মন ছুঁয়েছে সে - পর্ব ৩৫ - মৌরিন আহমেদ - ধারাবাহিক গল্প

মন ছুঁয়েছে সে 
পর্ব ৩৫ 
মৌরিন আহমেদ 
.
.
.
নিজের স্টাডি টেবিলের সামনে গম্ভীর মুখে বসে আছেন জয়নাল আবেদীন। সামনে একগাদা কাগজ, দু' তিন রকমের কলম আর ফাইল। টেবিলের একপাশে খুলে রাখা ল্যাপটপ। অপর পাশে ঠাঁই হয়েছে ধোঁয়া ওঠা কফির মগের। গত দু' ঘণ্টা ধরে স্টাডি টেবিলের এই চেয়ারটায় বসে আছেন উনি। এরমধ্যে একবারও তার চেহারার গম্ভীরতা কেটে গিয়ে স্বাভাবিকতা ফুটে উঠেছে কী না সন্দেহ! 

মাঝে মাঝে তার এই গাম্ভীর্য ভরা মুখচ্ছবি তে আবার ভ্রু কুঞ্চনও সংযুক্ত হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর পর কলম হাতে নিয়ে ছড়িয়ে রাখা কাগজগুলোর ওপর খসখস' করে কী কী যেন লিখেছেন। আবার কখনো কখনো কাগজ-কলম ছেড়ে ল্যাপটপ নিয়ে বসছেন। তড়িৎ গতিতে কী কী যেন টাইপ করছেন। 

তার এই নিবিষ্ট চিত্তে কাজের মাঝে কেউ যেন কোনোভাবেই ব্যাঘাত না ঘটায় তাই রুমের পরিবেশটাও তারই মতো গম্ভীর! জানালার থাই গ্লাসগুলো যে একটুও ফাঁক করা ভারী পর্দার কারণে সে ফাঁকও আর নজরে পড়ে না। বাহির থেকে বাতাসও আসে না। অবশ্য সারাক্ষণ এসির বাতাসে ঘর যেমন শীতল হয়ে থাকে, তাতে প্রকৃতির বাতাসের প্রয়োজন নেই! তবুও আকাশ দেখা বলে একটা কথা আছে। কিন্তু সে অভিপ্রায় এ ঘরের মালিকের আছে বলে মনে হয় না!

লাগোয়া ব্যালকনির দরজা চিরকাল বন্ধই থাকে। একমাত্র খুব অবসরেই ওখানটায় এসে ঠাঁই নেন জোহরা বেগম। আজকাল তারও আর সময় নেই।

ঘরের দেয়াল হালকা আকাশী রঙের, মেঝে শুভ্র টাইলসে ঘেরা। কোথাও কোনো শৌখিন দ্রব্য কিংবা পেইন্টিং জাতীয় শিল্প-টিল্প কিছু নেই। অথচ এ বাড়ির প্রতিটা কোণায় কোণায়ই শৌখিনতা আর শিল্পী মনের ছোঁয়া প্রকাশ পায়। শুধু এই ঘরটা দেখলেই যে কেউই অনায়াসে বলে দেবে বাড়ির বাকি বাসিন্দাদের সাথে এই লোকটি কতটা বিচ্ছিন্নতা!

হঠাৎ শব্দহীন ভাবে ভেজিয়ে রাখা দরজাটা একটুখানি ফাঁক হলো। ভারী পর্দা দুটো সরিয়ে খুবই ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকতে দেখা গেল অনন্যাকে। ভেতরে ঢুকেই আবারও দরজাটা আগের মতো করে দিলো। শান্ত পায়ে হেঁটে স্টাডি টেবিলের কাছে এসে দাড়ালো। খানিকটা ভীত কণ্ঠেই ডাকলো,

 - বাবা?

ডাকটা ওনার কানে পৌঁছলো কী না ঠিক বোঝা গেল না। তিনি সাড়া দিলেন না। অনু আবারও ডাকলো,

 - বাবা, শুনছো?

তুলনামূলক জোড়ালো কণ্ঠ। জয়নাল সাহেব মাথা তুললেন না। ল্যাপটপের দিকে দৃষ্টি রেখেই জবাব দিলেন,

 - শুনছি....

 - আ..আমি তোমাকে কিছু জ...জরুরি কথা বলবো... তু.. তুমি.. কী..

কথা শেষ করার আগেই ওর দিকে তাকালেন জয়নাল আবেদীন। তার চাহনি দেখেই কেমন যেন ভয় পেয়ে যায় অনন্যা। ঠিক কী বলতে এসেছে তা গুলিয়ে ফেলে। কিন্তু ওর কথা শোনার আসায় জয়নাল আবেদীন এখনো তাকিয়ে আছেন বলেই বলার চেষ্টা করে,

 - ক...কয়েকদিনের জন্য আমাকে খা.. খাগড়াছড়ি যেতে হবে, বাবা। মামুর খোঁজ নেয়ার জন্য।

 - তোমার কী ধারণা তোমার মামু হারিয়ে গেছে?

বলেই পাশ থেকে কফির কাপটা তুলে একটা সিপ তুললেন উনি। অনু কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো তার কথায়। তবুও মেঝের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বললো,

 - হারিয়ে গেছে না অন্য কিছু হয়েছে সেটা জানার জন্যই খাগড়াছড়ি যেতে হবে। দু' দু'টো মানুষ পাঁচদিন ধরে নিখোঁজ, স্বাভাবিক ভাবেই তো বলা যায় তারা হারিয়ে গেছে...

 - বাহ্! যুক্তি তো ভালোই দেখালে.. কিন্তু তুমি কী জানো, তোমার মামার বয়স কত? মিনিমাম ত্রিশ তো হবেই। ত্রিশ বছরের একটা প্রাপ্তবয়স্ক লোক কী একা একা কোথাও যেতে পারে না? নিজের খেয়ালখুশি মতো চলার যথেষ্ট বয়স কি তার হয় নি?.. সে যদি দু' একদিন যোগাযোগ বন্ধ করে রাখে, তাহলেই কী ধরে নিতে হবে সে নিখোঁজ?

 - এটা দু' একদিনের ঘটনা নয়, বাবা? মামু পাঁচদিন, পুরো পাঁচদিন ধরে নিখোঁজ, ফোন বন্ধ, কন্ট্যাক্ট করতে পারছি না।.. আর ত্রিশ-ঊনত্রিশ বছরের কেউ কী বিপদে পড়তে পারে না? তার কী সাহায্যের প্রয়োজন হতে পারে না? 

কিছুটা উত্তেজিত লাগে ওকে। বাবার যুক্তিগুলো গিয়ে মস্তিষ্কে আঘাত হানে। তার মামুর কোনো খোঁজ নেই, অথচ এটা নিয়ে কী না তার বাবা উলটো যুক্তি দেখাচ্ছে? 

 - বিপদে পড়েছে? সাহায্য দরকার?. সেজন্য পুলিশে খবর দাও।.. আর আমি যতদূর জানি, তোমরা এ ব্যাপারটা নিয়ে পুলিশের সাথে যোগাযোগ করেছ, তাহলে? 

 - পুলিশ এ ব্যাপারে কিচ্ছু করতে পারবে না, বাবা!

 - তাহলে কে পারবে? তুমি? সেজন্য যেতে চাইছো? তুমি কী ইনভেস্টিগেটর টাইপের কেউ?... দেখ, অনন্যা। আমার মনে হয় না, লুৎফর হারিয়ে গেছে বা নিখোঁজ। ওর যথেষ্ট বয়স হয়েছে, জ্ঞান-বুদ্ধিও হয়েছে। সে যদি হারিয়েও যায়, একা একা ঠিক ফিরে আসতে পারবে। এ জন্য তোমাকে যেতে হবে না!
 
 - তুমি ব্যাপারটার গুরুত্ব ঠিক বুঝতে পারছ না। মামুর বয়স হতে পারে কিন্তু অভিজ্ঞতা বা বুদ্ধি ততটাও হয় নি। মনে নেই, গেল বছর গ্রাম থেকে আসার পথে বাড়ি না এসে অন্য জায়গায় চলে গিয়েছিল? তোমার কী তারপরও মনে হচ্ছে না মামু কোনো বিপদে ?

 - নাহ্, মনে হচ্ছে না। লুৎফর কে আমি আজ। অনেক বছর ধরে চিনি। আমার বিয়ের সময় তার বয়স ছিল ছয় বছর। আমি দেখেছি ওই বিচ্ছু ছেলের মাথায় কী বুদ্ধি ছিল... বদের বদ ছিল একটা!.. ও বাইরে বাইরে ভোলা-ভালা ভাব দেখায়, অথচ আসলে ও একটা হাড়ে বজ্জাত লোক! 

 - মামুর সম্পর্কে একটাও উল্টপাল্টা কিছু বলবে না,বাবা!

হঠাৎ গর্জে ওঠে অনন্যা। জয়নাল আবেদীন সাহেব অবাক চোখে তাকান। বিস্ময়ে বললেন,

 - তুমি আমাকে থ্রেট করছো!

 - থ্রেট করছি না, সত্যিটা বলছি!.. তুমি আমার মামুর সম্পর্কে যা যা বলেছ তার একবিন্দুও সত্যি নয়!.. আমায় বাইশ বছরের জীবনে মামুর মতো ভালো লোক, আমি আর একটাও দেখি নি। আর তোমার দেখার কথা বলছো? তুমি তোমার পরিবারের সাথে কখনো সময় কাটিয়েছ যে পরিবারের সদস্যদের কথা জানবে? তোমার দেখা একপাক্ষিক, অযৌক্তিক, অমূলক-- সমস্তই তোমার মনগড়া! বানোয়াট!

 - তুমি এসব কি বলছো?

 - ঠিকই বলছি আমি। বাইশ বছর ধরে দেখে আসছি বাবা হিসেবে আবদার পূরণ করা তো দূর, কোনোদিন পাশে ডেকে কথা বলো নি তুমি!.. তোমার মেয়ে কোথায় বড় হচ্ছে, কোথায় মিশছে, কিচ্ছুটি দেখো নি!... আর মামু? তাকে তো সারাজীবন এ বাড়ির উটকো ঝামেলাই মনে করেছো। সে নিখোঁজ হলে তুমি খুশি হবে না? হবেই তো!

 - আমার মনে হয় তোমার মাথা বিগড়ে গেছে অনন্যা! তাই আমার সামনে দাড়িয়ে এসব উল্টো-পাল্টা বকছো!

 - মাথা বিগড়োয় নি। ঠিকই আছে... কিন্তু এখন আমি যা করবো তাতে তোমার মাথা বিগড়ে যাবে.. তাই বলছি, রিল্যাক্স।...

ওর আত্মবিশ্বাস, কথার ভাবভঙ্গি আর কথা শুনে ভীষণ চমকে উঠলেন জয়নাল আবেদীন। এ তিনি কাকে দেখছেন? তার মেয়ে অনামিকা আবেদীন অনন্যা কে? এই তার ভীতু মেয়ে? যে তার বাবার নাম শুনলেই, সামনে দাড়ালেই ভয়ে দাঁত কাঁপুনি তুলে ফেলতো! 

অনুর দিকে তাকাতেই সে আবারও বললো,

 - আমি আজ, এই মুহূর্তে তোমার সাথে নিজের সমস্ত সম্পর্ক শেষ করে ফেলবো, বাবা! আজ থেকে তুমি আর আমার বাবা নও, না আমি তোমার মেয়ে!.. সারাজীবন যখন পিতার দায়িত্ত্ব পালন কর নি, তখন আর ভবিষ্যতেও লাগবেবলে মনে হয় না। আমি বেরিয়ে যাচ্ছি এখনই....

বলেই ওনাকে আর কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে যায়। জয়নাল আবেদীন বিস্ময়ে তাকান, কিন্তু অনু ফিরেও তাকালো না। দরজা পেরিয়ে মুখের উপর 'দুম' করে সেটা লাগিয়ে দেয়। হনহন করে নিজের ঘরের দিকে ছুটে যায়!

বিছানার ওপর আগে থেকেই গুছিয়ে রাখা ছিল তার লাগেজ। আর কিছু লাগবে কী না সেটা পরখ করার জন্য পুরো ঘরটা আরেকবার দেখে নিল। প্রয়োজনীয় কী একটা চোখে পড়তেই এগিয়ে এলো ব্যালকনির দিকে। ফিরে এলো টাওয়াল হাতে নিয়ে।

সেটা ভাঁজ করে লাগেজে ঢুকাতে নিলেই ঘরে ঢুকলেন জোহরা বেগম। তার চেহারা এখন উদভ্রান্তের মতো লাগছে! দরজার আড়ালে দাড়িয়ে তিনি এতক্ষণ অনু আর জয়নাল আবেদীনের কথাবার্তা সব শুনেছেন। অনু যে হঠাৎ করে এতো উত্তেজিত হয়ে উঠবে সেটা এখনো ভাবতে পারছেন না তিনি!আর বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা? নিজের বাবাকে ত্যাজ্য করার কথা? এসব কি! 

উনি ছুটে এসে অনুর হাত আঁকড়ে ধরেন। উদ্বিগ্ন গলায় বললেন,

 - কোথায় যাচ্ছিস, মা?.. বাবার সাথে এমন রাগ করতে আছে? বল্? উনি তোর বাবা। তোর খারাপ চায় উনি?... ভালোটাই চায়। দরকার কি খাগড়াছড়ি যাওয়ার? শোন্ না!..

 - দরকার নেই?.. তোমার ভাই হারিয়ে গেছে আর তুমিই এ কথা বলছো? এটা তুমি কী বললে মা!

মুহূর্তের মতো থমকে থাকে অনন্যা। জোহরা তার শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে ফোঁপানো শুরু করেন। কী জবাব দিবেন উনি ওকে? ভাইয়ের চিন্তা তার নেই? এই প্রশ্নের জবাব? আছে, অনেক চিন্তা আছে। তার ছোট্ট ভাইটাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেন তিনি। কতো আদর যত্ন মায়া মমতা তার প্রতি! অথচ এখন তিনি কিছুই করতে পারছেন না। স্বামী তার কথা মানতে নারাজ, মেয়ে তার রাগ করে বাড়ি ছাড়বে, কোনটা সামলাবেন তিনি? তবুও কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,

 - তুই যাস্ নে, অনু। বাবার কথা শুনে এমন রাগ করতে নেই। তোর মামু ঠিক চলে আসবে, তোকে যেতে হবে না!..

 - তুমি ভাবছো, আমি মামুর জন্য চলে যাচ্ছি? না মা, আমি সেচ্ছায়-সজ্ঞানে নিজের জন্য চলে যাচ্ছি। সত্যি কথা বলছি, ওই লোকটাকে.. ওই লোকটাকে আমার সহ্য হয় না! কিছুতেই না!.. একটা রোবট মানব, মেশিন, সে কখনো আমার বাবা হতে পারে না!.. সারাজীবন দেখে আসছি, আমি অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি মা!.. আর থাকতে পারবো না এখানে! আমি চলে যাবো, চলে যাবো, এখান থেকে...

অনন্যার রাগ-অভিমান আর ক্ষোভ দেখে হতভম্ব হয়ে রইলেন জোহরা। ওর রাগ কী তুষের আগুনের মতো? বাইশ বছর ধরে ভিতরে ভিতরে জ্বলছে? আর সহ্য করতে না পেরে সে চলে যেতে চাইছে?

হঠাৎ কি যেন ভেবে নিজেকে শক্ত করলেন উনি। দাঁতে দাঁত কামড়ে, জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে কঠোর ভাষায় বললেন,

 - তুই যাবি না এখান থেকে। কিছুতেই না... এটা তোর বাবার বাড়ি নয়, আমার। বিয়ের সময় আমার বাবা আমায় যত গহনা দিয়েছিলেন, সেগুলো বেচা টাকায় কেনা এ বাড়ি।.. আমার বাড়ি! সে বাড়ি থেকে কিছুতেই চলে যাবে না আমার মেয়ে। এটা তোর বাড়ি। তোকে থাকতেই হবে!

কথাগুলো শুনে বাকরুদ্ধ চাহনিতে তাকিয়ে থাকে অনন্যা। বলার মতো ভাষা খুঁজে পায় না। জোহরা আবারও বললেন,

 - তুই যা, মা। লেবুকে খুঁজে নিয়ে আয়.. কিন্তু তুই এখানে ফিরে আসবি, এটা তোর বাড়ি ভুলে যাস্ না। তোকে এখানে ফিরতেই হবে!

বলেই ওর গায়ে হাত বুলিয়ে দিলেন। ও আর দেরি করলো না। লাগেজ হাতে বেরিয়ে পড়লো।
.
.
.
চলবে..........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন