স্যার I Love You - পর্ব ০৫ - শারমিন আক্তার বর্ষা - ধারাবাহিক গল্প


'শ্রাবণ কে?'
প্রশ্ন শুনে ভ্রু কুঁচকে গেল আব্রুর। হতভম্ব গলায় বলল, 'কে শ্রাবণ?'
ইতি দাঁড়িয়ে ঠোঁট কামড়াচ্ছে। মুন্নি বিরক্ত গলায় বলল, 'তুই এখন চিনতে পারছিস না। তলে তলে ট্যাম্পু চালাও, আমরা বললে চিনি না।'
রুবেল একটু ঝুঁকে পড়ে। জিজ্ঞেস করল, 'আব্রু, তোকে দেখে মনে হয় না তুই প্রেম ভালোবাসাও করতে পারিস।'
মিম বলল, 'কি হল বল।'
'তোরা কি ওই নম্বরে ফোন করেছিলি?'
'না। লোকটা করেছিল। তবে, তিনি নিজের পরিচয় দিয়েছেন, আমরা তোর কাছ থেকে শুনতে চাই।'
আব্রু কিছুক্ষণ সময় নিল। জোরে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, 
'আমি একটা সম্পর্কে আছি। তার সাথে আমার পরিচয় ফেসবুকে। তারপর ধীরে ধীরে ভালোলাগা থেকে ভালোবাসা।'
'তুই কি ছেলেটির সাথে দেখা করেছিস?'
'না। আমরা আগামী সপ্তাহে দেখা করার প্ল্যান করেছি। সে শুক্রবারে ঢাকা থেকে আসবে।'
'তিনি দেখা করতে আসবেন, আমরা তোর সাথে যাব। সামনাসামনি দেখবো ভাইয়াটা কেমন। রাজি কিনা বল?'
আব্রু চাপে পড়ে রাজি হয়ে গেল। আব্রু বলল, 
'তোকেও স্যারকে আনতে হবে।'
ইতি হতভম্ব হয়ে গেল। সে অস্ফুট স্বরে বলল, 'কি স্যার? কিন্তু সে আমার বয়ফ্রেন্ড নয়।'
'এখানে সবাই মিঙ্গেল একমাত্র তুই সিঙ্গেল। এতগুলো মিঙ্গেলের মাঝে তুই একা কী করবি? তাই তুই স্যারকে সঙ্গে নিয়ে তবেই আসবি।'
ইতি চমকে উঠল।
রুবেল বলল, 'ইতি, ঘটনাটা স্যারকে বুঝিয়ে বলতে পারলে স্যার ঠিকই আসবেন।'

সদরদরজা খুললেন নাসিমা বেগম। ইতিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, 'আজ এত দেরি কেন?'
'আমি আজ বন্ধুদের সাথে ফুচকদ খেতে গিয়েছিলাম তাই দেরি হয়ে গেছে।'
'আবার রাস্তার খাবার? আচ্ছা যাও এখন ফ্রেশ হও।'
'ঠিক আছে।' ইতি রুমে এলো। স্নান করে ফ্রেশ হল। খাওয়া দাওয়া শেষ করে সে অপেক্ষা করছে স্যারের আসার জন্য। একটু পর শাওন স্যার এলেন, ইতির মন খারাপ দেখে জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে? ইতি প্রশ্নটা এড়িয়ে যায়। কিছু না বলে পড়তে লাগল। দুই ঘণ্টা পর শাওন চলে গেল। এভাবে ছয় দিন কেটে গেল। ইতি স্যারকে এখনো কথাটা বলতে পারেনি। ইতির কথা শুনে স্যার কেমন রিঅ্যাক্ট করবেন তা নিয়ে সে চিন্তিত।

আজ বৃহস্পতিবার, কাল শুক্রবার। যা বলা দরকার তা আজই বলতে হবে এবং স্যারকে রাজি করতে হবে। নইলে সে যেতে পারবে না। ক্লাসে বসে ইতি এসব ভাবতে থাকে। হঠাৎ আব্রু বলল, 'আজ কিন্তু শেষ দিন।'
মুন্নি বলল, 'এত ভয় পাচ্ছিস কেন, রুবেলকে দেখ সে আমাকে ভালোবাসতো কিন্তু বলতে পারিনি। আমি বলেছি বলেই প্রেম হয়েছে, তুই সাহস করে বল তোরও হবে।'
মিম কথার মাঝে ফোড়ন কাটল, 'সাবধানে ইতি। ওঁর কৌশলে কান দিবি না, ভুলে যাবি না যে ওঁর কথা শুনে নাঈমকে প্রপোজ করতে গিয়ে চড় খেয়েছিলাম।'
নাঈম হঠাৎ বলে উঠল, 'পরে তো চুমুও দিছিলাম।'
মিম কপালে হাত রেখে বলল, 'চুমুর কথা সবাইকে বলতে হবে কেন?'
'হে হে স্যরি।'
 ইতি বলল, 'আমি আমার মতো করে স্যারকে বলল। তোদের জ্ঞান দিতে হবে না। আর যদি দেখিস আমি আসিনি, তাহলে বুঝবি আমি স্যারকে বলতে পারিনি বা তিনি রাজি হননি।'
আব্রু বলল, 'স্যার, রাজি হলে ফোন করে জানাবি।'

ছুটি শেষে রুবেল মুন্নির সঙ্গে বেড়াতে যায়। রাস্তার একপাশে বিশাল লেক। ওপাশে ফুলের বাগান, একটু সামনে ফুচকার স্টল। মুন্নি দাঁড়িয়ে আছে। রুবেল হাতে একটা বেলী ফুলের চুড়ি পরিয়ে দিল। মুন্নি বিস্মিত গলায় বলল, 'কখন আনছিস এটা?'
'অনেকক্ষণ হয়ে গেল, তুই এখনো আমাকে তুই করে বলিস।'
মুন্নি খুশি হয়ে বলল, 
'তোকে তুমি বলে ডাকব ভাবতেই কেমন হাসি পায়।'
সঙ্গে সঙ্গে রুবেলের চেহারা বদলে গেল। রুবেলের মুখ গম্ভীর। রুবেল একটা বাক্স মুন্নির দিকে দিয়ে বলল, 'তোমার জন্য গিফট আমি বাড়ি গিয়ে খুলবি।'

ইতি রুমে পায়চারি করছে। স্থির হয়ে বসতে পারছে না। গভীর শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করল। শাওন এলো। সে প্রতিদিনের মতো সালাম দিল,
'আসসালামু আলাইকুম।'
'ওয়াআলাইকুমুস সালাম স্যার।'
শাওন চেয়ার টেনে বসল। ইতির মুখটা খুব চিন্তিত দেখাচ্ছিল, শাওন জিজ্ঞেস করল, 'ইতি আর ইউ ওকে?'
'হ্যাঁ স্যার। আমি ঠিক আছি।'
'তুমি এভাবে ঘামছ কেন?'
'গগ..গরম লাগছে।'
'এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দাও।'
ইতির সাথে শাওনের সম্পর্ক আগের চেয়ে সহজ হয়েছে। ইতি স্যারকে বলে, স্যার আমি আপনার থেকে অনেক বছর ছোট আপনি আমাকে তুমি বলে ডাকবেন। সেদিন থেকে শাওন তাকে তুমি বলে সম্বোধন করে। আগের স্যাররা তাকে তুই বা তুমি বলে ডাকলে তার ভালো লাগেনি। কিন্তু শাওনের মুখ থেকে তুমি সম্বোধন শুনতে সে নিজে মুখ ফুটে বলেছে।

ইতি ঢোক গিলল। তারপর বলল,
'স্যার, আপনাকে একটা অনুরোধ করতে পারি?'
'কি অনুরোধ?'
'আপনি কি কাল আমার সাথে বাইরে যাবেন? সারাদিন আমার আর আমার বন্ধুদের সাথে থাকবেন।' কথাটা শাওন বুঝতে পারেনি। ইতি হাঁপাচ্ছে হা করে মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস ফেলছে।। শাওন বলল, 'কি হয়েছে?'
'আমার দমবন্ধ লাগছে।'
শাওন এক গ্লাস পানি তুলে ধরল ইতির দিকে। 'আস্তে খাও।' ইতি হাত থেকে গ্লাসটা টেবিলে রাখল। শাওন বলল, 'এবার ডান হাত দিয়ে একটি নাসারন্ধ্র ধরে অন্যটি দিয়ে শ্বাস নাও। আর হাত পরিবর্তন করে বাম হাতে নাক চেপে ধরে শ্বাস ছাড়ো।' 
ইতি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। একটু শান্ত। শাওন বলল, 'এখন বলো।'
ইতি কিছুক্ষণ পর উত্তর দিল, 'আজ কলেজে ট্রুথ এবং ডেয়ার খেলায়, আমি ডেয়ার নিই। বন্ধুরা আমাকে ডেয়ার দিয়েছে, আমরা কাল ঘুরতে যাব তো ওঁরা বলেছে আপনাকে আমার সাথে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এটাই ডেয়ার। আমি যদি না পারি তাহলে আমার ঘুরতে যাওয়া হবে না। আর আপনি তো আমার সাথে যাবেন না তাই আমার যাওয়া হবে না। আমি হেরে যাব।'

শাওন গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল, 'কখন যাবে? আমি কিন্তু বেশিদিন থাকতে পারব না। মাকে পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে নিয়ে যেতে সন্ধ্যার আগে ফিরতে হবে।'
ইতির চোখ চকচক করে উঠল। শাওন স্যার বলে, 'আমি নিশ্চিত নই, তোমরা কোথায় যাবে? আমি রেডি থাকব। তুমি গাড়িতে তুলে নিও।'
স্যার ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল। ইতি উত্তেজিত হয়ে উঠল। সে চেয়ার ছেড়ে হঠাৎ শাওনকে জড়িয়ে ধরল। শাওন হতবাক। ইতি তাত্ক্ষণিক সরে গেল। দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে বলল, 'স্যরি স্যার। ভুল হয়ে গেছে।'
শাওন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর চলে গেল।
ইতির ভয় করছে। শাওন কিছু না বলে চলে যায়।

রাতেই প্ল্যান হয়ে গেল। কে কি পরবে? মেয়েরা শাড়ি আর ছেলেরা পাঞ্জাবি। ইতি ওঁর মায়ের একটা শাড়ি নিয়ে বসে আছে। ইউটিউবে অনেক ভিডিও দেখে শিখে নিল কিভাবে শাড়ি পরতে হয়। নাসিমা বেগম এসে শাড়ির কুঁচি আঁচল ঠিক করলেন। মেয়েকে শাড়িতে দেখে চোখ সরাতে পারছেন না। চোখের কোণ থেকে আঙুলের ডগায় হালকা কাজল লাগিয়ে ইতির কানের পেছনে লাগান। তারপর বললেন, 'কারো নজর না লাগুক।'

ইতি গাড়ি থেকে নেমে গেল। দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। স্যারের বাড়ির দিকে যাওয়া চিপা গলিতে গাড়ি ঢুকতে পারে না। এই কারণে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে, ইতি স্যারকে ফোন দিল। তিনি বলেন, তিনি রাস্তায় ছিলেন। ইতি মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। শাওন বাম পাশে এসে দাঁড়াল। সে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, 'শাড়ি?'
ইতি হাসল। বলল, 'হ্যাঁ। ওরা সবাই শাড়ি পরবে।'
ইতি লক্ষ্য করল স্যার আর তার জামাকাপড় একই রঙের। শাওন ইতস্তত করে বলল, 'আমি বুঝিনি তুমি সাদা শাড়ি পরবে।'
ইতি চোখ নামিয়ে নিল। তারপর দুজনে গাড়িতে উঠল।

রেস্তোরাঁর পুরো টেবিল বুক করে রেখেছে শ্রাবণ। সে তার প্রেমিকার বন্ধুদের ট্রিট দেবে। শ্রাবণ লক্ষ্য করল, কারোরই মেজাজ ভালো নেই। সবার মুখে একটা উদাসীনতা। শ্রাবণ জিজ্ঞেস করল, 'কী হয়েছে? আপনারা সবাই এভাবে বসে আছেন কেন?'

মুন্নি বিরক্ত গলায় আব্রুর বোকামির কথা বলল। শ্রাবণ বলল, 'আব্রু তোমার এটা করা উচিত হয়নি। দেখো সবাই আছে কিন্তু তোমার অন্য বন্ধুটা নেই।'
আব্রু বলল, 'আমি ভেবেছিলাম এই উসিলায় হয়তো ইতি আর ওর স্যার কাছাকাছি আসবে।'
'কিন্তু তোমার চিন্তা লাভ কম ক্ষতি বেশি করেছে।'
' স্যরি।'
রুবেল বলল, 'ইতি থাকলে মজা হত।'

শ্রাবণ সবার পছন্দের খাবারের অর্ডার দিল। আব্রু এখনো বলেনি সে কি খাবে। শ্রাবণ নিচু গলায় বলল, 'ম্যাডাম, কিছু বলবেন না কি চুপ করেই থাকবেন?'
'আমার ভালো লাগছে না।'
শ্রাবণ গেটের দিকে তাকিয়ে দেখে দু'জন কাপল গেট দিয়ে ঢুকছে। ওদের সেইম পোশাক দেখে শ্রাবণ ধরে নিল ওরা কাপল। শ্রাবণ বলল, 'ওই কাপলটাকে দেখ একসাথে কত সুন্দর লাগছে।'
শ্রাবণের দৃষ্টি অনুসরণ করে তারা গেটের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল। মুন্নি বলল, 'ইতি।'
'ছেলেটা কে সাথে?' মিম বলল।
নাঈম ভারী গলায় বলল, 'এমন সুদর্শন ছেলে ওঁ ভাড়া করেনি তো?'
রুবেল ধমক দিয়ে বলল, 'কী বাজে কথা। তিনি সম্ভবত ইতির স্যার।'
আব্রু শ্রাবণের উদ্দেশ্য বলল, 'ওরা কাপল না।'
'কাপল না?'
'ওটাই ইতি আর তার সাথে স্যার।'
ইতি টেবিলের কাছে এসে দাঁড়াল। হাসিমুখে তাদের সঙ্গে স্যারের পরিচয় করিয়ে দিল। পরিচিত হয়ে খুশি হল। আব্রু কর্কশ কন্ঠে বলল, 'তুই আসবি কাল আমাকে কল করিসনি কেন?'
ইতি হাসল। বলল, 'সারপ্রাইজ দিব বলে। আমি যদি আগে ফোন করে বলতাম তাহলে এখন অবাক হতি না।'
আব্রু চোখ সরু করে বলল, 'তোকে পরে বুঝাব।'
ওয়েটার খাবার দিয়ে টেবিল ভরে দিল।
নাঈম তার খাওয়া বাদ রেখে মিমকে খাইয়ে দিচ্ছে। রুবেলও তাই করল। শ্রাবণ আব্রুর দিকে তাকিয়ে হাসছে। ইতি শাওনের দিকে ঝুঁকে পড়ল। সে ফিসফিস করে বলল, 'স্যার। ওও স্যার?'
'হ্যাঁ বলো।'
'আমি কি আপনাকে খাওয়াবো?'
শাওন চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে।
'স্যার একটু?'
'না।'
'কেন? ওঁরা তো দিচ্ছে।'
'কারণ তারা কাপল। আমি তোমার শিক্ষক।'
'এখন শিক্ষক নন।'
'বোঝার চেষ্টা করো। তুমি যা বলছ তাই করলে তারা ভাববে আমাদের মধ্যে সম্পর্ক আছে।'
'কে কি ভাবল তাতে আমার কিছু আসে যায় না।'
শাওন একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল।

গ্রামের রাস্তা দিয়ে তিনটি গাড়ি যাচ্ছে। ইতি জানালা খুলে সবুজ ধানক্ষেতের দিকে তাকাল। নন্দন পার্কে যাওয়ার কথা থাকলেও যাওয়া হয়নি। গাড়ি ঘুরিয়ে একটা গ্রামের রাস্তায় ঢুকল। শহরের লোকেরা খুব বেশি পার্ক ও রেস্তোরাঁয় যায়, তারা জানে না প্রকৃতি কত সুন্দর। প্রকৃতির নিদর্শন শুধু গ্রামেই পাওয়া যায়। শ্রাবণ গাড়ি ব্রেক করল। তারপর একে একে তিনটা গাড়ি থেকে মানুষ নামল। একাকী এই নির্জন পথে প্রিয়জনের হাত ধরে হাঁটতেই শান্তি। কিছুদূর ওঁরা একে অপরের হাত ধরে জোড়ায় জোড়ায় এগিয়ে যাচ্ছে।

ইতি ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে শাওনের দিকে তাকাল। শাওন দুই হাত প্যান্টের পকেটে রেখে সোজা হাঁটছে। ইতি শ্বাসরুদ্ধ কন্ঠে বলল, 'আহাম্মক। অনূভুতি বোঝে না।'
.
.
.
চলবে.........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন