রাত ৯:০৫ মিনিট।
তারা কাজলের বাবা ও মায়ের পাশে বসে রাতের খাবার খেতে শুরু করে। কাজলের বিয়ে উপলক্ষে আত্মীয়-স্বজনে ভরে গেছে ঘর। নুজাইফা বেগম বললেন,
'মুরব্বিরা তাদের মতো কথা বলছে, তাদের কথা কান দিও না। খাওয়া শেষ করে রুমে গিয়ে ঘুমাও। পরশু হলুদ সে কারণে রাত জাগবে না।'
নুজাইফা বেগম আরও বললেন,
'নীল, ঘুমাতে যাওয়ার আগে ব্যাথার ঔষধ খেতে ভুলবে না। তারপরেও যদি ব্যাথা না কমে, তবে সকালে আমাদের গ্রামের এক খালা তিনি ঝাড়ফুঁক করেন, তোমাকে তার কাছে নিয়ে যাব।'
নীল বলল,
'আচ্ছা আন্টি।'
আজাদ দেওয়ান কড়া গলায় বললেন,
'কাজল, তুমি থাকতে তোমার বন্ধুরা ব্যাথা পায় কেন?'
কাজল নিচু গলায় বলল,
'আমি খেয়াল করিনি বাবা।'
'আগে থেকে ওদের যত্ন নিবা। তারা আমাদের অতিথি, তাদের ভালোভাবে দেখার দায়িত্ব আমাদের।'
রাতে পায়ের ব্যাথা কমেনি বরং বেড়েছে। নীল সারা রাত ঘুমাতে পারেনি। সকালে নুজাইফা বেগম নীলকে নিয়ে ওই মহিলার কাছে আসেন। সে গরম সরিষার তেল দিয়ে পায়ে মালিশ করছে আর কিছু একটা বিড়বিড় করছে। নীল যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। পাঁচ মিনিট পর ছেড়ে দেন। অবিশ্বাস্যভাবে, নীলের পায়ের ব্যাথা অদৃশ্য হয়ে গেল। সে এখন সোজা হাঁটতে পারে। নুজাইফা বেগম ওই নারীকে একশ টাকা দেন। তারপর বাড়িতে যাওয়ার জন্য একটি রিকশা ডাকলেন।
নীলের পায়ে ব্যথার কারণে গতকাল ঠিকমতো ঘুরতে পারেনি ওঁরা। আজ আবার তারা বেরিয়েছে। নীল লাল জামা পরেছে। নীল এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল, হঠাৎ একটা ছাগলের বাচ্চা দেখতে পেয়ে তার দিকে হাঁটা শুরু করল। ছাগলের বাচ্চা মাঠের মাঝখানে লাফাচ্ছে। নীল কুটিল হেসে বাচ্চাটিকে ধরল। ছাগলের বাচ্চা তার মায়ের কাছে দৌঁড়ে গেল এবং নীল তার পিছনে তাড়া করল। কিছু দূরে একটা ষাঁড় গরু বেঁধে রাখা ছিল, নীলের গায়ের জামার লাল রং দেখে সে ঢুঁ মারতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে তার দিকে ছুটতে লাগল।
দূর থেকে তানজুম 'নীল' বলে চিৎকার করে। হঠাৎ তার হাতটা শক্ত করে ধরে কেউ টান দিল। নীল অভ্রকে দেখল। আর তারপর ষাঁড়টাকে দেখল। কাঁঠাল গাছের সাথে দড়ির দিয়ে বাঁধা এজন্য আর এগিয়ে আসতে পারছে না। কিন্তু সে দড়ি ছেড়ার চেষ্টা করছে। অভ্র নীলকে কিছুটা দূরে সরিয়ে আনলো। নীলের শরীর কাঁপছপ। অভ্রর চোখ ভয়ানক লাল হয়ে গেল। অভ্র দাঁত কিড়মিড় করে রাগে গজগজ করে বলল,
'তোমার সমস্যা কি? গ্রামে এসে লাল জামা পরে ষাঁড়ের সামনে দৌড়াচ্ছ। তুমি কি জানো না, ষাঁড়ের লাল রং পছন্দ করে না। লাল দেখলে রেগে যায়।'
নিচু গলায় বলল নীল,
'আমি দেখিনি।'
অভ্র রাগ দমন করে নীলের পাশ দিয়ে চলে গেল। রাস্তায় পাশাপাশি হাঁটছে দুজন। কিন্তু কেউ কারো সাথে কথা বলছে না। নীল বারবার অভ্রর দিকে তাকায়, ফর্সা লোকটার মুখ রাগে লাল হয়ে ওঠে। নীল ঠোঁট মেলে হাসল। বাঁশ দিয়ে সাকু তৈরি করা হয় এক পাশ থেকে আরেক দিকে যাওয়ার জন্য। নীল সোজা হয়ে দাড়িয়ে আছে। বাঁশের সাকু পার হতে নিলেই সে পানিতে পড়ে যাবে। অভ্র এসে পাশে দাঁড়াল। হাত বাড়িয়ে বলল,
'হাত ধরো, তোমাকে পড়তে দেবো না।'
গ্রাম ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেল। এখন আবার হেঁটে বাড়ি ফেরার আগ্রহ পাচ্ছে না। এতক্ষণ হাঁটার জন্য ওদের হাঁটুতে ব্যাথা করছে। তারা একটা গাছের গুঁড়িতে বসল। অভ্র চোখ বন্ধ করে প্রকৃতির ঠান্ডা বাতাস অনুভব করে। হঠাৎ সে অনুভব করল তার বন্ধ চোখের পাতায় গরম হাওয়া পড়ছে। অভ্র হঠাৎ চোখ খুলল। নীল ওর সামনে ঝুঁকে এসে দাঁড়িয়েছে। নীল ভাবছিল, অভ্র ঘুমাচ্ছে আর তার মুখে ফুঁ দিচ্ছে। অভ্র হঠাৎ ওর কাণ্ড দেখে জোরে হেসে উঠল।
নীলা তাড়াতাড়ি সরে গেল।
__
ভোর হয়ে গেছে, পূর্ব আকাশে সূর্য উঠছে। পাখিরা কিচিরমিচির শুরু করেছে। সূর্যের আলোর সাথে সাথে বাড়ির সমস্ত লোকেরা জেগে ওঠে এবং বাড়ির কাজে লেগে পড়ে। কাজল ঘুমাচ্ছে, গতকাল অনেক স্ট্রেস গেছে। নীল উঠে বসল। চুলে হাত গুটিয়ে বলল,
'এই কাজল, এই। উঠ! আজ তোর বিয়ে।'
'আর দশ মিনিট।'
সারা বাড়িতে এক ধরনের হৈচৈ শুরু হয়ে গেছে আর বরকে চারিদিকে ঘিরে ধরেছে। বর ও তার বন্ধুদের গেট থেকে অভ্যর্থনা জানানো হয় এবং স্টেজে বসানো হয়। কাজী যথাসময়ে এলেন, পথে দেরি হয়নি। কাজী মশাই বিবাহ সম্পূর্ণ করেন এবং তারপর চলে যান। নীল ছোট বারান্দা থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে অভ্রকে বারবার খোঁজার চেষ্টা করছে।
'কাউকে খুঁজছ?'
নীল হঠাৎ একটা ফিসফিস আওয়াজে চমকে গেল। পিছনে না তাকিয়েই বলল,
'না। আমি কাকে খুঁজব?'
'তুমি উত্তরের পরিবর্তে প্রশ্ন করছ?'
'কেন? প্রশ্ন করা বারণ।'
অভ্র হঠাৎ নীলের হাতটা পিছনে নিয়ে মুচড়ে দিল। মৃদু ব্যাথায় কণ্ঠে বলল নীল,
'ব্যাথা করছে।'
'এটা তো সামান্য ব্যাথা নীল। কিন্তু তুমি প্রতিবার তোমার কথায় আমার হৃদয়কে টুকরো টুকরো করে দাও।'
অভ্র নীলের হাত ছেড়ে দিয়ে বাড়ির বাইরে চলে গেল। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে চলে যাওয়ার পালা। নীলের দুই চোখ অভ্রকে খুঁজছে। আকাশ দাঁড়িয়ে তানজুমের সঙ্গে কথা বলছিল, একপর্যায়ে দুজনে নম্বর বিনিময় করে। নীল তাদের কাছে এসে জিজ্ঞেস করে,
'তোমরা অভ্রকে দেখেছ?'
আকাশ বলল,
'কয়েক ঘণ্টা আগে দেখেছি।'
'তাকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না।'
'আমি কল দিচ্ছি।'
ফোন বন্ধ। অভ্রকে চারপাশে খোঁজা হল। তন্ময় তার ফোনে অভ্রর মেসেজ চেক করে, এক ঘণ্টা আগে সে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। তার জন্য কাউকে টেনশন করতে নিষেধ করে। তন্ময় লেখাটা পড়া শেষ করে নাম্বারে কল দিল। বন্ধ।
___
সাত দিন কেটে গেল। তির্যক সূর্যের আলো চোখে পড়লে চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলল নীল। আলতো করে চোখ খুললো, মাথাটা খুব ভারী লাগছে। মাথার একপাশে হাত দিয়ে উঠে বসল। এবার সে চারপাশে তাকায়। নীল তার বেডরুমে বসে আছে। ঘরটি উজ্জ্বল সাদা। একদিকে বড় থাই গ্লাস আর অন্যপাশে বেশ বড় করিডোর। ঘরের সবকিছু সাদা এবং কিছু জিনিস কালো এবং ধূসর।
কাজলের বিয়ের পর থেকেই ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ে নীল। সে এখন অনেকটা সুস্থ। আজ ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে, মায়ের সাথে বেশি কথা বলেনি। এই দিনগুলি গম্ভীর ভঙ্গিতে কাটিয়েছে সে। অভ্র নিখোঁজ, সে কাজলের বিয়ের দিন চলে যায় এবং তারপর থেকে তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি। নীল সারাক্ষণ চাতকপাখির মতো বসে থাকে যখন তার ফোন বেজে ওঠে। ফোনে কল বা মেসেজ করলেই ফোনে নীল চেক করে। এই ভেবে অভ্র ফোন দিল। প্রতিবারই সে হতাশ হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে নীল। সঙ্গে আছে তানিয়া ও তানজুম। গম্ভীর গলায় বলল তানজুম,
'আকাশ, অভ্র ভাইয়ের হদিস জানে না। আমি প্রতিদিন তার সাথে কথা বলি। আমি প্রায় তাকে অভ্র ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করি। সে কিছু জানে না।'
নীল বলল,
'হঠাৎ কোথায় চলে গেল সে? এমনকি তার বন্ধুরাও জানে না, সে কোথায়?'
তানিয়া হঠাৎ বলে উঠল,
'আন্ডারগ্রাউন্ডে যায়নি তো?'
নীল বিরক্তিতে কপালে ভাজ ফেলল।
নয় বছরের একটি মেয়ে ঝড়ের বেগে ছুটে এলো। সে নীলের দিকে একগুচ্ছ গোলাপ তুলে দিল। তারপর মৃদু স্বরে বলল,
'আপু ফুল নাও।'
নীল হাসলো। ফুলটা নিল তারপর ব্যাগ থেকে টাকা বের করে দিতে লাগল। মেয়েটি বলল,
'তোমার টাকা লাগবে না আপু। ওই ভাই আগেই টাকা দিয়ে দিয়েছেন।'
নীল ভ্রুকুটি করল। হঠাৎ সামনে তাকিয়ে দেখল অভ্র দাঁড়িয়ে আছে। নীল মেরুদণ্ড টানটান করে বলল,
'অভ্র?'
.
.
.
চলবে........................................