অভ্র নীল - পর্ব ০১ - সিজন ২ - শারমিন আক্তার বর্ষা - ধারাবাহিক গল্প


বন্ধুর বিয়ে উপলক্ষে গাজীপুর থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কাজীপাড়া এলাকায় যাচ্ছে নীল। যানজটের কারণে চার ঘণ্টার যাত্রায় সময় লেগেছে ছয় ঘণ্টা। বাসস্ট্যান্ড থেকে আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে দুটি রিকশা চলতে শুরু করে। হঠাৎ একটা রিকশা থেমে গেল। রিকশার টায়ার সমতল। একজন আরেকজনকে ছেড়ে যেতে পারবে না। এ কারণে ওঁরা রিকশা দুটিকে বিদায় করলো। তানজুম বলল,
  'এখন কী করব? আমরা এই জায়গা চিনি না, কোন দিকে যাবো?'
তানিয়া বলল, 
  'দেওয়ান বাড়ির নাম বলেছিল কাজল।'
  'এই জায়গার নাম কী? আশেপাশে জিজ্ঞেস করার মতো কাউকে দেখছি না।' বলে নীল চারদিকে তাকাল। সামনের রাস্তা দেখে সে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলল। কর্দমাক্ত পথ, সম্ভবত বৃষ্টি হয়েছিল। বিরক্ত গলায় বলল তানজুম,
  'এই কাঁচা রাস্তা দিয়ে যাবো কী করে? যদি গর্ত থাকে বা পড়ে যাই?'
মৃদু গলায় বলল নীল,
  'একটা প্রেমিক থাকলে, কোলে তুলে নিয়ে যেত।'
তানিয়া বলল,
  'আমাদের কি কপাল। এই কপালে প্রেমিক নেই।'

ব্যাগটা হাতে নিয়ে একটু এগিয়ে গেল। একটু সামনে আসতেই একটা গাড়ি দেখতে পেল, একটা লোক গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। নীল লোকটির পিঠ দেখতে পায়। খুশিতে বলল,
  'তোরা অপেক্ষা কর। ওই লোকের কাছে শুনে আসছি দেওয়ান বাড়ি কত দূরে।'

নীল এসে দাঁড়াল। স্পষ্ট গলায় বলল,
  'মাফ করবেন চাচা। বলতে পারবেন এই দেওয়ান বাড়িটা কোথায়?'

ভ্রুকুটি করে লোকটি ঘুরে দাঁড়াল। উচ্চস্বরে বলল,
  'চাচা মানে কি? আমি কোন দিক দিয়ে চাচার মত দেখতে?'
নীল অপরাধী সুরে বলল,
  'আমি দুঃখিত। পেছন থেকে দেখলাম তাই বুঝতে পারিনি।'
  'দেখ মিস। রাস্তায় ছেলেদের চাচা বা ভাই বলাটা গুরুতর অপরাধ। এ জন্য অন্তত এক মাস জেল খাটানো উচিত।'
নীল মাথা নাড়ল। বিড়বিড় করে বলল,
  'পাগল।'

নীল চলে এলো। তানজুম জিজ্ঞেস করল,
  'লোকটা কি বলছিল?'
  'মাথা নষ্ট! আমি ভুল করে চাচা ডেকেছি এজন্য সরি বলেছি। তারপর সে আমাকে বলে চাচা-ভাই ডাকার অপরাধে আমাকে এক মাসের জন্য জেলে যেতে হবে।'
তানজুম আর তানিয়া জোরে হেসে উঠল।

একজন কৃষক ধানক্ষেত থেকে বেরিয়ে হেঁটে আসছেন। নীল তাকে দেখে দেওয়ান বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করে। লোকটির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। হাসিহাসি মুখে বললেন,
  'দেওয়ান বাড়ি যাইবেন? আমার সাথে আসেন।'

লোকটি নিজ উদ্যোগে তাদের বাড়ির গেটে নিয়ে আসে। কাজল দ্বিতীয় তলার বারান্দায় বসে আছে। সে তার বন্ধুদের দেখে সাথে সাথে দৌঁড়ে নিচে নেমে এলো। গেটে ঢুকে দেখল একটা ছাগল জবাই করা হচ্ছে। নীল জিজ্ঞেস করল,
  'ছাগলটা কিসের জন্য?'
  'তন্ময় ভাইয়া মানে আমার হবু স্বামী। ঢাকা থেকে তার বন্ধুরা এসেছে। বলেই বাবা ছাগল জবাই করলেন। কাটার কাজ শেষ হলে জেঠাট বাড়িতে পাঠিয়ে দেবে।' কাজল বলল।
  'ওওহ, আচ্ছা।' বলল তানজুম।
তানিয়া বলল,
  'তোদের পোষা প্রাণী আছে?'
কাজল বলল,
  'সব না। তবে গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল, ভেড়া আছে।'

কাজলের মা বাবা তাদের দেখে খুব খুশি হয়েছেন। নুজাইফা বেগম বললেন,
  'কাজল, ওদের তোমার ঘরে নিয়ে যাও। আমি নাস্তা পাঠাচ্ছি।'

পরশু দিন হলুদ। আর একদিন আছে। একদিন কাজল ওদের নিয়ে গ্রামে বেড়াবে। ওদের গ্রামের সৌন্দর্য বন্ধুদের দেখাবে, কাজল বলল,
  'উনি আজ বিকেলে আসবে। তোরা রেডি থাকবি। আমরা সবাই একসাথে বের হবো।'
নীল ভ্রু তুলেছে। 
  'উনি কে?'
তানজুম হেসে বলল,
  'তুই কি বুঝতে পারছিস না উনি কে?'
তানিয়া বলল,
  'উনি-ই তিনি, তিনি-ই উনি।'

দুপুরের খাবারের পর খুব ভালো ঘুম হলো। বেশিক্ষণ ঘুমাতে পারলো না, কাজল তাদের তুলে বাইরে যাওয়ার জন্য তাড়া দেয়। ওরা একটু পরিপাটি হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেখল একজন লোক অনেকগুলো গরু নিয়ে যাচ্ছেন। পুকুরপাড় যাওয়ার পথে গরু, মুরগি ও হাঁস দেখা গেল। পুকুরের জলে সূর্যের আলো পড়ছে। নীল দেখল একটা কাঁঠাল গাছ, ডালে একজোড়া পাখি বসে আছে। দুজন প্রেম নিবেদন করছে।

পুকুর থেকে দু মিনিট হাঁটলেই আবার রাস্তা। তারা সেদিকে এগিয়ে গেল। তানজুম বলল,
  'উনি কখন আসবে?'
কাজল বলল,
  'তন্ময় ভাইয়া লেইট তো হবেই।'
নীল অবাক হল। একটা গরুর গাড়ি এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। গাড়ি থামল। পুরুষলোক জিজ্ঞাসা করলেন, 
  'দেওয়ান বাড়ির ছোট মেয়ে। কোথাও যাবা?'
প্রশ্নটি ছিল কাজলের উদ্দেশ্য যার উত্তরে সে বলল,
  'আমি কোথাও যাবো না। তারা আমার শহরের বন্ধু তাই আমি তাদের গ্রাম দেখাচ্ছি।'
লোকটা হাসল। বলেন,
  'আচ্ছা, ভালো করে দেখাও।'
তানিয়া বলল, 
  'আপনার গাড়িতে উঠতে টাকা লাগবে?'
লোকটা কোমল গলায় বলেন, 
  'দেওয়ান বাড়ির মেয়ের কাছ থেকে টাকা দিতে পারবো না। তোমরা চাইলে ওঠো, আমি তোমাদের একটু ঘুরাতে পারবো।'
নীল বলল,
  'আমি উঠব না। আমি পড়ে গেলে কি হবে?'
কাজল বলল,
  'পড়বি না। আমি তোকে ধরে রাখব।'

বাতাসের উষ্ণতা শরীরকে শীতল করে ফেলছে। নীল আশেপাশে উঁকি দিয়ে হঠাৎ বলল,
  'এই প্রথম গরুর গাড়ি উঠলাম। শহরের দামি গাড়ির চেয়ে ভালো লাগছে।'

যেখান থেকে উঠেছে সেখানেই নেমে গেল। দখিনা বাতাস বইছে, ধানের ক্ষেত মৃদু দোল খাচ্ছে, পাখিরা মুক্ত আকাশে বিক্ষিপ্ত হয়ে উড়ছে। চারিদিক দেখে মুগ্ধ নীল খুশির কণ্ঠে বলল, 
  'বাহ। কত সুন্দর।'
  'তোমার চেয়ে বেশি নয়।'

পুরুষ কন্ঠ শুনে নীল তৎক্ষণাৎ পিছন ফিরল। দুপুরের লোকটা ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। তার ঠোঁটে সুন্দর হাসি। একটু ঝুঁকে আবার ফিসফিস করে বলল,
  'তুমি অনেক বেশি সুন্দর।'
নীলা অবাক হল। রাগ দমন করে বলল,
  'তুমি? তুমি কি আমাকে ফলো করছ?'

লোকটি নিবিড়ভাবে মাথা নাড়ল। যার অর্থ, না। তারপর সোজা হয়ে উঠে শক্ত কণ্ঠে বলল, 
  'সুন্দরী মেয়েদের ফলো করতে নেই। কারণ ছেলেরা আগে থেকেই তাদের পেছনে লাইন ধরে থাকে।'
লোকটা চলে গেল। নীল পিছন ফিরে দেখল কাজলের সাথে কথা বলছে আরও তিনজন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। নীল এগিয়ে গেল। কাজল তাদের পরিচয় করিয়ে দিল। তন্ময়ের বন্ধু অভ্র এবং আকাশ ও শুভ।

নীল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। অভ্র একটা হাসি দিয়ে বলল।
  'তোমার সাথে দেখা করে ভালো লাগল।'
নীল দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
  'আমার ভালো লাগছে না।'

নীল একটু দূরে দূরে হাঁটছে। আনমনা হয়ে ইটের সঙ্গে হোটচ খেয়ে পড়ে গেল। সে হঠাৎ পা ধরে চিৎকার করে। তারা ছুটে এল। অভ্র জিজ্ঞেস করল,
  'তুমি কি হোটচ খেয়েছ?'
নীল উপর নিচ মাথা নাড়ল। যার মানে, হ্যাঁ।

নীল উঠে দাঁড়াতে পারছে না। সে এভাবে চলতে পারবে না। অভ্র গম্ভীর ভঙ্গিতে বসে আছে। হঠাৎ করেই নীলকে কোলে তুলে নিল। নীল অবাক গলায় বলল। 
  'তুমি কি করছ? আমাকে নামিয়ে দাও।'

শান্ত গলায় অভ্র বলল,
  'নড়বে না, আমি সামলাতে পারব না।'
  'নামাও, আমি কিন্তু চিৎকার করব।'
নীলের কথা অভ্রর কান দিয়ে যাচ্ছে না। সে ডোন্ট কেয়ার মনোভাব নিয়ে হাঁটতে লাগল, নীল রেগে অভ্রর কাঁধে কামড় দিল। অভ্র বড় বড় চোখ করে নীলের দিকে তাকিয়ে বলল,
  'তুমি আমার মাংস খেতে চাও কেন? তুমি কি জীবনে কখনো মাংস খাওনি?'
  'খেয়েছি। কিন্তু তোমার খাওয়া হয়নি।'
  'খাইতে চাও?'
অভ্র পলক ফেলল। তারপর একটা বাঁকা হাসি দিয়ে বলল, 
  'আমি কিন্তু বারণ করব না।'

নীল কিছু বলল না। তারা একটা বিশাল কড়ই গাছের নিচে বসলো। ঝালমুড়ি বিক্রি করতে এ পথে আসছেন এক ব্যক্তি। কাজল জিজ্ঞেস করল, 
  'ঝালমুড়ি খাবি?'
তানিয়া বলল, 
  'খাবো।'
শুভ হঠাৎ বলে উঠলো, 
  'আমি আর বেয়াইন গিয়ে নিয়ে আসছি।'
নীল বলল,
  'আমার জন্য কম ঝাল হওয়া চাই।'
অভ্র নীলকে ঘাসে বসিয়ে দিল। তারপর সে বসে পড়ল এবং জোরে শ্বাস নিতে লাগল। তন্ময় জিজ্ঞেস করে,
  'তুই হাঁপাচ্ছিস কেন?'

অভ্র স্পষ্ট স্বরে বলল,
  'ছোট্ট এক হাতির বাচ্চা কোলে নিয়ে ছিলাম।'
নীল কপট রাগ চেপে বলল,
  'আমি হাতির বাচ্চা?'
অভ্র বলল,
  'আমি কারো নাম বলিনি।'
আকাশ একটা জলের বোতল অভ্রর হাতে দিল। অভ্র মৃদু হেসে বলল,
  'ধন্যবাদ।'
অভ্র পানি শেষ করে। ঠান্ডা গলায় বলল,
  'তুমি খুব ভারী! ডায়েট করবে।'
নীল অভ্রর দিকে তাকিয়ে চোখ গরম করে বলল,
  'অসভ্য।'
  'আমি মোটেও অসভ্য নই মিস অঞ্জনা।'
  'নীলাঞ্জনা।'
  'ওহ সরি, সরি। নীলাঞ্জনা, নীল বা নীলা।'
নীল আঙুল নাড়তে নাড়তে বলল,
  'আমার সাথে বকবক করবে না।'
  'আমি হাঁস নই যে প্যাকপ্যাক করব। মানুষ তো বকবক করতেই হবে।' অভ্র ঠোঁট টিপে হাসল।

___

রাত বারোটা। ঘুমের তাড়নায় তানজুমের চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হতে চলেছে, তখন কেউ একজন তার দুই গালে আলতো করে হাত রেখে মৃদু স্বরে ডাকল,
  'মা, উঠো না। আরও গল্প শুনব।'
তানজুম ঘুমন্ত গলায় বলল,
  'বাবা, আজ ঘুমাও। আমি কাল শুনাবো।'
তপু বলল,
  'মা আমি এখন শুনব।'
তানজুম ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, 
  'আমার ঘুম পাচ্ছে।'

তানজুম ঘুমিয়ে পড়ে। তপুর চোখে ঘুম নেই। যেন তার চোখ থেকে ঘুম কেড়ে নিয়েছে কেউ। উদাস চোখে তাকিয়ে আছে মায়ের ঘুমন্ত মুখের দিকে। করুণ কণ্ঠে বলল,
  'আমি নীল আন্টির গল্প আরও শুনতে চাই।'

তানজুম মাঝে মাঝে স্মৃতিচারণ করে এক বন্ধুর নাম উল্লেখ করে। নাম নীল! তপু, তার মায়ের দুই বন্ধু তানিয়া ও কাজল আন্টির সাথে পরিচিত কিন্তু নীল। নীল নামটা বললেই তানজুমের চোখ ভিজে ওঠে। সে কে? এর কারণ কী? তপু অনেকদিন জিজ্ঞেস করে, নীল কে? তানজুম কখনোই নীল কে তা তপুকে বলেনি। তপু এখন বড় হয়েছে, সে ক্লাস সিক্সে পড়ছে। হঠাৎ একদিন মায়ের কাছে জানতে চাইল নীল এর কথা। তানজুম সেদিন তাকে উপেক্ষা করেছিল। আজ সে নিজ থেকে তার ছেলেকে নীলের গল্প বলা শুরু করেছে। তপুর আনন্দ সবে শুরু হয়েছে আর মা ঘুমিয়ে পড়েছে। তপু বিরক্তি নিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করে।

সকালে স্কুলে যায় তপু। বিকেলে স্কুল থেকে আসার পর বন্ধুদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলতে মাঠে যায়। আজ স্কুল থেকে এসে ব্যাগটা পড়ার টেবিলে রাখল। স্নান সেরে মায়ের পাশে বসল। তানজুম টিভিতে নাটক দেখতে দেখতে তপুর উদ্দেশ্য বলল,
  'তুমি আজ খেলতে যাওনি। শরীর খারাপ?'
তপু বাম থেকে ডানে মাথা নাড়ল। তারপর বলল,
  'আমার কিছুই হয়নি। আম্মু?'
তানজুম টিভির দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল,
  'হুহ?'
  'আমি নীল আন্টির পুরো গল্প শুনতে চাই।'

১৪ বছর পরে, পুরো স্মৃতি বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। তানজুম জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলল যেন তার বুকে পাথর চাপা পড়েছে আর সে শ্বাস নিতে পারছে না।

তপু পা ভাঁজ করে বসে রইল। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
  'আম্মু, বলো।'
 
ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল তানজুম। চোখ দুটো বন্ধ। শুঁকনো গলা পানি খেয়ে ভিজিয়ে নিল। তারপর একটু সময় নিয়ে তানজুম বলল,
  'তপু, তুমি একদম নীলের মতো, তোমার তার মতো ধৈর্য নেই। নীল তোমার মতই চঞ্চল ছিল এবং এক মুহূর্তের নোটিশে অধৈর্য হয়ে যেত।'
.
.
.
চলবে.....................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন