উন্মুক্ত লাইব্রেরী
পর্ব ১৪
আয্যাহ সূচনা
সন্ধ্যা নামছে ব্যাপৃত ঢাকা নগরীতে। আকাশে লাল আভা মেখে সূর্য পশ্চিমাকাশে ডুবে গেছে। তখনও শহরের কোলাহল স্তিমিত হয়নি।এবার যে নীড়ে ফেরার পালা।রাস্তায় যানবাহনের গর্জন দূর হতে কর্ণপাত হয়।আর মানুষের ভিড়ও একটু একটু করে পাতলা হয়। বাতাসে তখন একটা মিষ্টি শীতলতার পরশ, যেন দিনের ক্লান্তি মুছে দিয়ে রাতের স্বপ্নময়তার গল্প বলতে চায়।শহরের প্রতিটি ইট-পাথরের গায়ে লুকিয়ে আছে অগণিত অজানা বিবরণ।তারপরও মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে সেই সন্ধ্যার বাড়ি ফেরার মুগ্ধতা।
“তুমি আমার মত একটা মানুষের লেইগা এত খাটা খাটনি কেন করতাছো?”
“কখনো কারো জন্য খাটুনির সুযোগ পাইনি তাই”
“ঢং মারাও?”
“কুৎসিত ভাষা! ছিঃ!”
ছন্নছাড়া অনুভূতিহীন বর্ণ।চেয়ে আছে অন্বেষার দিকে অর্থহীন চাহনিতে।বুকের মধ্যে থাকা অনুভুতি উৎপাদনে অকার্যকর হৃদপিন্ড বুঝতে পারছে না তাকে।হাসপাতালের বিছানার পাশে বসে অন্বেষা।সারা দিবা এবং রাত্রি।দুইদিন ধরে এমনি চলছে।তার নিঃশব্দ যত্নে কাটে প্রহর।অপারেশনের পর তদারকিতে কোনো কমতি নেই।এত যত্নে অভ্যস্ত নয় বর্ণ।অন্বেষার যত্নমাখা সেবায় অস্থির হয়ে উঠছে ক্ষণেক্ষণে।
“আমারে সারাজীবনের ঋণের তলে ফালাইবার চাও?”
“কিসের ঋণ?কোনো ঋণ নেইতো।”
“তোমার কথাবার্তা,আচরণ আমার অসহ্য লাগতাছে”
অন্বেষা দায়সারা ভাবে কথার উল্টো প্রশ্ন করলো,
“আচ্ছা তোমাকে ঋণী করলে তুমি ঋণ শোধ করতে?”
“আমারে চিনছো এতদিনে?”
“হ্যাঁ”
“ঋণ শোধ করার মতো সৎ মানুষ আমি না।”
স্বাভাবিক সুরেই অন্বেষা জবাব দেয়,
“ঠিক আছে।তাতেও কোনো সমস্যা নেই”
কি করে এই মেয়েটা এত ধৈর্যশীল?অভিযোগহীন সময় কাটছে তার।অন্বেষার মনের গভীরে যেন লুকিয়ে আছে আশার দিশা। বর্ণের শূন্য চোখ।ভাবশূন্য;জ্ঞানশূন্য।আজকাল পূর্বের অন্বেষার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।এতো ভারী পরিবর্তন।নাকি বর্ণের রঙে মেখে নিজের রং বদলালো?
অন্বেষা খাতায় কলম চালাতে চালাতে আকস্মিক হেসে বলে,
“তুমি বোর হচ্ছো তাইনা?মারামারি করতে পারছো না? রংবাজি,মাস্তানি কোনোটাই পারছো না?খুব খারাপ লাগছে তাই না?”
বর্ণ ডান পার্শ্বের ভ্রু উঁচু করে কঠিন গলায় বলে,
“মজা লইতাছো?”
“মজা কেনো নিবো?”
অন্বেষার ভাবসাব নেওয়া যাচ্ছে না আর।বর্ণ চাইছে সে ওর উপর বিরক্ত হোক।তর্ক করুক।এতে শান্তি মিলবে তার।কেউ তার প্রতি রাগ, বিরক্তি প্রকাশ করলে শান্তি মেলে।
“তুমি জানো আমি বন্দী থাকার মানুষ না।ইচ্ছা কইরা ঘায়ে মরিচ ঢলা দিবার আইছো পিশাচিনী?”
অন্বেষা পুনর্বার হাসে। বই খাতা বন্ধ করে পাশে রাখলো।সব গুছিয়েছে সুন্দর করে।আজকেই শেষ দিন।আগামীকাল সকালে ছুটি পেয়ে যাবে বর্ণ।একটু স্বস্তি মিললেও বর্ণের উপর কোনো ধরনের ভরসা নেই।বাড়ি ফেরার পর পাশাপাশি থাকা সম্ভব নয়।সে যাবে তার আস্তানায় আর অন্বেষা নিজের।
“তুমি কাকে বেশি ভালোবাসো?”
বর্ণ সাথে সাথে জবাব দেয়,
“কেউরে না।কেউরে ভালোবাসার মত বদনসিব আমার হয়নাই।”
অন্বেষা একবার চাইলো বর্ণের দিকে।পরপর পলক ঝাপটায় নিচে চেয়ে।মুখ ঘুরিয়ে জানালার বাহিরে তাকিয়ে বললো,
“আমি তোমাকে গল্প বলি শুনো।”
“আমি হুনতে চাই না।”
“আচ্ছা বলি তারপরও”
বলে অন্বেষা হেসে উঠে ঠোঁট কামড়ে।বর্ণের মাথাটা নষ্ট হয়ে যাবে কিছুদিন পর।সে উপলব্ধি করতে পারছে।একা ছিলো বেশ ছিলো।
“তুমি আমার জিন্দেগীর অভিশপ্ত আত্মা।আমি বুঝতাছি আমার হাতে বেশিদিন নাকি নাই।”
“চুপ!মুখ বন্ধ আর কান খোলা রাখো।শুনতে না চাইলেও আমি জোর করে শুনাবো।আমার বলতে ভালো লাগে।এতদিন পাগলের মতো একা একা গল্প করেছি।এখন বর্ণ নামের একটা মক্কেল পেয়েছি।”
বর্ণের মস্তিষ্কের চেতনারা দলভুক্ত হয়ে আশ্চর্যের চরম উচ্চ সীমানায় গিয়েছে।অন্বেষা এমন আচরণ ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকলে তারা লাফিয়ে মরবে।তাদের বেঁচে থাকার অধিকার নেই।
অন্বেষা বলতে শুরু করে। বর্ণ খেয়াল করলো তাকে।গল্প বলতে নিলেই সে চায় শূন্যে,
“তোমার চেয়ে ভালো বিজনেস মাইন্ডতো আমার। জানো এই হাইফাই শহরে কিভাবে বেঁচে আছি?জানবে কি করে? আমিই বলি।আমার সপ্তাহে পাঁচদিন ক্লাস থাকে।সকাল আটটা থেকে দুপুর বারোটা পর্যন্ত। দেড়টা থেকে আমার অফিস।বেতন আট হাজার। রিসিপশনিস্ট এর কাজ কোচিং সেন্টারে।মাঝেমধ্যে পরীক্ষায় গার্ড দেই, খাতা সাজাই,প্রশ্ন বানাই। সব মিলিয়ে ভালোই।তারপর কি করি জানো? সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় অফিস শেষ।সেখান থেকে যাই বাজারে।বাজারে আমার পরিচিত সবজি ওয়ালা আছে।”
অন্বেষার কথা মনোযোগ সহকারে শুনছিলো।হুট করে পোকা নড়ে উঠে মগজের।ছটফট শুরু করে। অন্বেষাকে থামিয়ে বলতে লাগলো,
“বিয়া বইয়া যাও সবজি ওয়ালার লগে।তোমার লগে মানাইবো। সারাজীবন ফ্রি শাক সবজিও পাইবা।”
“চুপচাপ কথা শুনো! বাগড়া দিবে না।”
বিষম খেয়ে বসে রইলো এই আদেশে বর্ণ।নির্ঘাত ছেলে মানুষ হলে একটা চড় পড়তো গালে। অন্বেষা আপন মনে বলতে লাগলো আবার,
“সেখান থেকে সবজি কিনি। কিনে নিয়ে সাতজন হাঁদারামের জন্য রান্না করি।তারপর জব্বার চাচা আসে নিয়ে যায়।ওরা আবার মাসে দশ হাজার টাকার মতো দেয়।কত হলো? আঠারো হাজার।সেখান থেকে বাড়ি ভাড়া,যাতায়াত খরচ,আমার খাওয়া দাওয়া,বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ।”
তারপর অকস্মাৎ ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে খুব উৎসাহ নিয়ে বললো,
“জানো আমার দাদীর দেওয়া পুরোনো একটা সিন্দুক আছে।আমি সেখানে আমার বাড়তি টাকাগুলো রেখে দেই।যদিও খরচ হয়ে যায় মাস শেষ না হতেও।কিন্তু আমি দিব্যি আছি।”
ছোটখাটো বিষয়ে খুশি হতে পারে কয়জন?একজন নারী এই ঢাকা শহরে টিকে আছে।এটাই অনেক মনে হলো বর্ণের কাছে।তবে মুখে প্রকাশ করলো না।তার মনে যে প্রশ্নটি ছিলো সেটি করলো,
“হাঁদারাম কারা?”
অন্বেষা দুষ্টু হেসে জবাব দেয়,
“আছে একদল ব্যাচেলর।”
বর্ণের কেমন যেনো লাগলো।ভালো ঠেকেনি ব্যাপারটা।নিম্ন সুরে প্রশ্ন ছুঁড়ে,
“ব্যাচেলরগো লেইগা রান্দো?’
অন্বেষার হাসির রেখা সেখানেই অটল।মিটমিট হেসে বলে,
“ওরা জানে ওদের জন্য জব্বার চাচার বউ রান্না করে পাঠায়।”
“তাইলে তুমিই জব্বার চাচার বউ!” বলে স্মিত হাসে বর্ণ।
“আরেহ ধুর!জব্বার চাচার বউ সেলাই এর কাজ করে।উনি চুলোর সামনে বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারেনা।চামড়া জ্বলে।তাই আমি ওনাদের জন্যও খাবার পাঠাই।”
“দিল দরিয়া!” তুচ্ছ কণ্ঠে বলে উঠে বর্ণ মাথা দুলিয়ে।
“তুমি কি করলে জীবনে? চিটারি বাটপারি ছাড়া?”
বর্ণ বলে, “ছিঁড়ছি!”
অন্বেষার মুখ ফুটে আপনাআপনি প্রশ্ন আসে, “কি?”
“বয়ে আকার বা ল বাল”
হতাশ অন্বেষা!বর্ণের প্রতি হতাশ।নাম বর্ণ অথচ জীবনে কোনো বর্ণের রং নেই।তাকে দেখলে মনে হয় ধূসর এক সত্তা।যার কিছুই নেই।আবার অনেককিছু আছে। অন্বেষা অবলীলায় বলে উঠে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে,
“আমি ভীষণ খুশি আমার এই জীবন নিয়ে। কারো সাথে কোনো লেনাদেনা নেই।তবে আছে কিছু অপূর্ণতা।তুমি বলো?”
“বর্ণ নিজের কাছে সমৃদ্ধ,বর্ণ নিজের কাছেই পূর্ণ”
________
বর্ণের অপারেশন করিয়ে হৃদয় থেকে ভারী একটা বোঝা নেমেছে। সবে মাত্র বাড়িতে গেছে সে। অন্বেষা দেই অব্দি যেতে পারেনি।তার দায়িত্ব দিয়েছে বড় কাঁধে।সাব্বির এবং তার বাবা মিলে বর্ণকে বাড়ি নিয়ে গেছে।পই পই করে সাব্বিরকে বুঝিয়ে এসেছে অন্বেষা।কোনোভাবেই যেনো ওকে একা না ছাড়ে।সারাক্ষণ আঠার মত লেগে থাকার আদেশ সাব্বির সাদরে গ্রহণ করেছে খুশি মনে।সেও তার ভাইজানের পাগল।সাথে থাকতে পারলেই শান্তি।
আজ সাব্বির ছেলেটার জন্য ভালো কাপড় আর জুতো নিয়ে যাবে।সেদিন তার পরিধেয় বস্ত্রের অবস্থা ছিল বেহাল।স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার পূর্বেই সামনে সৌভিককে।আজ রাগ নয় বরং হাসি মুখে এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করলো,
“কি খবর সৌভিক ভাই?আজ এই রাস্তায়?”
সৌভিক সময় নিয়ে জবাব দিলো, “আসছিলাম কাজে।”
“কাজটা কি আমাকে দেখা?”
থতমত খায় সৌভিক খানিকটা। হতবুদ্ধির মত চেয়ে।মায়ের কথামত কাজ করলেও মুখে তেমন জো পায় না। অন্বেষা বলে,
“কি হলো সৌভিক ভাই?আপনার চাপা দেখছি সমান হয়ে গেছে।”
সৌভিকের সেদিনের কথা মনে পড়ে গেল। আপনাআপনি হাত যায় গালে।প্রচণ্ড রকমের আঘাত পেয়েছিলো সেদিন। অন্বেষা সৌভিকের ভয়ার্ত মুখ দেখে আরো বেগ পেলো।বলে উঠে,
“জানেন সৌভিক ভাই?যে ছেলেটা আমাকে বাঁচালো আপনার হাত থেকে?সে আমার প্রেমিক। গুণ্ডা মাস্তান টাইপের একটু। একটা ছেলেকে অলমোস্ট মার্ডার করে ফেলেছিলো।আর হাত পা ভেঙে পঙ্গু করে দেয়া ওর প্রতিদিনের কাজ।”
সৌভিক উল্টো পথে হাঁটা ধরলো ধীরে সুস্থে। অন্বেষা চেনে তাকে। সে তার মায়ের হাতের মোহরা।ছোটবেলা থেকেই ভীতু রকমের ছেলে নাকি তার সাথে এসে জোরাজুরি করবে। অন্বেষা দুয়েক কদম এগিয়ে সৌভিককে বলে,
“কোথায় যাচ্ছেন সৌভিক ভাই? শুনুন আরেকটা জরুরি কথা।আপনার আর আপনার পরিবারের নামে জিডি করেছি।আপনাদের মতলব কখন বদলায় বলা মুশকিল বাপু।আপনার আম্মাজান এর কানে দিয়েন কথাটা।”
সৌভিককে ভয় দেখাতে পারে পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে।কিসের জিডি?কিসের কি?যাচাই বাছাই না করেই মেনে নিলো।মনে মনে বেকুব বলে ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়ে।সেখানে আরো দুটো আকর্ষণীয় মুখ।ঝুমা এবং রুম্পা।মৃদু হাসির চেয়ে ধারালো তলোয়ার হয়না শত্রুর জন্য। শত্রুরা অন্যের সুখেই পুড়ে বেশি।অন্বেষা স্বাভাবিক এর চেয়ে বেশি হাসি ফুটিয়ে হেঁটে চলে যায়।যাওয়ার পূর্বে তাদের অবাক মুখশ্রী দেখতে ভুল করেনি।
______
নিজের এলাকা,নিজের গোড়াপত্তন।গলির মুখে দোকানে চায়ের ধোঁয়া। আহা! একঝাঁক শান্তি এনে ঢেলে দিলো।অনেকদিন পর বাহিরের বাতাবরণের সাথে সাক্ষাত বর্ণের।এই শান্তি আর কোথায় মেলে না।এই ওলি গলির আনাচে কানাচেতে তার জীবনের গল্পের অনির্বচনীয় সুর বাজে। পুরান ঢাকার এই সন্ধ্যা, এই কোলাহলের,এখানে ফেলা প্রতিটি নিঃশ্বাস কাব্যের মত মধুর।
প্রিয় নাস্তা করতে বেরিয়েছে বর্ণ। তবে ব্যথাযুক্ত পা নিয়ে বেরোতেই মনে হলো নাহ!আজ বাকরখানি নয় বরং মোগলাই পরোটা বেশি টানছে। ঘ্রানে ঘ্রানে হোটেলের সামনে এসে দাঁড়ায়।তবে হাত একদম খালি।না কাজে যেতে পেরেছে এতদিন না টিউশনে।
গলা উঁচু করে ডাকলো বর্ণ।বললো, “এই রাব্বী!”
হোটেল থেকে রাব্বী বেরিয়ে আসে।বর্ণকে চেনে সে। এসেই বলল,
“ক”
“হাতে মাল পাত্তি নাই বুঝছোস।কিন্তু পেট চু চু করতাছে।মোগলাই খাওয়াবি?”
রাব্বী জবাব দিলো, “টাকা ছাড়া কেমনে কি?”
“আরেহ দেস না শালার পুত।দিয়া দিমু টাকা”
ঠিক তখনই মেয়েলী কণ্ঠে দুজনের কথা বার্তায় ব্যাঘাত ঘটে।ফিরে তাকালো ডান দিকে।এতদিন দেখা সাক্ষাত ছিলো না। ফোনে আলাপ হয়েছে।জ্বালিয়ে মেরেছে বর্ণকে। অন্বেষাকে দেখে কপালে হাত রাখলো বর্ণ।বিড়বিড় করে বললো,
“আবার টপকাইছে বালডা!”
অন্বেষা রাব্বীর উদ্দেশ্যে বলে,
“ভাই দুটো মোগলাই দিন।আলাদা দিবেন।”
রাব্বী ভেতরে চলে গেলো। অন্বেষা বর্ণের দিকে চেয়ে বললো,
“কি খবর?পায়ের অবস্থা কেমন?”
“খবর আমার ভালোই আছিলো। তোমারে দেখলাম একশো নাম্বার বিপদ সংকেতে আছি।’
অন্বেষা তার কথাকে সম্পূর্ণ গুরুত্বহীনভাবে শুনলো।এর প্রেক্ষিতে কোনো জবাব দেয়নি।বলে উঠে,
“ওষুধ নিয়েছো?”
বর্ণ বিরক্ত হয়ে বলে উঠে,
“এক কথা কতবার জিগাও ছেমড়ি?এতদিন ফোনে জ্বালায়া শান্তি পাও নাই?”
“না পাইনি”
তাদের তর্কের মাঝে খাবার হাজির। অন্বেষা একটি প্যাকেট নিজে নিয়ে আরেকটি বর্ণের দিকে এগিয়ে দিলো।বর্ণ ক্ষেপে উঠে।বলে,
“কি চাও তুমি?আমি তোমারে কইছি আমারে খাওয়াও?কেন করতাছো এসব?আমারে নিচা দেহাইবার চাও?”
“ভুল বুঝা তোমার স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে বর্ণ।”
বর্ণ রূঢ় গলায় বলে,
“আমি ঠিকই বুঝতাছি।আমার কত অস্থির লাগতাছে নিজের কাছে জানো?আমি কোনোভাবে তোমার যত্ন মাইনা নিতে পারতাছি না।নিজের কাছে নিজেরে ছোট লাগতাছে। আমি বর্ণ দুইদিন না না খাইয়া বাঁচতে পারি। জিবলা সামলানোর মুরোদ আমার আছে।আর তুমি?আমারে জোর কইরা ঋণের তলে ফালাইতাছো?তুমি আমার অপারেশন করাইছো।আমার পিছনে খাটছো। এসব চিন্তা আমারে ঘুমাইবার দিতাছে না।যে মানুষ খালি পেটে আয়েশের ঘুম দিবার পারে ওই মানুষ আজকা তোমার কারণে ভরা পেটে নির্ঘুম।”
এতগুলো কথা বলে লম্বা নিঃশ্বাস ফেললো বর্ণ।অজান্তেই নিজেকে প্রকাশ করে ফেললো না?তার মাঝে এক বিচলন দেখা যাচ্ছে।প্রবল আত্মসম্মানবোধের।বর্ণ আবার বলে,
“বিটলামি ফাইজলামি করি তাই বইলা আমারে হালকাভাবে নিবা না কইলাম।আমার জেদ তোমারে নিয়া ধ্বংস হইবো।সময় আছে পিছে হইটা যাও”
বর্ণের এই নতুন রূপে ভিতরে ভিতরে অন্তর পুলকিত।যেদিন বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যায় মন সিন্দুকের দুয়ার খুলেছিলো কিছু সময়ের জন্য। আজ তার কথাগুলো অজান্তেই ভালো লাগছে অন্বেষার।ভালো লাগার কাছে বর্ণের রাগ তুচ্ছ মনে হলো বটে।
“চায়া আছো কেন!”
“আমি তোমার পর বলে মনে হচ্ছে যে আমি তোমার উপর দয়া দেখাচ্ছি?”
বর্ণ বিরক্তিকর ভঙ্গিতে দুদিকে মাথা দুলিয়ে অস্থির স্বরে জবাব দেয়,
“আমি জানি না এতকিছু।আমার থিকা নিরাপদ দুরত্ব বজায় রাখো।আমি মানুষ ভালো না। সবাই জানে এলাকার বর্ণ খারাপ,বর্ণ মাস্তান।”
চোখ বুঁজে বিশেষ এক সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করে অন্বেষা। মন এবং মস্তিষ্কে ইতিমধ্যে তুমুল মতবিরোধ চলছে।এই বিবাদে কে জয়ী হবে সেটা আর দেখার প্রয়োজনবোধ করলো না অন্বেষা। শেষমেশ আকস্মিক অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নিয়ে বললো,
“আমি ভালো খারাপের ভয় কম করি।করলে হয়তো একই ঘরে শত্রু নিয়ে বসবাস করতে পারতাম না।এই শহরে একা মেয়ে হয়ে টিকে থাকতে পারতাম না।আমাদের কোনো লেনাদেনা নেই এই সমাজের সাথে বর্ণ।আমরা আলাদা দেখো?আর পাঁচটা মানুষের মত আমাদের জীবন নয়।তবে এতদিনে তোমার সাথে সব কাকতালীয় সাক্ষাত ইঙ্গিত করে আমাদের দুজনের একে অপরের সঙ্গ দরকার।আমাদের দুজনকে আমরা ছাড়া কেউ বুঝতে পারবে না।......আমার বলতে একদমই লজ্জা হচ্ছে না এই ছন্নছাড়া, ভবঘুরে,আধ পাগল বর্ণের চির সঙ্গ আমি চাই।তোমার জন্য না হোক আমার নিজের আত্মিক প্রশান্তির জন্য।একাকীত্ব ভীষণ ভয়ঙ্কর।আমি এই নিস্তব্ধতায় ভুগছি দীর্ঘকাল।এবার নাহয় আমার উপর দয়া দেখাও। হাত বাড়িয়ে এই ভয়াবহতা থেকে বের করে আনো।।”
চলবে…….......................