহস পায়না।আমি এদিকে জিতা গেছি।আমারে আবার ওই বাড়িতে নিতে চাইছিলো।আমি ওগো বাড়ির গেটে মুইতা থুইয়া আইছি।ধুচি না ওই জানোয়ার এর ট্যাকা!সম্পদ!কিন্তু ওরা যে আমারে ডরায়?এটা আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া।”

উচুঁতে বসে থাকা বর্ণকে আকস্মিক জড়িয়ে ধরলো অন্বেষা।কথাগুলো শুনে নিজেকে সামলাতে পারছে না।কিন্তু বর্ণ তাল সামলায় কোনো রকম।মৃদু চেঁচিয়ে বলে,

“আরেহ ছেড়ি পইড়া যামুতো!”

“কে ছিলো তোমার বাবা?”

বর্ণ এক বুক ভর্তি নিঃশ্বাস ফেলে।চোখ যায় আসমানে।জবাব এলো,

“হাআআআহ! মোকলেস মাতবর”



চলবে…….......................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন