ইতির অনেকক্ষণ কেঁদে তারপর ঘুমিয়ে পড়ল। রাতে নাসিমা বেগম খাবারের জন্য ডাকতে এসে দেখেন মেয়েটি ঘুমাচ্ছে। তাই আর ডাক দেয়নি। খাবার ঘরে রেখে চলে যান। ইতি রাতে ঘুম থেকে ওঠেনি। দূর থেকে একটা শব্দ শোনা যাচ্ছে। ইতি পিটপিট করে চোখ খুলল। ফজরের আযান দিচ্ছে, মোবাইল ফোনে সময় দেখে নামাজের জন্য উঠে গেল। আজ মোনাজাত অনেক লম্বা করে। প্রার্থনা করতে করতে ইতি অনেকক্ষণ কাঁদল। জীবনের সব কিছুর জন্য ক্ষমা চাওয়ার পর নামাজ শেষ করে। জায়নামাজ ভাজ করে রেখে তারপর রুম থেকে বারান্দায় চলে গেল। স্নিগ্ধ সকাল, উষ্ণ হাওয়া শরীরকে হালকা করে তুলেছে। গাছের ডালে ছোট্ট পাখিটি কিচিরমিচির করে, খাবারের সন্ধানে তার বড় বড় ডানা ঝাপটায়। সূর্যের আলো মিষ্টি। এত উজ্জ্বল নয়। ইতি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল। নাসিমা আর খালেদা রান্নাঘরে নাস্তা তৈরি করছে। নাসিমা বেগম হঠাৎ ইতিকে দেখে বললেন, 'আজ এত ভোরে উঠেছ কী করে?'
'গতকাল সন্ধ্যায় ঘুমিয়েছিলাম আম্মু আর আজ ফজরের আজানের সময় ঘুম ভাঙল।'
'সে কি রাতে উঠোনি?'
'না।'
'রাতে তোমার ঘরে খাবার রেখে এসেছিলাম। সম্ভবত সেটাও খাওনি।'
'আম্মু, তুমি আবার কখন খাবার রেখে এসেছ?'
'তখন তুমি ঘুমাচ্ছ।'
ইতির মনটা আজ খুব ভালো। সে হেসে মায়ের কাছে গিয়ে বলল, 'আম্মু আমি তোমাকে রান্না করতে সাহায্য করতে চাই।'
নাসিমা বিষম খেল যেন। হতভম্ব কণ্ঠে বললেন,
'আজ সূর্য কোন দিক থেকে ওঠেছে।' নাসিমা মৃদু হাসল। তারপর ইতির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, 'তোমাকে কিছু করতে হবে না। তুমি রুমে গিয়ে পড়তে বসো।'
ইতি গেল না. সে পেঁয়াজ কাটতে এগিয়ে গেল। খালেদা বললেন, 'মামণি, আমারে দেও।'
'আমি পারব।'
ইতি পেঁয়াজ কাটতে লাগল। চোখ জ্বালাপোড়া করে টপ টুপ করে অশ্রু পড়ছে। ইতির চোখে হাত ছুঁয়ে বলল, 'আম্মু চোখ জ্বলছে।'
নাসিমা বললেন, 'তাড়াতাড়ি চোখে পানি দাও।'
জোরে হেসে উঠলেন খালেদা। তারপর বললেন, 'সকলে পিঁয়াইজ কাটতে পারে না, মামণি। আমি আগেই কইছিলাম আমারে দিতে।'
ইফাদ সিকদার ড্রয়িংরুমে বসে খবর পড়ছেন হঠাৎ হাসির শব্দ শুনে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল। ইতির অবস্থা দেখে আন্দাজ করলেন এখানে কি হয়েছে। ইফাদ সিকদার কড়া গলায় বললেন, 'আমার মেয়ে কাঁদছে আর তুমি হাসছ?' বলে থামলেন। তারপর ইতির কাছে গিয়ে বলল, 'মামণি ছুরি রাখ। তোমাকে এসব করতে কে বলেছে?'
খালেদা বললেন, 'স্যার আমরা কই নাই। ইতি মামণি আমাগো হেলেপ করতে আইসে।'
ইফাদ সিকদার বললেন, 'আহা, খালেদা, ওটা হেলেপ হবে না, বলুন হেল্প।'
খালেদা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। তারপর বললেন,
'হালেপ।'
ইতি হঠাৎ করে হেসে উঠল। নাসিমা বললেন, 'তোমার মেয়ের হঠাৎ রান্নার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়েছে।'
ইতি রাঁধতে জানে না। মেয়েরা প্রথমবার রান্না শেখে মায়ের কাছ থেকে। তার মেয়ের বেলায় না হয় উল্টোই হল। ইফাদ সিকদার ইতিকে রান্না শেখানোর সিদ্ধান্ত নেন। সে একটু থেমে বললেন, 'তোমরা রান্নাঘর থেকে বের হও। আমি আর আমার মেয়ে আজ নাস্তা বানাবো।'
নাসিমা হেসে চলে গেল।
ড্রয়িং রুমের সোফায় বসলেন। টিভি অন করে মুভি দেখতে লাগল। খালেদা খুবই চিন্তিত। রান্নাঘর নোংরা হলে তাকে পরিষ্কার করতে হবে। খালেদা বলেন, 'আফা, আমি রান্নাঘরে গিয়া দেইখা আহি হেরা কী করে?'
নাসিমা বললেন, 'চিন্তা করো না। তোমার স্যার দেশি-বিদেশি সব খাবারই ভালো রান্না করতে পারেন। সে সব সামলে নিবে। আমরা পালিয়ে বিয়ে করি কারণ আমাদের পরিবার আমাদের প্রেম মেনে নেয়নি। পরিবারের কেউ আমাদের ঘরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। এরপর আমরা আসি গাজীপুর শহরে। তোমার স্যার কঠোর পরিশ্রম করে আজ একটি কোম্পানির মালিক হয়েছেন। আমার বিয়ের পাঁচ বছর পর ইতির জন্ম হয়। ওকে পেটে নিয়ে আমি কিছু করতে পারতাম না। তোমার স্যার রান্নাঘর ও বাড়ির সব কাজ নিজ হাতে করতেন। আল্লাহ আমাকে তার মতো স্বামী দিয়েছেন। আল্লাহর কাছে অনেক ধন্যবাদ।'
খালেদার চোখে জল। নাসিমা এখন বললেন, 'এ বিষয়ে ইতি কিছুই জানে না। আর সে জানে না যে তার নানা বাড়ি আছে, দাদার বাড়ি আছে।'
ডাইনিং টেবিলে সব আইটেম গুছিয়ে রাখল ইতি। তারপর উচ্চস্বরে বলল, 'আম্মু, খেতে আসো।'
ক্যাম্পাসে বসে বাদামের খোসা ছাড়াচ্ছে ইতি। নাঈম বলল, 'ইতি তুই গতকাল অনেক কিছু মিস করছিস।'
ইতি তাকাল। বলল, 'লাইক?'
'চৌর রোডে বিশাল মেলা বসেছিল। সন্ধ্যার পর আমরা সবাই যাই। শুধু তুই আর তানিম বাদে।'
ইতি বলল, 'আগামী সপ্তাহে যাব।'
রুবেল হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, 'তোমার টিউটরের খবর কী?'
ইতি হতাশ গলায় বলল, 'যে ছেলেটাকে গতকাল ধাক্কা দিয়েছি। আমার জন্য কাজের ইন্টারভিউ দিতে পারেনি। সেই আমার নতুন স্যার।'
ওঁরা হতবাক। মুন্নি ঝাপসা করে বলল,
'কি?'
'তোকে কিছু বলেনি?' তানিম জিজ্ঞেস করল।
'না।'
'আশ্চর্য! তোর জন্য তার ক্ষতি হয়েছে কিন্তু তিনি তোকে কিছুই বলেনি।' আব্রু বলল।
'স্যার সে কি এখনো আছে নাকি পালিয়ে গেছে?' মিম জিজ্ঞেস করল।
'হ্যাঁ আছে। চাকরি না হওয়া পর্যন্ত পড়াতে আসবেন।'
কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে ইতি সেসব মানুষের সাথে দেখা করল যাদের সে কষ্ট দিয়েছে। খুব লজ্জিত এবং দুষ্টুমির জন্য ক্ষমা চাইল। মুন্নি অবাক গলায় বলল, 'ইতি বদলে গেছে। সে আগের মতো নেই।'
'তুই ঠিক বলেছিস।' বলল রুবেল।
ইতি এগিয়ে এলে। নাঈম জিজ্ঞেস করল, 'তুই এত বদলে গেলি কী করে?'
'কেউ একজন চোখে আঙুল দিয়ে ভুলগুলো তুলে ধরেছে। আমরা মজা করার জন্য অনেক কিছু করে মানুষকে কষ্ট দেই। যারা এসব ভোগে তাদের কথা ভাবি না।' বলল ইতি।
আবদুল একটি রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি থামাল। ইতি বন্ধুদের নিয়ে হালকা কিছু খাবার খাওয়ার জন্য ঢুকল। আবদুল তাদের সাথে টেবিলে বসে খাবার খেল। ছোটো থেকে মেয়েটাকে বড় হতে দেখেছেন তিনি জানেন ইতির মন খুব ভাল। দুষ্টু মেয়েটা হঠাৎ করে শান্ত হয়ে গেছে। ইতি বসে বসে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। মুন্নি বলল, 'বল তোর কি হয়েছে?'
ইতি জোরে নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর কিছুক্ষণ একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে সব বলল। রুবেল বলল, 'বাহ, স্যার আসতেই তোকে বদলে দিল। নিশ্চয়ই জাদু জানে।'
'কী ধরনের জাদু?' মুন্নি জিজ্ঞেস করল।
'কথার জাদু।'
নাসিমা বেগম বাইরের খাবার পছন্দ করেন না। তিনি মনে করেন, অন্যরা বাড়ির মতো যত্ন করে রান্না করেন না, তিনি ইতিকে প্রায় বাইরে খেতে নিষেধ করেন এই ভেবে যে সেসব খাবার খাওয়া শরীরের জন্য ক্ষতিকর। আজ ইতি বাইরে থেকে খেয়ে আসছে শুনে রাগান্বিত কন্ঠে বললেন, 'তুমি বন্ধুদের নিয়ে বাসায় আসোনি কেন? আমি সবাইকে রান্না করে খাওয়াতাম। বাইরের খাবার শরীরের জন্য ভালো নয়। কবে বুঝবে?'
কিছুক্ষণ পর স্যার পড়াতে আসবেন তাই নাসিমা বেগম বেশি চিৎকার করলেন না। ইতি বইটা দিয়ে পড়ার চেষ্টা করল। স্যার সালাম দিয়ে রুমে প্রবেশ করলেন। ইতি নিজেকে গুটিয়ে নিল। স্যার করুণ গলায় বলল, 'আই এম স্যরি। আমি একটু দেরি করে এসেছি। রাস্তার কাজ চলছে, অন্য রাস্তা দিয়ে ঘুরে আসতে হয়েছে।'
ইতি মাথা নিচু করে রইল। শাওন স্যার হঠাৎ বলে উঠল,
'আজকে আপনার একজন স্যারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তিনি আমাকে বলেছেন যে আপনি তার কাছে গিয়ে ক্ষমা চেয়েছেন। শুনে ভালো লাগল। আমরা সবাই মানুষ। আমাদের কাউকে ছোট করা উচিত না।'
ইতি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে স্যারের দিকে। শাওন ইতির দিকে তাকিয়ে দেখল যে সে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। হঠাৎ করেই গলাটা কর্কশ হয়ে উঠল। আঙুলে তুড়ি বাজিয়ে বলল, 'ইতি আপনি আমার কথা শুনেছেন?'
'হ্যাঁ স্যার।'
'আমার দিকে না তাকিয়ে বইয়ের দিকে তাকান।' শাওন বলল।
'জজ..জি স্যার।'
শাওন ভ্রুকুটি করল। 'আপনি তোতলা?'
ইতি চোখ বড় বড় করে মেলে বলল, 'হ্যাঁ? না।'
'তাহলে তোতলাচ্ছেন কেন?'
'আমি মোটেও তোতলাইনি স্যার।' ইতির একটু রাগ হল। শাওন মৃদু হাসল, 'এখন পড়ুন।'
নাসিমা বেগম খালেদাকে দিয়ে কফি পাঠান। দরজার সামনে থেকে খালেদা বললেন, 'সার আসমু?'
'হ্যাঁ, আসুন।'
'সার আফনার কফি।'
'জি রাখুন।'
খালেদা চলে গেলেন। স্যার কফির মগটা নিয়ে ঠোঁটে ছুঁয়ে অদ্ভুদ শব্দ করলেন। ইতি একবার চোখ সরু করে দেখল, ইতি তাকিয়ে আছে দেখে শাওন হাতের কফির মগটা ইতির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, 'কি? আপনি খাবেন?'
ইতির ঠোঁট উল্টে ফেলল। ওঁর রাগ লাগল। বলল, 'কারো মুখের খাবার খাই না।'
'তাহলে বারবার তাকাবেন না, বদনজর লাগবে।'
ইতির রাগ ক্রমশ বাড়তে থাকে। সে বই বন্ধ করে স্যারের দিকে তাকাল। মনে মনে বলল, 'ইচ্ছে করছে এক ঘুষিতে বত্রিশটি দাঁত ফেলে দেই। নির্ঘাত ভালো হয়ে গেছি বলে কিছু করছি না।'
এক সপ্তাহ কেটে গেল। সবাই ইতির পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে। ইফাদ সিকদার উচ্ছ্বসিত ইতির শান্ত আচরণ তার পছন্দ হয়েছে। ইতি কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। সে এখন সবসময় হাসিখুশি থাকে। মুন্নি এলো। ইতির পাশে বসে বলল, 'কি চলছে তোর পেটে?'
'মানে?'
রুবেল ইতির কপালে টোকা দিয়ে বলল, 'তুই এই সপ্তাহে হাজার বার স্যারের নাম বলেছিস। তার প্রতিদিনের গল্প এখন আমাদের মুখস্থ। তোকে দেখে ছেলেমেয়েরা বলে দিবে তুই স্যারের প্রেমে পড়েছিস।'
আব্রু জিজ্ঞেস করল,
'তোর আর স্যারের মধ্যে কি চলছে?'
'কিছুই চলছে না।'
নাঈম বলল, 'স্যারের নাম কি যেন?'
মিম বলল, 'শাওন আহমেদ।'
'তোরা ভুল ভাবছিস।'
'আমরা কি ভুল ভাবছি? স্যারের কথা বলা সময় তোর চোখে মুখে হাসি ফুটে। এগুলো কি ভুল?'
ইতি মর্মাহত। সে বলল, 'স্যারকে আমার ভালো লাগে। তার কথা শুনতে ভালো লাগে। সে কথা বলার সময় তাকিয়ে থাকতে মনে চায়। আজকাল তাকে না দেখতে পেলে আমার হংসবাম্প অনুভব হয়। স্যার যখন হাসে বুকের মাঝে ধুকধুক করে। স্যার যতক্ষণ আমার পাশে থাকে ততক্ষণ আমার বুক ধড়ফড় করে।'
রুবেল বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। চলে যাওয়ার সময় সে বলল, 'প্রেমে পাগল হয়েছে।'
ইতি আজ বন্ধুদের সাথে ফুচকা খেতে আসছে। একসময় আব্রু ওর ফোন খুঁজতে লাগল। হঠাৎ করেই পাওয়া যাচ্ছে না। সে এলোমেলো কন্ঠে বলল, 'আমার ফোন?'
এমন পরিস্থিতি যে আব্রু প্রায় কেঁদে ফেলবেয। ইতি তার ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে বলল, 'সকালে ক্যাম্পাসে ফেলল এসেছিস। আর এখন খবর হল?'
আব্রু ফোন ধরতে চাইল। মিম বলল, 'দাঁড়া। প্রথমে বল কল লিস্টে হার্ট লিখে কার নাম্বার সেভ করছিস। ঘণ্টা ঘণ্টা কথা বলছিস। আর মেসেঞ্জার পাসওয়ার্ড দিয়ে লক করা। কেন?'
.
.
.
চলবে..........................