অভ্র নীল - পর্ব ০৬ - শারমিন আক্তার বর্ষা - ধারাবাহিক গল্প

অভ্র নীল 
পর্ব ০৬ 
শারমিন আক্তার বর্ষা 
.
.
.
দ্বিতীয় লোকটি পরিষ্কার চোখে চারপাশে তাকাল এবং তারপর হঠাৎ চিৎকার করে বলল, 'এইটা ভাঙা বাড়ি, এই জায়গা নিরাপদ না। লোকে কয় এই বাড়ি ভুতুড়ে এই রাস্তায় রাইতে মানুষজন আসে না। বাঁইচা থাকতে চল পালাই।'
তৃতীয় লোকটি বলল, 
' এক মাইয়ার লাইগা জীবন দিমু? চল যাই।'
বাড়িটি গাছের পাশে অবস্থিত। নীলের শরীর ভয়ে কাঁপছে। লোকগুলো চলে যাওয়ার পর নীল দৌঁড়ে গাছের আড়াল থেকে উত্তর দিকে চলে গেল। ছুটে গেল খোলা মাঠে। একটু দূরে একটা নদী। চাঁদের আলো আছড়ে পড়ছে, নদীর পাড়ে জলের দিকে ঝুঁকে আছে বড় বড় গাছ। নীল অস্থির হয়ে উঠল। হঠাৎ সে দেখতে পেল ভয়ংকর কিছু একটা তার দিকে আসছে। বড় চোখ, চোখের মনি উজ্জ্বল, অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে। নীল খুব ভয় পায়। ভয়ের কারণে তাৎক্ষণিক অজ্ঞান হয়ে যায়।

অভ্র তাড়াহুড়ো করে গাড়ি থেকে নেমে পাগলের মতো নীলকে খুঁজেছে আর চিৎকার করছে। আকাশ বলল, ' অনেক খুঁজলাম পাচ্ছি না, দেরি হওয়ার আগেই চল পুলিশে যাই।'
শুভ উদ্বিগ্ন গলায় বলল, ' ২৪ ঘণ্টা না হলে পুলিশ মিসিং ডায়েরি লিখবে না।'
অভ্র বলল, ' আমার খোঁজা এখনও শেষ হয়নি।'
অভ্র খোলা মাঠে এসে 'নীল' বলে চিৎকার করে। নিলয়ের হাতে একটা লাইট। সে এখানে-ওখানে আলো মারতে থাকে। হঠাৎ কিছু একটা দেখে বলল, 'স্যার, ওদিকে দেখুন। হয়তো কেউ আছে।'
নীলের মুখে আলো মারল নিলয়। অভ্র নিচু গলায় বলল,
'নীল।'
নীলকে নিয়ে ওঁরা হাসপাতালে এলো। চেক-আপ করা হয়েছে। ডাক্তার বললেন, ' শরীর দুর্বল এবং কোনো কারণে হয়তো ভয় পেয়েছিল তাই অজ্ঞান হয়ে গেছে। স্যালাইন দিয়েছি, কাল সকালের মধ্যে সেন্স আসবে, টেনশন করবেন না।'
' থ্যাংক ইয়্যু ডক্টর।' বলল অভ্র।

সকালে জ্ঞান ফিরল নীলের। সে হঠাৎ 'ভূত' বলে চিৎকার করে। অভ্রকে চোখের সামনে বসে থাকতে দেখে নীল দুই হাতে জড়িয়ে ধরল। অভ্র বলল, 'নীল শান্ত হও। কি ঘটেছে আমাকে বলো?'
সব শুনে অভ্র গম্ভীর হয়ে বসে আছে। আকাশ বলল, 'হয়তো ওটা বিড়াল ছিল। কারণ তাদের চোখ অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে।'
নীল তার ফোন খুঁজল। নিলয় ফোনটা ওঁর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, 'ম্যাম, আপনার ফোন। গাড়িতে পড়ে ছিল।'

অভ্র ধৈর্য ধরে পুরো ভিডিওটা দেখল তারপর নীলের মাথায় হাত রেখে শান্ত গলায় বলল, 'তুমি এই ছোট্ট জিনিসটা নিয়ে নিজেকে কতটা বিপদে ফেলেছ তার কোনো ধারণা আছে? আর কখনো এমন করবে না।'

অভ্র পুলিশ নিয়ে বাসায় চলে এলো। লায়লা ও মারিয়াকে প্রতারণার কারণে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। অভ্র ছোটবেলায় একটি মেয়ের সাথে রোজ দেখা করত এবং অভ্রর এখনও তার প্রতি সহানুভূতি রয়েছে। মারিয়ার জন্য সে সম্পর্কে এলোমেলো হয়ে গেল। কিন্তু মারিয়া সে-তো আসল মানুষ নয়। প্রথম নজরে যদি একটু যাচাই-বাছাই করত, তাহলে আজ এমন দিন দেখতে হতনা। অভ্র ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরল।  
নীল অভ্রর কাছে এসে বলল, 'যা হয়েছে তাতে আপনার দোষ ছিল না। নিজেকে সামলান।'
অভ্র নরম সুরে বলল,
' আমি তাকে কখনোও ভুলবো না। তোমাকে বিয়ে করে তোমার জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছি। কিন্তু তোমাকে প্রথম দেখে মন বলেছিল, তুমি আমার। শুধু আমার এই আমার কথা শুধু তোমার সাথে যায়।'

অভ্র রাগ করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। জানিনা সে কখন ফিরবে। নিজেকে সামলানোর জন্য ওঁর নিজেকে কিছুটা সময় দেওয়া উচিত। ঘর গোছানোর সময় নীল একটা ডায়েরি পেল। ডায়েরির উপর অংশে কয়েক ফোঁটা চোখের জল। অবশ্যই অভ্রর ডায়েরি। অনুমতি ছাড়া কারো ব্যক্তিগত জিনিস পড়া উচিত না। তবু নীল বিছানায় বসে ডায়েরির পাতা উল্টাতে থাকে। ডায়েরির প্রথম পৃষ্ঠায় একটা নাম দেখে ভীষণ অবাক হলো নীল। গুটি গুটি অক্ষরে সেথায় লিখা-

                                     পরী...

নীল পরের পৃষ্ঠাটি উল্টাল, সে পাতাটির লেখা পড়ে নীলের চোখে জল চলে আসলো। পরের পাতা পড়ে কাঁদল নীল। নিজেকে সামলাতে না পেরে ডায়েরিটা নিয়ে মেঝেতে বসে পড়ল। কাঁদতে কাঁদতে ডায়েরির পাতা উল্টায়। এত মোটা ডায়েরির মাত্র ১০ পৃষ্ঠা লেখা পরীকে নিয়ে। নীল ডায়েরিটা হাতে নিয়ে দৌঁড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। অভ্রকে খুঁজতে সে ছাঁদে আসে। ছাঁদের এক কোণে অভ্র দাঁড়িয়ে আছে। জীবনে প্রথমবার সিগারেট খাচ্ছে। নীল এসে পেছনে দাঁড়িয়েছে বুঝতে পেরে অভ্র তার হাত থেকে সিগারেটটা ফেলে দিল। নীল কান্না থামিয়ে বলল, ' এই ডায়েরিতে লেখা পরী আপনার বন্ধু। শিশু পার্কে খেলার সময় তার সাথে দেখা হয়েছিল?'
অভ্র কোন প্রতিক্রিয়া জানায়নি। সে শান্ত গলায় বলল, 'ডায়েরি পড়েছ?'
নীল উত্তর দিল না। অভ্র ঘুরে দাঁড়াল। নীল কাঁদছে। তার চোখে জল দেখে সে হতভম্ব হয়ে গেল। কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করল অভ্র।

নীল মুখ খুলল। বলল, ' আপনি পরীকে কথা দিয়েছিলেন আপনি সারাজীবন তারই থাকবেন আর এটাও বলেছিলেন আপনি ফিরে না আসা পর্যন্ত সে যেন আপনার জন্য অপেক্ষা করে। সেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে আমাকে বিয়ে করেছেন। কেনো?'
অভ্র বলল, ' শান্ত হও নীল আমি তোমাকে ভালোবাসি।'
নীল উচ্চকিত কণ্ঠে বলল, ' প্রতিশ্রুতি দিয়ে যদি প্রতিশ্রুতি রাখতে না পারেন তাহলে কেন প্রতিশ্রুতি দেন? আপনাকে বিশ্বাস করে, পরী হয়তো আজও আপনার অপেক্ষায় আছে। আর ভালোবাসা, আজ যদি পরী আপনার সামনে এসে আপনার তার কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতিগুলো নিভাতে বলে, তখন আপনি কি করবেন?'

নীলের প্রতিটি কথাই অভ্রর হৃদয়ে গিয়ে লাগছে। এবং তার চোখ ছলছল করছে। অভ্র ভাবল, পরী যদি কখনো ফিরে আসে? তখন সে কেমন করে তার মুখোমুখি হবে?
অভ্র বাবা-মাকে লুকিয়ে শিশু পার্কে খেলতে যেত। সেখানে একদিন একটি মেয়ের সঙ্গে তার দেখা হয়। প্রথম দেখাতেই দুজনে খুব ভালো বন্ধু হয়ে যায়। একজন আরেকজনের নাম জিজ্ঞেস করলে কেউ বলে না। দুজনে তাদের একটি ডাকনাম দেয়। এবং তারা একে অপরকে সেই ডাকনামে ডাকে। এরপর আর কারোর আসল পরিচয় জানা হয়নি। অভ্র মেয়েটির নাম রেখেছে পরী। মেয়েটা হয়তো তার একটা নাম দিয়েছে। ডায়েরিতে মেয়েটির দেওয়া নাম লেখা নেই। নীল তখনও কাঁদছে। অভ্রর ভ্রু কুঁচকে গেল। হঠাৎ তার মনে হলো নীল যে কথাগুলো প্রথমে বলেছিল, সেগুলো অভ্র ডায়েরিতে কখনো লিখেনি। যেদিন আমেরিকা চলে যাচ্ছিল সেদিন অভ্র মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পরীকে অপেক্ষা করতে বলেছিল। অভ্র দৃঢ় ও গম্ভীর গলায় বলল,
' তুমি কি করে জানলে আমি পরীকে অপেক্ষা করতে বলেছিলাম?'
নীল এগিয়ে গেল। অভ্রর পায়ে পা রেখে দাঁড়াল। তারপর অভ্রকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকল। নীল স্তম্ভ গলায় বলল, 'মেঘ। আমার মেঘ।'
অভ্র অবাক হয়। নীলের কাঁধে তার থুতনি রেখে ফিসফিস করে বলল, 'নীল তুমি পরী!'
নীলের গালে হাত রেখে চোখের জল মুছে দিল অভ্র তারপর ঠোঁট দিয়ে নীলের কপালে আলতো করে স্পর্শ করল। 

সূর্যের মিষ্টি আলো জানালার কাঁচ দিয়ে ঘরে উঁকি দিচ্ছে। অভ্রর মুখে সূর্যের আলো পড়ছে। নীলের ঘুম ভাঙল, চোখ খুলেই নিজেকে অভ্রর বুকে পেল সে। অভ্রর কপালে বড় বড় চুল পরে আছে নীল এক হাতে চুল সরিয়ে অভ্রর কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে বিছানা থেকে উঠে গেল।
আলমারি থেকে একটা শাড়ি বের করে ওয়াশরুমে গেল। স্নান সেরে এসে চুল শুকানোর জন্য আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে লক্ষ্য করল, অভ্র নড়চড় করছে। কারণ তার মুখে সূর্যের আলো পড়ছে। নীল জানালার কাছে গিয়ে পর্দা মেলে দিল। এখন অভ্র আর নড়ছে না। দুই মিনিট পর নীল আবার পর্দা সরিয়ে দিল। অভ্র আবার নড়ে উঠল। নীল জোরে জোরে হেসে ওঠল। অভ্র পিটপিট করে চোখ খুলল। ঘুমঘুম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ' নীল কেন জ্বালাছ?'
' রাতের প্রতিশোধ নিচ্ছি।'

অভ্র বিছানা থেকে উঠে গেল। সে নীলের ঠিক পিছনে এসে দাঁড়াল। তারপর ভেজা চুল আঁচড়াতে লাগল। হঠাৎ বলল, 'তুমি জানো না, তোমার চুল আমার খুব প্রিয়। আজ থেকে আমি তোমার চুলের যত্ন নেব, তেল দেব, চিরুনি করব এবং বেণি করব। বুড়ো হলেও চুল আঁচড়াবো।'
অভ্র তার একহাতে তেলের বোতল ধরে তার অন্যহাতের তালুতে তেল ঢেলে নীলের চুলে দিয়ে দিচ্ছে। নীল মুগ্ধ দৃষ্টিতে অভ্রর দিকে তাকিয়ে আছে।

এক মাস আনন্দে কেটে গেল। বিকাল ৩টা। তোয়া একা একা ছাঁদে বসে আছে। নীল আর অভ্র এক সঙ্গেই ছাঁদে এলো৷ তোয়া-কে দেখে অভ্র জিজ্ঞেস করল, ' কি হয়েছে তোর, এত চুপচাপ কেন? বই হাতে নিয়ে বসে আছিস কিন্তু মন পড়ায় নেই।'
তোয়া উদাস কন্ঠে বলল, 'ভাইয়া, ভুলে গেছো?'
অভ্র কিছুক্ষণ ভেবে বলল, 'কি?'
' আজ বাবা-মায়ের বিবাহ বার্ষিকী। চলো কিছু প্ল্যান করি এবং তাদের সারপ্রাইজ দিই।'
অভ্র বলল, ' মা-বাবা নিজেদের জন্মদিন পালন করেন না আর বিবাহবার্ষিকী?'
নীল মৃদুস্বরে বলল, ' বাবা মা কখনো নিজের কথা ভাবে না। তারা তাদের বিশেষ দিন উদযাপন করে না। কারণ বাবা-মা নিজের চিন্তা রেখে সন্তানদের চিন্তা করেন। আমাদেরও দায়িত্ব তাদের জন্য কিছু করা।'
অভ্র ভ্রুকুটি করল, ' তুমি কি করতে চাও?'
.
.
.
চলবে..........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন