হৃদয়েশ্বরী - পর্ব ৪৫ - সাদিয়া মেহরুজ দোলা - ধারাবাহিক গল্প


উশান বাগানে চারা রোপণ করছে। বুঁনো গোলাপের চারা। মীরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে উশানের চারা রোপণ করা দেখছিল এক মনে। সিক্ত কেশ দিয়ে তার পানি পড়ছে টপটপ করে সেদিকে খেয়াল নেই তার। পানি পড়ে তার সদ্য নতুন শাড়ীটার আঁচল পুরো ভিজে গিয়েছে। ভেজা আঁচল মুক্ত সমীরে উড়ে যখন তার হাতে বাড়ি খেল তৎক্ষনাৎ হুঁশে ফিরল মীরা। উশান তখন উঠে দাঁড়িয়েছে। মীরা ছুটল রুমে! উশানের সাথে যেন চোখাচোখি নাহয় তার জন্য আজ সকাল থেকে সে এক প্রকার পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। অদ্ভুত হলেও সত্য মীরা ভীষণ লজ্জা পাচ্ছে।ভয়ানক লজ্জা! উশানের মুখোমুখি হতে হবে তা ভাবলেই তার গা হিম হয়ে উঠছে ত্রপার ভারে। কি মুশকিল! 

রুমে উপস্থিত হওয়ার পর মীরা চটপট সিদ্ধান্ত নিল সে এখন শাড়ী বদলে উমাইশার রুমে ঢুকবে। সেই ১ বার যে ঢুকবে উশান বাসা থেকে না যাওয়া পর্যন্ত আর বের হবেনা। কিছুতেই না! স্বগতোক্তি করা শেষ করে মীরা নতুন একটা শাড়ী হাতে নিল। ওয়াশরুমে শাড়ী হাতে ছুটবে তৎক্ষনাৎ উশান রুমে হাজির।

-" এই মেয়ে এই দাঁড়াও! "

কান এঁটো করা ধমক শুনে মীরা থামল মাঝরাস্তায়। পিছন ফিরল নতজানু রূপে। দৃষ্টিপাত যখন তার ভূমিতে স্থির হয়ে তখন সে শ্রবণ করল তাড়াহুড়ো করে ফেলা পদচারণের শব্দ। প্রখর ধ্বনি! কর্ণকুহরে এসে বাজছে বারবার। আঁড়চোখে সম্মুখে তাকাতেই খেয়াল হয়, উশান তার সামনে দাঁড়িয়ে। লোকটার মুখাবয়ব দর্শন করা হলো না মীরার। নতজানু যে সে! 

-" সকাল থেকে এমন পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছ কেন বলো তো? ঘুম থেকে উঠে পেলাম না। বাহিরে যাওয়ার সময়ও দেখলাম না। বাগানে গাছ লাগিয়ে উঠে দাঁড়ানোর পর ছুটে চলে গেলে আর এখন আবার পালাচ্ছো। সমস্যা কি? "

স্বাভাবিক হওয়ার প্রয়াস চালাল মীরা। হাতের শাড়ী কখন তার হাত পিছলে পড়ে গিয়েছে তা টেরই পায়নি সে। মেঝে থেকে নজর সরিয়ে মাথা তুলল। বলে উঠলো, 

-" পালাবো কেন? কাজ ছিল তাই রুমে ছিলাম না।"

উশান তীক্ষ্ণ নজরবিদ্ধ করল মীরাকে। বোঝার চেষ্টা করল আসলে হয়েছেটা কি এই মেয়ের? মীরা যে এই মাত্র মিথ্যা বলছে তা সে পুরোদমে নিশ্চিত।একটু নিখুঁত ভাবে মীরাকে অবলোকন করার পর উশানের আসল ব্যাপারটা বোধগম্য হলো। অদ্ভুত হাসল সে। কন্ঠের খাদ নামিয়ে গভীর স্বরে প্রশ্ন করল, 

-" কালকের ব্যাপারটার জন্য লজ্জা পাচ্ছো তাই না? মিথ্যা বলবে না! "

মীরা অপ্রতিভ হলো। বুঝলো কি করে এই লোক? আশ্চর্য! সে কি মুখবয়বে প্রতিক্রিয়া ফুটিয়ে তুলেছিল? হয়তো! নাহলে বুঝবে কি করে?উশানের প্রশ্নে নিরুত্তরহীন সে। ছুটল উশানকে ফাঁকি দিয়ে বাথরুমে। পেছন হতে উশান তখন চেঁচিয়ে বলল,

-" আশ্চর্য মেয়ে! লজ্জা পাওয়ার কি আছে? কাল রাতে না লজ্জা ভেঙে দিলাম? "

_____

 ' রুমিশা মাহবুব! বাংলাদেশে একজন দায়িত্ববান সাংবাদিক তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তার হ'ত্যাকারী তার আপন বোন রাহনুমা। ঠিক কি কারণে তাকে রাহনুমা হ'ত্যা করেছে তা জানা যায়নি এখনো। এ বিষয়টা সম্পর্কে আমি বলি স্যার। রুমিশা ছিলেন রাহনুমার ফুফাতো বোন। আপন বোন নয়! তবে তাদের দু'জনকে এ যাবৎ আপন বোন হিসেবেই সর্বদা পরিচয় দিয়ে আসা হয়েছে। রাহনুমার বাবা মাহাবুব তালুকদার, তিনি তার বোনের অকাল মৃত্যুর পর রুমিশা মাহাবুবকে নিজের কাছে এনে নিজের মেয়ের মতো লালন - পালন করা শুরু করেন।রুমিশার বাবা ছিল না। তিনি মারা গিয়েছিলেন। তার মৃত্যুর পর তার পরিবার রুমিশা এবং তার মায়ের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেন। 

মাহাবুব তালুকদার এবং তার স্ত্রী রুদিবা সবসময়ই রুমিশাকে নিজেদের আপন মেয়ে রাহনুমার থেকে রুমিশাকে বেশি ভালোবাসতেন। কারণটা জানা নেই সঠিক। রাহনুমা নিজের বাবা মাকে অন্য একটা মেয়ে কে বেশি ভালোবাসা, মর্যাদা দিতে দেখে তিনি ছোট থেকেই হয়ে উঠেছিলেন অদ্ভুত, রগচটা এবং আত্ন অহংকারী! দিনকে দিন অবহেলায় বড় হতে থাকা রাহনুমার মনে ছিল রুমিশাকে নিয়ে বেজায় হিংসা, ক্ষুদ্ধতা। রাহনুমার রুমিশার প্রতি ঘৃণার শুরুটা হয় এখান থেকেই। তারপর কিভাবে কি করে রাহনুমা প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার সাথে সাথে যুক্ত হলেন এক সন্ত্রা'সী দলের সাথে। সেখান থেকে তিনি হয়ে উঠলেন হিংস্র, নর'পশু! একটা সময় পরিবার থেকে নিরবিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন তিনি। তারপর একদিন রাতের আঁধারে নিজের বাড়ি ফিরে নিজের বাবা মা কে হ'ত্যা করলেন অত্যান্ত বা'জে ভাবে। তার লক্ষ্য ছিল রুমিশাকেও মে'রে ফেলা। কিন্তু রুমিশা তখন পড়াশোনার জন্য ঢাকায় থাকতেন। সুযোগ পাননি সে রুমিশাকে হ'ত্যা করার। তার কয়েকবছর পর! একদিন যখন মোক্ষম সুযোগ হাতে পেলেন তিনি সেদিন রুমিশাকে মে'রে ফেললেন তিনি রুমিশার দুই পুত্র সন্তানের সামনে। '

সেলফোনে আসা এই বার্তাটিকে কমপক্ষে চার থেকে পাঁচবার পড়ে ফেলেছে উজান। বারংবার বোঝার চেষ্টা করছে কে পাঠাল এই বার্তা? কে জানে এ সম্পর্কে? যেই নাম্বার থেকে ম্যাসেজ এসেছিল তার ফোনে, সেই নাম্বারটা ট্র্যাক করতে গিয়ে ব্যার্থ হয় তার টিম! উজানের অন্তঃকরণ তখন তুমুল অবিন্যস্ত। আচানক তার মাথায় এলো সিয়ার নামটা সুস্পষ্ট রূপে! আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে সিয়া তার মায়ের দোষ কিছুটা লাঘব করতে এই বার্তাটি প্রেরণ করেছে। কিন্তু সিয়া, এই মেয়েটা এখন কোথায়? 

________

-" কবে ফিরবে আবার? "

মলিনতা, একরাশ মন খারাপ বৃথা লুকানোর চেষ্টা করল মীরা। তবে সে সফল হলো না বোধহয়। উশান ঠিকই বুঝে নিল তার মন খারাপ। মাত্রই শাওয়ার নিয়ে বেড়িয়ে সে ইউনিফর্ম পড়ছিল। শেষ দু'টো বোতাম তাড়াহুড়ো করে লাগানো কালীন হাত দু'টো একটু একটু করে স্থির হয়ে আসলো তার। ধীরাজ পায়ে উশান এগোল মীরার নিকট। নিকটবর্তী পৌঁছে মীরার হাত দু'টো নিজের হাতের মুঠোয় নিল। জোড়াল শ্বাস ফেলে বলল,

-" দেখো মীরা! আমি মিশনে যাচ্ছি। সেখান থেকে ফিরে আসা না আসার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আল্লাহ তায়ালার হাতে থাকে। আমি নিশ্চিত হয়ে কিছুই বলতে পারবোনা। তবে হ্যা, আমি এর আগেও মিশনে গিয়েছি। ফিরেও এসেছি তবে আহত হয়ে! কখনোবা সুস্থ রূপে। আমার সাথে যারা যেত হয় তারা সুস্থ ভাবে ফিরতো, নয়তো আহত কিংবা মৃ'ত্য রূপে। আমি আমার অভিজ্ঞতা, কনফিডেন্স থেকে বলতে পারি আমি ফিরবো। সুস্থ রূপেই! এখন যদি আল্লাহ চান আমি মারা যাই তাহলে মরে যাবো। বুঝেছ? "

মীরাকে বিষন্ন দেখাল। উশান হতাশ হয়! মীরা কেন এমন? মেয়েটা কি বোঝে না উশান তার এই রূপ দেখে গেলে নিজের কাজে মনোযোগ দিতে পারবে না। 

-" তুমি ম্যাচিউর মীরা! ১৮-১৯ বছরের কিশোরী মেয়েদের মতো আচরণ করবে না। আমি ফিরে আসি কিংবা না ফিরি! এটা তোমার ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না। গট ইট? হাহ্? "

মীরা নম্র দেখাল। অত্যাধিক নম্র। সবসময় কঠিন দেখানো মীরাকে আচানক যেন পৃথিবীর সবথেকে নম্র মানুষটি মনে হলো। গাছপালা যেমন তার খাদ্য বস্তু রোদ, বাতাস, বৃষ্টি না পেলে নেতিয়ে যায় ঠিক তেমনি করে মীরা নেতিয়ে গেল। অবিন্যস্ত চাহনি মেলে আশেপাশে দেখে মাথা এলিয়ে দিল উশানের প্রশস্ত বুকে। দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করল উশানকে। তবে সম্ভবপর হলো না। তার হাত দু'টো বেশ কাঁপছে। মীরা থেমে থেমে গলার স্বর নম্র করে বলল, 

-" তোমার কিছু হলে আমি সত্যি সত্যিই সেই মূর্হতে মারা যাব আমি। "

উশান বেফাঁস হলো। তৎক্ষনাৎ সে সামলালো নিজেকে। স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,

-" টিপিক্যাল ওয়ার্ড'স। "

মীরা ক্ষুদ্ধ হলো। রুষ্ট কন্ঠে শুধাল, 

-" ইট'স নট টিপিক্যাল ওয়ার্ড'স। "

উশান হেঁসে ফেলল। মীরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে উঠলো, 

-" ওকে! ওকে! "

পরবর্তী কয়েক লহমা মীরা নিশ্চুপ রইল। কিছু বলার মতো খুঁজে পেল না। অথবা বলতে চাইল না। উশানও কথা বাড়ায়নি! হাত ঘড়ি দেখল সে। তার দেরী হচ্ছে। তবুও ইচ্ছে করছে না যেতে।এই মেয়েটা কে ফেলে যেতে হবে ভাবতেই তো কেমন তার বুকে মোচড়ঁ দিচ্ছে! শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আফসোস গুলো ছিল ক্ষনিকের। পরপর নিজেকে সামলে নিল সে৷ তাকে এসব কথা মানায়? কিছুতেই না! 

গা ছমছম করা মৌনতায় ধস নামিয়ে মীরা হুট করে বলল, 

-" আমি কখনোই নিজের থেকে কাওকে কক্ষনোই বেশি ভালোবাসি না জানো? কাওকে নিজের থেকে বেশি ভালোবাসা মানেই কষ্ট পাওয়া!সেই ব্যাক্তিটার চিন্তায় রাতদিন ডুবে থাকা। সে যদি কষ্ট থাকে তাহলে সেই মূর্হতটার মতো মারাত্মক মরণ যন্ত্রণাময় মূর্হত আরেকটাও নেই। আমি জানতাম এসব! তবুও কি করে নিজের থেকে বেশি আপনাকে ভালোবেসে ফেললাম বলুন তো? আপনার মতো নিষ্ঠুর - পাষাণ লোকটাকে আমার একটুও ভালোবাসা উচিত হয়নি একটুও না! "

উশান মীরার নুইয়ে রাখা মুখোশ্রী চিবুক ধরে ওপরে তুলল। মীরা কাঁদছে না! তবে আঁখি দু'টো দীঘির পানির মতো টলমলে হয়ে। উশান গেলেই যে তারা অনুমতি পেয়ে টপটপ করে শ্যাম রঙা গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়বে তা উশান জানা আছে।মীরা নিজেকে ধাতস্থ করল। তুলতুলে দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, 

-" আমার কপালে একটা চুমু খাও তো সময় নিয়ে। "

নিঃসঙ্কোচ আবেদন, আকুতি। উশান এক মূর্হত দেরী না করে তাই করল। পাঁচেক মিনিট পর সরে এসে উঠে দাঁড়াল। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র হাতে নিয়ে কৃত্রিম বিরক্তি নিয়ে বলল, 

-" আমার লেট করিয়ে দিলে মেয়ে! "

যাওয়ার পথে উমাইশার সাথে কয়েকক্ষণ আলাপ করে, উজানকে মীরা - উমাইশার দায়িত্ব তুলে দিয়ে উশান যখন সবেমাত্র গাড়িতে উঠে বসল তৎক্ষনাৎ কোথা থেকে যেন মীরা ছুটে আসলো। উজান দাঁড়িয়ে ছিল বাহিরে। ভাইকে বিদায় দিতে। কবে না কবে আবার আসে উশান! মীরাকে ছুটে আসতে দেখা মাত্র উজান দু'জনকে স্পেস দিয়ে সরে গেল। উজান যেতেই মীরা উশানকে ঝাপটে ধরল! বলল,

-" জলদি জলদি ফিরে আসবে। ঠিক আছে? হুহ্?"

উশান অধর প্রসারিত করে হাসল। জবাব দিল, 

-" আসবো! মাদকতাকে ফেলে কতক্ষণ দূরে থাকা যায়? বাসায় যাও এখন। "

-" আপনি যেতে যেতে একটু থাকিনা। "

উশান বিশেষ বারণ করল না। উজানকে ডাক দিল। উজান আসতেই দু'জন গাড়িতে বসে নিজ গন্তব্যে রওনা দিল। গাড়িটা চক্ষু আড়াল হওয়া অব্দি মীরা মূর্তির ন্যায় স্থির হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল ক্ষণ কয়েক। সে বিমর্ষ গলায় শুধাল, 

-" শেহজাদা ফিরে আসুক। সুস্থরূপে, অতি দ্রুত! "
.
.
.
চলবে.........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন