হৃদয়েশ্বরী - পর্ব ৩২ - সাদিয়া মেহরুজ দোলা - ধারাবাহিক গল্প


অপরাহ্নের প্রথম প্রহর। রক্তিম বর্ণের অন্তরীক্ষের নিচে দল বেঁধে পুঞ্জ পুঞ্জ শুভ্র মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে। মেঘের আড়ালে সময়ের ঢাকা পড়েছে হরিদ্রা সূর্য। সময়ের তালে তালে সে নিজের বিদায় বার্তা জানাচ্ছে। সমীরে তখনও নিদারুণ তপ্ততা।দ্রুত পদে নিত্যপর্নের দোকান থেকে বের হলো মীরা। জলদি বাসায় ফিরতে হবে। ক্লাস শুরু হতে না হতেই ক্লাস টেস্টের রুটিন দিয়েছে তার৷ পরিক্ষা গুলো গুরুত্বপূর্ণ বেশ। এখনো তেমন প্রস্তুতিই নেয়া হয়নি। মীরা হাঁটা ধরলো তপ্ত রৌদ্দুরের মাঝেই। অন্তরীক্ষ হুট করে মেঘবর্ণ রূপ ধারণ করলো। দানবীয় শব্দধ্বনি থেমে থেমে আছড়ে পড়ছে। মনে হয় রৌদ্দুরের উত্তপ্তায় অতিষ্ঠ হওয়া মানুষদের স্বস্তি প্রদানের জন্য বৃষ্টি আসবে।

মীরা লম্বা লম্বা কদম ফেলে হাঁটছে। তার পদচারণ ক্ষণে ক্ষণে বৃদ্ধি পাচ্ছে তো আবার কমে আসছে। বর্তমানে তার মন ও মস্তিষ্কের সকল নিউরন অন্যত্রে পড়ে। তারা গহীন চিন্তায় মগ্ন। মীরা বেশ মনোযোগ সহকারে ভাবছিলো উশানের কথা। লোকটার সাথে তার যোগাযোগ, কোনোরূপ কথাবার্তা নেই আজ এক সপ্তাহের মতো হবে। উশানের কড়া শিডিউল মেইনটেইন করে ট্রেনিং দিতে হচ্ছে। উশান ট্রেনিং দিচ্ছে মূলত জুনিয়রদের। যাদের ' এসি ' পদের আওতা ভুক্ত করা হয়।

মীরা চরম আহত হয় যখন এই বার্তা তার কর্ণগোচর হয়।তার মাঝেমধ্যে আফসোস হয় বড্ড কেনো সে এমন ব্যাস্ত মানুষটার প্রেমে পড়লো? তপ্তশ্বাস ছাড়লো মীরা। বিড়বিড়িয়ে বলল, 

-' আপনাকে ছাড়া এক - একটা মূর্হত যে আমার নরক যন্ত্রণা সমেত মনে হচ্ছে। আমি বাকি জীবনটা কাটাবো কি করে? বলুন তো শেহজাদা! '

হাঁটার গতি বাড়লো। মস্তিষ্কের নিউরনে আঁটকে থাকা সেই সুন্দর দিনটার কথা মনে করলো মীরা ফের আরো একবার। লাজুক নেত্রে দৃষ্টি নত করলো তৎক্ষনাৎ। উশানের স্পর্শ! অনাকাঙ্ক্ষিত সেই স্পর্শ তার দেহে এখনো কাঁপুনি তৈরি করে। সে কি ভয়ংকর অনুভূতি। তবে পরবর্তীতে যখন স্পর্শটার অধিকারের দিকটা খুঁজতে যায়। তখন? তখন তার অন্তঃকরণ, বক্ষঃস্থল অদৃশ্য কষ্টে জর্জরিত হয়। সে নাহয় প্রথমদিন আবেগের বশে উশানকে জরিয়ে ধরেছিলো। কিন্তু পরবর্তী দিন গুলোতে তো দূরত্ব বজায় রেখে চলতো। তাদের মাঝে যে এখনো কোনো পবিত্র সম্পর্ক গড়ে উঠেনি। পরিণয় হয়নি!তাহলে সেই স্পর্শের কি নাম দেবে সে? 

আচানক ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো। উত্তপ্ত ভূমি শীতল হতে লাগলো। মীরা সকল চিন্তা দূরে ফেলে হাতের ব্যাগ গুলো ভূমিতে ফেললো শব্দ করে। দুই হাত দু'দিকে ছড়িয়ে দিয়ে অন্তরীক্ষের পানে চেয়ে নেত্রজোড়া বন্ধ করে নিলো। আহা বৃষ্টি! পরম শান্তির বৃষ্টি! বৃষ্টিবিলাসে মত্ত হলো সে। অদূরে নাম না জানা গাছে বসে থাকা নীলচে রঙের পাখি দু'টোও বোধহয় মুগ্ধ হয়ে দর্শন করলো শ্যাম কন্যার বৃষ্টিবিলাস। 

___

শুভ্র প্রভাতের আগমন ঘটেছে কিয়ৎকাল পূর্বেই। তখন সময় ছয়টা ছুঁই ছুঁই! অত্যান্ত তাড়াহুড়ো করে বরফ সমেত ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করে মাত্র বাথরুম থেকে বের হলো উজান।তার কোমড়ে তোয়ালে পেঁচানো। শরীরে বাকি পোশাক বলতে আর কিছুই নেই। ঠান্ডায় এক প্রকার দাঁতে দাঁত লেগে আসছে তার। কাল রাতে অবিরত বর্ষণ বর্ষিত হওয়ার দরুন পানি এতোটা ঠান্ডা হয়ে রয়েছে।বাম হাত দিয়ে অন্য আরেক তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে সবেই কক্ষের মাঝখানে এলো তৎক্ষনাৎ কোনো নারীর বিকট এক চিৎকার কর্ণপাত করে হাত ফসকে উজানের তোয়ালে পড়ে গেলো ভূমিতে। 

-' ও মাই গড! ছিহঃ! এটা আমি কি দেখলাম। '

সিয়া উজানকে এক পলক দেখে চটজলদি উল্টো ঘুরে দাঁড়ালো। উজান ভীষণ চমকে দ্রুত করে বিছানায় পড়ে থাকা সবুজ রঙের কাপড়টা নিজের সহিত পেঁচিয়ে নিলো। অতঃপর প্রশ্ন ছুড়লো, 

-' কি আশ্চর্য! মিস লাফালাফি? আপনি এতো সকালে আমার ফ্লাটে, আমার রুমে কি করছেন? '

সিয়া উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে বসলো, 

-' আগে বলুন। আপনি কি গায়ে পোশাক জরিয়েছেন? আমি কি ঘুরবো? '

-' অবশ্যই। আমি ব্যাঙদের মতো নির্লজ্জ নই যে যার তার রুমে হুটহাট প্রবেশ করবো। '

সিয়া চটে গেলো প্রচন্ড পরিমাণে। তিক্ত কন্ঠে বলল,

-' আপনি আবার! আবার আমাকে ব্যাঙ বলছেন? আচ্ছা আমাকে কোন এঙ্গেলে আমাকে ব্যাঙের মতো লাগে বলুন তো? আমি কি ব্যাঙের মতো দেখতে নাকি ব্যাঙের মতো ' ঘ্যাঙর! ঘ্যাঙর! করে ডাকি? '

ওষ্ঠ দ্বারা অধর চেপে মৃদু হাসলো উজান। বলল,

-' ব্যাঙের মতো দেখতে কিনা জানিনা। কিন্তু মাত্রই তো ব্যাঙের মতো করে ডেকে দেখালেন। আর কি লাগে? প্রমাণ হলো তো আপনি ব্যাঙ। এন্ড মিস! আপনি কিন্তু দারুণ ডাকতে পারেন ব্যাঙের মতো। '

রুষ্ট চাহনি নিক্ষেপ করলো সিয়া। কটমট করে কিছু বলতে নিয়েও থেমে গেলো। লোকটা তাকে কথার জালে ফাঁসাচ্ছে। দারুণ চালাক মানব তো! 

মৌনতা বজায়। নীরবতা ধ্বংস করে উজান বলে উঠলো, 

-' কিসের জন্য আমার ফ্লাটে এসেছেন বললেন না তো মিস. ব্যাঙ? আর আমার বাসার ঠিকানা পেলেন কোথায়?ফ্লাটের দরজাই বা কে খুলে দিল?'

উজানকে মাথা হতে পা পর্যন্ত পরখ করে সিয়া বাঁকা হাসি দিলো। হাসিটা দর্শন করা মাত্র ভ্র কুঁচকে নেয় উজান। মেয়েটার মাথায় আবার কি শয়তানী ঢুকলো? কে জানে! দুই কদম এগোল সিয়া।ক্ষীণ সুরে বলল, 

-' উম.., এসেছিলাম তো এক কাজে। কিন্তু এখানে এসে যে আপনাকে হাফ লেডিস অবস্থাতে দেখবো তা কে জানতো? জানলে আরো আগে আসতাম আমি। ইশ! দারুণ বিনোদন দিলেন সকাল সকাল উজান সাহেব। '

হকচকিয়ে নিজের প্রতি দৃষ্টিপাত ফেললো উজান। তৎক্ষনাৎ তার চক্ষু ছানাবড়া।তাড়াহুড়ো করে এটা কি গায়ে জরিয়েছে সে?উমাইশার শাড়ী? মাই গড!কি লজ্জাজনক ব্যাপার-স্যাপার। উজান উঠে পড়ে দৌড় লাগালো বাথরুমে। সিয়ার অবস্থা তখন হাসতে হাসতে নাজেহাল। ফুলো ফুলো গাল দু'টো তার হাসতে হাসতে ব্যাথায় জর্জরিত হয়ে নাজেহাল অবস্থা। তবুও হাসি যেনো থামার নামই নিচ্ছে না।

___

তখন সায়ংকাল। অম্বর জুড়ে ক্ষীণ নীলাভাব বজায় রয়েছে। ক্ষণকালে সেইটুকুও বিদায় নিচ্ছে ধীরে ধীরে। অম্বরের এক কোণে টিমটিম করে জ্বলছে সন্ধ্যাতারা। শীতল সমীরের সাইঁ সাইঁ পদচারণ।এক ফালি চাঁদের রশ্মি প্রতিফলিত হয়েছে নিখুঁত ভাবে মীরার বাসার সামনের সুইমিং পুলে। অত্যান্ত মনোযোগ সহিত মীরা তাই লক্ষ করছিলো এতক্ষণ যাবৎ। মাঝেমধ্যে মৃদু শব্দে মুখোশ্রী কুঁচকে হাঁচি দিচ্ছে। রুহি গম্ভীর মুখে বসে। মীরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠলো, 

-' আর কতক্ষণ এমনে বসে থাকবি? সরি বললাম তো নাকি? প্রমিস ইয়ার..! আর ভিজবোনা বৃষ্টিতে। একটু নরমাল হ এবার। '

জবাবহীন রুহি। নিরবে প্রস্থান করলো কক্ষ হতে। মীরা হতাশ হয়! মেয়েটা এতো রাগছে কেনো?একটু তো বৃষ্টিতেই ভিজেছে। সু'ই'সাইড তো আর করার চেষ্টা করেনি আশ্চর্য! 
কিয়ংদশ বাদে রুহি আসলো। মীরার পায়ে ধপ করে বসলো। হাতে তার এলোমেলো ধোঁয়া উড়ন্ত কফির মগ। মীরার হাতে মগ দিয়ে হতাশ কন্ঠে বলল,

-' গম্ভীর স্বভাবের এক্টিং করা এতো কঠিন ক্যান জান? ভাবছিলাম আজ সারাদিন তোর ওপর রাগ কইরা গম্ভীর হয়ে থাকমু। পারলাম না! নাকে কেমন উশখুশ করে। '

কফি গলাধঃকরণ করতে করতে মীরা হটাৎ কেশে উঠলো। জিজ্ঞেস করলো,

-' গম্ভীরের এক্টিং এর সাথে নাকের কি সম্পর্ক? আশ্চর্য! '

-' আছে। আছে। বুঝবানা তুমি। খাও এখন জলদি। আমি একটু আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে কথা বইলা আসি। '

মীরা বাম ভ্রু উঁচু করে বলল,

-' নতুন? কবে হলো? '

রুহি একটু লাজুকলতা রূপ ধরার ভাঙ ধরলো। হলো না! দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে থেমে থেমে বলল,

-' এইতো কয়েকদিন। কাহিনি দেখছো বেইব? আমি লজ্জা পাওয়ার ও এক্টিং করতে পারিনা। কি মুশকিল! '

কৌতূক শুনেছে! এমনিভাবে হাসলো মীরা৷ রুহি ততক্ষণে ফোন হাতে নিয়ে পাশের কক্ষে চলে গিয়েছে। মীরা উঠে দাঁড়ালো৷ উদ্দেশ্য তার কিচেন।হাতের কফির মগটা ধৌত করা প্রয়োজন।পথিমধ্যে যেতেই আচানক ফোনের ম্যাসেজ টোন কর্ণপাত হলো। ফিরে আসা বৃদ্ধা আঙুল দ্বারা টাচস্ক্রিনে স্পর্শ করতেই তার নেত্র সম্মুখে দৃশ্যমান হলো ইংরেজি বর্ণমালার মাধ্যমে প্রেরিত ছোট্ট একটা বার্তা। বার্তাটি কিছুটা এরূপ,

-' Come to the ground floor. I'm waiting for you. Come first. '

ফোন, হাতের কফি মগটা অবিন্যস্ত রূপে পড়ে রইল ম্যাট্রেসের ওপর। ধপাধপ পা ফেলার শব্দে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলো৷ অনেকটা ' হাওয়ায় উড়ে ' কথাটার মতো করেই মীরা বাতাসের বেগে ছুটলো গ্রাউন্ড ফ্লোরে। কাঙ্ক্ষিত স্থানে পৌঁছানোর পরই হাঁপাতে হাঁপাতে চারপাশে নজর বুলালো। কোথায় সে? সটান হয়ে দাঁড়িয়ে সামনে এগোতেই বাঁধা প্রদান করা হলো পেছন হতে৷ এক জোড়া শক্তপোক্ত হাত তাকে পিছন থেকে জরিয়ে ধরলো। চিবুক এসে স্থাপন হলো তার কাঁধে। এযে উশান! মীরার তা বুঝতে বেগ পেতে হলো না। ক্ষীণ সময় বাদে ভরাট কন্ঠে উশান বলে উঠলো, 

-' আ'ম হেয়ার ম্যাডাম। আ'ম হেয়ার! '
.
.
.
চলবে........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন