শ্যামকন্যার মায়াবী চোখ - পর্ব ০১ - আবিদা সুলতানা - ধারাবাহিক গল্প


চোখ! সৃষ্টি রহস্যের এক অতুলনীয় অধ্যায়। এই অনন্য উপহার, যার মাধ্যমে প্রতিটি প্রাণী যেন পৃথিবীর রহস্যময়তায় নিমগ্ন হয়ে পড়ে। চোখের গভীরতা, তার দৃষ্টির ভাষা; এ অবর্ণনীয় প্রতীক যা আমাদের চেতনায় স্পর্শ করে। চোখের মধ্যে লুকিয়ে থাকে একেকটি গল্প, একেকটি অনুভূতি, যা আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়, মনের গোপনতম কোণে আলোড়ন তোলে।  

চোখের ভাষা এমন এক ভাষা যা কোনো শব্দের ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় না; এটি অনুভবের মাধ্যমে বলা হয়ে যায়। প্রেমের মর্মরবাণী, আকুল প্রতীক্ষা, কিংবা গভীর হতাশা, সবকিছুই চোখের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। সবার মাতৃভাষা একদিকে, চোখের ভাষা আরেকদিকে। যে চোখ ভালোবাসার চাহনিতে নিমগ্ন, তা শুধুমাত্র প্রেমের নিরব সাক্ষী নয়, বরং এক অনন্ত ভালোবাসার মূর্ত প্রতীক।  

একবার চোখের মধ্যে গভীরতা খুঁজে পেলে, তা থেকে দৃষ্টি ফেরানো সহজ নয়। এই চোখের ভাষা বোঝার ক্ষমতা যে অর্জন করতে পারে, সে হৃদয়ের স্পন্দনও বুঝতে পারে। যে পুরুষ আপনার বাহ্যিক সৌন্দর্যের জন্য নয়, বরং চোখের নিঃশব্দ আকর্ষণে মুগ্ধ হয়, সে আপনাকে সত্যিকারের ভালোবাসে। যুগের পর যুগ পেরিয়ে যায়, কিন্তু চোখের সেই তৃষ্ণা মেটে না।  

এই চোখ দিয়েই তৈরি হয় ভালবাসার ভাষা, আবার এই চোখ দিয়েই জন্ম নেয় ঘৃণার আগুন। এমনই এক জাদুকরি সৃষ্টিকর্ম স্রষ্টার, যে চোখে ঘায়েল হয় হাজারো মানুষ। কিন্তু, এই মায়াবী চোখই যদি কোনো প্রাণের সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়? যদি চোখের এক নিঃশব্দ চাহনি একটি সাম্রাজ্যের পতন ঘটায়? এই চোখের শক্তি এবং মায়া এতটাই অদ্ভুত যে, তা প্রেমের চরম উন্মাদনা থেকে শুরু করে ধ্বংসের কালো মেঘে আচ্ছন্ন করে ফেলতে পারে। 

চোখের এই অনির্বচনীয় মাধুর্য, তার গভীরতা এবং শক্তি, এক ভিন্নমাত্রায় হৃদয়কে স্পর্শ করে, যা বাক্য দিয়ে প্রকাশ করা হয়তো কখনোই সম্ভব নয়।

_____________


——— " তুমি এখানে কী করছ?"

আরাফের কন্ঠে স্পষ্ট ক্রোধ, তার কণ্ঠস্বর গর্জনে ভরপুর, বজ্রপাত হল কক্ষে। 

আরিয়া ভয়ে কেপে উঠল,

———- "ক,,ককিছুই না, আব্বু..."

আরাফ আর অধিক কিছু শোনার প্রয়োজন মনে করল না। আরিয়ার কোমল হাতখানি কঠিনভাবে ধরে সে স্টোর রুম হতে বাহির করে আনল। তার মুখে প্রবল ক্রোধের ছাপ। দৃষ্টিতে অগ্নি জ্বলছে। আরিয়ার নিরীহ প্রশ্নের কোনো মূল্য নেই তার নিকট; এই মুহূর্তে সে একমাত্র ভাবিত, আরিয়া কীভাবে ঐ নিষিদ্ধ ঘরে প্রবেশ করল।

রাত দশটা অতিক্রান্ত হয়েছে তখন। ক্লান্ত দেহে দিনভর কর্মের ভার নিয়ে আরাফ মাত্রই স্ব-শয্যায় শায়িত হয়েছিল, তন্দ্রার নিঃশব্দ নিবিড়তায় শরীর দোল খাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ দরজার শব্দে তার ঘুম ভঙ্গ হল। ঐ গৃহটি নিতান্ত অতি ক্ষুদ্র, একতলা পাকা বাড়ি; ছাদের উপরে ছোট্ট একটি স্টোর রুম। মূল দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে প্রথমে চোখে পড়ে ছোট্ট অঙ্কনকক্ষ, বামপার্শ্বে ক্ষুদ্র রন্ধনশালা। ডানদিকে ছোট ঘর, যা দুইজন মাত্র বসবাসকারীর জন্য যথেষ্ট। 

আরিয়ার সপ্তম জন্মবার্ষিকীতে আরাফ তাকে পৃথক শয়নকক্ষে থাকবার অভ্যাস করিয়েছিল, যদিও সর্বদা তার সর্বদৃষ্টি থাকত মেয়ের ওপর। সে নিজে কখনও দরজা বন্ধ করে শয়ন করত না, আর আরিয়াকেও তা করতে দিত না, এই ভয়ে যে শিশুটি হয়তো কখনো দরজা আটকে দিবে। সেই ভয়ে আরাফ দরজার লক ভেঙে ফেলেছিল, আর দরজার নীচে কাঠ দিয়ে এমনভাবে আটকিয়ে রেখেছিল যেন খোলার সঙ্গে সঙ্গে শব্দ হয়। আর ছাদের দরজাও সর্বদা বন্ধ রাখবার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করেছিল, এবং স্টোর রুমে তালা দিয়ে রাখত যেন আরিয়া কখনো সেদিকে পা না বাড়ায়। 

এত সাবধানতা সত্ত্বেও, আজ তার সমস্ত প্রচেষ্টা ধূলি'সাৎ হল। আরাফ জানত যে এমন একদিন আসবে, এই ভয়ে তার বহু রাত নির্ঘুম কেটেছে । কিন্তু আজকের রাত তার সকল ভয়কে বাস্তবতায় পরিণত করল। কেমন করে আরিয়া ছাদের চাবি পেল? স্টোর রুমের চাবিই বা কোথায় পেল? এইসব ভাববার সময়ও সে পাচ্ছে না। এখন সে শুধু এটাই ভাবছে, তার মেয়ে কিছু দেখেছে কি না! 

আরিয়ার প্রতি তার ক্রু'দ্ধ দৃষ্টি নিবদ্ধ রইল। চোখের আ'গুনে সমস্ত দ'গ্ধ করতে চাচ্ছে। বাবাকে এত রা'গান্বিত অবস্থায় কখনো দেখে নি আরিয়া। পিতার এমন ভয়ংকর রূপ দেখে সে ভয়ে থরথর করছে, সারা দেহ কাঁপছে ছোট্ট আরিয়ার। আরাফের মুখমণ্ডল ক্রো'ধে লাল হয়ে উঠেছে, দম দ্রুত দ্রুত উঠছে। তার কণ্ঠস্বর কঠিন ও কর্কশ হয়ে উঠল,

——— “তোমাকে কতবার বলেছি ওখানে যেতে মানা, কেন গিয়েছিলে সেখানে? বলো!”

আরিয়া ভয়ে নিস্তব্ধ রইল, তার মুখটা সাদা হয়ে গিয়েছে। বাবার এমন ভয়ংকর রূপ দেখে তার হৃদয় শঙ্কায় পূর্ণ। আরাফ বুঝল, এরূপে কিছু হবে না। চোখ বন্ধ করে নিজেকে সংযত করল, কোমল স্বরে বলল,

-——— "শোনো মা, বাবা তোমাকে আর কিছু বলব না। কিন্তু তুমি আমাকে কথা দাও, আর কখনও ওখানে যাবে না। যদি কখনও বাবাকে হারাতে চাও, তবেই যাবে, অন্যথায় নয়। তুমি কি চাও তোমার বাবা হারিয়ে যাক? "

আরিয়া মাথা নেড়ে সায় দিল, "না", সে আর কখনও যাবে না। আরাফ গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মনের ভার একটু হালকা হল। আরিয়াকে খাটে শুইয়ে তার কপালে চুম্বন করে কাঁথা টেনে দিল, তার কোমল শরীর আবৃত করল। শয়ন করবার নির্দেশ দিয়ে দরজার দিকে যেতে লাগল, কিন্তু হঠাৎ থেমে গেল আরিয়ার প্রশ্নে,

———- "আব্বু, ঐ চোখ কার?"

এই প্রশ্ন শুনেই আরাফ স্থবির হয়ে গেল। তার দেহ জমে গেল মুহূর্তে। বক্ষের মধ্যে ধ্বংসস্তূপের মত ভেঙে পড়ল তার সমস্ত আশাবাদ। কণ্ঠরুদ্ধ হয়েগেল। মাথায় প্রবল ঝড় বইল। এতদিন যার ভয় করে সে দিনরাত্রি যাপন করেছে, আজ সেই ভয় সত্যে পরিণত হল। 

তার বক্ষের মধ্যে এক তীব্র যন্ত্রণা বইতে থাকল। কেও যেন তার অন্তরে ছু'রি চালাল। আরাফ অনুভব করল, তার কন্যা আজ এমন কিছু দেখেছে যা সে কখনোই জানাতে চায়নি। 
.
.
.
চলমান...........................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন