হৃদয়েশ্বরী - পর্ব ৪০ - সাদিয়া মেহরুজ দোলা - ধারাবাহিক গল্প


তখন সায়ংকাল। উশান বাসায় পৌঁছেই দিক - বেদিক না দেখে রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। গভীর তন্দ্রায় সে বিভোর। উজান মাত্রই রুমে আসলো হাতে পানির গ্লাস নিয়ে। উশানকে ঘুমোতে দেখে সে ললাটে পরাপর কয়েকটা ভাজ ফেললো। উশান যদি ঘুমাতোই তাহলে তাকে পানি আনতে বললো কেনো?আশ্চর্য তো! উশান শুধু খাটায় তাকে দিয়ে। চরম বদমাশ এই ছেলে! 

পানির গ্লাস হাতে ফিরে যেতে নিয়েও পথিমধ্যে থামলো উজান। ঘাড় বাঁকিয়ে পেছন তাকিয়ে ভাবলো কিছু। তার অধর যুগল কোণে তখন কুটিল হাসি। সে শব্দহীন পায়ে এগোল উশানের নিকট। পানির ওপর ভাসমান একটা বরফ নিয়ে যেইনা সে উশান এর শার্ট গলিয়ে ত্বকে সংস্পর্শ করাবে তৎক্ষনাৎ উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা উশান পিছন থেকেই তার হাত শক্ত করে চেপে ধরলো। উল্টো করে ফেলে দিলো তাকে ভূমিতে। ব্যাথায় ছোটখাটো চিৎকার দেয় উজান। উশান ছিলো বিছানার একদম পাশে। সে বালিশ থেকে মাথা উঁচু করে উজানের পানে তাকালো। ভরাট কন্ঠে বলে উঠলো, 

-' আমার সাথে চালাকি? বেয়াদব! '

উজান মেঝেতেই শুয়ে ছিলো।উল্টো হয়ে পড়াতে নাকে এবং কপালে দারুণ ব্যাথা পেয়েছে।যন্ত্রণায় মুখোশ্রী কুঁচকে নিয়ে নাক ঘষলো। পরপর ব্যাথাতুর গলায় বলল,

-' তুই না ঘুমিয়ে ছিলি ভাই? আমাকে কি করে দেখলি আজব তো! না কি ঘুমের ভান ধরে ছিলি আমাকে শায়েস্তা করার জন্য? '

-' তোকে শায়েস্তা করতে গিয়ে আমি আমার ঘুম নষ্ট করবো? হাহ্! তোর পায়ের আওয়াজ আমি শুনতে পেয়েছি ষ্টুপিড! একটা কাজও তো দেখি ঠিকমতো করতে পারিস না। পুলিশ হয়ে গেলি কি করে ডাফার? '

উশান হাত উঁচু উজানের গাল বরাবর থাপ্পড় লাগায় পরাপর দু'টো! উজান ভীষণ রকমের চমকায়! হতভম্ব হয়ে সে মেঝে থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বিছানা থেকে দূরে সরে যায় চটজলদি।অতঃপর বিভ্রান্তি নিয়ে বলে,

-' আরেহ্ আবার কি করলাম? থাপ্পড় ক্যান? '

উশান বালিশে মুখ গুঁজে প্রতিত্তুর করলো, 

-' আমাকে ঘুম থেকে জাগানোর শাস্তি। এখন দ্রুত বের হ আমার রুম থেকে। নাহলে এবার তোর হাত পা ভাঙবো!'

উজান গালে হাত ডলতে ডলতে সামনে এগোল।গাল জ্বলছে তার। যেনো কেও মরিচ লাগিয়ে দিয়েছে। যেতে যেতে বিড়বিড়িয়ে বলল, 

-' হুদাই! এইটা বল আমার গাল দেখলেই তোর থাপ্পড় পায়। তাই ঠা'স ঠা'স করে মেরে দিস। আমিও দেখে নিবো! ভাবী আসুক। ভাবীকে দিয়ে তোকে অত্যাচার করাবো। '

রুম থেকে বের হতে নিলে উজানের আচানক কর্ণকুহরে এসে পৌঁছায় ভারী কন্ঠস্বর, 

-' তোর ভাবী আমাকে অত্যাচার তো দূর। সে আমায় মিনিটে সেকেন্ডে ভালোবাসবে। আদর করবে।সো এই চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফ্যাল। '

 হুমড়ি খেয়ে পড়তে নিতেই নিজেকে কোনোমতে সামলালো উজান। বুকের টিশার্ট টেনে থু থু ছিটিয়েঁ ভীতিভাব দূর করার প্রয়াস চালালো। রুম থেকে বের হয়ে বক্ষঃস্থলের মাঝ বরাবর হাত রেখে সে সন্দিহান গলায় বলল,

-' ভাইরে ভাই! ভাই মানুষ না অন্যকিছু। এতো আস্তে বলার পরও শুনে কি করে? আশ্চর্য! '

___

রেস্টুরেন্ট থেকে মাত্রই ফিরেছে রুহি, মীরা। আজ তাদের চাপ ছিলো ভীষণ। একেই বিশ্ববিদ্যালয়ের এতো ক্লাস, পরিক্ষা, ল্যাব! তার ওপর রেষ্টুরেন্টে কাজের চাপ ছিলো আজ বেশি।দু'জনের মুখোশ্রীতে ক্লান্তির ছাপ এঁটে সেঁটে আছে। ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে রুহি নিজের বিছানায় শুয়ে পড়লো। মীরা ছুটলো তোয়ালে হাতে ওয়াশরুমে। শাওয়ার নিয়ে তবেই সে বিশ্রাম করবে। টুইঙ্কেলকে আদর করে মীরা সবেই এক সেট পোশাক নিয়ে বাথরুমে প্রবেশ করেছে। টুইঙ্কেল ফ্যালফ্যাল করে রুহি, মীরাকে দর্শন করে ছুটলো রান্নাঘরে। টুল টেনে তার ওপর দাঁড়িয়ে সে সুন্দর করে লেবু কাটলো। দু'টো গ্লাসে পানি ভরে তাতে লেবুর রস দিয়ে চিনি মিশ্রিত করে লেবুর শরবত বানালো। রুহি, মীরা বাহির থেকে ক্লান্ত হয়ে ফিরেছে। টুইঙ্কেল তার টিচারের কাছ থেকে শুনেছে বাহির থেকে ক্লান্ত হয়ে ফিরলে লেবুর শরবত খেতে হয়। তাহলে ক্লান্তিভাব কিছুটা হলেও দূর হয়। দেহে সতেজতা আসে। 

গ্লাস দু'টো ট্রে তে রাখলো টুইঙ্কেল। তারপর টুল থেকে নেমে কাঁপা কাঁপা পায়ে এগোল সামনে। পড়ে যায় যায় গ্লাস! তবুও সামলে নিলো সে কোনোমতে। কিছুতেই গ্লাস দু'টো পড়ে যেতে দিলো না। টুইঙ্কেল যখন রুমে এসে পৌঁছালো তখন মীরা বেড়িয়েছে ওয়াশরুম থেকে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তখন সে চুল শুকাচ্ছিলো হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে। টুইঙ্কেল তার হাতের ট্রে টেবিলে রাখলো। তাকে এখনো দু'জন দেখেনি। সে একটা গ্লাস নিয়ে দৌড় দিলো মীরার নিকট। মীরার পিছন দাঁড়িয়ে বলে উঠলো, 

-' মিষ্টি! মিষ্টি খাও এটা। তোমার ভালো লাগবে। '

মীরা হেয়ার ড্রেয়ার রেখে পিছন ফিরলো।টুইঙ্কেলের হাতের পানীয় দেখে সর্বপ্রথম সে বুঝলো না এটা কি আসলে! সে জিজ্ঞেস করলো, 

-' তোমার হাতে কি টুইঙ্কেল? পানি? পানি এমন ঘোলা কেনো আম্মু? ময়লা পড়েছে? '

টুইঙ্কেল ডানে বামে মাথা নাড়লো। ইশারা ইঙ্গিতে জবাব দিলো ' না। ' পরবর্তীতে চটপট কন্ঠে বলল, 

- ' এটা পানি না মিষ্টি। এটা শরবত। লেবুর শরবত। তুমি বাহির থেকে টায়ার্ড হয়ে এসেছো না? টায়ার্ড হলে লেবুর শরবত খেতে হয়। মিস বলেছে। '

টুইঙ্কেলের হাতের গ্লাস মীরা পাশে রেখে দিলো। দুই হাত বাড়িয়ে কোলে তুললো টুইঙ্কেল কে। গালে চুমু খেলে ফটাফট। ততক্ষণে রুহিও এগিয়ে এসেছে ফোন ফেলে। মীরা আদুরে গলায় বলল, 

-' প্রিন্সেসের কতো বুদ্ধি। তা আম্মু তুমি কেনো কষ্ট করতে গেলে? কিচেনে যাবেনা আর ওকে?লেবু কেটেছো কি করে? হাত কাটেনি তো? দেখি, '

রুহি টুইঙ্কেলের গাল টেনে দিয়ে বলল,

-' বুদ্ধি তো থাকবেই। দেখতে হবেনা কুচুপুচু কার শিষ্য। '

' শিষ্য ' শব্দটার অর্থটা হয়তো টুইঙ্কেলের বোধগম্য হলো। সে গাল ফুলিয়ে আঙুল উঁচু করে বলল,

-' আমি তোমার ছিছো ( শিষ্য) না। আমি মিষ্টির ছিছো। '

হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকালো রুহি। মীরা তখন গলায় শব্দ করে হাসছে। দু'জনের আলাদা প্রতিক্রিয়া দর্শন মাত্র টুইঙ্কেল কিছু না বুঝে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে। কিয়ৎক্ষণ পর হতবিহ্বলের রেশ কাটিয়ে রুহি প্রশ্ন করলো, 

-' ছিছো কি কুচুপুচু? তুমি কি বাই এনি চান্স ' ছিচু ' বলতে চেয়েছো? আই মিন হিসু। বাথরুমে যাবে? এ্যাই মীরা। ওকে কোল থেকে নামা। ওর হিসু পেয়েছে। '

মীরা ধমকে বলল, ' চুপ গাধি! ও শিষ্য বলেছে। ঠিক মতো উচ্চারণ করতে পারেনি শব্দটা। ' 

- ' ইয়া আল্লাহ! কুচুপুচু তুমি তো দেখি শিষ্য শব্দটার রফাদফা করে দিলে। মাই গড! '

টুইঙ্কেল কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে শাসিয়ে বলল,

-' আমি কুচুপুচু না। আমি টুইঙ্কেল। কল মি টুইঙ্কেল।'

-' কুচুপুচু! আমি তোমাকে ডাকবো কু..চু..পু..চু। '

লেগে গেলো মূর্হতেই দু'জনের ঝগড়া। মীরা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। এই দু'টোর কেনো বনিবনা হয় না? এতো কেনো অমিল? এতো কেনো বাকবিতর্ক! 

___

তিমিররাত্রির তৃতীয়তম প্রহরের বিচরণ বাতাবরণে। রুহি, টুইঙ্কেল গভীর তন্দ্রায় আচ্ছন্ন। মীরা তখন কথা বলছে উশানের সাথে। ভিডিও কলে। কথা বলার সময়কাল মাত্র দুই মিনিট পেরুলো! কথা বলার ফাঁকে উঁকি ঝুঁকি দিলো মীরা ফোনে। উশান এর আশেপাশ সুক্ষ্ম নজরে অবলোকন করে বলল,

-' ঘুমোবেন না?'

গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র ঘাটছিলো উশান। তার আঁখি দু'টো ফুলো ফুলো।একটু আগেই ঘুম থেকে উঠেছে।সকালে নিজের কর্মস্থলে যাবে।তাই এখন থেকেই জরুরী কাগজপত্র গুছিয়ে রাখছে।কাগজ গুলো ফাইলে সারিবদ্ধ ভাবে গুছিয়ে রাখতে রাখতে উশান ব্যাস্ত কন্ঠে জবাব দিলো,

-' কাজ আছে মীরা। কাজ শেষ হলেই ঘুমাবো। '

-'খেয়েছেন দুপুরে? '

-' খেয়েছি মাত্র। তোমার, টুইঙ্কেল আর রুহির খাওয়া হয়েছে? '

মীরা মৃদু হেঁসে ' হ্যা ' বলল। তার ভালোলাগে ভীষণ যখন উশান তার খোঁজ খবর নেয়ার পাশাপাশি রুহি আর টুইঙ্কেলেরও খোঁজ খবর নেয়। লোকটা বেশ দায়িত্ববান। সবদিকে তার নজর। 

-' হাসছো যে? '

মীরা ধ্যানে আসলো। জবাব দিলো, 

-' উঁহু এমনি। উজান ভাইয়া, আপু তারা কেমন আছে? এতদিন পর আপনাকে দেখে নিশ্চয়ই খুব খুশি তাই না? আপনাকে তো একই দেশের ভেতরে থেকেও দেখতে আসতে পারেনি আপু। ঊষা আন্টির জন্য! উজান ভাই ব্যাস্ত মানুষ। '

-' আপু আমায় যখন প্রথম দেখলো তখন চমকে কেঁদে ফেলেছিলো। উজান প্রথমে খুশি হলেও এখন হয়তো আমার ওপর একটু রেগে। থাপ্পড় মেরেছি দু'টো ওকে। '

মীরা যখন চড় মারার কারণ জিজ্ঞেস করলো উশান তখন পুরো বিস্তর ঘটনা তাকে খোলাসা করলো। এটাও বলল উজান মীরাকে দিয়ে তাকে অত্যাচার করার ফন্দি আঁটছে। উশান তখন যা প্রতিত্তুরে বলেছিলো উজানের এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে তখন মীরা চমকে হাসি বন্ধ করলো। এতক্ষণ সে হাসছিল দুই ভাইয়ের কীর্তি শুনে। কিন্তু আপাত লহমায় লজ্জা পেয়ে তার হাসি অধর থেকে উধাও হলো। উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো, 

-' ছি্! এসব বলেছেন আপনি নিজের ছোট ভাইকে?আল্লাহ! এসব ভালোবাসা, আদর - টাদরের কথা উজান ভাইয়াকে কেনো বললেন? আপনার কি একটুও লজ্জা নেই?'

উশান অকপটে স্বীকার করলো, ' না নেই। '

-' নির্লজ্জ লোক। '

- 'যাই হই না কেনো, তোমারই তো। তুমি এই নির্লজ্জ উশানকেই পছন্দ করো, ভালোবাসো! '

-' আপনার এই নির্লজ্জ কারবার আবার শুনলে কিন্তু খবর আছে। '

হাতের কাগজপত্র টেবিলে রাখলো উশান। ঠোঁট কামড়ে ধরে বলল,

-' এটা কেমন কথা! আমি তো ভাবছি বিয়ের পর এমন সব নির্লজ্জের মতো কাজ করবো যার কারণে তুমি রুম থেকেই বের হতে না পারো। আর আমি তোমায় রুমে একলা পেয়ে সারাক্ষণ ভালোবাসবো।'

আর একটা কথাও বলল না মীরা। কন্ঠনালী জমাট করলো। উশান দিনকে দিন মাত্রাতিরিক্ত ঠোঁটকাটা, উদ্ভট কথা বলে তার সাথে। বেয়াদব লোকটা কি বুঝে? না মীরা এসব কথা শ্রবণ করা মাত্রই লজ্জায় আহত হয়।

প্রখর, কান এঁটো করা শব্দ হলো কোথাও। শব্দের উৎপত্তি উশানের বারান্দা। উশান উঠে পড়ে দৌড় লাগালো সেদিকে। ল্যাপটপ স্ক্রিনের অপর পাশ হতে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে মীরা। তার হুট করেই কেনো যেনো অস্থির, অস্থির লাগছে। ললাটে নোনা ঘাম জমেছে বিন্দু, বিন্দু। বারান্দার কাছে যেতেই উশান চাপা স্বরে মৃদু চেঁচিয়ে উঠলো অনিচ্ছা সত্বেও। আসলে সে তার সদ্য পাওয়া আঘাতটা মীরাকে দেখাতে চাচ্ছেনা। মীরা দেখলেই ব্যাকুল হয়ে উঠবে যা উশান আপাতত চাচ্ছে না। 

-' কি হয়েছে? আল্লাহ! আপনার হাত থেকে তো রক্ত পড়ছে। কি করে হলো? '

বারান্দার সম্মুখে দেয়া নীলচে রঙের পর্দা দু'টো দ্রুত হাতে সরালো উশান। লহমায় এক নারী অবয়ব এর দেখা মিললো। সে এক ছুটে লাফ দিয়েছে বারান্দা থেকে। উশান দৌড়ালো সেদিকে। স্পষ্টত দেখলো মেয়েটা লাফ দিয়ে পড়েছে নিচে দাঁড়িয়ে থাকা ফুলে ভর্তি ট্রাকে। ট্রাক দ্রুততার সাথে সে স্থান প্রস্থান করলো। ট্রাকটার পেছনে থাকা নাম্বারসহ যাবতীয় সবকিছু ঠোটস্থ করলো উশান। ফিরে এলো দ্রুত। ল্যাপটপ অফ করতে করতে চটপট বলল,

-' মীরা পরে কথা বলছি। আমাকে কেও আঘাত করতে এসেছিলো। সম্ভবত দরকারী কিছু ইনফরমেশনও নিয়ে গেছে। ওকে ধরতে হবে। '

কল কাটার পূর্ব মূর্হতে মীরা বিচলিত কন্ঠে শুধালো, 

-' শুনুন! মেয়েটাকে আমি চিনি। যতটুকু উল্টোপিঠ দেখে মনে হলো। মেয়েটা সিয়া। '

উশান তার ভ্র দ্বয়ের মাঝখানে ভাজ ফেললো। প্রশ্ন করলো, 

-' সিয়া! হু ইজ দিস গার্ল? '
.
.
.
চলবে...........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন