মৃদু হাওয়ায় ভেসে আসে কাঁচা ধানের মৃদু গন্ধ। ইতি খালি চোখে দেখে হাঁটতে লাগল। হঠাৎ শাওন মৃদু গলায় নাম ধরে ডাকল, 'ইতি।'
ইতি ধীর পায়ে হেঁটে যাচ্ছিল হঠাৎ মাথা তুলে পাশের দিকে তাকিয়ে দেখল সে নিরিবিলি রাস্তায় একা। আশেপাশে স্যার নৈই। বিস্তীর্ণ মাঠ আর দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে থাকা বড় বড় গাছ। কাউকে না দেখে ইতি একটু ভয় পেয়ে গেল। শাড়ির কুঁচি তুলে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। স্যার কোন দিকে না তাকিয়ে সোজাপথে হাঁটছেন। ইতি একরকম দৌঁড়ে শাওনের কাছে গেল তারপর জোরে আওয়াজ দিল। শান ভ্রুকুটি করল। সে পেছন ফিরে দেখল সে ইতির থেকে অনেক দূরে। শাওন চোখ নামিয়ে নিল। অনিচ্ছাকৃতভাবে, তার চোখ বারবার ইতির দিকে চলো যায়। মনে হচ্ছে সে একটি চুম্বক এবং লোহা চুম্বক দ্বারা লোহা টেনে নেওয়া হচ্ছে। ইতি হাঁপাচ্ছে। সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, 'আমাকে একা রেখে চলে আসলেন কি করে? আমার কোনো ক্ষতি হলে কি হত?'
'তুমি ধীর গতিতে হাঁটছিলে তাই পিছনে পড়ে গেলে। আমি খেয়াল করিনি।'
শাওন গভীর চিন্তায় পড়ে গেল। ইতির ডাকেও সাড়া মেলেনি। ইতি এগিয়ে এলো। শাওনের হাত নেড়ে বলল, 'স্যার।'
স্তম্ভিত মুখে শাওন বলল, 'হ্যাঁ। কি হয়েছে? আমার হাত ধরে আছো কেন? ছেড়ে দাও, কেউ দেখবে।'
ইতি হাতটা আরেকটু শক্ত করে ধরে বলল,
'ধরেছি আর ছাড়ব না।'
শাওন তার শক্তি ব্যবহার করে তার হাত ছাড়িয়ে নিল।
দুইজন ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেখে চারজন মধ্যবয়সী লোক এগিয়ে এসে হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, 'বাড়ি কোথায়? এখানে কি করছ? বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছ?'
'আমাদের এলাকায় আগে দেখিনি।'
'জুয়ান মাইয়াকে নিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছ? রাখার জায়গা না থাকলে আমাকে দাও।'
ইতি হতভম্ব হয়ে গেল। সে শাওনের পিছনে লুকিয়ে আড়াল হয়ে যায়। শাওন দৃঢ় কণ্ঠে বলল, 'পথ থেকে সরে যাও। আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে।'
'দেখ, এক তো পালিয়ে আসছস আবার জোরে কথা বলছস তোকে তো।'
পরিস্থিতি হাতের বাইরে যাওয়ার আগেই এই জায়গা ছেড়ে চলে যেতে হবে। ইতি সাহস করে বলল, 'আমরা পালিয়ে আসিনি। গ্রামে বেড়াতে আসছি। দয়া করে আমাদের যেতে দিন।'
দ্বিতীয় লোকটি হেসে উঠল। এক হাত দিয়ে ছুঁতে চাইল। 'ওঁকে টাচ্ করার সাহস করবেন না,' শাওন চিৎকার করে উঠল।
'আমি ছুঁবো, ধরব, তুই কী করবি?'
তৃতীয় লোকটি হঠাৎ ইতির হাত চেপে ধরল। ইতি চিৎকার করে উঠল, শাওন দুজনকে ধাক্কা মারল। রাস্তার পাশে একটি বাঁশের গুঁড়ি আছে, হাত দিয়ে বাঁশ টেনে প্রথমে দু’জন পরে চারজনকে পিটিয়ে মাটিতে শুইয়ে দেয়।
ইতি বলল, 'স্যার আপনার হাত দিয়ে রক্ত পড়ছে।'
শাওন তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে। ইতি বলল, 'বাঁশটা ফেলে দিন স্যার। আর মারলে ওঁরা মারা যাবে।'
'যারা নারীদের অসম্মান করে তাদের বাঁচার অধিকার নেই।'
'স্যার তাদের দলের বাকিরা আসার আগেই আমাদের চলে যাওয়া উচিত। আরও ঝামেলা হলে এখান থেকে সহজে বেরোতে পারব না।'
শাওন বাঁশটা ফেলে দিল। তারপর ইতির হাত ধরে দক্ষিণের দিকে দৌঁড়ে গেল। তাদের থেকে অনেক দূরে। দুজনেই হাঁপাচ্ছে, ইতি বলল, 'পানি।'
'এখানে পানি কোথায় পাব? আশেপাশে কোনো দোকান নেই।'
শাওন বুঝতে পারল সে এখনও ইতির হাত ধরে আছে। সঙ্গে সঙ্গে হাত ছেড়ে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। একটু দূরে একটা মেলা চলছে, সেখান থেকে গানের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।
'চলো, এগিয়ে যাই। ওখানে তোমার পানি পাব।'
ইতি কখনো গ্রামের মেলায় আসেনি এসব তার কাছে নতুন। অনেক ঘুরে দেখার পর পানি পাওয়া গেল। ইতির তৃষ্ণা নিবারণ করে দুজনে মেলায় ঢুকল। ইতির বাচ্চারা খেলনা পছন্দ করছে। সে শাওনকে বুদবুদ কিনে দিতে অনুরোধ করল। শাওন তার জন্য একটা কিনেছে। ইতির এত খুশি হয়েছিল যেন সে আকাশের চাঁদ পেয়েছে। কিছুক্ষণ পর সে বুদবুদ ফুঁকছে। শাওন মৃদু হেসে বিড়বিড় করে বলল, 'বাচ্চা মেয়ে।'
ইতি জোরে হেসে উঠল। কিছুক্ষণ পর তাদের দেখা মিললো। তারা মেলায় ঘুরে এখন বেরিয়েছে। রুবেল এগিয়ে এসে বলল, 'চল যাই। শীঘ্রই সন্ধ্যা হবে।'
ইতি দুটো পাখি পালে। সারাদিন পর বারান্দায় তাদের সামনে এসে দাঁড়ালে তারা খাঁচায় হৈচৈ শুরু করে। মনে হয় পুরো একটা দিনের সব অভিযোগই বক্তব্য। তাদের খাবার দেখল, সবকিছু দিয়েছেন নাসিমা বেগম। ইতি রুমে এসে ফোন হাতে নিল, মেসেঞ্জার গ্রুপে বেশ কয়েকজনের মেসেজ, তাদের মধ্যে মুন্নি বলল, 'তোর পাশে স্যারকে দারুণ লাগছিল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রপোজ কর। ভাল বাসা অনেকদিন খালি থাকলে অন্য পাখিরা দখল করতে চাইবে।'
রুবেল বলল, 'ওঁ ঠিক বলেছে।'
ইতি বলল, 'সামনেই আমার জন্মদিন সেদিন প্রপোজ করার কথা ভাবছি।'
শরীর ক্লান্ত বিছানায় শুয়ে ইতি চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ল।
◩
দুদিন পর। হঠাৎ নীরবতা ভেঙে গেল ফোনের রিংটোনে। শাওন তার মায়ের সাথে কথা বলছে, উনি জানায় তার শরীর আগের থেকে অনেক ভালো। ফোনের রিং শুনে শাওন মায়ের রুম থেকে উঠে নিজের রুমে চলে আসে।
'হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম।'
'ওয়া আলাইকুমুস সালাম। স্যার, কেমন আছেন?'
'আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি?'
'ভাল।' সে কিছুক্ষণ থেমে বলল, 'স্যার, আপনি কোথায়?'
'আমি বাসায় আছি। কেন?'
'আমার সাথে বাইরে যাবেন?'
'এই সময়? তুমি কোথায়?'
'আপনার বাড়ি ওই গলির মাথায়।'
'কি? তুমি এই সময়ে সেখানে দাঁড়িয়ে কি করছ? এলাকার সব ছেলে কি ভালো? তোমাকে একা দেখে কেউ এসে যদি বিরক্ত করে?'
'আপনি আসুন।'
শাওনের পরনে ঢিলেঢালা টি-শার্ট ও প্যান্ট। হাত দিয়ে কপালের চুল পিছনে ঠেলে দিল। ইতির সামনে দাঁড়িয়ে বলল, 'এই সময়ে এখানে আসছ কেন?'
'আপনাকে দেখতে।'
'হুহ?'
'গাড়িতে উঠুন।'
'কোথায় যাব?'
'আজ চৌড় রাস্তায় মেলা, গতবার যেতে পারিনি। শুনেছি মেলা সুন্দর তাই আজ যাবো।'
'তাহলে তুমি আমাকে গাড়িতে উঠতে বলছ কেন?'
''আমি একা কেন সব সুন্দর জিনিস দেখব? আমার সাথে আপনাকে দেখাব।'
পাশে একটা মেয়ে আছে। আর সে চুপচাপ হাঁটছে। ইতি ত্যক্ত হয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। স্যার বলল, 'কিছু খাবে?'
'না।'
'ফুচকা?'
'আপনি খাওয়াবেন?'
'হুম।'
'তাহলে খাব।'
এক প্লেট ঝাল ঝাল ফুচকা আর এক প্লেট ঝাল ছাড়া ফুচকা দিতে বলল ইতি। ফুচকাওয়ালা ভুল করে ইতির প্লেটটা স্যারকে দিল আর স্যারেরটা ইতিকে। ইতি জানে ওর স্যার ঝাল খেতে পারে না। শাওনের ফর্সা মুখ এক কামড়ে লাল হয়ে গেল। 'ইতি? ঝাল!'
ইতি এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিল। দুই গ্লাস পানি পান করার পরও ফুসকুড়ি কমেনি। পাশের দোকান থেকে একটা কাপ আইসক্রিম নিয়ে এলো ইতি। শাওন কিছুক্ষণ পর বলল, 'এত ঝাল ফুচকা খাও কী করে? জানো না, বেশি ঝাল শরীরের ক্ষতি করে।'
ফুচকাওয়ালা ভুল করে মারাত্বক ঝাল দিয়েছে। এজন্য শাওন তাকে অনেক কথাই বলেছে। মেলার ফুটপাতের দোকানগুলো সন্ধ্যার পর জমজমাট হয়ে ওঠে। ইতি আর স্যার পাশাপাশি হাঁটছে। হঠাৎ ইতি একটা ঝুড়ির সামনে এসে থামল, একজোড়া কানের দুল ওর খুব পছন্দ হয়েছে। স্যার সঙ্গে থাকায় সে এই নিয়ে কোনো আগ্রহ দেখাল না। কিছুক্ষণ পর স্যার ইতিকে অপেক্ষা করতে বলে হঠাৎ চলে গেলেন। ফিরে এলো একটু পরে। রাত আটটা বাজে। বাড়ি ফেরার জন্য গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। ইতি গাড়ি থেকে নেমে গেল। গেট দিয়ে ঢুকতেই স্যার ডাকলেন, 'ইতি।'
'হ্যাঁ স্যার।'
'এদিকে এসো।'
ইতি খুশিতে এগিয়ে এলো। স্যারের মুখোমুখি দাঁড়াল।
শাওন বলল, 'তোমার হাতটা দাও।'
'হাত? কেন?'
'দাও। বলছি।'
ইতি ডান হাতটা সোজা করল। শাওন তার শার্টের পকেট থেকে কিছু একটা বের করে ইতির হাতের তালুতে রাখল। ইতি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। শাওন বলল, 'রুমে গিয়ে দেখবে, এখন যাও।'
ইতি ডানদিকে মাথা নেড়ে বাড়িতে ঢুকে রুমে চলে গেল। বিছানায় বসে কাগজ খুলছে। উত্তেজনা বাড়ছে। হাত পা কেমন কাঁপছে? ইতি কাগজ খুলে দেখল একটা ঝুমকো কানের দুল যেটা সে একটু আগে পছন্দ করেছিল। ইতির লজ্জা পেল। বিড়বিড় করে বলল, 'স্যার, আমাকে লক্ষ্য করেছিল?
সকাল ১১টা। ২১ ডিসেম্বর।
একমাত্র মেয়ের জন্মদিন। প্রতিবছর বড় করে আয়োজন করে ইফাদ সিকদার। এ বছর তিনি ব্যাপক আয়োজনে ঘর সাজিয়েছেন। সন্ধ্যায় পার্টি। ইতি ধীরে ধীরে রেডি হবে।
বাড়ি অতিথিতে ভরে গেছে। সবাই অপেক্ষা করছে ইতির কেক কাটার মূহুর্তের। হাতে ছুরি নিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে ইতি। স্যার এখনো আসেনি। যে কারণে কেক কাটছে না। ওঁ কত অনুরোধ করেছে, তবুও এখনো আসছে না কেন? ইফাদ সিকদার ও নাসিমা বেগম দুজনেই তাকে আমন্ত্রণ করেছিল। তাহলে আসছে না কেন?
মুন্নি বলল, 'স্যার বোধহয় আসবেন না। তুই কেক কাট।'
ইতি একবার চোখ মেলে মুন্নির মুখের দিকে তাকাল তারপর ছুটে রুমে চলে গেল।
দুদিন কেটে গেল। স্যারের খোঁজ নেই, ফোন বন্ধ, পড়াতে আসছে না। ইতির মন ছটফট করছে, আবদুল চাচাকে নিয়ে স্যারের বাড়ি গলির মাথায় আসলো। গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে লাগল। সে শাওনের বাসা চিনে না, আশেপাশে মানুষকে জিজ্ঞেস করে বাড়িটা দেখল কয়েকবার কলিং বেল বাজানোর পরও কোনো শব্দ নেই। উপর থেকে বাড়িওয়ালা আসলেন। তার কাছ থেকে জানা যায়, স্যার আজ দুদিন ধরে হাসপাতালে আছেন। তার মায়ের অপারেশন হয়েছে। হয়তো সে কারণেই ফোন বন্ধ।
ইতি গাড়ির কাছে ফিরে এল।
পরদিন সকালে শাওন ফোন করল। বাড়িতে আসার পর বাড়িওয়ালা তাকে ইতির কথা জানায়। ইতির ঘুম ছুটে গেল উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল, 'স্যার আপনি ঠিক আছেন?'
'হ্যাঁ আলহামদুলিল্লাহ। স্যারি, আমি তোমার কথা রাখতে পারিনি। মায়ের শরীরটা হঠাৎ এত খারাপ হয়ে গেল যে কিছুই বুঝতে পারলাম না। হাসপাতালে ছুটতে ছুটতে তিন দিন কীভাবে কেটে গেল বুঝতেই পারছি না, তোমাদের ফোন করে বলব, আমি সেই পরিস্থিতিতে ছিলাম না। আর শুনলাম তুমি গতকাল বাসায় আসছিলে।'
'অনেকদিন হল আপনাকে দেখি না। দেখব, দেখা করব।'
.
.
.
চলবে..........................