শ্রাব‌ণের সে অপেক্ষা - পর্ব ০১ - শার‌মিন আক্তার সাথী - ধারাবাহিক গল্প

শ্রাব‌ণের সে অপেক্ষা 
পর্ব ০১ 
‌শার‌মিন আক্তার সাথী 
.
.
.
১!!

চৈত্র মা‌সের ‌কো‌নো এক তপ্ত বিকালে আমার আর ঐশীর বি‌য়ে ঠিক হ‌য়েছি‌ল। কী তপ্ত গরম ছি‌ল সে‌দিন! অসহ্য গর‌মে ঘে‌মে নে‌য়ে বা‌জে অবস্থা হ‌য়ে‌ছি‌ল সবার। ছোট‌ো মামার উপর রাগও হ‌য়ে‌ঠিল খুব। কী দরকার ছি‌ল, এ অসহ্য গর‌মে মে‌য়ে দেখ‌তে আসার? আমার নি‌জে‌কে মা‌টি কাটা কামলা‌দের মত লাগ‌ছি‌ল। সারা গা‌ ঘা‌মে ভেজা, সা‌থে বিশ্রী গন্ধ। নীল র‌ঙের শার্টটা ঘা‌মে ভিজে গা‌য়ের সা‌থে লে‌প্টে আছে। ভা‌র্সি‌টি থে‌কে দুপু‌রে বাসায় যাই‌নি, বন্ধু‌দের সা‌থে আড্ডা দি‌য়ে বিকা‌লে বা‌ড়ি ফির‌ছিলাম। তখন ছোটো মামার কল, জি‌জ্ঞেস কর‌লেন,
"কোথায় আছি?"
আমি বললাম,
"রাস্তার মো‌ড়ে।"
মোড় থে‌কেই গা‌ড়িতে তু‌ললে নি‌লেন। ভিত‌রে বাবা-মা আর আমার মেজ বোন সামিয়া বসা ছি‌ল। আমি ভিত‌রে ঢোকার পর মামা বল‌লেন,
"আমারা তোর জন্য মে‌য়ে দেখ‌তে যা‌চ্ছি।"
মেজাজটা খা‌নিক চড়া হ‌লেও ছো‌টো মামার সা‌থে মেজাজ দেখা‌নোর সাহস ছিল না। তি‌নি বেশ রাগী, গম্ভীর। তাই ঠান্ডা গলায় বললাম,
"আগে বা‌ড়ি গি‌য়ে গোসল ক‌রে, ফ্রেশ হয়ে তারপর যাই।"
আমার কথা শু‌নে যে তি‌নি চরম বিরক্ত বোধ কর‌ছেন তা তার কুঁচ‌কা‌নো ভ্রু দে‌খেই বুঝা যা‌চ্ছে। ‌তি‌নি বল‌লেন,
" গতকালই তো বলে‌ছিলাম, আজ বিকা‌লে মে‌য়ে দেখ‌তে যা‌ব তৈরি থা‌কিস। ত‌বে বন্ধু‌দের সা‌থে টো টো কর‌তে গে‌ছিলি কেন?"
মাথা নিচু ক‌রে বললাম,
" ইয়ে মা‌নে মামা, আমি ভু‌লে গেছিলাম।"
" তাহ‌লে এখন এই গাধা বে‌শেই চল। মে‌য়েটা দেখুক সে কোন গাধার সা‌থে সংসার কর‌তে চল‌ছে।"
" মামা..."
" কো‌নো কথা না। মে‌য়ের বাবা চট্টগ্রা‌মে চাক‌রি ক‌রেন। আজ রা‌তের লঞ্চে তি‌নি ঢাকা যা‌বেন তারপর চট্টগ্রাম। তি‌নি তার উপ‌স্থি‌তি‌তে মে‌য়ে দেখা‌তে চান। তাছাড়া মে‌য়েও তো ঢাকা'র এক‌টি ক‌লে‌জে প‌ড়ে। আজ বাবার সা‌থে সে-ও ঢাকা যা‌বে। স‌ন্ধ্যার পর তারা চ‌লে যা‌বেন। আমা‌দের এখ‌নি যে‌তে হ‌বে। তোর পোচপাচ করার জন্য ব‌সে থাক‌লে আজ আর ‌মে‌য়ে দেখা হ‌বে না। যখন মে‌য়ে দেখার কথা খেয়াল ছি‌ল না, তখন এমন হনুমান বে‌শেই চল।"

মামার কথার উপর তখন কথা বলার সাহস আর হ‌লো না। গর‌মে সারা‌দিন রো‌দে ঘু‌রে এম‌নি তো হনুমান লাগ‌ছে। গো‌দের উপর বিষ‌ফোড়া যে বাসায় এসে‌ছি সেখা‌নে কিছুক্ষণ আগে বিদ্যুৎ চ‌লে যাওয়‌ায় এখন পু‌রোপু‌রি হনুমা‌নের দ‌লের একজনই লাগ‌ছে। আমি নি‌শ্চিত কো‌নো হনুমান আমা‌কে দেখ‌লে হনু ভে‌বে টে‌নে টে‌নে তা‌দের দ‌লে নি‌য়ে যা‌বে। তারপর আমা‌কেও গা‌ছে গা‌ছে লাফা‌তে হ‌বে।
মে‌য়ে‌কে আমা‌দের সাম‌নে আনা হ‌লো। মেয়ের হা‌তে ধোঁয়া ওঠা গরম চা‌য়ের ট্রে। এই গরম চা দেখে আমার গা গোলা‌চ্ছে। কেমন জা‌নি ঝা‌রি মারল পুরো শরী‌রে। মে‌য়ের দি‌কে না তা‌কি‌য়ে আমি একম‌নে চা‌য়ের দি‌কেই তা‌কি‌য়ে রইলাম। সা‌মি‌য়া আমা‌কে খোঁচা দি‌য়ে ফিস‌ফিস ক‌রে বলল,
" ছোঁচার মতো ওমন চা‌য়ের দি‌কে তা‌কি‌য়ে আছিস কেন? জীব‌নে চা খাস‌নি?"
আমি খা‌নিক ন‌ড়েচ‌ড়ে বসলাম। মে‌য়ের দি‌কে তাকালাম। সাধারণ উজ্জ্বল চেহারা, বেশ মি‌ষ্টি দেখ‌তে। মা, মে‌য়েটা‌কে জি‌জ্ঞেস কর‌লেন,
" তোমার নাম কী মনা?"
‌মে‌য়েটা মাথা তু‌লে বলল,
" ঐশী।"
" কি‌সে প‌ড়ো?"
"এবার এইচ এস সি দিব।"
"কোন বিভা‌গে পড়া‌শোনা কর‌ছো?"
"বিজ্ঞান।"
" মাশাআল্লাহ্! এস এস সি কত প‌য়েন্ট ছি‌ল।"
" জি ৪.৮৮।"
বাবা বেশ শব্দ ক‌রে বল‌লেন,
" মাশাআল্লাহ! মাশাআল্লাহ! আর একটু হ‌লেই তো এ প্লাস পে‌তে।"
" ‌জি আঙ্কেল। আস‌লে জীব‌বিজ্ঞান আর পদার্থ‌বিজ্ঞান পরীক্ষার সময় আমার টাইফ‌য়েড হ‌য়ে‌ছি‌ল। সে কার‌ণে ঐ দু‌টোতে প‌য়েন্ট খুব কম আস‌ঠে।"
" এব‌ার মন দি‌য়ে প‌ড়ো যা‌তে এবার এ প্লাস আসে।"
ঐশী মাথ‌া কাত ক‌রে বলল,
" জি আচ্ছা।"
আমার ম‌নে হ‌চ্ছি‌ল এরা বি‌য়ের জন্য মে‌য়ে দেখ‌ছে না বরং চাকরির ইন্টার‌ভিউ নি‌চ্ছে। আর মে‌য়েটা‌কেও দে‌খে বেশ স্বাভা‌বিক লাগ‌ছে। আমার ম‌তো নার্ভাস সে না। নার্ভাস হ‌লে এত স্বাভা‌বিক ভ‌ঙ্গি‌তে প্র‌শ্নের উত্তর দি‌তে পারত না। ভা‌লো, মে‌য়ে‌দের ম‌ধ্যে আত্ম‌বিশ্বাস থাকা ভা‌লো।

আমা‌কে আর ঐশী‌কে যখন একা‌ন্তে কথা বল‌তে দেওয়া হ‌লো, তখন আমার ওকে জি‌জ্ঞেস করা প্রথম কথা ছি‌ল,
" আপনা‌দের বাসার ফ্রীজে ঠান্ডা পা‌নি আছে? আমা‌কে বরফ দেয়া এক গ্লাস ঠান্ডা পা‌নি দেওয়া যাবে?"
ঐশী ক‌য়েক সে‌কেন্ড আমার দি‌কে তা‌কি‌য়ে থে‌কে বলল,
"একটু অপেক্ষা করুন।"
‌কিছুক্ষণ পর ঐশী একগ্লাস ঠান্ডা পা‌নি নি‌য়ে আসল। সা‌থে এক বা‌টি বরফ আর আরেকটা গ্লা‌সে তরমু‌জের জুস, ভিত‌রে বরফ কু‌চি আর লেবু দেওয়া। স্বচ্ছ কা‌ঁচের বা‌টি‌তে স্ল্যাইস করা তরমুজ। আহা এই অসহ্য গর‌মে এসব আমার কা‌ছে অমৃ‌তের মত লাগ‌ছি‌ল। শরবত আর পা‌নিটা পর পর দুই চুমু‌কে খে‌য়ে ফেললাম। ত‌ারপর তরমু‌জের বা‌টিটা হা‌তে নি‌য়ে বিনা ধিধায় বা‌টিটা খা‌লি করে ফেললাম। একে তো তরমুজ আমার পছ‌ন্দের ফল আর প্রচন্ড গর‌মে ফ্রিজে রাখ‌া ঠান্ডা ঠান্ডা তরমুজ। উফ! এরই নাম তো অমৃত। মে‌য়েটা বোধ হয় আমার খাওয়া দে‌খে অবাকই হ‌লো, কিন্তু তা‌তে কী! এই গর‌মে আমার জা‌নে প্রাণ ফি‌রে ‌পেলাম। খে‌য়ে মে‌য়েটার দি‌কে তা‌কি‌য়ে বললাম।
" আপনা‌কে আমার খুব পছন্দ হ‌য়ে‌ছে। এই গর‌মে যে এত মজার শরবত খাওয়ায় তা‌কে নিঃসন্দে‌হে জীবন প‌থে চলার সঙ্গী করা যায়।"
‌মেয়েটা আমার কথায় অবাক হ‌লেও লাজ‌ুক হাসল। হা‌সি‌তে মুগ্ধ হ‌য়ে ম‌নে ম‌নে তার নাম দিলাম লাজুক লতা।"
সে‌দিন মোটামু‌টি আমা‌দের বি‌য়ের সব পাকা কথা ঠিক হলো। আং‌টি বদলও হলো। সাম‌নের আষা‌ঢ় মা‌সে আমা‌দের বি‌য়ে হ‌বে। আমি ম‌নে ম‌নে ভে‌বে‌ছিলাম আষা‌ঢ়ে বি‌য়ে হ‌লে শ্রাবণ পর্যন্ত বিয়ের পর প্রেম ক‌রে তারপর শ্রাবণ‌ে ভা‌লোবাসার প্রণয় হ‌বে।

২!!

চৌদ্দ বছর পর,
জীবন থে‌কে চ‌লে গে‌ছে চৌদ্দটি বছর। চৌদ্দ বছ‌রে বদ‌লে গেছে জীব‌নে চলার মোড়। শুধু জীব‌নের মোড়-ই বদলানি বদ‌লে‌ছে বহু জীবনও। না ঐশীর সা‌থে আমার বি‌য়ে এখনও হয়‌নি। খুব বে‌শি ভা‌লোবাসার একটা সম্পর্ক হওয়ার পরও শেষ পর্যন্ত আমা‌দের বি‌য়েটা আর হয়‌নি। কিছু ঘটনা আর দূর্ঘটনায় আমা‌দের চলার পথ এক হ‌তে দেয়‌নি। ত‌বে আমার বা ঐশীর কা‌রোরই এখনও বি‌য়ে হয়‌নি।
.
.
.
চল‌বে.......................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন