ক্লান্তিতে ভরপুর সময়। ফাবিহা শুয়ে আছে। বিছানায় উবুড় হয়ে শুয়ে আছে। পায়ে মলম লাগিয়েছে কিছুক্ষণ আগে। এবার বেশ আরাম লাগছে। তবুও খানিকটা জ্বালাপোড়া এখনও হচ্ছে।
ফাবিহা কিছু একটা ভাবছে। বোধহয় আরহানের কথা। আজ ঠিক সময়ে আরহান তাকে সাহায্য না করলে বড্ড বিপদে পড়ত সে। হঠাৎ তার মনে পড়ল আরহানের বলে যাওয়া সেই শেষ কথাটা,
“আমি ব্ড্ড অধৈর্য্যশীল মানুষ রৌদ্রময়ী, প্রথম বেলায় ধৈর্য্যটা আঁটকে রাখতে পারলেও দ্বিতীয়টায় আর পারলাম না। আমি খুবই দুঃখিত।”
ফাবিহার চট করে মনে পড়ল আরহান তখন 'রৌদ্রময়ী' বলে তাকে আখ্যায়িত করেছে। ফাবিহা চমকে উঠল। প্রথমে এটা ওতটা আন্দাজে আনেনি। এখন কেমন যেন ঠেকছে। আচ্ছা, ছেলেটা রৌদ্রময়ী বলে কেন ডাকল?– সে রোদ্দুরে বসে ছিল বলে, নাকি রোদ্দুর সহ্য করতে পারে না বলে। ছেলেটাকে নিয়ে কি খুব বেশিই ভাবছে ফাবিহা? না তা হবে কেন! ফাবিহা মাথা ঝাড়ল। বড্ড বেশিই বাড়াবাড়ি হচ্ছে।
হঠাৎই খটখট করে আওয়াজ হলো। কে যেন ধুমুড়ধামুড় শব্দ করে হেঁটে আসছে। ফাবিহা কিছুসময় পরখ করে বুঝল রাহেলা আসছে। দরজার দিকে তাকাবে এরই মাঝে রাহেলা হুড়মুড় করে ঘরের ভিতর ঢুকে বলল, “আপা, খাইবেন না?”
ফাবিহা শোয়া থেকে উঠে বসল। শান্ত স্বরে বলল,
“হুম খাব।”
রাহেলার হাতে খাবার ট্রে। সে ফাবিহার জন্য খাবার নিয়ে এসেছে। রাহেলা এগিয়ে এসে খাবারগুলো বিছানায় রাখল। বলল,
“চাচিজানে আপনার জন্য খাবার পাডাইছে আপা।”
ফাবিহা দেখল। দ্রুতই হাত ধুইয়ে খাওয়া শুরু করল। বলল, “তুমি খেয়েছ?”
রাহেলার তড়িৎ উত্তর, “জে আপা।”
রাহেলা আরাম করে বিছানার পাশে মেঝেতে বসল। ফাবিহা বলল, “তোমাকে কতবার বলেছি মেঝেতে বসবে না।”
রাহেলা একগাল হেঁসে বলল,
“আপা রাগ হইয়েন না। আমার নিচে বইতেই বেশি মজা লাগে।”
ফাবিহা উত্তর দিল না। রাহেলা বলল,
“জানেন আপা আজকে কি হইছে?”
ফাবিহা আগ্রহ নিয়ে বলল,
“কি হয়েছে?”
রাহেলা বলতে লাগল,
“আজকে দুপারে যহন আপনে বাড়িতে আছিলেন না তহন ওই সামনের বাড়িডায় তৌহিদ ভাইজান আছে না– কি সুন্দর গান গাইছে। গান হুইনা আমার পরান ডা জুড়াই গেছে। আপা জানো, গান হুইন্না আমি খালি চাইয়াই রইছি, চাইয়াই রইছি।”
ফাবিহা হেঁসে ফেলল। বলল,
“চাইয়াই রইছ।”
“তাইলে কই কি আপা? এত সুন্দার গান আমি আগে হুনি নাই।”
ফাবিহা আবারও মৃদু হাসল। রাহেলা যে একটু বেশিই বাড়িয়ে বলছে তা জানে সে। রাহেলা হঠাৎই মন খারাপ করে বলল,
“তয় জানেন আপা, আইজ আমার মন ভালা নাই।”
ফাবিহা ভাত মুখে চিবোতে চিবোতে বলল,
“কেন?”
“ওই যে শান্ত ভাইজানে।”
“কি হইছে তার?”
“আপা পোলাডা কথা কইতে পারে না। তারে দেখলেই আমার মনডা খারাপ হইয়া যায়। জানেন আজকে তৌহিদ ভাইজানে গান গাইলেও গিনটার শান্ত ভাইজানে বাজাইতে আছিল।”
“ওটা গিনটার না গিটার..
“ওই হইছে আপনে আছেন ভুল নিয়া আমার মন ভালা নাই। শান্ত ভাইজানে খুবই সুন্দর দেখতে জানো আপা। তারওপর চশমা পড়ে। চোখগুলানও কি সুন্দর? এত সুন্দর একটা পোলা কতা কইতে পারে না। ভাবলেই তো কেমন লাগে! আমার খুব কান্না আহে।”
ফাবিহা কি বলবে বুঝছে না। ফাবিহার সাথে শুধু আরহানের সাথেই সাক্ষাৎ হয়েছে। তবে সে শুনেছে তাদের অতিথি নিবাসে আরো যে দুজন থাকছে তাদের নাম তৌহিদ আর শান্ত। শান্ত যে কথা বলতে পারে না। এটা কাল রাতেই রাহেলা বলেছিল। খারাপও লেগেছিল বড্ড। ফাবিহা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “দুনিয়াতে সবাই পারফেক্ট হয়ে আসে না রাহেলা।”
রাহেলা মলিন কণ্ঠে জানাল,
“এমনডা ক্যান হয় আপা।”
“সবই আল্লাহর ইচ্ছে।”
রাহেলা কিছু বললো না। চুপ হয়ে গেল।
••••••••••••••
“আসসালামু আলাইকুম। প্রিয় শ্রোতারা। শুভ সন্ধ্যে। আপনারা শুনছেন রেডিও তরঙ্গ নাইনটি টু পয়েন্ট টু রেডিও এফএম। আমি আরজে আরহান। আপনাদের সবাইকে স্বাগতম জানাচ্ছি। আবারও হাজির হলাম আপনাদের সাথে সামান্য আড্ডা, গল্প, আর আপনাদের ফেভরেট গান শোনানোর জন্য। আপনারা সরাসরি আমাকে ফোন করতে পারেন 82904 এই নম্বরে। এছাড়া আমাদের ফেসবুক পেইজে নক করতে পারেন, কমেন্ট করতে পারেন লাইভ শোয়ের কমেন্ট বক্সে যত খুশি তত। বেশি দেরি না করে শুরু করে দিচ্ছি আজকের আমাদের অনুষ্ঠান। আজকের কথোপকথনের নাম হিসেবে আমি রাখছি 'মন নিয়ে কথাকথি।' আপনারা সবাই জানেন আমি রোজ রোজ নিউ নাম ব্যবহার করতে পছন্দ করি। তাই দেরি না করে দ্রুত ফোন করুন 82904 এই নম্বরে।”
আরহান থামল। মাত্রই আরহান তার রেডিও স্টুডিতে হাজির হলো। আরহান সপ্তাহে চারদিন এফএম এ কথা বলে। তার কাজের কোনো টাইম টেবিল নেই সে হঠাৎ আচমকা হাজির হয়। তবে তাকে বেশির ভাগ সময় পাওয়া যায় রাতে। দশটার পর। তবে আজ সন্ধ্যাতে হাজির হয়েছে। এমনটা মাঝে মাঝে হয়। এছাড়া সপ্তাহের রোজ শুক্রবার বিকাল বেলা আসে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে। মানুষের সাথে কথা বলে। আড্ডা দেয়, গান শোনায়।'
মাইক্রোফোনে আবারও আরহানের ভাড়ি কণ্ঠ শোনা যায়। সে বলে,
“আজ খুব তাড়াতাড়ি এসেছি বলে কেউ আবার রাগ করবেন না। আপনারা তো জানেনই আমি একটু উড়োলো স্বভাবের মানুষ। তাই হঠাৎ হঠাৎ উড়ে এসে হাজির হই। আপনাদের বিভ্রান্ত করাই। তবে আধতেও বিভ্রান্ত হওয়ার উপায় নেই আজ আমি অনেক রাত অবধি আছি। চলুন দেখে নেই আমাদের ফাস্ট কলারকে। হ্যালো কে বলছেন?”
ওপাশ থেকে একটা মেয়ের কণ্ঠ শোনা যায়। সে বলে, “আমি রূপা।”
আরহান মিষ্টি হেঁসে জানায়,
“কোন রূপা হিমুর রূপা নাকি অন্য কারোর রূপা।”
রূপা হেঁসে ফেলে। বলে,
“আপনি কোনটা বললে সন্তুষ্ট হবেন?”
“তুমি যা বলবে আমি তাতেই সন্তুষ্ট।”
“তাহলে আমি আরহানের রূপা।”
আরহান এ কথার পিঠে কিছু বললো না। প্রসঙ্গ পাল্টে জানাল,
“তোমাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি? কোনো গান শুনতে চাও?”
“আমার মনটা বড্ড খারাপ।”
“মাঝে মাঝে আমাদের মন খারাপ হয়। এটা খুব একটা বড় বিষয় নয়। মন খারাপের কারণ?”
“আমার মন খারাপের আধতেও কোনো কারণ নেই।”
“এটা আরো সুন্দর ব্যাপার। তুমি বরং আমাদের সঙ্গে থাকো। গান শোনো। দেখবে মন ভালো হয়ে যাবে।”
কল কেটে গেল। পরবর্তী আর একটা কল আসতেই আরহান সেই কলটাও ধরে বলল,
“হ্যালো কে বলছেন? কোথা থেকে বলছেন?”
ওপাশে একটা ছেলের কণ্ঠ শোনা যায়। সে বলে,
“আমি তৌহিদ। ঢাকার আনাচে কানাচে থেকে বলছি,
কণ্ঠ শুনে আরহানের আর বুঝতে বাকি নেই। এ কে? তবুও সৌজন্যতার খাতিরে বলল,
“কিভাবে সাহায্য করতে পারি?”
নিজের বিছানায় বসে থাকা তৌহিদ হাসে তখন। পাশেই শান্ত বসা। তৌহিদ বলে,
“আমার একটা মনের মানুষ নেই। আপনি কি কোনোভাবে সাহায্য করতে পারবেন?”
“আপনার মনের দরজা খুলে রাখুন দেখবেন কেউ না কেউ ঠিক হাজির হবে।”
কল কেটে গেল। আরহান বলল,
“নিয়ে নিচ্ছি ছোট্ট একটা বিরতি ততক্ষণ পর্যন্ত শুনতে থাকুন একজন শ্রোতার প্রিয় গান, 'স্রোতস্বিনী'...
গান চালু করে কানের হেডফোন নামিয়ে ফেলল আরহান। মনে মনে বলল, “এই তৌহিদের বাচ্চা আর ভালো হলো না।”
••••••••••••
রাত তখন এগারোটার কাঁটায় ছুঁই ছুঁই। সোফায় বসে টিভিতে মুভি দেখছিল ফাবিহা। বাড়িতে বাবা মা নেই। ফাবিহার চাচা আচমকাই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাকে দেখতে গেছেন। কিছুক্ষণ আগে ফোন করেছিলেন, 'চাচা ঠিক আছে তাঁরা বাড়ি আসছেন।' ফাবিহা তাদেরই অপেক্ষা করছে আপাতত। রাহেলা নেই। সে রোজ রাত দশটার পরই ঘুমিয়ে যায়। সারাদিন ননস্টপ চলতে থাকলেও রাত দশটার পর তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এতে করে পুরো বাড়িটা খাঁ খাঁ করে। রাহেলার ওপর মাঝে মাঝে ফাবিহা বিরক্তবোধ করলেও মেয়েটা আশেপাশে না থাকলে কেমন যেন চারপাশ বোরিং লাগে। যেমন এখন লাগছে। কলিংবেলটা বেজে উঠল। ফাবিহা বুঝল বাবা-মা বোধহয় চলে এসেছে। সে আস্তে করে সোফা থেকে উঠল। খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেঁটে গেল দরজার কাছে। এরই মাঝে কলিংবেল আবারও বাজে। ফাবিহা দরজা খুলে বলে,
“এতবার কলিংবেল বা..
পুরোটা আর বলা হয় না। কারণ সামনে আরহান দাঁড়িয়ে। ফাবিহা বিব্রতবোধ করল। শুকনো হেসে জানাল, “আপনি?”
আরহানের শান্ত কণ্ঠের উত্তর,
“মাসুদ আঙ্কেল আছেন?”
“না বাবা একটু বেরিয়েছেন।”
“ওহ।”
এই বলে পকেট থেকে কিছু টাকা বের করল আরহান। বলল,
“মাসের এডভান্স ভাড়াটা আঙ্কেল আসলে দিয়ে দিয়েন। বলেছিলাম আজ দিব তাই এই সময় আসলাম। আপনাকে অসস্থিতে ফেলার জন্য দুঃখিত।”
ফাবিহা হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিল। বলল,
“আপনি কি সরিটা খুব বেশিই বলেন?”
“আপনাকে বেশি বলা লাগছে।”
“এমন কেন?”
“ধরতে পারছি না।”
আরহান যেতে নিল। পিছন থেকে ফাবিহা আবার বলল,
“আপনি কি রেডিওতে মেয়েদের মন ভালো করার দায়িত্বও নিয়ে থাকেন?”
আরহানের পা থেমে গেল। পিছন ফিরল। তার বিস্ময়সূচক চাহনি। মেয়েটা জানল কিভাবে? তবে কি শুনছিল তার রেডিও এফএম। ফাবিহা বলল,
“কি হলো কথা বলছেন না যে?”
“একটা মানুষ কি একটা মানুষের মন ভালো করার দায়িত্ব নিতে পারে?”
“সত্যিই কি পারে না?”
“বোধহয় পারে, আমার জানা নেই।”
“আপনার শো টা শুনছিলাম বেশ সুন্দর।”
“ধন্যবাদ। আপনার পায়ের অবস্থা কেমন– সেড়েছে?”
“খানিকটা।”
আরহান চলে গেল। ফাবিহা তখনও দাড়িয়ে। তার আরহানকে ভালো লেগেছে। খুব বেশি ভালো লেগেছে কিনা ধরতে পারছে না। তবে ভালো লেগেছে এতটুকু জানে।
.
.
.
চলবে.......................................................................