বর্তমান
______
আলতো হাতে ইনান ডায়েরীটা বন্ধ করল। কভারে খুব সুন্দর থ্রিডি বাটারফ্লাই ক্লে দিয়ে বানানো। নিচে ছোট্ট ডায়েরীর নাম লেখা ‘MY BUTTERFLY’
ইনান দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এই ডায়েরীটা জেহফিল নিজ হাতে বানিয়েছে, কভার হতে শুরু করে পেজগুলোও হোমমেড। মারাত্মক সুন্দর! আর উৎসর্গ করা হয়েছে ইনানকে। ইনানকে ঘিরে ভালোবাসার কথা আর ছোট ছোট কিছু মুহুর্ত নিয়েই ডায়েরীটা লেখা। ইনান জানত না জেহফিল যে ডায়েরী লেখার অভ্যাস আছে। ইনানের জন্য জেহফিলের পাগলামি সব কিছু এটায় লেখা। বাইরের যে কেউ পড়লে বলবে কোনো পাগল এক কথা একজনকে নিয়ে বারবার লিখেছে, কিন্তু ইনান জানে, বুঝে, প্রতিটা অক্ষরও কী ভালোবাসায় লিখেছে জেহফিল! এই বুঝটা কত দেরিতে আসলো তার জীবনে…
নিশ্চয়ই লেখার সময় জেহফিল বিড়বিড় করে ‘আমার বাটারফ্লাই, আমার বাটারফ্লাই’ কথাটা ক্ষণে ক্ষণে আওড়িয়েছে!
রাতের শেষে ঠাণ্ডা বেশ পড়েছে! তাদের বাড়ির পেছনের জঙ্গলের দিকে তাকালে মনে হয় মেঘের দেশে আছে। কুয়াশার চাদর মাকড়সার জালের মতো বিছিয়ে আছে। গাছগুলোর সবুজাভ ভাবও দেখা যাচ্ছে না এতই কুয়াশা।
ডায়েরীটা ড্রয়ারে রেখে দেয়ার সময় কিছু একটার দিকে চোখ পড়ল ইনানের। চোখ সরু করে ড্রয়ারের ভেতরে আরো একটা মোটা ডায়েরী দেখতে পেল সে। ইনান ভ্রু কুঁচকে বের করল সেটা। দেখে মনে হচ্ছে পার্সোনাল ডায়েরী, তবে আগের ডায়েরীটা থেকে এই ডায়েরীটার অবস্থা করুণ। দেখেই বোঝা যায় কতটা অযত্নের এটা। ইনান এসব ডায়েরীর ব্যাপারে জানতো না। কী মনে করে রুম পরিস্কার করতে করতে জেহফিলের ড্রয়ার খুলল আর এসব দেখল। জেহফিল কখনোই ইনানকে ডায়েরীগুলোর ব্যাপারে বলেনি বিধায় কৌতুহল থেকেই নিজে খুলে দেখল।
এখনকার ডায়েরীটা সবুজ রঙের। কভার সাধারণ। একটা বক্সের মতো দেখতে, সামনে তালা লাগানো। ইনান ভাবল, এই জেহফিলকে না জানিয়ে এই ডায়েরীটা দেখা উচিত হবে কিনা। জেহফিল যদিও কিছু বলবে না তাও! ইনান ডায়েরীটা উল্টেপাল্টে দেখতে লাগল কোথাও চাবি ঝুলানো আছে কিনা, নেই। চাবি ছাড়া তালা খোলারো উপায় নেই।
ইনান যখন তালা খোলার চেষ্টা করছিল সেই মুহুর্তে ফ্লোরে কিছু পড়ার আওয়াজে চমকে যায় সে। শরীর কেঁপে উঠে চমক পেয়ে। হাতে থাকা ডায়েরীটা পড়তে পড়তে বেঁচে যায়। ডায়েরীটা টেবিলের উপর রেখে দরজার বাইরে আসতেই দেখে জেহফিল দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ ঠিক ইনানের বের হওয়া দরজার দিকেই। যেন জানত ইনান আসবে। ইনানকে দেখে জেহফিল মিষ্টি হাসে, বিনিময়ে ইনানও মুচকি হেসে এগিয়ে আসে। ফ্লোর থেকে ক্রাচ তুলে জেহফিলের বাম হাতে ধরিয়ে দেয়।
‘ড্রয়ারে একটা সবুজ রঙের ডায়েরী দেখেছি। ওটার চাবি কোথায় জেহফিল?’
জেহফিল নিরুত্তর থেকে বাম হাতে ক্রাচ চেপে ডান পায়ে আর ক্রাচে ভর দিয়ে দিয়ে হাঁটতে থাকে। ইনান জেহফিলের বাম পায়ের দিকে তাকাতে তাকাতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
দুই মাস আগে কার অ্যাক্সিডেন্টে জেহফিলের বাম পায়ের হাড় গোড়ালির গাঁট ভেঙে যায়। দুই মাসেও জেহফিলের পা ঠিক হয়নি। যার দরুণ সিঙ্গেল ক্রাচের সাহায্যে জেহফিলকে এখন চলাফেরা করতে হয়। সেই অ্যাক্সিডেন্ট যে ইনানের ক্ষতি করেনি তা নয়, ইনানের মাথার পেছনে প্রচণ্ড আঘাত পায়, যার কারণে এখনো ঔষধ নিতে হয়।
‘পোলাও করব নাকি বিরিয়ানি?’
ইনান হালকা স্বরে বলল। জেহফিলের ডান হাত তার হাতের মুঠোয়।
জেহফিল এক পলক ইনানের দিকে তাকিয়ে নজর ফিরিয়ে নিলো। ধীর পায়ে টেনে টেনে রান্নাঘরের দিকে এগোয়। জেহফিলের উদ্দেশ্য বুঝতে ইনানের সময় লাগে না। সে দ্রুত জেহফিলের হাত চেপে ধরে। আরেক হাতে জেহফিলের কোমর।
‘আমরা এখন বেডরুমে যাচ্ছি।’ কিছুটা ধমকের সুরে বলল ইনান।
এই বলে জোর করে জেহফিলকে রুমে নিয়ে আসলো। জেহফিলকে খাটে শুইয়ে সে চলে যেতে উদ্যত হলেই জেহফিল ইনানের হাত টেনে ধরে।
মৃদু গলায় বলল, ‘ইজেল আর রঙ দিয়ে যাবে প্লিজ?’
ইনানের গলা ভিজে আসলো। কান্নার ঢোক গিলে মাথা নাড়িয়ে আর্টরুমের দিকে পা বাড়ালো সে। আজ সারাদিনে জেহফিল প্রথমবারের মতো মুখ খুলেছে। ইদানিং জেহফিল কেমন অদ্ভুত রকমের চুপচাপ থাকে। খুব প্রয়োজন ছাড়া মুখ ফুটে কিচ্ছুটি বলে না। শুধু ইনানের পানে গভীর দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। সেই দৃষ্টি দেখে ইনানের মনে হয় জেহফিল মুখে না বলেও অনেক কথা ইনানকে বলছে। কিন্তু বোকা ইনান বুঝতেই পারছে না…
অ্যাক্সিডেন্টের আগের জেহফিল আর এখনকার জেহফিলের মধ্যে তফাৎ অনেক। অনেক মানে অনেক। ইনান টের পায় জেহফিলের পরিবর্তন। কিন্তু ইনান সময় চায়। নিজের কাছেই সময় চায়। দুর্ঘটনার বেশি দিন হয়নি। ইনান নিজেও ধাক্কা সামলে উঠতে পারেনি এখনো। মাঝরাতে হঠাৎ হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় দুঃস্বপ্নে।,সেদিনের দুর্ঘটনার রেশ এখনো রয়ে গেছে। জেহফিলকে বাসায় নিয়ে এসেছে সে মাত্র পরশু। জেহফিলের অবস্থা তো তার থেকেও গুরুতর। তাহলে জেহফিলকে কিছুদিন সময় দেয়া উচিত স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য।
ইনান নিজেকে সান্ত্বনা দিতে দিতে আর্টের সরঞ্জাম নিয়ে জেহফিলকে দিয়ে আসলো।
রান্নাঘরে গিয়ে বারবার জেহফিলের রান্নার কথাগুলো মনে পড়ছে তার। জেহফিল ইনানকে কখনোই রান্নাঘরে ঢুকতে দিতো না। ইনান মুখে বলা মাত্রই সেই ডিশ সাথে সাথেই তৈরি করে দিতো জেহফিল। এখনো জেহফিল ইনানের অগোচরে রান্নাঘরে ঢুকতে যায় আর যদি ইনান দেখে ফেলে, সে ধমকা ধমকি করে জেহফিলকে রান্নাঘর থেকে বের করে। জেহফিল ধরা পড়ে মুচকি হেসে রুমে চলে যায়। কিন্তু ইনান চায় জেহফিল একটু কথা বলে ইনানের সাথে ঝগড়া করুক। যেই ঝগড়ায় জেহফিল হেরে যাবে আর ইনানের জয় দেখে বিজয়ের হাসি হাসবে।
ইনান দিন গুণছে সেই দিনটি দেখার আশায়।
রাতের বেলায় খাবার টেবিলে ইনান হুট করে জেহফিলের ডান পায়ে বসে পড়ল। জেহফিল বলেছিল একবার, ইনান যাতে সবসময় জেহফিলের কোলে বসে খায়। মাথা ঘুরালো জেহফিলের অভিব্যক্তি লক্ষ্য করার জন্য। দেখল জেহফিল শূন্য দৃষ্টিতে ইনানের দিকে তাকিয়ে আছে। সেই চোখে বিস্ময় নাকি সন্তুষ্টি ইনান বুঝতে পারল না। তাই সে উঠে পড়ে কোল থেকে। কিন্তু জেহফিল বাম হাতে ইনানের কোমর জড়িয়ে ধরে আচমকা। বিদ্যুতের মতো শক খায় ইনান। শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায় শিহরণে। কতদিন পর জেহফিল তাকে নিজ থেকে জড়িয়ে ধরেছে!
জেহফিল ইনানের ঘাড়ের কাছে নাক এনে লম্বা নিঃশ্বাস টেনে নেয়। তার উষ্ণ নিঃশ্বাসে ইনান চোখ চেপে ধরে শক্ত করে। জেহফিল তার ঠোঁট দুটো ইনানের কানের কাছে নিয়ে এসে সময় নিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠে,
‘বাটারফ্লাই..!’
কতদিন পর এই নামে ডাকল জেহফিল! শেষ শুনেছে যেদিন ইনানের চোখ বন্ধ হয়ে এসেছিল। যেদিন ভেবেছিল জেহফিলকে আরো চোখের দেখা দেখবে না সে। ঠিক কতদিন পর প্রিয় ডাকটা জেহফিলের ঠোঁট থেকে বেরিয়ে আসলো!! ইনান নিজেকে সামলাতে পারে না। হু হু করে কেঁদে উঠে পিছনে ঘুরে জেহফিলের ঘাড় জড়িয়ে ধরে। কান্নারত গলায় বলে,
‘মিস করেছি অনেক জেহফিল। আপনার বলা বাটারফ্লাই ডাকটা অনেক মিস করেছি আমি।’
.
.
.
চলবে…...........................