শ্রীঘর
পর্ব ০৩
আতিয়া আদিবা
.
.
.
বিয়ের প্রথম একমাস সাহিল দিবাকে স্পর্শ করে নি। কেনো করে নি তা নিয়ে দিবার মনে কখনো কোনো প্রশ্ন জাগে নি। কিন্তু এখন এই বিষয়গুলো তার মনে ভীষণ ভাবে দাগ কাঁটছে।
এমন নয় যে তাদের বিয়েটা পারিবারের পচ্ছন্দে হয়েছিলো। যাকে এরেইঞ্জ ম্যারেজ বলে। ওদের ভালোবাসার সম্পর্কটা পরিবারের সম্মতিতেই বিয়ের মতো পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। দিবা রাতে একফোঁটাও ঘুমাতে পারলো না। জমিলার কথা কতটুকু সত্যি তা ভাবতে লাগলো। মানুষটাকে সে ভুল বুঝছে না তো? ভালোবাসার মানুষটিকে দিবা অসম্মান করছে না তো? অতীত নিয়ে সে কখনোই সাহিলকে কিছু বলে নি। কিন্তু আজ বলেছে। কাজটা কি ঠিক হয়েছে? মানুষ রাগের সময় উচিত সিদ্ধান্তের চেয়ে অনুচিত সিদ্ধান্তই বেশি গ্রহণ করে। দিবার এবার সাহিলের জন্য খারাপ লাগতে শুরু করলো। সে মনে মনে ঠিক করলো আগামীকাল জমিলা আসলে সাহিলকে এবং তাকে সামনা সামনি দাঁড় করিয়ে প্রশ্ন করবে সে। এতে সত্যি মিথ্যা কিছুটা হলেও বুঝতে পারা যাবে।
পরেরদিন সকাল সাতটার মধ্যে দিবার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। সে ধীর পায়ে আস্তে আস্তে সাহিলের ঘরে গেলো। ছেলেটার মুখের ওপর পর্দা ভেদ করে সূর্যের সরু আলো পড়েছে। দূর থেকেই দিবা দেখতে পেলো সাহিলের নাকের পাশে চোখের ঠিক কোণে কি একটা চিকচিক করছে। কাছে গিয়ে দেখতেই দিবার বুকের ভেতোর হুহু করে উঠলো। পানি! সাহিলের চোখে পানি। তার মানে ও সারারাত কেঁদেছে। এই দেখে দিবা এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। তার মনে হতে লাগলো জমিলা মিথ্যা বলছে। সাহিল এমনটা করতেই পারে না। দিবা ছাড়া অন্য কাউকে সে স্পর্শ করার কথা চিন্তাও করতে পারে না। সাহিলের বুকের ওপর মাথা রেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো দিবা। সাহিল জাগনা পেয়ে গেলো। দিবাকে এভাবে কাঁদতে দেখে সাহিল প্রথমে কিছু আন্দাজ করতে পারলো না।
" আমার ভুল হয়েছে, সাহিল। আমার অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি নি। তোমার ওপর আস্থা রাখতে পারি নি। তুমি প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও!"
এবার সাহিল দিবাকে বুকে নিয়েই আস্তে আস্তে উঠে বসলো। মুখের ওপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে দিবার চোখ মুছে দিলো।
" এভাবে বলো না। আমি বলছি না তুমি জমিলাকে অবিশ্বাস করো। কিন্তু আমার কাছেও তো তোমার শোনা উচিত ছিলো। তুমি সেই সুযোগ টুকু আমাকে দিতে! সেটাও দিলে না। কিসব উলটা পালটা বকলে। তুমিও যদি আমায় অবিশ্বাস করো আমায় বিশ্বাস করবেটা কে?"
দিবা হেঁচকি তুলতে তুলতে বললো,
" আমি করবো। জমিলাকে আমি কাজ থেকে বের করে দিবো।"
" না। তা কেনো দিবে? আগে সামনা সামনি হই। কারণ এটা জানাটাও গুরুত্বপূর্ণ জমিলা কেনো এ ধরনের কথা বলেছে।"
" হুম। তাও ঠিক।"
" আচ্ছা হয়েছে। এখন কান্নাকাটি বাদ। যাও ফ্রেশ হয়ে আসো। ক্ষুধায় মরে যাচ্ছি! রাতে কিছু খাই নি।"
দিবা চোখ মুছে হাসি হাসি মুখে সম্মতি জানিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। দিবা বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই সাহিলের নাম্বারে একটি ম্যাসেজ আসলো। অপরিচিত নাম্বার। সাহিল ম্যাসেজ অন করে পড়লো। একটি লাইন লিখা।
" The clock is ticking "
সাহিল ট্রু কলারে নাম্বারটা সার্চ করলো। কিন্তু কোনো আইডেন্টিটি বের করা সম্ভব হলো না। তারপর সে সরাসরি নাম্বারটিতে কল করে বসলো। কিন্তু ফোন সুইচড অফ বলছে। মাত্রই এই নাম্বার থেকে টেক্সট আসলো আর এখনই সুইচড অফ বলছে! এটা কি করে হতে পারে? সাহিলের কপালে চিন্তার রেঁখা দেখা গেলো। চিন্তিত মনে সে ফ্রেশ হতে উঠে চলে গেলো।
ঘড়ির কাটা টিকটিক করে নয়টার দিকে এগোচ্ছে। সূর্যরশ্মিও বেশ তীব্র। দিবার রান্না করা শেষ। এটুকু সময়ের মধ্যেই সে চটজলদি আলু ভাজি আর রুটি ভেজে নিয়েছে। সাহিলের পচ্ছন্দের ব্রেকফাস্ট। সাহিল ফ্রেশ হয়ে জামা কাপড় পালটে ডায়নিং এ এসে বসলো। দিবা খাবার বেড়ে দিচ্ছে। সাহিল বললো,
" আলুভাজিটা মনে হচ্ছে অনেক মজা হয়েছে।"
" আগে মুখে নিয়ে তো দেখো!"
" ভাজিটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে অনেক মজা হয়েছে! আর আমার বউয়ের হাতের রান্না তো মাশা'আল্লাহ।"
" হয়েছে এখন একটু খান আপনি?"
সাহিল হেসে এক টুকরো রুটি ছিড়ে যেই মুখে দিতে যাবে দরজায় বেল বাজলো। দিবা ভ্রুঁ কুঁচকে বললো,
" জমিলা এসেছে হয়তো। আমি খুলে দিয়ে আসছি। আর শুনো, খাবার টেবিলে কিছু বলার দরকার নেই।"
দিবা দরজা খুলতে গেলো। সাহিল হাত থেকে রুটির টুকরো থালায় রেখে দিলো। দরজা খুলার সাথে সাথে পুরুষ কন্ঠ শোনা গেলো,
" আমরা থানা থেকে এসেছি। আপনার স্বামী বাসায় আছে?"
দিবা উত্তর দেওয়ার আগেই একজন পুলিশ " এক্সকিউজ মি" বলে সুরুসুর করে ঘরে ঢুকে গেলো। দিবা উঁচু গলায় তাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
" এসব কি? ভেতোরে যাচ্ছেন কেনো আপনি?"
পুলিশ সাহিলকে নিয়ে সদর দরজার কাছে আসলো। দরজার অপাশে দাঁড়িয়ে থাকা অফিসার বললেন,
" আপনার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ এসেছে। ইউ আর আন্ডার এরেস্ট।"
সাহিল হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে আছে। দিবা রুক্ষ কন্ঠে বললো,
" মানে কি? এসব কি বলছেন আপনারা? কার শ্লীলতাহানি করেছে আমার বর?"
" অভিযোগকারীর ম্যাডাম।"
" কে অভিযোগ করেছে?"
পুলিশ উত্তর দেওয়ার আগেই জমিলার কন্ঠ শুনতে পাওয়া গেলো। সিড়ি দিয়ে উঠে আসছে সে।
" আমি করছি আফা।"
" জমিলা! তুমি কি করছো এসব?"
" দেখেন আফা! আপনাগো যে প্রেম আফনি জীবনেও ভাইরে কিছু কবেন না। উলটা আমার চরিত্রে দোষ খুঁইজা কাম ছাড়ায় দিবেন।"
এবার আঁচলে মুখ ঢেকে কান্নার অভিনয় করে জমিলা বললো,
" আমি গরীব মানুষ। আমার চরিত্রে এমন দোষ ধরায়া কাম ছাড়ায়া দিলে সবাই আমারে খারাপ জানবো। কেউ কাম দিবো না। না খাইয়া মরা লাগবো। তাছাড়া, এসব পুরুষ মানুষগো পুলিশেই দাওয়া উচিত। তাও যদি নারী পিপাসা মিটে।"
সাহিল কথাগুলো শুনে চোখ বন্ধ করে ফেললো।
" চলুন মিস্টার সাহিল। বাকি কথা থানায় হবে।"
সাহিলকে নিয়ে পুলিশ নিচে চলে গেলো। দিবা আটকানোর চেষ্টা করলো কিন্তু লাভ হলো না। জমিলাও তাদের সাথে চলে গেছে। দিবা কান্না করতে করতে ডায়নিং এ চলে এলো। সাহিলের প্লেটে এক টুকরো রুটি এখনো পড়ে আছে। ঘড়ির কাটায় অদ্ভুতভাবে শব্দ বেরুচ্ছে। টিক টিক। যেনো খারাপ সময় শুরু হয়ে গেছে সাহিল আর দিবার জীবনে।
.
.
.
চলবে........................