সায়র - পর্ব ১৩ - আশফি শেহরীন চিত্রা - ধারাবাহিক গল্প


পড়ন্ত বিকেল। বাহিরে ছোট্ট উঠানে দুই তিনটা কুকুর একমনে ঘেউঘেউ করছে। উঠানের কোণে ছিমছাম একতলা বাসায় চারটা রুম। এগুলাকে রুম না বলে স্টোর রুম বলা যেতে পারে। বরং স্টোর রুমও এর চেয়ে বড় হয়। এই কনকনে শীতেও ঘরের ভেতরে এত গরম যে উজানের ইচ্ছে করছিল কোট খুলে ফেলতে। 

উজান এসেছে ময়মনসিংহ। কিরণের বাড়িতে। শক্ত গদিতে উজান বসা। সূর্যের মৃদু কিরণ জানালার ফাঁক গলে মেঝের উপর থাকা উজানের পায়ের কাছে লুটোপুটি খাচ্ছে। উজান আর না পেরে কোট খুলে সাইডে রাখল। উঠে গিয়ে ফ্যানের সুইচ চালাতে গিয়ে দেখল কারেন্ট নেই। অথচ পাশের বাসা থেকে টিভির আওয়াজ আসছে। 

'ফ্যান চলবে না। মিটারের ব্যালেন্স শেষ।'

কিরণ রান্নাঘর থেকে আসতে আসতে বলল। তার হাতে লেবুর শরবত। উজানের সামনে শরবত রাখতেই উজান ঢকঢক করে খেয়ে নেয়। এত গরম লাগছিল যে উজানের ভেতরকার আত্না বেরিয়ে যাচ্ছিল যেন। 

'থ্যাংকস।' টিস্যুতে মুখ মুছতে মুছতে উজান বলে। একহাতে টিস্যু দিয়ে মুখ মোছাটাও যে কী সুন্দর হতে পারে তা উজানকে না দেখলে বুঝত না কিরণ। এই ছেলের সবকিছুতেই আর্ট। কিরণ সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে পাশের গদিতে বসে। 

'কী জন্য এসেছো?' কিরণের প্রশ্ন। 

বিকেলের রোদ তখন উজানের পা থেকে উঠে তার চোখে গিয়ে লাগছে। উজ্জ্বল মিষ্টি রোদের উজানের চোখ আর চুল ঝলমল করছিল। উজানকে দেখে কিরণের এক মুহুর্তের জন্য মনে হলো সে কোনো বইয়ের চরিত্র থেকে উঠে আসা রমণীদের প্রাণপুরুষ। যাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা বুকে নিয়ে বেঁচে থাকা যায় চিরকাল। 

'তুমি জানো না কী জন্য এসেছি?' উজানের পাল্টা প্রশ্ন। 

'এতদিন তো চেয়েছিলে আমি যাতে জুভের জীবন থেকে সরে যাই। আর এখন যখন চলে এসেছি তখন আবার ফিরে যাওয়ার জন্য বলছো?'

একটু থামে কিরণ। সে একটু ভুল বলেছে। সে চলে আসেনি, জুভের থেকে ছাড়া পাওয়া তার জন্য এই জীবনেও সম্ভব না বোধহয়। তার মন বলছে ঠিকই তাকে চলে যেতে হবে জুভের বন্দিনী হয়ে। 

সে তাচ্ছিল্য করে বলে, 'তোমার মতো ভাই আমি আমার জীবনে খুব কমই দেখেছি জানো উজান। ছোটো ভাইয়ের অপকর্ম জেনেও কীভাবে তার জীবনে একটা মেয়েকে ঠেলে দিচ্ছো, মেয়েটা তোমার ভাইয়ের কাছে ভালো থাকবে না জেনেও, শুধুমাত্র ভাই সুখে থাকবে বলে। অথচ ভাবছো না একটা মেয়ের জীবন যে শেষ হয়ে যাচ্ছে।'

'তোমার কি জীবন বলতে আদৌ কিছু আছে কিরণ?' 

উজানের প্রশ্নে চকিতে চায় কিরণ। বিভ্রান্তি খেলা করে তার মুখে, আসলেই তো! তার জীবন বলতে আদৌ কিছু আছে? নেই তো। কী অবলীলায় সত্যিটা বলে দিলো উজান! 

কিরণকে চুপ থাকতে দেখে উজান বলে, 'যাহোক, তুমি আজ এই মুহুর্তে আমার সাথে যাবে। জুভ পাগল হয়ে গিয়েছে তোমার জন্য।'

শেষ উক্তিটি শুনে মনে মনে হাসে কিরণ। হাহ! পাগল! তার জন্য পাগল! কি চমৎকার মিথ্যা কথা! 

সেই মুহুর্তে উজানের ফোনে একটা মেসেজ আসে। উজানের ফোনটা টেবিলেই ছিল। না চাইতেও মেসেজটা চোখে পড়ে যায় কিরণের। এক নিমিষে তার চোখ পড়ে ফেলে মেসেজটা। তারপর এমনভাবে চোখ সরিয়ে নেয় যেন সে মেসেজটা দেখেইনি। উজান মোবাইলের আওয়াজ শুনে মোবাইলটা হাতে নেয়। একবার মেসেজে চোখ বুলিয়ে উল্টো করে রেখে দেয় যাতে কিরণ দেখতে না পারে। 

'তোমাকে একটা সত্যি কথা বলি কিরণ, জাওভানকে তুমি যেমন ভাবছো ও ঠিক সেরকম নয়। তিনদিন আগে তুমি যা দেখেছো তা সম্পূর্ণটাই ভুল। চোখের দেখাটাও কিন্তু অনেক সময় ভুল হয় কিরণ। এই সবকিছুই ইয়ানার প্ল্যান ছিল। ও তোমাকে সহ্য করতে পারে না সেটা তুমি জানো, তাই ও অমন বিশ্রী খেলা খেলেছে তোমার সাথে। জাওভান শুধুমাত্র ঐ খেলার শিকার হয়েছে। ওর কোনো দোষ নেই। ইয়ানা এসব করেছে যাতে তোমার আর জুভের সম্পর্ক ভেঙে যায়।'

কিরণ জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। একটু আগের মেসেজের কথা মনে পড়ে তার, মেসেজটায় লিখা ছিল, "আমি যে ইয়ানার সাথে সবসময় মেকআউট করি এটা যাতে কোনোভাবেই কিরণ না জানে উজি। আমার শুধু কিরণকে চাই ব্যস। আর ও'কে এনে দেওয়ার দায়িত্ব তোর। অপেক্ষা করছি আমি।"

মেসেজটা যে জাওভানের তা বুঝতে সময় লাগে না কিরণের। কিন্তু উজান তো আর জানে না যে তার অগোচরে মেসেজটা কিরণ দেখে ফেলেছে। অথচ ভাইকে নির্দোষ প্রমাণ করতে উজান কি সুন্দর মিথ্যা বলছে। মনে হয় যেন কিরণ বিশ্বাস করবে!!

কিরণ মেসেজের কথা গোপন রেখেই শান্ত কন্ঠে বলল, 

'মানলাম এসব ইয়ানার প্ল্যান। কিন্তু ইয়ানা কী করে জানলো যে আমি ঐদিন জুভের বাসায় যাবো? ইয়ানা তো ঠিকভাবে জানেও না আমি কখন কোথায় থাকি বা কী করি। তাহলে সেইদিনই বা কীভাবে জানল?'

উজান এবার চুপ করে রইল। সে বুঝতে পারেনি কিরণ যে এই প্রশ্নটা করবে, নাহলে সে আরেকটু সাজিয়ে মিথ্যাটা বলত। আসলে জুভের জন্য তার টেনশন হচ্ছিল প্রচণ্ড। জাওভান অসুস্থ হয়ে গেছে প্রায়। নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে সারাদিন কিরণের নাম জপছে, ঠিক প্রথমদিনের মতো। উজানের মন পুড়ে ভাইয়ের এ অবস্থা দেখে। ছোটোবেলায় জাওভান যা যা আবদার করতো সব পূরণ করেছে উজান, সব। এখন তার কাছে কিরণকে ভিক্ষা চাইছে। উজান জানে যে জাওভানের বিশ্বাস একমাত্র তার ভাই-ই পারবে কিরণকে এনে দিতে। 

কিরণের ফোন তখন তারস্বরে বেজে ওঠে। মায়ের ফোন। কিরণ ফোন ধরে জানতে পারল আজ কিয়াদের অপারেশনের ডেট। এটাই নাকি শেষ অপারেশন। তারপর কিয়াদ বাড়ি ফিরতে পারবে। কিরণ দ্রুত তার হাতব্যাগ নিয়ে নেয়। তার শরীরটাও ভালো নেই। খাওয়া দাওয়া হচ্ছে না ঠিকমতো, তার উপর এত টেনশন।

'কোথায় যাচ্ছো?'

'হসপিটালে।' জুতা পরতে পরতে কাষ্ঠ গলায় বলে কিরণ। 

উজান আর কিছু না বলে উঠে দাঁড়িয়ে বাহিরে চলে যায়। কিরণ ঘরে তালা লাগিয়ে বের হতে গিয়ে দেখে উজান গাড়ি নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছে। 

উজান গাড়ির দরজা খুলে বলে, 

'গাড়িতে উঠো।'

কিরণ বিনাবাক্যে উঠে পড়ে। এখান থেকে মেইন রাস্তা পর্যন্ত হেঁটে যাওয়ার মতো শক্তি নেই তার। আর হসপিটালেও পৌঁছাতে হবে তাড়াতাড়ি। তাই গাড়িতে উঠতে দ্বিমত করেনি। 

হসপিটালে আসলে কিরণ তৃতীয় তালার দুইশত তিন নং ওয়ার্ডে যায়। রুমের শেষের দিকে কিয়াদের বেড। 

উজানের দম বন্ধ হয়ে আসে হাসপাতালের ভ্যাপসা গন্ধে। চারিদিকে এত এত অসুস্থ মানুষ, এত কোলাহল তার মতো ইন্ট্রোভার্ট মানুষের মাথা ধরিয়ে দিচ্ছে। দম আটকে সে কিরণের পিছু পিছু যায়। রুমের প্রতিটা মানুষ উজানকে অবাক চোখে দেখছে। উজান রুমের অর্ধেক গিয়েই ফিরে আসে। রুমের বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকে। 

কিরণের মায়ের চেহারা রুগ্ন। ঘুমন্ত কিয়াদের পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলাচ্ছে। কিরণকে দেখে তাঁর মুখ কিছুটা উজ্জ্বল হয়। 

'কিরণ মা। এসেছিস!' 

তার মা মমতাজ কিয়াদকে জাগাতে নেয়। কিরণ বাঁধা দেয়। 

'উঠিও না ও'কে। ঘুমাচ্ছে ঘুমোক।'

ঘুমন্ত ভাইয়ের চেহারা মায়া মায়া। কিরণ ভাইয়ের কপালে চুমু খায়। কিয়াদের মাথার পাশে রসায়ন আর পদার্থবিজ্ঞান বই। এই ছেলে হাসাপাতালে এসেও পড়ালেখা ছাড়েনি। 

'তোর অনেক কষ্ট হয় না রে কিরণ?'

কিরণ চোখ উঠিয়ে মায়ের দিকে তাকায়। তার মায়ের চোখ ছলছল করছে। চোখ ফিরিয়ে নেয় সে, বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে সে নিজেও কান্না আটকাতে পারবে না। তাকে কান্না করতে দেখলে মাও ভেঙে পড়বে। 

'আমার মাঝে মাঝে মনে হয় তোকে যদি জন্মটা না দিতাম, তাহলে তোর এই নিষ্ঠুর দুনিয়া দেখা লাগতো না। সব ভুল আমার।'

'তুমি আবার শুরু করেছো মা।' কিরণ বিরক্তির ভান ধরে চোখের জল আটকায়। 

'না রে, সত্যি বলছি। ছোটো থেকেই তো তোকে কত কিছু সহ্য করে আসতে হয়েছে। আমি মা হয়ে কিছু করতে পারলাম না তোর জন্য।'

'ডাক্তার কী বলেছে? অপারেশনের ব্যাপারে।' কিরণ কথা ঘুরায়। তার এখন অতীতের কথা মনে করতে ইচ্ছা করছে না। 

'ডাক্তার যেন কী বলেছে? বলেছিল অপারেশন করতে, কত টাকা যেন লাগবে..ভুলে গেছি।' মমতাজ মনে করার চেষ্টা করলেন। দিনে দিনে তিনি স্মৃতিশক্তি লোপ পাচ্ছেন মনে হয়। কিছুই মনে থাকে না ইদানীং। 

'আচ্ছা আমি গিয়ে কথা বলে আসছি। তুমি থাকো।'

কিরণ উঠে বাহিরে যায়। বাহিরে উজানকে পায়চারি করতে দেখে। কিরণ পাশ কাটিয়ে চলে যায়। কিরণকে কোথাও যেতে দেখে উজানও তার পিছু নেয়। কিরণ রিসেপশনিস্টকে জিজ্ঞেস করে অপারেশনের ব্যাপারে। আর জানায় সব মিলিয়ে মোট পঁচানব্বই হাজার লাগবে। 

কিরণের ব্যাংকে এত টাকা নেই। যা ছিল তা দিয়ে এই কয়দিন মায়ের আর কিয়াদের ঔষধে শেষ হয়ে গিয়েছে। কিরণ ব্যাংক থেকে লোন নিবে ভাবে, যেহেতু এছাড়া আর উপায় নেই তার কাছে। 

কিরণ হসপিটালের বাইরে বের হলে উজান পেছন থেকে ডাক দেয়। 

'আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি।' 

কিরণ ক্রুদ্ধ স্বরে বলে, 'লাগবে না।'

এই বলে আবার হাঁটা দেয়। উজান দৌড়ে এসে কিরণের হাত ধরে থামায়। 

'হাত ছাড়ো উজান।'

'লিসেন কিরণ। তোমাকে সব দিক দিয়ে সাহায্য করব আমি। তার বদলে তোমাকে আমার সাথে যেতে হবে।'

'না লাগবে আমার সাহায্য, না আমি আপনার সাথে যাব।' চিৎকার করে উঠে কিরণ। হাত ছাড়িয়ে নিতে চায় সে। পারে না। উল্টো উজান আরো শক্ত করে চেপে ধরে। 

'পাবলিক প্লেসে সিন ক্রিয়েট করো না। সবাই দেখছে।'

কিরণ চারিদিকে তাকিয়ে দেখে প্রত্যেকটা মানুষ তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। কিরণ শান্ত হয়। উজান কিরণের হাত টেনে ধরে দোকানের কোণায় নিয়ে আসে। 

উজান বড় করে শ্বাস নেয়। মুখ গম্ভীর করে বলে, 

'তুমি বাধ্য কিরণ। আমি শুধু ভদ্রতা বজায় রেখে তোমাকে যাওয়ার জন্য বলছি। জাওভানকে এখানে না নিয়ে এসে নিজে এসেছি শুধু তোমাকে বুঝিয়ে নিয়ে যেতে। আমার সাথে গেলে তোমারই লাভ। জুভকে যদি বলি তুমি এখানে আছো, তাহলে ও কিন্তু তোমাকে আর তোমার মা ভাইকেও ছাড়বে না, সেটা তুমি খুব ভালো করেই জানো নিশ্চয়ই। তোমাকে তো নিয়ে যাবেই, সাথে তোমার মা আর ভাইয়ের জীবনটাও শেষ করবে।'

কিরণ থমকানো গলায় বলে, 'তুমি আমাকে থ্রেট দিচ্ছো?'

'যা ভাবো।' উজানের শীতল গলা। 

কিরণের অশ্রুর ধারা গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে। তা দেখে মায়া হয় না কঠিন হৃদয়ের উজানের। সে গাম্ভীর্যতা বজায় রেখেই বলে, 

'তোমার ভাইয়ের অপারেশনের টাকা থেকে শুরু করে সব টাকা আমি দিবো। তোমার চিন্তা করতে হবে না।'

'ঠিক এরকম একটা ডিলের জন্যই আমি জুভের কাছে বন্দী হয়েছি। এখন আবার সেই একই ডিল!' কিরণের কণ্ঠ রুদ্ধ। চোখ ঘোলা হয়ে আসছে ক্রমশ।

'আমার ডিলটা মাত্র একমাসের ছিলো, তারপর তো তোমাকে আমি মুক্ত করেই দিয়েছিলাম। জুভ তোমাকে আটকিয়েছে, তাহলে দোষটা কি আমার? আর তোমাকে আমি বাড়তি আরো অনেক সুযোগ দিবো কিরণ। তোমার ভাইয়ের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য যা লাগে সব দিবো। নতুন পরিবেশ পাবে তোমার পরিবার। তুমি কি এখনো রাজী হবে না? নাকি নিজের স্বার্থের কথা চিন্তা করে এই সুযোগটা হারাবে?'

কিরণ ধরা গলায়, ক্ষীণ কণ্ঠে শুধু এইটুকুই বলে, 'তুমি অনেক স্বার্থপর উজান, অনেক স্বার্থপর।'

.

.

কিরণকে উজান নিজের বাংলোতে নিয়ে এসেছে। কিরণ বলেছে তার কিছুদিন সময় দরকার। সে জাওভানের সাথে এখনি দেখা করবে না। উজানও সময় দিয়েছে, তবে শর্তস্বরূপ কিরণকে জুভের সাথে ফোনে কথা বলতে হবে। জুভকে ম্যানেজ করার দায়িত্ব উজানের। 

কিরণকে তার বাসায় ছেড়ে দিতে চেয়েছিল সে, পরে মনে পড়ে, কিরণ বলেছিল এ মাসের শেষেই বাসা ছেড়ে দিবে। আর এ মাস শেষ আজকে। তাই উজান কিরণকে বলেছে সে তার ব্যাগ গুছিয়ে আনতে, বাকি জিনিসপত্র পরে উজান লোক দিয়ে নিয়ে যাবে। কিরণের আগে থেকেই প্রয়োজনীয় সব গুছানো ছিল। তাই সমস্যা হয়নি। 

এ মাসের ভাড়া উজানই দিয়ে দেয় যেহেতু কিরণের কাছে তত টাকা ছিল না। ভাড়া দেয়ার সময় আয়াতের সাথে দেখা হয়ে যায় তাদের। 

আয়াত কিরণকে দেখে বলে, 

'কিরণ তুমি কোথায় ছিলে গো? তোমার বয়ফ্রেন্ড তো আমার বাসায় এসেছিল কাল, সে কি হাঙ্গামা সৃষ্টি করেছে। আমি যত বলেছি তুমি কোথায় আছো আমি জানি না, তিনি তো বিশ্বাসই করেনি। উল্টো আমাকে থ্রেট দিয়েছে জানো। এখন তুমি এসে গেছ ভালোই হয়েছে। আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম তোমার বফের হুমকিতে।'

কিরণ জুভের হয়ে ক্ষমা চাইল। সে এখান থেকে চলে যাবে সেটা আয়াত আজই জেনেছে। কিরণের যে টাকার সমস্যা সেটা সে বুঝেছে। তবে সে বাবাকে বলে কিরণের থেকে কম ভাড়া নিতে পারত যদি উজানের উপর নজর ভালোভাবে গেঁথে যেত। কারণ উজানকে পেতে হলে কিরণকে মাধ্যম হিসেবে কাজে লাগানো যেত। কিন্তু এখন তো উজানের থেকে নজর সরে গিয়ে আহযানের উপর পড়েছে, আর আহযান নিজেই এসে ধরা দিয়েছে। তাই আর কিরণকে তার লাগবে না। তাই সে কিরণকে বাসা ছাড়তে বারণও করেনি। তবে একটু খারাপ লাখছে, যেহেতু তার সাময়িক জুনিয়র ফ্রেন্ড ছিল কিরণ। 

কিরণকে নিচের তলার একটা রুমে থাকতে দেয় উজান। আর কিরণকে সাবধান করেছে উপরের তলায় যাতে ভুলেও পা না মাড়ায়। কারণ সেখানে কিরণের পদচারণ তাকে ডিস্টার্ব করবে যা সে মেনে নিতে পারবে না। 

কিরণ জুভের সাথে ফোনে কথা বলেছে। ভিডিওকলে বলতে হয়েছে। যদিও জুভ বুঝতে পারেনি কিরণ কোথায় আছে। কিরণের সাথে যখন কথা বলছিল জুভ এত আগ্রাসী হয়ে গিয়েছিল যে কথা মাঝে কিরণকে কল কেটে দিতে হয়েছে। দুইদিন হয় কিরণ এখানে এসেছে। তাকে নিয়ম করে প্রতিদিন দুইবার কল করতে হয় জুভকে। তার খোঁজখবর নিতে হয়। প্রথমে জুভ পাগল করেছিল কিরণ কোথায় আছে বলতে। পরে আর অবশ্য বলেনি। নিশ্চয়ই উজান কিছু একটা বলে সামলিয়েছে। 

উজান এখানে সারাদিন থাকে, তবে কিরণের সাথে বলে না বললেই চলে। এখানে আসলে উপরের তলায় গিয়ে নিজের আর্ট আর স্কাল্পচারের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তার নাকি কয়েকদিন পর এক্সিবিশনে যেতে হবে। 

সে দুপুরে এখানে আসে, আর রাত হলেই ফ্লাটে ফিরে যায়। মাঝখানের সময়টুকুতে সে কিরণের খোঁজ নেয়না, ইচ্ছে করেই এড়িয়ে যায়। কিরণ তত মাথা ঘামায় না। উজানকে না দেখলেই ভালো, দেখলে বারবার তার স্বারপরতার কথা মনে পড়ে। 

কিরণের ভাইকে কেবিনে শিফ্ট করেছে উজান। মমতাজকেও ভালো ডাক্তার দেখিয়েছে, অধিক টাকা দিয়ে নার্স রেখেছে আলাদা করে যাতে মমতাজের কষ্ট না হয়। কিরণ যখন মায়ের সাথে ফোনে কথা বলছিল তখন এক প্রসঙ্গে মমতাজ বলেন, 

'তুই যেই ছেলের কথা বলেছিলি না, সে তো অনেক ভালো রে।'

কিরণ বুঝতে পারে না প্রথমে, 'কার কথা বলছো?'

'ঐ যে তুই নাকি বিয়ে করবি কোন ছেলেটাকে। তোকে নাকি অনেক ভালোবাসে, ঐ ছেলেটা।'

কিরণ ভাবে জাওভান। জাওভান সম্পর্কে কিরণ তার মাকে কিছুই জানায়নি। বললে আরো টেনশন করবেন। তাই শুধু সে বলেছিল, এখানে একটা ছেলেকে তার পছন্দ হয়েছে, আর তারা বিয়ে করবে। তার মাও কিছু বলেনি, তার মেয়ে এত কষ্টের পর একটু সুখে থাকুক এটাই তো চায়। 

কিরণকে চুপ থাকতে দেখে তার মা বলে চলে, 

'কাল এসেছিল এখানে, কিয়াদের জন্য কত বই এনেছে জানিস, খাবার আনল কয়েক পদের। আমার সাথে বসে অনেকক্ষণ গল্প করল। কত অমায়িক ব্যবহার! তোর সাথে অনেক মানাবে।'

কিরণ স্তম্ভিত হয়। জাওভান ওখানে গিয়েছে? জুভ তো জানেই না এসব ব্যাপারে, তাহলে সে কীভাবে যাবে?

'মা, জাওভান ওখানে গিয়েছে?'

'কে?'

'জাওভান।'

'সেটা আবার কে?'

'যার কথা বলছো তুমি।'

'ওর নাম তো উড়ান না জানি কী বলল।'

কিরণ চমকিত হয়। উজানের কথা বলছে না কি? নিশ্চিত হওয়ার জন্য বলে, 'উজান?'

'হ্যাঁ হ্যাঁ ঐ উজান।'

কিরণের চোখে বিস্ময় খেলা করে। উজান গিয়েছে! কই একবারো তো বললো না সে! 

'মা, আমি তোমাকে যার কথা বলেছি সে উজান না, ওর নাম জাওভান। মনে নেই তোমার।'

'কী নাম? জাওভান! কী জানি, আমার তো মনে নেই।'

'যে গিয়েছে সে উজান, সে হচ্ছে জাওভানের বড় ভাই।'

'ও বুঝেছি। বড় ভাইটা কত ভালো, না জানি ছোটো ভাইটাও কত ভালো হয়। দেখবি তোকে রানী করে রাখবে।'

কিরণ ভেতরটা দগ্ধ হয়ে যায় অদৃশ্য আগুনে। কষ্টের হাসি হেসে মনে মনে বলল, "হুম অনেক ভালো সে, আমার জীবনে তার চেয়ে ভালো লোক খুবই কম দেখেছি। একদম মাথায় করে রাখবে আমায়।"
.
.
.
চলবে......................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন