পূর্ণিমা সন্ধ্যা - পর্ব ০৩ - নবনীতা শেখ - ধারাবাহিক গল্প


সাধারণত অপরাধীরা চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারে না, চোখের পাতা কাঁপে তাদের। ইফতি বিষয়টা বোঝে। অরণীকে পরীক্ষা করতে, কিংবা এমনিই ইচ্ছে করছে বলেই হয়তো তার দিকে ইফতি স্থির দৃষ্টিতে তাকাল। গলায় গাম্ভীর্যের শতভাগ স্পর্শ রেখে বলল,
-“আমি ইফতেখার মাহমুদ।”

অরণীর খুব বলতে ইচ্ছে করল, 
-“ওহ আচ্ছা। সুন্দর নাম।”

অথচ পরিস্থিতির সাথে যাচ্ছে না, যাবে না বলে এমন কথা সুন্দরী অরণী বলতে পারল না। বরঞ্চ তাকাল চোখের দিকে। অরণীর চোখের দৃষ্টি তারও অধিক স্থির। নড়বড়ে নয় গলার আওয়াজও। অসম্ভব দৃঢ়তার সাথে সে বলল,
-“সন্ধ্যায় আপনাকেই কল করেছিলাম?”
-“হ্যাঁ। বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন।”

পুরো দুনিয়া এখন অরণীর কাছে অবসন্ন লাগছে। খিদেয় পেট জ্বালা করছে। সব গোছানো শেষ প্রায়। রান্নাও হয়ে এসেছে। মা'কে এনেই খাবে একসাথে। এই অবস্থায় বিস্তর আলোচনার শক্তি তার নেই। শ্রান্ত গলায় বলল,
-“আমি প্রচণ্ড টায়ার্ড আর অনেক কাজ বাকি। ক্যান উই টক টুমোরো, প্লিজ?”

কী অবলীলায় নিজের পরিস্থিতিটা জানাল অরণী! জড়তা ও সংকোচের দোহায় দিয়ে বেশিরভাগ মানুষই ‘না’ বলতে পারে না। অরণীর ‘না’ বলতে জড়ত্ব কাজ করে না। ব্যাপারটা প্রশংসনীয়। ইফতি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
-“শ্যিওর।”

অরণী স্বস্তির শ্বাস ফেলল। ইফতি চলে যেতেই সে রান্না শেষ করে শাওয়ার নিয়ে নিল। এক্সট্রা জামা কাঁধব্যাগে থাকে তার। একটু ফ্রেশ লাগতেই সে রিকশা নিয়ে বের হয়ে গেল তাবাসসুমের বাসার উদ্দেশ্যে। মাকে নিয়ে আসতে হবে এখন।

______

রাত সাড়ে এগারোটার এদিকে সময়। বারান্দায় রাখা সোফায় গা এলিয়ে বসে সিগারেট টানছে ইফতি। পরনে টিশার্ট-ট্রাউজার। সদ্য শাওয়ার নেওয়া ভেজা চুলগুলো কপালে লেপটে আছে। চোখ দুটো বন্ধ করে একনাগাড়ে কয়টা যে সিগারেট শেষ করল, ইফতি জানে না। কখনো হিসেবও রাখে না। 

রিকশার টুংটাং শব্দে তার ঘোর কাটে। মাথা ঘুরিয়ে ওদিকে তাকানোর ইচ্ছেটা তার হলো না। একাকিত্ব খুব জ্বালাচ্ছে আজ তাকে। সবকিছু বিষণ্ণ লাগছে। বোধহয় না দুনিয়ার কোনো চমকই এখন তাকে উৎফুল্ল করতে পারবে। অথচ বোধ না হওয়া জিনিসটা ঘটল। কিছুক্ষণ পর একটা মেয়েলি আওয়াজ তার কানে এলো,
-“মামনি, সাবধানে নামো।”

আওয়াজটা মোটা নাকি চিকন, তা বিশেষ বোঝা যাচ্ছে না। তবে মিষ্টত্ব নেই, নমনীয়তা আছে শতভাগ। ইফতি না চাইতেও এবার সামান্য তাকাল ওদিকে। অরণীর সাথে একজন চল্লিশোর্ধ্ব মহিলাকে দেখতে পেল। দু'জনের চেহারার গঠনে আশি শতাংশ মিল। একদেখায় বলে দেওয়া যায়, এরা মা-মেয়ে। এতে ভাবার প্রয়োজন পড়ে না।

শুধু যে দু'জনের চেহারাতেই মিল লক্ষ করা যাচ্ছে, এমনটা না। মুখাবয়বের অভিব্যক্তিও শতভাগ মিলে যাচ্ছে। যেন তারা দু'জনই এই পৃথিবীর ওপর নাখোশ, এই সমাজব্যবস্থার ওপর নারাজ। 

বরাবরই লক্ষ করা যায়, মায়েরা তাদের সন্তানদের ঢাল হয়ে দাঁড়ায়, সবসময় আগলে রাখে। এবার কিছুটা ভিন্ন ঘটনা দেখা গেল। মেয়ে তার মায়ের ঢাল হয়েছে, মাকে আগলে রাখছে। একহাতে লাগেজ ও অন্যহাতে মাকে জড়িয়ে নিয়ে সে হেঁটে হেঁটে ভেতরে প্রবেশ করল। মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে, বয়স খুব একটা নয়। অথচ পুরো পৃথিবীর দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে রেখেছে যেন। 

ভীষণ গভীর মনোযোগে এতকিছু খুব সহজেই লক্ষ করল ইফতি। ঠোঁটের ভাঁজ থেকে সিগারেট সরিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল। বাঘিনী একটা!

মাকে নিয়ে অরণী যখন নতুন ফ্ল্যাটে প্রবেশ করল, বড়ো করে শ্বাস টেনে প্রশস্ত হেসে বলল,
-“তোমার নিজের সংসার এটা। আমার আর তোমার বাড়ি। একটু সাজিয়ে-গুছিয়ে নিই, চলো!”

জল ছলছল চোখে তাকাল আয়শা অরণীর দিকে। আজ সকালে পাওয়া আঘাতটা তাকে বড়ো মলিন করে ফেলেছে। কোনো অনুভূতিই ঠিকঠাক প্রকাশ করতে পারছে না। পারছে শুধু অবাক হতে, চোখে জল আসে মাঝেসাঝে। এছাড়া বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া তার মাঝে দেখা যাচ্ছে না। 

অরণী আয়শাকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। পুরো ফ্ল্যাটটা ঘুরিয়ে এনে বেডরুমে বসাল। এরপর ফ্রেশ হয়ে নিয়ে রান্না করে রেখে যাওয়া খাবার অরণী থালা ভরে এনে আয়শাকে বলল,
-“মামনি, খিদে পেয়েছে। খাইয়ে দেবে?”

আয়শা মেয়েকে খাইয়ে দিলো। সারাদিনের না-খাওয়া অরণী একটু বেশিই খেলো এখন। আয়শাকেও খেতে বলল। খাওয়া শেষে অরণী আয়শাকে ঘুম পাড়িয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। 

জীবন তাকে কোন মোড়ে এনে দাঁড় করিয়েছে সে ভাবতে লাগল। দায়িত্ববোধ বেড়েছে তার। আগামীকাল মাকে নিয়ে বেরোতে হবে। একটা সংসারে কী কী প্রয়োজন, তাতে অরণীর সম্পূর্ণ ধারণা নেই। অন্যদিকে আয়শাকে ব্যস্ত রাখা এখন ভীষণ প্রয়োজন।

হুট করেই কোত্থেকে যেন সিগারেটের ধোঁয়া উড়ে এলো। অরণী কেশে উঠল শব্দ করে। সিগারেটের ধোঁয়া তার সহ্য হয় না, মাথা ঘোরায়, বমি পায়।

কাশির শব্দ শুনতে পেয়ে সোফায় গা এলিয়ে বসে থাকা ইফতি মাথা তুলল। আলস্যতায় ঘাড় নেড়ে ঠিক ওপর তলায় আড়াআড়িভাবে অবস্থান নেওয়া বারান্দাটায় তাকাল। একটা সদ্য চেনাজানা সুন্দরী অপরিচিতাকে দেখতে পেল সে। মেয়েটির পরনে সাদা কামিজ, সাদা পাজামা। সে কাশছে। ইফতির তাকিয়ে থাকতে থাকতে সেকেন্ড পাঁচেকের মধ্যেই রুমের ভেতর প্রবেশ করে ফট করে বারান্দার থাই গ্লাস আটকে ফেলল অরণী।

ইফতি ওদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তার মধ্যমা আর তর্জনীর ভাঁজে গুঁজে রাখা সিগারেটটার দিকে তাকাল। ঠোঁট উলটে বলল,
-“স্মোকও করতে পারব না?”

________

আজ অফডে। অরণী আয়শাকে নিয়ে সকালে বেরোল, দুপুরের আগেই ফিরে এলো। সঙ্গে আনল এত এত জিনিস। গেইটের কাছে আসতেই করিম এগিয়ে এসে জিনিসপত্র ওপরে নিয়ে যেতে সাহায্য করল। গতরাতে ইফতি তাকে বলেছে,
-“করিম চাচা, শোনো। মেয়েরা মানসিক দিক থেকে পাথর হলেও, শারীরিক দিক দিয়ে অতও স্ট্রং নয়। পুরুষ-সহায়তা প্রয়োজন তাদের। তুমি পারলে বাজার-টাজারের ব্যাগ ফ্ল্যাটে উঠিয়ে দিয়ে এসো।”

করিম তার কথা শুনেছে। ইফতি বিষয়টা লক্ষ করে খানিকটা প্রসন্নই হলো। বিকেলের দিকে অরণী আয়শাকে নিয়ে তার ফ্ল্যাটে এলো। ইফতি বিভিন্ন প্রশ্ন করল। কোথায় পড়ছে, কী করছে, কোথায় থাকত আগে, কেন হঠাৎ বাসা ভাড়া নেওয়া! ওপরে ওপরে যতটা বলা সম্ভব অরণী বলেছে। এমন অপরিচিত এক ব্যক্তিকে বিস্তারিত বলতে অরণীর বাঁধে। সুখকর তো কিছু নয়। পরে লোকটা না ভেবে নেয়, সহানুভূতি নিতে এসব বলেছে সে। তাছাড়া অরণী অন্তর্মুখী চরিত্রের মেয়ে। এতই সহজ নাকি নিজের জীবনের সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতি মুখে বিশ্লেষণ করা?

ইফতি অরণীকে যতই দেখছে ততই অবাক হচ্ছে। একটা মেয়ে এতখানি অন্যরকম কী করে হতে পারে? অরণীকে দেখে মনে হচ্ছে না সে রক্তে-মাংসে গড়া মানুষ, খুব করে মনে হচ্ছে এই মেয়েটা কংক্রিটের তৈরি।

অল্পক্ষণের ভেতরেই অরণী আয়শাকে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে এলো। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ইফতিকে জিজ্ঞেস করল,
-“আমার না-হয় এক ইউনিভার্স সমস্যা, তাই মাকে নিয়ে একা থাকছি। কিন্তু আপনি কেন?”

অরণীর প্রশ্ন করার ধরন শুনে ইফতি না চাইতেও হেসে ফেলল। চোখে হেসে উত্তর দিলো,
-“ম্যাডাম, আমার ইউনিভার্সের গোটাটাই সমস্যা। তাই একা থাকি।”

অরণী আর কিছু বলল না, মাকে নিয়ে ফ্ল্যাটে চলে এলো। আয়শা অরণীকে একবার জিজ্ঞেস করল,
-“তোর অনেক কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাই না, মা?”

অরণী মুচকি হেসে আয়শার একহাত ধরে বলল,
-“আমকে তৈরি করতে তোমারও অনেক কষ্ট করতে হয়েছিল, মামনি।”

আয়শা নিজের মেয়েকে নিয়ে গর্ব করত আগে থেকেই। তার মেয়ে সেরা। পড়াশোনায়, সৃজনশীলতায় ও অন্যান্য অনেক দিকেও। এসব নিয়ে যখন এলাকার ভাবিদের বলত, তারা সামনে প্রশংসা করলেও আড়ালে প্রচণ্ড হিংসেয় জ্বলে যেত। তারা বলত,
-“মেয়েমানুষ, বিয়ে দিলেই পরের বাড়ি চলে যাবে। তখন তোমাদের দেখবে কে? একটা ছেলেও তো নেই। এখনই একটু একটু করে ভবিষ্যতের জন্য টাকা-পয়সা গুছিয়ে রাখো।”

আবার বলত,
-“মেয়েমানুষকে এত পড়িয়ে কী লাভ? সেই তো পরের বাড়িতেই পাঠিয়ে দেবে? চাকরি করলেও পরের বাড়িতেই খরচা করবে। তোমাদের দিকে তাকিয়েও দেখবে না। এরচেয়ে মেয়ের ওপর এত খরচ কোরো না। বয়স হয়েছে, বিয়ে দিয়ে দাও।”

আয়শা প্রতিবাদ করে বলত,
-“আমার মেয়েকে আমি পড়াব, আমি দুনিয়াদারি শেখাব, আমি মাথায় তুলে রাখব। মেয়ের প্রতি আস্থা আছে আমার।”

বড়ো শ্লেষ করে একজন এ-কথার প্রতুত্তরে একবার বলেছিল,
-“দুধে ধোয়া তুলসিপাতারাও বাপ-মায়ের মুখে চুনকালি মারে!”

আয়শা তা বিশ্বাস করতে পারেনি, বিশ্বাস করেও না। নিজের অনুরূপ তার মেয়ে, কেন ব্যতিক্রম কিছু ঘটাবে? নিশ্চয়ই শুদ্ধতা, পবিত্রতা ও ন্যায়পরায়ণতায় তার মেয়ে কোনোরকম কলঙ্ক লাগাবে না।

আয়শা অরণীর দিকে তাকিয়ে বলল,
-“অন্য কোনো মেয়ে কখনও এভাবে মায়ের সুখের দায়িত্ব নেয় না।”

অরণীর হাসি মুখ ছড়িয়ে গেল, চোখ দুটো ছোট এলো। সে ভীষণ খুশিমনে বলল,
-“অল ক্রেডিট গোজ টু ইউ। আমাকে তুমি এভাবেই তৈরি করেছ।”

আয়শা প্রচণ্ড সুখ অনুভব করল। স্ত্রী হিসেবে যেমন-তেমন, মা হিসেবে সে জিতে গেছে। এ কথা ভাবলেও যেন মন বাগিচায় ভ্রমর ওড়ে, গান গায় আমোদিত হয়ে।

এমন সময় হুট করেই কলিং বেল বাজায় সামান্য ভড়কেই উঠল আয়শা। হাসি নিভে এলো অরণীর। সরু চোখে তাকাল দরজার দিকে। এ-বাসায় তো কারো আসার কথা নয়!
.
.
.
চলবে......................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন