না দেওয়া চিঠি - অনিমা কোতয়াল - অনু গল্প


!!১!!

আষাঢ় মাস। গাঢ় ধূসর মেঘ আচ্ছন্ন করে রেখেছে আকাশকে। খানিক বাদে বাদেই মৃদু আওয়াজে ভেসে আসছে মেঘের গর্জন। বোঝাই যাচ্ছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামবে। নিজের সিগ্ধ ছোঁয়ায় জাগিয়ে তুলবে সবুজ প্রকৃতিকে।

ধারণাকে সত্য প্রমাণ করতেই যেন বাতাস তার গতি বাড়িয়ে দিল। নদীর স্রোত নিল আরও তীব্র বেগ। এমন পরিস্থিতিতে গ্রামের সবার মধ্যেই যেন ছোটাছুটি বেঁধে গেল। সকলেরই যত দ্রুত সম্ভব বাইরের কাজ শেষ করে ঘরে ফেরার চেষ্টা। অথচ তিশান চুপচাপ বসে আছে নদীর পাড়ের নারকেল গাছটার নিচে। আশেপাশে কী হচ্ছে সেটা নিয়ে কোনরকম মাথা ব্যাথাই নেই। আপাতত মারাত্মক মন খারাপে ডুবে আছে এই যুবক। বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিলেও এই মুহূর্তে কিছু যায় আসেনা ওর। পরপর দুবার বি.সি.এস পরীক্ষা দিয়েও কোন লাভ হলো না। দ্বিতীয়বার প্রিলিটা পার করলেও পরের ধাপে গিয়েই ব্যর্থতা নামক হতাশা ধরা দিল তার হাতে। এই নিয়ে আশেপাশের মানুষের কটু কথা, ব্যঙ্গ, সহানুভূতি নামক খোঁচা প্রায়ই সহ্য করে চলে তিশান। জন্মদাত্রী মাও আজ সকালে বেশ কয়েকটা কড়া কথাও শুনিয়ে দিয়েছে ওকে। রাগে, দুঃখে ভাতের থালায় অর্ধেক ভাত রেখেই উঠে চলে এসছে। চাকরি না হয় হচ্ছেনা। যেভাবেই হোক সংসারটাতো ওই টানছে না-কি? এতো কথা শোনানোর কী আছে? মন খারাপ আরও বাড়ল তিশানের। মুখ ফুলিয়ে একটা ঢিল ছুড়ে মারল প্রবাহমান নদীতে।

এরমধ্যেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। বৃষ্টি পছন্দ নয় তিশানের। চারপাশটা ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে যাওয়ার ব্যপারটা ভালো লাগেনা ওর। কিন্তু আজ মন খারাপ আর হতাশার ভারটাই যেন বেশি ছিল। তাই ঠায় বসে রইল সেখানেই। ধীরে ধীরে বৃষ্টির গতি বৃদ্ধি পেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভিজে চুবচুবে হয়ে গেল তিশান। তবুও উঠলোনা ছেলেটা। ওভাবেই বসে একধ্যানে তাকিয়ে রইল নদীর দিকে।

' হ্যালো? আপনিও কী বৃষ্টিতে ভিজতে বেড়িয়েছেন?'

মিষ্টি এক নারী কন্ঠ শুনে চমকে উঠল তিশান। সেই কন্ঠস্বর অনুসরণ করে তাকাল ও। দেখল, একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তিশান ভ্রু কুঁচকে ফেলল। মেয়েটার পরনে একটা কালো কুর্তি আর জিন্স, গলায় একটা নীল ওড়না পেঁচিয়ে রেখেছে। বৃষ্টিতে সম্পূর্ণ ভিজে গেছে সে। ফর্সা শরীরে ভেজা কালো রঙটা বেশ ফুটে উঠেছে। কিন্তু মেয়েটার মুখ অপরিচিত। সে যে এই গ্রামের নয় দেখা মাত্র বুঝতে পারছে তিশান। মেয়েটা হালকা হেসে আগের চেয়ে উঁচু আওয়াজে প্রশ্ন ছুঁড়লো, 'আপনিও কী আমার মত বৃষ্টিতে ভিজতে ভালোবাসেন?'

মেয়েটার প্রশ্নে তিশান মুখ ঘুরিয়ে নিল। নিজের দৃষ্টি আবার নদীর দিকে নিক্ষেপ করে বলল, 'না, আমার বৃষ্টি পছন্দ না।'

মেয়েটা বোধ হয় বেশ অবাক হল। বৃষ্টি পছন্দ না? তবুও এভাবে বসে বসে ভিজছে? পাগল না-কি ছেলেটা? সে দু-কদম এগিয়ে এসে বলল, 'পছন্দ না? তাহলে এভাবে বসে বসে বৃষ্টিতে ভিজছেন যে?'

তিশান মেয়েটার দিকে না তাকিয়েই সোজাসাপ্টাভাবে উত্তর দিল, 'মন ভালো নেই, তাই।'

মেয়েটা মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, 'তারমানে আপনিও বৃষ্টি পছন্দ করেন। কারণ মন খারাপ বলে আপনি বৃষ্টিতে ভিজছেন। আর বৃষ্টিতে ভিজলে আপনার মন ভালো হয়ে যায়। সেজন্যই ভিজছেন নিশ্চয়ই? তাহলে মিথ্যে বললেন কেন?'

তিশান আবার ভ্রু কুঁচকে তাকাল মেয়েটার দিকে। ও নিজে বলছে ওর বৃষ্টি অপছন্দ। কিন্তু মেয়েটা কীসব যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করেই ছাড়ছে ওর বৃষ্টি পছন্দ। অদ্ভুত! মেয়েটা কোন যুক্তিবিদ না-কি? যা ইচ্ছে হোক, ওর তাতে কী? বৃষ্টির গতি অনেকটাই কম এখন। মেয়েটা হুট করেই তিশানের পাশে বসে পরল। এক গাল হেসে তিশানের দিকে তাকিয়ে বলল, ' আমি মহুয়া। আপনি?'

তিশান চমকালো। চেনা নেই, জানা নেই, একটা অপরিচিত একটা ছেলের পাশে বসে পরল? তাও এমন পরিবেশে? তারওপর বকবক করেই যাচ্ছে। গ্রামের লোকজন দেখলে কী ভাববে? চাইছেটা কী এই মেয়ে? এসব ভাবনা মনে থাকার পরেও সৌজন্যতার খাতিরে বলল, 'আমি তিশান।'

' বাহ ভালো নাম তো।'

' আপনার নামটাও সুন্দর।'

' থ্যাংক ইউ। বাই দা ওয়ে, আমি কী আপনাকে তুমি করে বলতে পারি? আমার না "আপনি" বেশিক্ষণ পোষায় না।'

তিশান কোন উত্তর দিলোনা। তবে মেয়েটার এতোটা মিশুক স্বভাব মন্দ লাগল না ওর। মহুয়া তিশানের মৌনতাকেও সম্মতি ধরে নিয়ে বলল, ' জানো আমার অনেকদিনের ইচ্ছে ছিলো গ্রামে থাকার। কিন্তু কয়েকবছর যাবত বাংলাদেশেই আসা হয়না। দুদিন আগে বাংলাদেশে এসছি আর আজ সোজা গ্রামে। এটলাস্ট!'

তিশান বুঝতে পারল মহুয়া বিদেশে থাকে। এইজন্যই এতো খোলা মনের। গ্রামীণ রীতিনীতিও বোঝেনা। বুঝলে খোলা মাঠে এভাবে ভিজতোনা। না এমন ভেজা শরীরে অপরিচিত এক পুরুষের পাশে বসে গল্প জুড়তো। আর এই গ্রামে নতুন এসছে বলেই ও চেনেনা। তবে মেয়েটার কন্ঠস্বর তিশানকে তীব্রভাবে আকৃষ্ট করছে। এতো সুন্দর করে কথা বলে কেন মেয়েটা? মহুয়া আবার বলল, 'দেখো আমার কী ভাগ্য! আসতে না আসতেই কী সুন্দর বৃষ্টি উপহার পেলাম। আসলে এরা হয়তো আমার জন্যেই অপেক্ষা করছিল। তাই আসতে না আসতেই সাদরে বরণ করে নিল। তাইনা?'

তিশানের হাসি পেল। বৃষ্টিও কারো জন্যে অপেক্ষা করে বুঝি? বর্ষাকালে যে এখানে প্রায় রোজই বৃষ্টি হয় মেয়েটা কী জানে না? বোধ হয় না। মেয়েটার এই ভুল ধারণা ভেঙ্গে দিতে মোটেও ইচ্ছে করল না তিশানের। কেন যেন, কল্পনার জগতে বিচরণকারী এই মেয়ের বাচ্চাসুলভ কথাই ওর বেশ ভালো লাগছে। প্রথমে বিরক্ত লাগলেও এখন মেয়েটার কথাবার্তায় মনটা নিমেষেই ভালো হয়ে গেল ওর। মেয়েটা খুব মিশুক আর মিষ্টি। ওর প্রতিটা বাক্যেই যেন মন ভালো করার ঔষধ আছে। তিশান এবার নিজেই প্রশ্ন করল, ' বৃষ্টি এতো ভালো লাগে?'

মহুয়া উচ্ছসিত কন্ঠে বলল, 'ভীষণ ভালো লাগে। যাদের বৃষ্টি ভালো লাগেনা তারা আসলে বৃষ্টিকে অনুভব করতেই পারেনা। আপনিই ভাবুন, এতো বিশাল আকাশ, সেখানে ভেসে বেড়ানো সুন্দর সুন্দর মেঘ, আর সেই মেঘ গলে পরা অসংখ্য পানির ফোটা আমাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। কত চমৎকার না ব্যাপারটা?'

তিশান হাসলো। অনেকটা সময় পর মুখে হাসি ফুটে উঠল ওর। মেয়েটার চঞ্চলতা, আর এতো সুন্দর বাচনভঙ্গি ওর মন নিমেষেই ভালো করে দিলো। তিশান এবার হাসি মুখেই প্রশ্ন করল, 'এখানে কোথায় এসে উঠেছেন আপনি?'

' আমি নানাবাড়ি এসছি। ইদ্রিস মাদবরের বাড়ি চেনো নিশ্চয়ই? ওটাই। একমাসের জন্যে বেড়াতে এসছি।"

' ও, আপনি চেয়ারম্যান সাহেবের নাতনি?"

' হ্যাঁ। আর হ্যাঁ, তুমি এসব আপনি-টাপনি বাদ দিয়ে তুমি করেই ডাকো আমাকে। না হলে নিজেকে সিনিয়র সিটিজেন বলে মনে হচ্ছে।'

তিশান শব্দ করে হাসল। বলল, ' আচ্ছা।'

' এভাবে বসে বসে ভিজতে ভালো লাগে না-কি? চলো না হাঁটি?'

মেয়েটা এমনভাবে বলল, তিশান 'না' করতে পারল না। না করার ইচ্ছাও ছিলোনা। তিশান নিজের শার্টটা খুলে ফেলল। খানিকটা ইতস্তত করে সেটা মহুয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ' এটা ওপর দিয়ে পরে নাও। এটা গ্রাম তো, এভাবে দেখলে লোকে খারাপ বলবে।'

মহুয়া বিস্ময় নিয়ে নিজের দিকে তাকাল। সরল কন্ঠে বলল, 'কেন? আমিতো ছোট কোন পোশাক পরিনি?'

' না, তা পরোনি। কিন্তু তুমি ভিজে আছো।'

' তো?'

তিশান ঠিক কী বলে ব্যপারটা বোঝাবে মহুয়াকে সেটা বুঝতে পারছে না। তাই নিজেই শার্টটা মহুয়ার গায়ে জড়িয়ে দিল। মহুয়া ড্যাবড্যাবে চোখে তাকিয়ে রইল তিশানের দিকে। তিশান মহুয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে হাঁটা শুরু করল। মহুয়া কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে দ্রুত পদে এগিয়ে গিয়ে তিশানের পাশ দিয়ে হাঁটতে শুরু করল। 

মহুয়া বকবক করেই যাচ্ছে আর তিশান শুধু ওর কথার সাথে 'হুঁ, হ্যাঁ' করছে। কিন্তু মেয়েটার কথা শুনে ওর অদ্ভুতরকম ভালোও লাগছে। যদিও মেয়েটার বেশিরভাগ কথারই বিষয়বস্তু ছিল গ্রামের সৌন্দর্য, ওর কোন জিনিসটা কত ভালো লেগেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। ধীরগতির বৃষ্টি এখনো ভিজিয়ে দিচ্ছে ওদের। কিন্তু প্রথম দেখায় কারো সাথে এতো মিশে যাওয়া যায়, এতো কথা বলা যায় সেটা তিশান জানতোনা। তিশান একটু পরপর আড়চোখে মহুয়ার দিকে তাকাচ্ছে। মহুয়াকে দেখতে দেখতে অজান্তেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটছে ওর।

বৃষ্টি থেমে গেছে বেশ কিছুক্ষণ আগেই। ওরা এখনো হাঁটছে। হঠাৎই পেছন থেকে 'মহুয়া' বলে কেউ ডেকে উঠল। ওরা দুজনেই পেছনে তাকালো। মহুয়া দেখল ওর মামী রেশমা দাঁড়িয়ে আছে। মহুয়া সাথে সাথেই চোখ বন্ধ করে জিবে কামড় দিল। ও বাড়িতে কাউকে না বলেই বেড়িয়ে চলে এসছিল। নিশ্চয়ই সবাই খুঁজে মরেছে। রাস্তাটা কাঁদাময়। রেশমা দুহাতে নিজের শাড়িটা একটু উঁচুতে তুলে এগিয়ে এসে বলল, 'তুমি এখানে? জানো সবাই কত চিন্তা করছে? এমনিতেই এই গ্রামের কিছুই চেনোনা। তারওপর বাইরে এতো বৃষ্টি। চল বাড়ি চল।'

বলে একবার তিশানের দিকে তাকিয়ে মহুয়ার হাত ধরে হাঁটা দিল। তিশান তাকিয়ে রইল মহুয়ার যাওয়ার দিকে। মহুয়াও একবার ফিরে তাকাল। একটু দূরে গিয়েই রেশমা মহুয়াকে বলল, 'এসব ছেলেদের সাথে যতটা সম্ভব দূরত্ব রেখে চলবে বুঝলে। এটা গ্রাম, বিদেশ না। এসব ছেলেরা কিন্তু ভালো হয়না। একা পেয়ে কোন ক্ষতি করে দিলে?'

মহুয়া কোন উত্তর দিলোনা। ওর তো তিশানকে ভালোই লেগেছে। খারাপ কিছুই মনে হয়নি। মহুয়া চোখের আড়াল হতেই তিশান একবার আকাশের দিকে তাকালো। ডান হাত দিয়ে ভেজা চুলগুলো নেড়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল এবার। এখন মনটা বেশ ফুরফুরে হয়েছে। খিদেও পেয়েছে বড্ড। 

!!২!!

তিশানদের ঘরটা টিনের। চৌচালা ঘর। মাঝখানে টিন দিয়ে দুটো রুম বানানো হয়েছে। বাড়ি ফিরতেই তিশান দেখল, উঠানে বসানো মাটির চুলায় রান্না করছে ওর মা। ভেতরে গিয়ে একটা গামছা নিয়ে বেড়িয়ে এসে তিশান বলল, 'মা ভাত বাড়ো। আমি দু-মিনিটে গোসল করে আসছি।'

আমেনা তিশানের দিকে তাকিয়ে কর্কশ গলায় বলল, 'তহন তো খুব অর্ধেক থাল ভাত ফালাই উইঠা গেলি। কী পাইছত আমারে? সারাদিন তর ভাতই বাড়মু আমি? আমার বহুত কাম আছে। পারমুনা এহন।'

তিশান আমেনার কথায় পাত্তা দিলোনা। চলে গেল গোসল করতে। গোসল সেড়ে এসে দেখল, ঠিকই পাটি বিছিয়ে থালায় খাবার ঢেকে রেখে দিয়েছে আমেনা। তিশানও চুপচাপ খেতে বসে গেল। খুব খিদে পেয়েছিল। তবে সারাটাদিনই মহুয়ার কথা মনে পরেছে ওর। কিছুক্ষণ পরপর মেয়েটার খিলখিল করে হেসে ওঠার শব্দটা কানে বাজছিল বিরতিহীনভাবে।

!!৩!!

সকাল সাড়ে সাতটার মত বাজে। আকাশটা আজ বেশ পরিষ্কার। গাঢ় নীল আকাশে সকালের উজ্জ্বল রোদ ঝলমল করছে। রোদের আলো পেয়ে ভেজা সবুজ প্রকৃতি আরও বেশি সতেজ হয়ে উঠেছে। খানিক বাদে বাদে গবাদিপশুদের আওয়াজ ভেসে আসছে।

তিশান কম দামি সস্তার একটা জিন্সে আর সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি পরে বেরিয়েছে। কোমরে একটা গামছা বেঁধে ওর সবজির ক্ষেতটার আগাছা পরিস্কার করছে। এরমধ্যেই হঠাৎ কেউ ডেকে উঠল, 'তিশান?'

নিজের নাম নেওয়াতে কাচি চালানো থামিয়ে সামনে তাকাল তিশান। তাকিয়ে বেশ অবাক হল। কারণ মহুয়া দাঁড়িয়ে আছে। মহুয়ার হাতে ওর সেই শার্ট। ও সঙ্গেসঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, 'তুমি এখানে?'

মহুয়া এগিয়ে এলো। তিশানের দিকে শার্টটা এগিয়ে দিয়ে বলল, 'তোমার শার্টটা ফেরত দিতে এসছিলাম।'

' কিন্তু আমার বাড়ি কীকরে চিনলে?'

' আমার মামাতো বোনের সাথে এসেছি। ওর প্রাইভেট পড়া ছিল। যাওয়ার আগে আমাকে পৌঁছে দিয়ে গেছে।'

' একটা শার্ট ফেরত দেওয়ার জন্যে এতো কষ্ট করে আসার দরকার ছিলোনা।'

' আরে, শার্ট ফেরত দেওয়াতো বাহানা। এই সুযোগে গ্রামটা আরেকটু ঘুরতে পারব সেজন্যই এলাম।'

তিশান হাসল। গামছাটা কোমর থেকে খুলে গলায় ঝুলিয়ে বলল, 'এতো প্রকৃতি প্রেম? এটা কী বিদেশে থেকেছো বলে?'

মহুয়া সবজির গাছগুলোতে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, 'উমহুম, যখন দেশে ছিলাম তখনও ভালো লাগত। এই ক্ষেতটা তোমার?'

' হ্যাঁ আমারই। আসলে এই জমিটা আমার বাবার। আমার বাবাই আগে বিভিন্ন সবজির গাছ লাগাতো। এখন আমি লাগাই।'

' তোমার বাড়িতে আর কে কে আছে?'

তিশান হাসি মুখে গামছায় হাত মুছতে মুছতে বলল, ' আমার মা আর আমি। বড় বোন আছে একটা, বিয়ে হয়ে গেছে তাঁর।'

মহুয়া একটু অবাক হয়ে বলল, 'একটু আগে যে বললে তোমার বাবা এখানে সবজি চাষ করতেন?'

' করতেন। কিন্তু এখন করেন না। উনি মারা গেছেন পাঁচবছর হল।'

কথাটা বলতে বলতে মন খারাপ হয়ে উঠল তিশানের। মহুয়া বুঝতে পারল ব্যাপারটা। এখন 'স্যরি, বুঝতে পারিনি' বললে লেইম সিমপ্যাথি বলে মনে হবে। তাই মহুয়া কিছু একটা ভেবে বলল, ' খুব সুন্দর কিন্তু। আচ্ছা দূরে আরও ক্ষেত দেখতে পাচ্ছি। আমাকে ঘুরিয়ে দেখাবে?'

তিশান মনে মনে খুব অবাক হচ্ছে মুহুয়াকে দেখে। এরকম বড় ঘরের একটা মেয়ে ওর সাথে পায়ে হেটে ক্ষেতে ঘুরতে চায়? এরকম অদ্ভুত কেন মেয়েটা? কিন্তু এবারও না করতে ইচ্ছে করছেনা তিশানের। তবুও বলল, ' এখন?'

' হম, কেন? তোমার কাজ আছে এখন?'

' না, তেমন কোন কাজ নেই। আজ বাড়িতে বলে এসছো তো?'

' হ্যাঁ, আজ ফোনও আছে আমার সাথে। চলো না?'

' এক মিনিট দাঁড়াও, আমি আসছি।'

বলেই দৌড়ে গেল বাড়ির দিকে। তিন/চার মিনিট পর ওপরে একটা শার্ট পরতে পরতে বেরিয়ে এলো তিশান। এরপর দুজনেই দূরের ক্ষেতগুলোর উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করল। হাঁটতে হাঁটতে মহুয়া বলল, 'আচ্ছা তুমি কী কর? মানে প্রফেশন কী?'

তিশান হেসে ফেলল। হাসিটায় হয়তো একটু তাচ্ছিল্যই মিশে আছে। মহুয়া ভ্রু কুচকে বলল, 'হাসছো যে?'

'বিশেষ কিছু না। কয়েকটা টিউশন করাই। আর ঐ সবজি চাষ। কয়েকটা কম্পানিতে জব ইন্টারভিউ দিয়েছি, কিন্তু হয়নি। আর দু-বার বিসিএস দিয়েছি কিন্তু টিকতে পারিনি।'

তিশান মুখে হাসি ফুটিয়ে কথাগুলো বললেও তার মধ্যে যে নিজের প্রতিই তাচ্ছিল্য মিশ্রিত ছিল সেটা বুঝতে মহুয়ার সময় লাগেনি। তাই আর কিছু বলল না।
তিশান মহুয়াকে নিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত দেখাচ্ছে। মাঝেমাঝেই মহুয়া বিভিন্ন গাছের নাম জিজ্ঞেস করছে। সবজির নাম জিজ্ঞেস করছে। আর তিশানও বেশ খোশমেজাজে মহুয়াকে গাছ, সবজি চিনিয়ে দিচ্ছে। বেশ ভালো লাগছে ব্যাপারটা ওর। নিজেকে বেশ জ্ঞানী জ্ঞানী মনে হচ্ছে। মহুয়াও খুব খুশি। ও চারপাশ দেখতে দেখতে খুশি হয়ে বলল, ' এই শোন। আমি যেই একমাস এখানে আছি। এই এক মাস তুমি আমাকে পুরো গ্রামটা ঘুরিয়ে দেখাবে। আশেপাশের গ্রামেও নিয়ে যাবে কিন্তু।'

তিশান অবাক চোখে মহুয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, 'আমিই কেন?'

' তুমি খুব ভালো এক্সপ্লেইন কর সবকিছু। আমার বেশ ভালো লাগে।'

' তোমার বাড়ির লোক কিছু বলবে না?'

' ওদের আমি সামলে নেব।'

বলে মহুয়া খানিকটা এগিয়ে গেল। ও খুব উপভোগ করছে এই প্রকৃতিকে। বাতাসে মহুয়ার মসৃণ খোলা চুলগুলো উড়ছে। মুখে চমৎকার এক হাসি। দেখতে বেশ স্নিগ্ধ লাগছে ওকে। তিশান হাত ভাজ করে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মহুয়ার দিকে। হঠাৎ করেই মনের মধ্যে অদ্ভুত কিছু অনুভূতি খেলা করছে ওর। কিছুক্ষণ পর হঠাৎই তিশানের হুশ ফিরল। কী সব চিন্তা করছিল ও? এই ভালোলাগার কোন মানে নেই। ভবিষ্যৎ নেই। কোথায় মহুয়া আর কোথায় ও। এসব আকাশকুসুম কল্পনা। দ্রুতই নিজের মস্তিষ্ক থেকে এসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলল তিশান। যথাসম্ভব স্বাভাবিক হয়ে মহুয়ার দিকে এগিয়ে গেল।

!!৪!!

প্রায় বেলা করেই বাড়ি ফিরল মহুয়া। বসার ঘরে এসে দেখে ওর দুই মামা বাদে বাড়ির সকলেই উপস্থিত। ওর মামারা যার যার কাজে গেছেন। ইদ্রিস মাদবর পেপার পড়তে পড়তে চা খাচ্ছিলেন। এটা ওনার রোজকার অভ্যাস। এই সময় খবরের কাগজ পড়তে পড়তে চিনি ছাড়া দুধ চা খায় সে। মহুয়াকে দেখে ইদ্রিস চায়ের কাপটা রেখে বলল, 'কী ব্যাপার মেমসাহেবা? সকাল সকাল কোথায় গিয়েছিলে।'

' কোথাও না নানুভাই। তোমাদের গ্রামের ক্ষেত দিয়েই ঘুরছিলাম। কত সুন্দর সুন্দর ক্ষেত ছিল! দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়।'

' তুমিতো এখানের কিছুই চেনোনা। একা একা ঘুরলে কীভাবে?"

' একা একা ঘুরেছি কে বলল? তিশান নামের ছেলেটা আছেনা? ওর সাথেই ঘুরেছি। ছেলেটা কিন্তু খুব ভালো।'

মহুয়ার মা নিলু খানিকটা শক্ত কন্ঠে বলে উঠল, ' অপরিচিত একটা ছেলের সাথে এভাবে একা একা বেড়িয়েছো কেন? এটা নিউইয়র্ক নয় মহু। এখানে কে কেমন তুমি জানো?'

রেশমাও মাথায় শাড়ির আচলটা টেনে এগিয়ে এসে বলল, 'তোমাকে তো কাল বললাম মহুয়া, এসব ছেলেদের কাছে ঘেঁষতে দিওনা। এরা সুবিধার হয়না। তবুও আজ গিয়েছিলে?'

মহুয়া ভ্রু কুঁচকে ফেলল। সবাই এভাবে কেন বলছে? ওর তো তিশানকে খুব ভালো একটা ছেলে বলেই মনে হলো। ইদ্রিস বলল, 'এতো চিন্তার কিছুই নেই। ওকে চিনি আমি। ছেলে ভালো। আমায় খুব শ্রদ্ধা করে।'

মহুয়া বেশ খুশি হল ইদ্রিসের কথা শুনে। উচ্ছসিত কন্ঠে বলল, 'জানো নানাভাই, ও আমাকে বলেছে পুরো গ্রাম ঘুরে দেখাবে। আসলে আমিই বলেছিলাম ওকে। আমিতো কখনও সেভাবে গ্রাম দেখিনি তাই।'

নিলু সাথেসাথেই আপত্তি তুলল, 'না, একদম না। পাগল হয়ে গেছো তুমি? কেমন না কেমন ছেলে। ওর সাথে কোথাও বের হবেনা। খুব বেশি ঘুরতে ইচ্ছে হলে তোমার ভাইদের বলে দেব। ওরাই ঘুরিয়ে দেখাবে।'

অন্ধকারে ছেঁয়ে গেল মহুয়ার সুন্দর মুখখানা। অনেকটা মন খারাপ করে বলল, 'কিন্তু ভাইয়ারা তো রোজ অফিসে যায়।'

এবার মহুয়ার বাবা ইজহার খান বলল, 'আচ্ছা, এভাবে বলছো কেন? এলাকার ছেলেই তো। এখানকার সবাই চেনে বাবাকে। ওর সাথে খারাপ কিছু করার সাহস করবেনা। মেয়েটা একটামাস গ্রামে আছে, ঘুরে দেখুক। আবার কতবছর পর আসবে ঠিক আছে? মাস শেষে না হয় ছেলেটার হাতে কয়েকটা টাকা ধরিয়ে দেব।'

ইদ্রিসও সম্মতি জানিয়ে বলল, 'হ্যাঁ, এমনিতেই ছেলেটা বেকার। এই সুযোগে কয়েকটা টাকাও রোজগার করতে পারবে। এই নিয়ে আর কথা বাড়িও না।'

কেউ আর কিছু বলার সাহস পেলোনা। আসলে ইদ্রিসের মুখের ওপর কেউ কিছু বলার সাহস পায়না এ বাড়িতে। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেনে নিতে হলো সবাইকে। তবে মহুয়া খুব খুশি হয়েছে। পুরো গ্রামটাটা ঘুরে ঘুরে দেখবে। উত্তেজনায় অস্থির হয়ে উঠছে ও।

!!৫!!

আজ বেশ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পরেছে তিশান। শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগছে আজ। খুব অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। কাল রাতে যদিও বৃষ্টি হয়েছে। তবুও তুলনামূলক বেশিই শীত শীত লাগছে। তারপরও কলের ঠান্ডা পানি দিয়ে বেশ লম্বা সময় নিয়ে গোসল করল তিশান। ধুয়ে রাখা বেশ ভালো একটা শার্ট আর জিন্স বের করে পরে নিলো। এরপর সুন্দর করে চুল আচড়ে, টিনের বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখা ছোট্ট আয়নাটা নিজেকে ভালোভাবে দেখে নিলো একবার। বেশ ভালোই লাগছে। ঠান্ডায় হাতের তালু ঘষতে ঘষতে পাশের রুমে গেল তিশান। মাটিতে বিছানো পাটিতে বসে বলল, 'মা, তাড়াতাড়ি খেতে দাও আমাকে। বের হবো।'

আমেনা ভাতের পাতিল এনে সামনে রাখতে রাখতে বলল, 'কী ব্যাপার? আজকে এতো সকাল সকাল কই যাইতাছোস?'

' চেয়ারম্যান সাহেবের নাতনি এসছে না? ওকেই একটু আশপাশ দিয়ে ঘুরিয়ে দেখাব।

' এইহানে আর দেহনের কী আছে?'

' বিদেশে থেকেছে, এরকম পরিবেশ আগে পায়নিতো। তাই এতো আগ্রহ। কাল এতো করে বলল, ভাবলাম বসেই তো আছি, একটু ঘুরিয়ে দেখাই। একি? শুধু ডাল কেন?'

আমেনা কর্কশ কন্ঠে বলল, 'তো এখন বিরিয়ানি রাইন্ধা দিমু? শ্যাষ কবে বাজার করেছিলি? যা আছে তাই দিছি।'

তিশান বিরক্তি নিয়ে খেতে শুরু করে দিল। আমেনা তীব্র আফসোস নিয়ে বলল, 'এতো লেখাপড়া কইরা হইল টা কী? কোন চাকরি-বাকরির বালাই নেই। এমনে কতদিন? এমন বেকার পোলার হাতে কোন বাপ মাইয়া দিবো? তারওপর ঋতুর বিয়াতে যে হার দেওয়ার কথা আছিল সেইটাও দেওয়া হয়নাই। দু-দিন পর যখন মাইয়াটারে ফেরত পাঠাইয়া দিবো তখন বুঝবি। কোন কামেরইতো হইতে পারলি না। নবাবজাদা আবার ডালভাত দেইখা নাক কুচকায়।'

তিশান ভ্রু কুঁচকে তাকাল। বিরক্ত হয়ে বলল, 'ভুল হয়ে গেছে। আর বলব না, মাফ চাই। তবুও খাওয়ার সময় মাথা নষ্ট করোনা আমার। রোজ রোজ ভালোলাগেনা এসব আর।'

আমেনা আর কিছু বলল না। তিশান কোনরকমে খেয়ে উঠে বেড়িয়ে গেল ঘর ছেড়ে। আমেনার সাথে রোজই একদফা কথা কাটাকাটি হয় ওর। ঝগড়ার মূল বিষয় হল তিশানের চাকরি। কিন্তু ছেলেটারও দোষ কী? চেষ্টাতো কম করছে না ও। কিন্তু আজকাল চাকরির বাজারে যোগ্যতার চেয়ে পকেটের ভারটাই বেশি প্রাধান্য পায়। সেটা আমেনাকে কীভাবে বোঝাবে? আর বিসিএস এ টেকার জন্যেও পড়াশোনায় যথেষ্ট সময় দিতে হয়। কিন্তু পরিবারের খরচের টাকা জোগাড় করার চাপে সেই সময়টা কই?

!!৬!!

বাড়ি থেকে সোজা ইদ্রিস মাদবরের বাড়ির গেইটের সামনে পৌঁছলো তিশান। দেখল যে মহুয়া ওখানেই দাঁড়িয়ে পাইচারী করছে। বারবার হাত ঘড়ির দিকে দেখছে। তিশান মৃদু হেসে গিয়ে গেল মহুয়ার দিকে। মহুয়াও তিশানকে দেখে হেসে ফেলল। নিজেও খানিকটা এগিয়ে এসে বলল, ' যাক এলে তাহলে। আমিতো ভেবেছিলাম আসবেনা?'

তিশান মহুয়ার মুখটা ভালোভাবে লক্ষ্য করে বলল, 'সারারাত ঘুমাও নি না-কি? মনে হচ্ছে যাবে বলে এখানেই বসে ছিলে?'

মহুয়া মুখ গোমড়া করে বলল, 'আরে না। আসলে এখানে ঘুমাতে প্রবলেম হচ্ছে খুব। নিউইয়র্ক এর সাথে এখানকার টাইম ডিফারেন্স অনেক তো। তাই এডজাস্ট করতে সমস্যা হচ্ছে।'

' আচ্ছা চল।'

তিশান আর মহুয়া পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করল। মাটির রাস্তা আর রাস্তার দুপাশ দিয়ে বড় বড় কাঠগাছ। সম্পূর্ণ মন ভালো করার মত পরিবেশ। তারওপর মহুয়া তো আগে এসব দেখেনি। তাই ওর অনেক বেশি ভালো লাগছে। মহুয়া চারপাশ দেখছে আর ওর ক্যামেরায় বন্দি করে রাখছে আশেপাশের সৌন্দর্য। ছবি তুলতে তুলতে মহুয়া বলল, 'আজ কোথায় যাচ্ছি আমরা?'

তিশান এতক্ষণ মহুয়ার দিকেই তাকিয়ে ছিল। এই সামান্য জিনিসে এতো আনন্দ মন কাড়ছিল ওর। কিন্তু মহুয়ার ডাকে যেন হুশ ফিরল। নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল, 'কালতো ক্ষেত ঘুরে দেখেছো। আজ গ্রামের রাস্তাগুলোই দেখাই? রাস্তার আশপাশ দিয়ে অনেককিছুই দেখতে পাবে। আসলে বিকেলে আমাকে আবার পড়াতে যেতে হবে তো তাই__'

' কোন সমস্যা নেই। আমি তো এখানেই আছি। আস্তে আস্তে সব দেখব।'

গ্রামের রাস্তাগুলো দিয়েই অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলো দুজন। মহুয়া প্রচুর ছবি তুলছে। কারণ এরকম পরিবেশের সাথে ও খুব একটা পরিচিত নয়। আর তিশান মহুয়ার অপরিচিত জিনিসগুলো ওকে ভালোভাবে চিনিয়ে দিচ্ছে। মহুয়া ছবি তুলতে তুলতেই বলল, 'তুমি কী রেগুলার টিউশন করাও?'

' হ্যাঁ। বেকার ছেলে। সংসার তো চালাতে হবে।'

' কে বলেছে তুমি বেকার? ছাত্র পড়ানোটাও একটা কাজ। আই থিংক চাকরির চেয়েও সম্মানের কাজ। টাকা হয়তো কিছুটা কম পাওয়া যায়। কিন্তু তারমানে এটা নয় ছেলেটা বেকার।'

' সবাইতো বেকারই বলে।'

' সবাই কী বলে আই ডোন্ট কেয়ার। আমার পয়েন্ট অফ ভিউ দিয়ে দেখলে তুমি কাজ করছ। ইন ফ্যাক্ট যথেষ্ট সম্মানের কাজ করছ। ইউ অলসো শুডেন্ট কেয়ার অফ দেম।'

তিশান মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মহুয়ার দিকে। মেয়েটার বলা এই কথাগুলো যেনো ওর একটু বেশিই মন কাড়ল। ভালোলাগা নামক অনুভূতিটা যেন আরো আষ্টেপৃষ্ঠে ধরল তিশানকে। মহুয়া তাকিয়ে দেখল তিশান মহুয়ার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। একদৃষ্টিতে। মহুয়া ভ্রু নাচিয়ে জানতে চাইল, কী হয়েছে? তিশানও মাথা নেড়ে বোঝালো কিছুই না। মহুয়া বলল, 'এখানে কোথাও রেস্টুরেন্ট নেই? খিদে পেয়েছে খুব।'

তিশান আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে বলল, 'এসব এলাকায় রেষ্টুরেন্ট পাবেনা। তবে বাজারের দিকে আছে ছোট একটা। কিন্তু খুব দূরে। আজ যাওয়া যাবেনা। সামনে একটা হাই স্কুল আছে। ওখানে ফুচকা, চটপটি, ঝালমুড়ি, আইসক্রিম সবই পাওয়া যায়। কিন্তু তুমি ওসব খাবে?'

' কেন খাবোনা? এগুলো মানুষ খায়না?'

তিশান হেসে ফেলল মহুয়ায় কথায়। তারপর হাতের ইশারায় রাস্তা দেখিয়ে বলল, 'চল!' 

স্কুলে গিয়ে মহুয়া সবকিছু দেখে বলল ও ঝালমুড়ি খাবে। কারণ ফুচকা আগে খেলেও কখনও ঝালমুড়ি খায়নি। কিন্তু ঝালমুড়ি খেতে গিয়ে বাঁধল বিপদ। ঝালে মহুয়ার অবস্থা নাজেহাল। সেটা দেখে তিশানের সে-কি হাসি। হাসতে হাসতে খেয়াল করল যে ঝালে অস্থির অবস্থাতেও মহুয়াকে খুব সুন্দর লাগে। কিন্তু হঠাৎ এটাও খেয়াল ওর হাসির দিকে থমকানো চোখে তাকিয়ে আছে বিদেশে বড় হওয়া এই সুন্দরী রমনী।

!!৭!!

এভাবেই দিন কাটতে লাগল। তিশান মহুয়াকে নিয়ে প্রায়ই ঘুরতে বেড় হয়। আশেপাশের গ্রাম, বিভিন্ন সবজির ক্ষেত, ইটের ভাটা, নদীর বিভিন্ন পার, কলাবাগান, কাঠবাগান সবকিছুই একটু একটু করে ঘুরিয়ে দেখিয়েছে মহুয়াকে। আর এই ছোট ছোট জিনিসগুলো দেখে মহুয়া কতটা খুশি হতো তা ভাবার বাহিরে। আস্তে আস্তে ওদের দুজনের মধ্যে বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেল। সময়ের সঙ্গে সেই বন্ধুত্ব গভীর হলো। মহুয়াতো তিশানের সাথে এতোটাই ভালোভাবে মিশে গেছিল যেন খুব পুরোনো বন্ধু। 

প্রথমে মহুয়ার পরিবার ব্যপারটা পছন্দ করছিল না। কিন্তু মহুয়ার আবদারও ফেলতে পারত না। কিন্তু যখন দেখল তিশান নিয়ম করে মহুয়াকে বাড়ি এসে নিয়ে যাচ্ছে, আবার নিরাপদে পৌঁছে দিচ্ছে। আর মহুয়াও ভীষণ খুশি। তখন আর তারা আপত্তি করল না। কিন্তু যত সময় যাচ্ছিল তিশান নামক যুবকের হৃদয় ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিচ্ছিল মহুয়া। সময়ের সঙ্গে সমান তালে বাড়ছিল দুর্বলতা। তিশান বুঝতে পারতো এর পরিণতি ভালো হবেনা। কিন্তু মনের ওপর কী নিয়ন্ত্রণ চলে? একদিন মহুয়া বায়না করে বসল যে নদীর মাঝের ঐ চর দেখতে যাবে। নাছোড়বান্দা টাইপের বায়না ছিল সেটা। তিশান অনেক কষ্টে একটা নৌকা জোগাড় করে মহুয়াকে নিয়ে গেছিল ওখানে। কিন্তু ওখানে পৌঁছতেই আবার বৃষ্টি নামল। সেদিন মহুয়া আর তিশান আবার একসঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজেছিল। তিশানের সেদিন বৃষ্টি মোটেও অসহ্য লাগেনি। বরং ভালো লাগছিল। প্রথমবার। সেদিনই তিশানের কফিনে যেন শেষ পেরেগটা পড়ে। অনুভূতি চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। বুঝতে পারে প্রেমে পরে গেছে মহুয়ার। কিন্তু মহুয়া? তার মনে কী চলছে?

!!৮!!

সেদিন বাড়ি ফিরে তিশান নিজেই নিজেকে বোঝায়। মহুয়ার মতো মেয়ের সাথে ওর কোনভাবেই যায়না। বিলাশবহুল অট্টালিকায় যে মেয়ে বড় হয়েছে সে এই টিনের চৌচালা ঘরে কীকরে থাকবে? তাছাড়া ও বেকার। মহুয়াকে দুবেলা ঠিকভাবে খাওয়ানোর যোগ্যতাও নেই ওর। কিন্তু ভালোবাসা? ভালোবাসা কী এসবের কাছে মূল্যহীন? যদি মহুয়ার মনেও এরকম অনুভূতি বাসা বেঁধে থাকে? ও কী পারবেনা এখানে মানিয়ে নিতে? কিন্তু যদি মহুয়া পারেও ওর পরিবার কী মেনে নেবে? এরকম মনের দ্বিধা-দ্বন্দ্বে কেটে গেল আরও কয়েকটা দিন। দেখতে দেখতে একটা মাস পার হয়ে গেল। 

তিশান আর মহুয়া নদীর পারে ঘাসের ওপর বসে আছে। দুজনেই চুপচাপ। দৃষ্টি নদীর প্রবাহে। তিশান একটু পরপর ঢিল ছুড়ছে নদীতে। বেশ লম্বা সময়ের নীরবতার পর মহুয়া বলে উঠল, 'আমি সামনের শুক্রবার ফিরে যাবো?'

কথাটা শুনে তিশানের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠল। চাপা যন্ত্রণা। অদ্ভুত এক অস্হিরতা। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল, ' ওহ।'

' মিস করবে আমাকে?'

তিশান অবাক দৃষ্টিতে তাকাল মহুয়ার দিকে। আজ মহুয়ার গলার স্বরে কিছু একটা ছিল। স্পষ্ট টের পেয়েছে তিশান। মহুয়া তাকাতেই তিশান চোখ সরিয়ে হাতের নখ দেখতে দেখতে বলল, ' এতোদিন একসঙ্গে ছিলাম। মিসতো একটু করবই।'

' কিছু বলার নেই আমায়?'

তিশান আবার অবাক হল। কিন্তু কোন উত্তর দিলোনা। মহুয়া হঠাৎই একটা অদ্ভুত কাজ করে বসল। তিশানের হাতের ওপর নিজের হাত রাখল। তিশান ভ্রু কুঁচকে তাকাল মহুয়ার দিকে। মহুয়া মলিন এক হাসি দিয়ে বলল, ' আমি কিন্তু খুব মিস করব তোমাকে।'

!!৯!!

রাতের বেলায় গভীর ভাবনায় মজে আছে তিশান। আজকে কেন জানিনা ওর মনে হচ্ছিল মহুয়ার ব্যবহার স্বাভাবিক ছিল না। আচ্ছা মহুয়াও কিছু অনুভব করে ওর জন্যে ? কিন্তু এটা কী সম্ভব? এতদিনে এমনিতেই অনেক দ্বিধাগ্রস্ত ছিল ওর মন। কিন্তু আজ তা আরও বেড়ে গেল। রাত প্রায় দু'টো পর্যন্ত অনেক ভাবল তিশান। দ্বিধা দ্বন্দ্বে ছটফট করল। অবশেষে ঠিক করল, ও ওর মনের কথা মহুয়াকে জানাবে। এরপর যা হওয়ার হবে। অন্তত আফসোস তো থাকবেনা যে ও মহুয়াকে বলেইনি। এতোদিন সাহস না হলেও আজ মহুয়ার আচরণ কিছুটা সাহস জুগিয়েছে ওর মনে। তিশান উঠে বসল। হাত বাড়িয়ে টেবিল থেকে তুলে নিল একটা খাতা। একটা ভালো দেখে পৃষ্ঠা ছিড়ে খাতার ওপর রেখে লিখতে শুরু করল,

' প্রিয় মহু,

মহু! হ্যাঁ এই নামটাতে তোমাকে ডাকার বরাবরই খুব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু ডাকার সাহস করে উঠতে পারিনি। এভাবে ভালোবেসে ডাকতে শুধু কাছের মানুষগুলোই পারে। কিন্তু আমি হয়তো সেই দলে পরার যোগ্য নই। তাই অনেক চেষ্টা করেছিলাম, আমার মনে অনিচ্ছাকৃত জাগা অনুভূতিকে মুছে ফেলতে। কিন্তু পারিনি। সময়ের সাথে সাথে এই অনুভূতি আরও গাঢ় হয়েছে। তোমার আর আমার মধ্যকার এতো পার্থক্য দেখিয়েও, এতো যুক্তি দিয়েও মনকে মানাতে পারিনি। উল্টে মন আমাকে বোঝালো, ভালোবাসতে তো কোন যোগ্যতার প্রয়োজন পরেনা। শুধু প্রয়োজন পরে ভালোবাসার। আচ্ছা? তুমিও কী তাই ভাবো? হয়তো এই চিঠিটা পড়ার পর তুমি আমার সম্পর্কে অনেক খারাপ ধারণা পোষণ করবে। কিন্তু বিশ্বাস কর, এই চিঠির একটা বাক্যও মিথ্যা নয়। এক বৃষ্টিভেজা দুপুরে তুমি আমার জীবনে এসছিলে। আমি বৃষ্টি মোটেও পছন্দ করতাম না। কিন্তু সেদিনের পর থেকে বৃষ্টি ভালো লাগতে শুরু করল। তার সাথে তোমাকেও। আরেক বৃষ্টি ভেজা দুপুরে সেই ভালোলাগা আরও তীব্র রূপ ধারণ করল। হয়তো সেটাইকেই ভালোবাসা বলে। কিন্তু বিশ্বাস করো, নিজেকে যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেয়েছিলাম আমি। নিজের অনুভূতিকেও দমিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম। জোর করে মনকে মানাতে চেয়েছিলাম যে আমি তোমার যোগ্য না। কিন্তু মনের ওপর তো কারো জোর চলেনা, তাইনা? আমারও চলল না। তোমাকে বলতে চাইনি এসব। ভেবেছিলাম মনেই রেখে দেব কথাগুলো। কিন্তু এখন নিজেকে আটকানো দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে। পারলাম না নিজের অনুভূতিকে দমিয়ে রাখতে। সাধারণ মানুষ তো, তাই। সামনাসামনি বলার সাহস আমার নেই। তাই চিঠি লিখছি। আমি জানিনা এটা পড়ে তুমি কী করবে। আমাকে ফিরিয়ে দেবে, নাকি একটা সুযোগ দেবে। সে যাই হোক, কিন্তু আমি নিজের মনকে এটা বলে সান্ত্বনা দিতে পারব যে আমি তোমাকে নিজের মনের কথা বলে দিয়েছি। শুধু এইটুকু অনুরোধ, এই চিঠিটা পাওয়ার পর তুমি সেটাই করবে যেটা তোমার মন বলবে। আমি শুধু তোমার কাছে তোমার হাত চাইতে পারি। তুমি নিজের হাত বাড়িয়ে দেবে কি-না সেই সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ তোমার। 

তিশান।'

মনে যা এসছে লিখে দিয়েছে ও। হয়তো লেখাগুলো বড্ড অগোছালো। স্বাভাবিক, প্রথম প্রেমপত্র তো। একটু হেসে কাগজটা যত্ন করে ভাজ করে রেখে দিল তিশান। কাল এটা মহুয়াকে দেবে। আচ্ছা মহুয়া কী ভাববে চিঠিটা পড়ে? লজ্জায় ওর গাল দুটো কী লাল হয়ে উঠবে? ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফুটে উঠবে? চোখ বন্ধ করে চিঠিটা বুকে জড়িয়ে ধরবে? নাকি রাগে চোখ লালচে হয়ে উঠবে? চিঠিটা দুমড়ে মুচড়ে ফেলে দেবে মাটিতে? কী করবে সে? কেমন প্রতিক্রিয়া হবে তার? এসব নানারকম চিন্তা করতে করতেই একটা নির্ঘুম রাত কেটে গেল তিশানের।

পরেরদিন সকালে একটু তাড়াতাড়ি উঠল তিশান। আজও প্রথমদিনের মত সকাল সকাল গোসল করে নিল। ওর কাছে থাকা সবচেয়ে ভালো জামাটা পরল। এরপর ভাজ করে রাখা সেই চিঠিটায় খুব যত্নে একবার হাত বুলালো। মুচকি হেসে চিঠিটা বুক পকেটে রেখে, না খেয়েই বেড়িয়ে পরল তিশান। আমেনা বেশ কয়েকবার পেছন থেকে ডেকেছে ওকে খেয়ে যাওয়ার জন্যে। কিন্তু তিশান শুনেও শোনেনি। ওকেতো আজ ওর মহুর কাছে যেতে হবে, নিজের মনের কথাটা জানাতে হবে তাঁকে। 

ইদ্রিস মাদবরের বাড়ির সামনে গিয়ে অনেকটা অবাক হল ও। কারণ গেইটের কাছে বড় বড় দুটো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। তিশান ভ্রু কুচকে ফেলল তা দেখে। আস্তে আস্তে গেইট দিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখল সবাই রেডি হয়ে উঠোনে দাঁড়ানো। আর একটা একটা করে লাগেজ গাড়িতে তুলছে। মহুয়াও রেডি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর চোখমুখ গম্ভীর। এসব দেখে হালকা চমকে উঠল তিশান। আজ কী মহুয়া চলে যাবে এখান থেকে? কিন্তু ওর যে অনেককিছু বলার আছে মহুয়াকে। না বলা অনেক কথাই তো রয়ে গেছে তিশানের মনে। সেগুলোর কী হবে? তিশানকে দেখে মহুয়া মুচকি হাসল। এরপর এগিয়ে তিশানের সামনে এসে বলল, 'ভালো হয়েছে তুমি এসছো। আসলে আমি আজই ফিরে যাচ্ছি।'

তিশানের হৃদপিণ্ডে গিয়ে আঘাত করল কথাটা। চারপাশ কেমন উত্তপ্ত হয়ে উঠল। কোনমতে একটা ঢোক গিলল ও। কম্পিত কন্ঠে বলল, 'কিন্তু তোমার তো দুদিন পর যাওয়ার কথা ছিলো তাইনা?'

' হ্যাঁ কিন্তু আজই যেতে হবে।'

' আমাকে ফোন করে জানাতে পারতে তো।'

ফোনের কথা উঠতেই মহুয়ার চোখ-মুখ আবার বিষণ্ন হয়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু করে ফেলল ও। উত্তর দিলোনা। ইজহার খান একটু কাছে দাঁড়িয়েই ওদের কথা শুনছিলেন। সে আরেকটু কাছে এসে তিশানের দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি হেসে বললেন, ' আসলে মহুয়ার বিয়ের ডেটটা এগিয়ে এসছে তো। তাই আরকি তাড়াতাড়ি যেতে হবে। মহুয়ার উড বি আজ নিজে নিতে এসছে আমাদের।'

তিশান বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে একবার মহুয়ার দিকে তাকাল। মহুয়ার চোখেমুখে কোন ভাবান্তর নেই। ও ওর লাগেজ নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। মহুয়ার আগে থেকে বিয়ে ঠিক ছিল? কই? ওকে তো বলেনি? যদিও ও মহুয়ার তেমন বিশেষ কেউ ছিলোনা যে নিজের সব কথাই ওর কাছে শেয়ার করবে। কিন্তু তাও! চারপাশ কেমন গুলিয়ে উঠল তিশানের। ইজহার পকেট থেকে কিছু টাকা বেড় করে তিশানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, 'এটা রেখে দাও। এতোদিন মহুকে নিয়ে ঘোরাফেরা করেছ। তার টিপস। আর শুনলাম তুমি এখনো বেকার। আমার কার্ড দিয়ে দিচ্ছি, তুমি আমার সাথে যোগাযোগ রেখ। একটা ছোটখাটো চাকরি ধরিয়ে দেব।'

বলে পকেট থেকে কার্ড বেড় করতে নিলেই তিশান বাঁধা দিল। মুচকি হেসে ইজহারের হাত ধরে টাকাটা আবার তার হাতে ফিলিয়ে দিয়ে দিয়ে বলল, 'আপনার মেয়ে গ্রামের অতিথি হয়ে এসছিল। আমি শুধু ওকে একটু ঘুরিয়ে দেখিয়েছি সবটা। আমার নিজের ইচ্ছেতেই। এটা আমার জব না যে টাকা নেব। আর রইল চাকরির কথা? কপালে থাকলে নিজের যোগ্যতায় ঠিক একটা চাকরি পেয়ে যাবো। তবে আপনার অনুগ্রহের জন্যে ধন্যবাদ স্যার।"

তিশানের এরকম উত্তরে হালকা অপমানিত বোধ করলেন ইজহার। তাই ওখান থেকে দূরে সরে দাঁড়ালেন গম্ভীর মুখ নিয়ে। এসব গরিব ছেলেপুলেকে ওনাদের মত বড়লোকরা টাকা ছুড়ে দেবে, তারা সেটা নিয়ে চুমু খেয়ে ওনাদের সালাম ঠুকবে। এটাই তো নিয়ম। এদের এতো ব্যক্তিত্ব কেন থাকবে? বিষয়টা ভেবেই বিরক্তিতে তিক্ত হয়ে উঠল তার মন।

 এরমধ্যেই বাড়ির ভেতর থেকে লম্বা করে একটা ছেলে বেড়িয়ে এলো। সুট-বুট পরে রেডি হয়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব উচ্চবংশের ছেলে। সবার তোষামোদ আর কথাবার্তায় তিশানের বুঝতে বাকি রইল না য‍ে এটাই মহুয়ার হবু স্বামী। তবুও নিশ্চিত হতে মহুয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল, 'ইনিই তোমার উড বি?'

মহুয়া একপলক সেই ছেলেটার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বোঝাল হ্যাঁ। মহুয়ার হ্যাঁ টা যেন ওর বুকে ছু*রি চালালো। তিশান একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, 'তোমাদের একসাথে ভীষণ মানাবে।'

মহুয়া রিক্ত দৃষ্টিতে তাকাল তিশানের দিকে। কিন্তু কিছুই বলল না। তিশানের কেমন সবকিছুই ফাঁকা ফাঁকা লাগতে শুরু করল। দম বন্ধ হয়ে আসছে ওর। চোখ জ্বলছে। আচ্ছা এখানে তো খুব অস্বাভাবিক কিছুই হচ্ছেনা। মহুয়ার বিয়ে আগে থেকে ঠিক থাকতেই পারে। আর মহুয়ার মত মেয়েদের বিয়ে তো এরকম ছেলেদের সাথেই হবে। এই অতি স্বাভাবিক বিষয়টাও ওকে এতো কষ্ট, এতো যন্ত্রণা কেন দিচ্ছে? ভেতরটাকে এভাবে কেন পোড়াচ্ছে? মনের যে হাজারো অনুভূতি মেশানো কথা জমা ছিল তা আজ মনেই রয়ে যাবে? না বলা কথাগুলো আজ না বলাই থেকে যাবে?

এরমধ্যেই সবাই একে একে গাড়িতে উঠতে শুরু করে দিল। মহুয়ার ডাক পরতেই মহুয়া তিশানের দিকে তাকিয়ে বলল, 'ধন্যবাদ তিশান। এতো সুন্দর একটা মাস উপহার দেওয়ার জন্যে। এই একটা মাস আমি কখনও ভুলবোনা।'

তিশান কিছু বলল না। মহুয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে হাসল কেবল। মহুয়া মৃদু আওয়াজে বলল, 'আসছি, ভালো থেকো।'

তিশান এবারও কিছুই বলল না। ঠোঁটের মলিন হাসিটা প্রসারিত হল কেবল। মহুয়া পা বাড়াল। ও গাড়ির দিকে যত এগিয়ে যাচ্ছে তিশানের বুকের ব্যথাটা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। নিশ্বাসও ক্রমশ ভারী হয়ে আসছে। গাড়িতে উঠে বসল মহুয়া। তিশান নিচের দিকে তাকিয়ে একটা লম্বা শ্বাস ফেলল। আবার গাড়ির দিকে তাকাতেই দেখতে পেল মহুয়া কাঁদছে। তিশান কিছু বুঝতে পারার আগেই গাড়ি দুটো একে একে ওর সামনে দিয়ে চলে গেল। ও একদৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে রইল গাড়িগুলোর যাওয়ার দিকে। যতক্ষণ দেখা যাচ্ছিল তাকিয়ে ছিল কেবল। গাড়িগুলো চোখের আড়াল হতেই বহু কষ্টে একটা ঢোক গিলল তিশান।

কিন্তু মহুয়া কাঁদছিল কেন? এরপর ভাবল হয়তো নানা-নানীকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছিল না তাই। মাথার চুলগুলো উল্টে ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল তিশান। এই মুহূর্তে কান্নাটা খুব দরকার ছিল। নিজেকে হালকা করার জন্য। কিন্তু কান্নাও আসছেনা আজ। 
কিছুক্ষণ পর আবারও আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি শুরু হল। তিশানের আবার বৃষ্টিকে অসহ্য লাগতে শুরু করল। বৃষ্টি কেন হচ্ছে এখন? কী দরকার? কর্দমাক্ত রাস্তা দিয়ে ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে বাড়িতে ফিরে গেল তিশান। বাড়ি ফেরার পরই আমেনা ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলল, 'আইজ আবার ভিইছা আইছোত? আমারে কী তর চাকর পাইছিস? দিনে দুই-তিনবার তর কাপুড় ধুইতে থাকমু খালি?'

তিশান কোন উত্তর দিলোনা। ভেতরে গিয়ে শার্ট খুলে ফেলল। তখনই পকেট থেকে নিচে পরল সেই চিঠিটা। তিশান চিঠিটা হাতে তুলে দেখল ভিজে চুবচবে হয়ে গেছে। তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে চিঠিটা ফেলে দিতে গিয়েও ফেলতে পারল না ও। অজানা টানে খুব যত্ন করে বিছানায় মেলে দিল শুকানোর জন্যে। এরপর একটা গামছা নিয়ে বাইরে গিয়েগোসল করে নিল।
ওদিকে আমেনা রোজকার মত তিশানের ওপর চিৎকার করেই যাচ্ছে। কিন্তু তিশান কোন উত্তর দিচ্ছেনা আজ। গোসল সেড়ে চুপচাপ নিজের রুমে গেল। আমেনার এবার টনক নড়ল। তিশানতো এভাবে চুপ করে থাকেনা। সবসময় মুখেমুখে উত্তর দিয়ে দেয়। আজ কী হল ছেলেটার? সে দ্রুতপায়ে গিয়ে দেখল তিশান চুপচাপ বিছানায় শুয়ে আছে। আমেনা গিয়ে বিছানায় তিশানের পাশে বসল। তেজ দেখিয়ে বলল, 'কী হইছে কী? খাওন নিয়া কতক্ষণ বইয়া থাকমু? খাইয়া একটু উদ্ধার কর আমারে।'

কিন্তু আমেনাকে অবাক করে দিয়ে তিশান ধীর কন্ঠে বলল, 'মা, তোমার কোলে মাথা রেখে শুই?'

আমেনার বুক কেঁপে উঠল। ছেলে তাঁর এর আগে এমন বায়না কখনও করেনি। সে দ্রুত তিশানের মাথায় হাত রাখল। দেখল ওর গা গরম। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। আমেনা উত্তেজিত কন্ঠে বলল, 'জর আইছে তো? কতবার কইছি এমনে ভিজিস না। কিন্তু আমার কথা আর কিল্লিগা শুনবি? আমি কী মানুষ না-কি?'

তিশান চুপচাপ আমেনার কোলে মাথা দিয়ে গুটিয়ে শুয়ে পরল। আমেনার চোখ ভিজে উঠল ছেলের এমন অবস্থা দেখে। নিশ্চয়ই আজ আবার কেউ কিছু বলেছে। লোকগুলো কী ছেলেটাকে শান্তি দেবেনা? সে তিশানের মাথায় হাত বুলিয়ে কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, 'আইজ আবার কেউ কিছু কইছে না? তুই অগোর কথা কানে নিস কেন? ওরা কী জানে তর ভবিষ্যত? একদিনেই কী সবাই উপরে উইঠা যায় না-কি? দেহিস খুব তাড়াতাড়ি তর চাকরি হইব । একদিন বড় অাফিশ্যার হবি তুই। আমি কইতাছি। প্রতি ওয়াক্ত নামাজ পইড়া আল্লাহর কাছে দোয়া করি। মায়ের দোয়া কবুল হইবনা? অবশ্যি হইব। তুই একদম মন ছোড করবি না।'

তিশান তখনও চোখ বন্ধ করে রেখেছে। বন্ধ চোখ দিয়ে ধীর গতিতে জল গড়িয়ে পড়ছে। আমেনা চোখ মুছতে মুছতে দেখলেন খাটে একটা ভেজা কাগজ বেছানো। তা দেখে তিশানকে জিজ্ঞেস করলেন, 'এইডা কীসের কাগজ রে বাবা?'

তিশান চোখ না খুলেই দুর্বল গলায় বলল, 'কিছুনা মা। একটা চিঠি। না দেওয়া চিঠি।'
.
.
.
সমাপ্ত..........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন