শাহজাহান তন্ময় - পর্ব ৫৯ - নাবিলা ইষ্ক - ধারাবাহিক গল্প


পুষ্পবৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির রিমঝিম ধ্বনিতে মুখরিত ঘর। বিছানার সামনেই জানালাটি। সেটি খোলা; অরুর দৃঢ় আবদারে। শীতল হাওয়া এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। 
অরু নিবিড় তন্দ্রায় আবিষ্ট। অক্টোপাসের মতন হাত-পা দ্বারা তন্ময়কে জাপটে ধরে আছে। মাথাটা শক্তপোক্ত মজবুত বক্ষঃস্থলের ওপরে। পা দুটো তন্ময়ের পুরুষালি ঊরুতে। হাত দুটো পেটের কাছটায় আদুরে ভঙ্গিতে রাখা। অন্ধকারাচ্ছন্ন কামরায় তন্ময় সজাগ। ঘুমের 'ঘ'টুকুও যেন চোখদুটোর ভেতরে নেই। ছোটোখাটো নরম তুলতুলে শরীরের সংস্পর্শে ঘুম না আসাটাই বরঞ্চ স্বাভাবিক। তন্ময়ের চোখদুটি আঁধারে তলানো অরুর ঘুমন্ত মুখটা দেখতে উদগ্রীব। বাতি বন্ধ করা সঠিক হয়নি। ওঠে জ্বালানোর সুযোগটুকু নেই। তন্ময় অতি তুচ্ছরূপে নড়লেই অরু গুঙিয়ে আরও আষ্টেপৃষ্ঠে জাপটে ধরে। এসময় অনুচ্চস্বরে তর্কবিতর্ক সমতুল্য কথোপকথন হচ্ছে দরজার ওপারে। ফিসফিসানি সুরের কথোপকথনরত মৃদু সেই আওয়াজ কর্ণগোচর হয় তন্ময়ের। ভ্রুদ্বয়ের মধ্যিখানে ততক্ষণ ভাঁজ পড়ে পাঁচটি। 

‘আরেহ ব্যাটা, ঠ্যালাঠ্যালি করিস না।’ বলতে-বলতে দ্বারে কান পাতল মাহিন। ভেতরকার অঘটিত কার্যকলাপ শুনতে উৎকণ্ঠিত। প্রগাঢ়, নিগূঢ় মনোনিবেশকারী তাকে ঠেলেঠুলে রিয়ান পাশে এসে দাঁড়াল,

‘সাইডে চাপ। শুনতে দে।’

রিয়ান কণ্ঠ খাদে নামিয়েছে। অবলীলাক্রমে কান পেতে দিয়েছে দরজায়। শ্বাসপর্ব থমকিয়ে রাখে ক্ষণিকের জন্যে। যেন নিজ শ্বাসপ্রশ্বাসের আওয়াজটুকু ভেতরের শব্দ শুনতে ব্যাঘত সৃষ্টি করবে! পেছনেই শুহানি দাঁড়িয়ে। মুখাবয়ব অনুরাগশূন্য। ছোটো-ছোটো চোখে চেয়ে চাপাস্বরে শুধায়,

‘এভাবেই থাকবি তোরা? তন্ময় বুঝতে পারলে রেগে যাবে।’

রুস্তম ঐকমত্য। তন্ময় ঠান্ডা মস্তকের হলেও– একাবার রাগ হলে আর দিকনির্দেশনা নেই। সাংঘাতিক অত্যন্ত বেগতিক ব্যাপারস্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। রুস্তম মাথাটা দু'পাশে দোলায়। তবে মুখে অমত করে না। ছোঁকছোঁক করে আছে দৃষ্টি। শ্রবণেন্দ্রিয় প্রগাঢ়। সৈয়দ আর ইব্রাহিম অবশ্য চুপচাপ অদূরেই দাঁড়িয়ে। হাতে কাচের প্লাওয়ার প্রিন্টেড প্লেট। সেথায় ড্রাগন ফল ছোটোছোটো করে কাটা। কাঁটাচামচ দিয়ে দুজন আমোদে ফল খাচ্ছে। প্রবণতা নিয়ে দেখছে এবং শুনছে ঠিকই। তবে কর্তব্যভার নিতে অপারগ। মাহিন ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে,

‘কিছু শোনা যাচ্ছে না কেন?’

রিয়ান কৌতুক সুরে বলে, ‘জনাব আপনি কী শুনতে চাচ্ছেন? আহ, উহ?’

জিহ্বা কামড়ে মাহিন মাথা নাড়ায়, ‘নিজের ডার্টি মিন্ডেড চিন্তা আমা ওপর চাপাস না।’

রিয়ান ভেঙায়, ‘তাহলে কান পেতে কী শুনতে চাচ্ছিস? মাহফিলের বক্তব্য?’

মাহিন আশ্চর্যের সপ্তমে, ‘আরোপ দিচ্ছিস কেন! আমি আমার বন্ধুর খবরাখবর জানতে আগ্রহী হতে পারি না?’

রুস্তম ফিক করে হেসে ওঠে। রিয়ানের চোখমুখ জুড়ে বিদ্রূপাত্মক, ‘বন্ধুর খবরাখবর বুঝি মাঝরাতে বন্ধুর দরজায় কান পেতে নেয়? এমন বন্ধু আমি গু লি করে মে রে ফেলতাম।’

‘তাহলে নিজেকে মা র। তুই কান পেতে আছিস স্টিল।’ 
মাহিন অনড়ভাবে প্রত্যুত্তর করে। রিয়ান তর্কে জড়াতে প্রস্তুত। আজ একটা দুর্বোধ্য মীমাংসা হোক। আজ এই মাহিনের একদিন কিংবা তার! রিয়ান তেড়ে এগুতেই কাঠের দরজাটা শিথিলভাবে খুলে গেল। দুয়ারে গম্ভীরমুখে তন্ময় এসে দাঁড়িয়েছে। গায়ে এখনো সাঁঝের পোশাক বিদ্যমান। মানে কী কিছুই হয়নি? কিচ্ছুটি নয়? ভেবেই মাহিন হতাশের শীর্ষতে। এই তন্ময়কে দিয়ে কিছু হবে না। এত সুন্দর সুযোগ খানা হাওয়াতে উড়িয়ে দিল? তন্ময় হাত দুটো বক্ষঃস্থলের ওপর ভাঁজ করে রেখেছে। চাহনি সুচের মতন শানিত। তার মৌনতাই যেন প্রশ্ন করছে। রুস্তম হাত তুলে নিজেকে নিরপেক্ষদলে রাখতে আলুথালু গলায় বলে,

'দোস্ত আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। ওরা দুজন জোরপূর্বক তুলে এনে বলল দাঁড়াতে। ফ্রিতে এক্সক্লুসিভ রোমান্টিক অডিও রোমান্স নাকি শোনাবে। সাবস্ক্রিপশন ছাড়া।’

সৈয়দ মাথা দোলায়। সে কঠিনভাবে সহমত। তারা একনিষ্ঠ দর্শক বৈ কিছু না। মাহিন ভ্যাবলার মতন হাসছে। বাম চোখটা ক্ষণে ক্ষণে টিপে দিচ্ছে। তন্ময় দেখেও দেখছে না। কয়েক'পা সামনে এসে দরজা লাগাল, 

‘সমস্যা কী তোদের?’

কিয়ৎক্ষণের নীরবতা ভেঙে রিয়ান নির্লজ্জ মতন হেসে প্রশ্ন করে, ‘দোস্ত, অরু কই?’

তন্ময় ভ্রু তুলে, ‘কেন?’
‘মেয়েটা কেমন আছে জানতে এসেছিলাম। কিছুর প্রয়োজন পড়ে কিনা। আমার কাছে কিন্তু সওওঅঅব আছে। কোন জিনিস লাগবে একবার বল শুধু। এক্ষণ এনে দিচ্ছি।’

তন্ময় চোখ রাঙিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
‘ওর হাজবেন্ড আছে।’ 

রিয়ান দুষ্টু হেসে বলে বসে, ‘আরেহ ছোটো বেইবি তো। তাই আরকি!’ কথাটুকু শেষ করে শেয়ালের মতন ছুটে পালাল। তন্ময়কে উত্তম অবসরটুকু দিলো না— ওকে ধরে উত্তমমধ্যম দেবার। রুস্তম, ইব্রাহিমও আর থাকল না। ত্বরান্বিত পদচারণে চলে যাচ্ছে। অবশিষ্ট থাকা মাহিনের মুখটা তেঁতো হয়ে এলো। সে একাই দাঁড়িয়ে। তন্ময় রাগিত গলায় কিছু বলবে পূর্বেই ঘরের ভেতর থেকে অরুর ঘুমঘুম কণ্ঠ শোনা গেল,

‘তন্ময় ভাই! কী হয়েছে?’

দরজাটা লাগানো। তন্ময় বেরিয়েই লাগিয়েছিল শিথিলভাবে। অরু হয়তোবা ওঠে গিয়েছে। কীভাবে ওঠল? নিদারুণ নিঃশব্দে বেড়িয়েও, কীভাবে! বেশ চতুরতার সাথে মাহিন বন্ধুর কাঁধ চাপড়ে দিল,

‘যাহ, তোর পিচ্চি বউ ডাকে।’

তন্ময় শাসাতে ভুলে না, ‘আরেকবার তোদের এই কাণ্ডকারখানা দেখতে পেলে পুকুরে চুবাব।’

মাহিন জিহ্বা কামড়ে দ্রুততম পদচারণে চলে এলো। আড়াল হয়ে করিডরে সবাই দাঁড়িয়ে। মুখ টিপে হাসছে। মাহিন গিয়েই রিয়ানের পেটে দুটো ঘুসি বসাল,

‘শা লা! নিজেরা মুরগির মত পালালি আমাকে রেখে।’

ঘুসি দুটো বলপ্রয়োগহীন। ব্যথা হওয়ার মত নয়। তবুও রিয়ান নীরব, স্থির থাকার মত পাত্র নয়। সেও লেগে পড়ে মা রতে। শুহানি নিজের ঘরে চলে গেল। বাকিরাও চলে যাচ্ছে নিজেদের ঘরে। করিডরে ধস্তাধস্তি করছে মাহিন আর রিয়ান। রুস্তম অবশ্য কিছু সময় আনন্দের সহিত দেখছিল। অতঃপর সেও নিজের ঘরের দিক পা বাড়াল।

————

শেয়াল গুলোকে পালাতে দেখে, এযাত্রায় তন্ময় দরজা খুলে ঘরে প্রবেশ করে। বাতি জ্বালানো। সাদা দীপ্তি ছড়িয়ে ঘরে। অরু দাঁড়িয়ে জানালার পাশে। বাইরেটা দেখছে। বজ্রপাত পড়ছে ঘনঘন। দরজা আটকানোর আওয়াজ শুনতে পেয়ে মাথা ফিরিয়ে চায় অরু। চোখদুটো ফোলা। ঘুমন্ত মুখটায় যেন চন্দ্রিমা এসে বসেছে। তন্ময়কে দেখে এগুতে শুরু করে,

 ‘কী হয়েছে? ভাইয়ারা ডেকেছিলেন?’

এই প্রশ্নের জবাব তন্ময় দেবে না। মৌনতা বজায় রেখে ঠাঁই থাকল। অরু কাছাকাছি এসে আবার শুধাতেই তন্ময় বলল,

‘ঘুম ভাঙল কীভাবে?’

অরুর কাছে যেন এই প্রশ্নের প্রত্যুত্তর প্রস্তুত, ‘আপনি নেই যে। বিছানা ফাঁকা। আমার হাতও ফাঁকা।’

ঠোঁটে ধেয়ে জমতে চাওয়া হাসিটুকু দানবের মতন গিলে ফেলে তন্ময়, ‘ফাঁকা তাতে কী? আশেপাশে হব। তুই না ঘুমিয়ে মাঝরাতে ওঠবি কেন?’

অরুর চোখ দুটো ছোটো ছোটো হয়ে এলো। নাক ফুলিয়ে মুখটা কাছাকাছি এনে নিগূঢ় দৃষ্টি তাঁক করল, ‘সিগারেট খেতে গিয়েছিলেন?’ বলেই সুগভীরভাবে শুঁকল। 

তন্ময় ঢোক গিলল। জটিল হলো দৃষ্টি। তার পুরুষালি হাতদুটো ইতোমধ্যে অরুর পাতলা কোমর বুঝে নিয়েছে। এক টানে নিজের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিবিড় গলায় বলল,

‘টেস্ট করে দেখ। জানতে ইজি হবে।’

অরু যেন নিজের শ্রবণেন্দ্রিয়কে বিশ্বাস করতে পারছে না। বড়ো চোখেতে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে। এবেলায় অদৃশ্যভাবে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়। চোখ তুলে চাওয়া যেন দুঃসাহসসম্পন্ন। তন্ময় ডান হাতের আঙুলের সাহায্যে অরুর থুতনি ধরে মুখ তুলে। অরু চোখদুটো খিঁচে বন্ধ করে আছে। তন্ময় মাথা ঝুকোয়। অরুর কানের কাছে মুখ নিয়ে মন্থর স্বরে আদেশ ছুঁড়ে,

‘তাকা।’

অরু বাধ্যভাবেই চোখ মেলে চায়। দৃষ্টিতে দৃষ্টির মিলন ঘটে। পরমুহূর্তেই তন্ময় চেয়ে থেকে দ্রুতবেগে অরুর ঠোঁট দুটোতে চুমু বসায়। চুমু বসিয়ে ক্ষান্ত হয় না। গভীর, নিবিড় চুম্বনে লিপ্ত হয়। অরুর হাঁসফাঁস করা দেহটিকে নিজের মধ্যিখানে জাপটে রাখে। নড়েচড়ে ওঠার সুবিধা থেকেও বঞ্চিত করে। চুমুটুকু শেষ করে ফের চায় অরুর মুখপানে। অরু পুনরায় চোখজোড়া বুজে আছে। ভেজা রক্তিম ঠোঁটদুটো স্থিরভাবে কাঁপছে। সে দৃশ্যে নিজের ভেজা ঠোঁটজোড়া জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে নেয় তন্ময়। দুষ্টুমি গলায় প্রশ্ন করে,

‘জবাব পেয়েছিস?’

অরু তো এভাবেই শুধিয়েছিল। এতকিছু ভেবে কী প্রশ্ন করেছিল? অথচ তার সাধারণ প্রশ্নটিকে কোথায় নিয়ে পৌঁছেছে। লাজে সে সুবিস্তৃত শক্তপোক্ত বাহু থেকে মুক্তি পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে। তন্ময় আরও ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে একগুঁয়ে গলায় ফের শুধায়,

'হুম? জবাব পেয়েছিস? নাকি আরেকবার টেস্ট করে দেখবি?’

অরু ত্বরিত মুরগির মত মাথা দু’পাশে নাড়ায়। অর্থাৎ না। সে জবাব পেয়েছে। তন্ময় নিঃশব্দে হাসে। ওকে ছাড়ে। শুধায়, ‘ক্ষুদা লেগেছে? কিছু খাবি?’

‘না। ঘুমাব। আসুন ঘুমুতে।’

অরুর সরল প্রত্যুত্তর কর্ণগোচর হতেই তন্ময় এবারো থমকায়। আশ্চর্য হয়। তেমনি আপ্লুত। মাঝেমধ্যে অরুটা তাকে বিস্ময়ের চূড়ান্তে পৌঁছে দেয়। অথচ মুখটা সরল প্রতিমার মতন। অরু ইতোমধ্যে বিছানায় শুয়েছে। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে তন্ময়ের অপেক্ষায়। যেন তন্ময় এলেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ঘুমোবে আমোদে। 
তন্ময় বাধ্যভাবেই বাতি নিভিয়ে বিছানায় আসে। অঝোরে বৃষ্টি তখনো নামছে। গুমোট আবহাওয়ায় রাতের প্রহরটুকু ভিন্ন। অরু বরাবরই বৃষ্টি পছন্দ করে। উপভোগ করে। আজও ব্যতিক্রম নয়। তন্ময়ের বুকপকেটে মাথা রেখে জানালার পানে চেয়ে। সুন্দর বৃষ্টি দেখছে। অরু আনমনেই বলে বসে,

‘আগামীকালও বৃষ্টি হলে ভালোভাবে। সিলেট দেখতে দারুণ লাগবে।’

তন্ময় অসন্তোষ কণ্ঠে ফোড়ন কাটে, ‘বৃষ্টি হলে ঘুরবি কীভাবে?’
‘ভিজে ভিজে।’ অরুর অকপটে জবাব।

তন্ময় নির্বিকার গলায় জানাল, ‘তাহলে ঘরেই থাকবি। বেরোনোর প্রয়োজন নেই।’

অরু ত্বরিত নিজের বলা কথা ঘুরিয়ে ফেলে, ‘তাহলে বৃষ্টি না আসুক। আমি চাচ্ছি না।’

এহেন কৈফিয়তে তন্ময় তৃপ্ত। আলগোছে অরুকে বক্ষঃস্থলে বুঝে নিয়েছে। অরুও শান্ত-স্থির বিড়াল। আরাম করেই তন্দ্রাচ্ছন্নতায় ডুবে যেতে প্রস্তুত।
.
.
.
চলবে.........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন