কলেজ গেটের সামনে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছেন আবদুল মিয়া। ইতি বের হতেই সে এগিয়ে এলো। ইতি জিজ্ঞেস করল, 'চাচা, আব্বুর সাথে যাওনি?'
আবদুল বললেন, 'মামণি বড়সাব অফিসের গাড়ি নিয়ে গেছে। তুমি এখন গাড়িতে উঠো, ম্যাডাম বলছেন তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে।'
ইতি গাড়িতে বসল। আবদুল গাড়ি চালাচ্ছিল এর মাঝে একবার জিজ্ঞেস করলেন, 'আজ কলেজে আসতে তোমার কোনো সমস্যা হয়নি, তো?'
'কোন সমস্যা হয়নি চাচা।'
আবদুল আর কিছু বলল না। নিঃশব্দে গাড়ি চালাতে লাগলেন।
সদর দরজা খোলা। ইতি চুপচাপ ভিতরে চলে গেল। নাসিমা রান্নাঘরে কিছু কাজ করছে। ইতি হঠাৎ পেছন থেকে চিৎকার করে উঠল, ‘ভোউউউউ।’
নাসিমা হতবাক। মা ভয় পেয়েছে দেখে ইতি হেসে উঠল। নাসিমা একটু রাগী গলায় বললেন, ‘ইতি?’
ইতি ঠোঁটে একটা হাসি ঝুলিয়ে বলল, ‘আম্মু তুমি ভয় পেয়েছ।’
নাসিমা একটা কাপড় দিয়ে হাত মুছে বললেন, ‘পাজি মেয়ে, দাঁড়াও, আমি তোমাকে মজা দেখাচ্ছি।’
ইতি আর দাঁড়াল না। রুমে ছুটে গেল। মাকে ভয় পাইয়েছে ভাবতেই একা একা খাটে বসে অনেকক্ষণ হাসল। তারপর ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকল। একটু পর বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। আগন্তুকের কথা ভেবে হঠাৎ মন খারাপ হয়ে গেল তার। একজন তার জন্য চাকরি পায়নি। নিজেকে অপরাধী মনে হতে লাগল। ছেলেটির সাথে আবার দেখা হলে ক্ষমা চাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইতি। হঠাৎ দরজায় টোকা পড়ল। কাজের মহিলা খালেদা দাঁড়িয়ে আছে। ইতি তাকে দেখে জিজ্ঞেস করল, 'আন্টি, আপনি ছুটিতে গ্রামে গিয়ে ছিলেন। কবে আসছেন?'
খালেদা বললেন, 'দুফুরে আসছছি মামণি। বড় আফা তোমারে খাইতে ডাকে। এট্টু ফরেই নতুন সার আইবো।'
'যান। আমি আসছি।'
স্যারের কথাটা শুনে কপাল ভাজ হয়ে গেল। সে খাবারের প্লেট নিয়ে টিভির সামনে বসে টম অ্যান্ড জেরি দেখে খেতে লাগল। নাসিমা হঠাৎ বলে উঠল, 'খাওয়ার সময় টিভি দেখে কে?'
'আম্মু সবাই দেখে।'
'টম অ্যান্ড জেরি দেখে দিন দিন তাদের মতো হয়ে যাচ্ছ। এখন টিভি বন্ধ করে তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে পড়তে বোসো যাও। শাওন কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবে।'
ইতি ভ্রু কুঁচকে বলল, 'মা, শাওন কে?'
নাসিমা খানিকটা বিরক্ত কণ্ঠে বললেন, 'নাম ধরে বলছ কেন? কতদিন তোমাকে বলেছি বড়দের নাম ধরে ডাকবে না?'
ইতি অবাক কন্ঠে বলল, 'আমি কি করে বুঝব সে বড় না ছোট?'
নাসিমা খানিকটা রাগী গলায় বললেন, 'শাওন আহমেদ তোমার নতুন টিউটর।'
ইতি বিড়বিড় করে বলল, 'এই নতুন স্যারকে নিয়ে কী করব? কেউ কল্পনাও করতে পারবে না।'
'আমি রুমে যাচ্ছি।' ইতি কাতর স্বরে বলল। নাসিমা বেগম তার মেয়েকে শাসনে রাখতে চাইলেও স্বামীর অতিরিক্ত আদরে মেয়েটি বানর হয়ে যাচ্ছে। রোজ একজন হলেও তার নামে বিচার আনবে। নাসিমা শাসন করতে গেলে ইফাদ বাধা দেয়। আর বলে, 'এখনই তো বয়স। এই বয়সে দুষ্টুমি না করলে কবে করবে?'
ইতি টেবিলে বসে আছে। গালে হাত রেখে বইয়ের পাতা উল্টাতে লাগল। হঠাৎ একটি পুরুষালি কণ্ঠস্বর শোনা গেল, সমস্ত অলসতা দূর হয়ে গেল তার।
'আসসালামু আলাইকুম।'
ইতি বইটা বন্ধ করে বলল, 'ওয়াআলাইকুমুস..'
পুরুষ লোকটার মুখ দেখামাত্র ইতি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। পাশে দাঁড়িয়ে আছেন নাসিমা বেগম। মৃদু স্বরে বললেন, 'ইতি, অর্ধেক সালাম দিলে কেন?'
ইতি তাড়াতাড়ি বলল,
'ওয়াআলাইকুমুস সালাম।'
ইতিকে দেখে লোকটার চিনতে বিড়ম্বনা হল না। সে চোখ বুলিয়ে আবার মাথা নিচু করল। নাসিমা ইতিকে বললেন, 'উনি তোমার স্যার শাওন।' তিনি আবার বললেন, 'শাওন বাবা, সে আমার মেয়ে ইতি এবং আপনার ছাত্রী।'
ইতির গলা শুঁকে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। সকালে যা হয়েছে এই লোকটি যদি মাকে বলে দেয়, মা তাকে খুব বকাঝকা করবে। ইতি ভয়ে ঢোক গিলল। একবার ভাবল স্যার নিশ্চয়ই মাকে সব বলে দিয়েছেন। ভাবনাটা ভুল, মাকে বললে, মা এখন এত সুন্দর করে পরিচয় করিয়ে দিত না। মানে, এখনও বলেনি। কিন্তু পরে যদি বলে?
মা মুচকি হেসে বললেন, 'তুমি ওকে পড়াতে শুরু করো। আমি তোমার জন্য নাস্তা পাঠাচ্ছি।'
শাওন বলল, 'না, আন্টি। আপনাকে এসব করতে হবে না।'
মা উচ্চস্বরে বললেন, 'তুমি আমার ছেলের মতো, আমি তোমার জন্য কিছু করতে চাই। চুপচাপ বসে থাকো।'
বইতে মুখ গুঁজে বসে আছে ইতি। কথা বলার সাহস হচ্ছে না। স্যার যদি সকালের ঘটনার প্রতিশোধ নেন। তাহলে?
ইতি বলল,
'স্যার?'
'জি বলুন।'
স্যার আপনি আজ্ঞে করছে দেখে ইতি অবাক হলো। এর আগে কোনো স্যার তাকে আপনি সম্বোধন করেননি। সবাই তুই বা তুমি বলে ডাকত। ইতি সোজা হয়ে বসল। প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে বলল, 'স্যার, আই এম স্যরি।'
শাওন তাকায়নি। জিজ্ঞাসা করল,
'স্যরি কেন?'
'আজ সকালে আমি আপনার সাথে অভদ্র আচরণ করছি এবং আপনাকে কাঁদায় ফেলে দিছি। আমি আপনাকে ফেলে দিতে চাইনি। আমি বুঝতে পারিনি ধাক্কা দিলে আপনি পড়ে যাবেন।'
গম্ভীর গলায় বলল শাওন,
'আমি সেসব ভুলে গেছি। আপনিও ভুলে যান।'
ইতি ঠোঁট চেপে তাকাল। সকালেই এই লোকটাকে সে দেখেছে, একটা রিকশার জন্য তার সাথে তর্ক করতে। এখন সেই লোক তারই সামনে গম্ভীর ভঙ্গিতে বসে আছে। একজনের কতগুলো রূপ? হতবাক হল ইতি।
ত্রিশ মিনিট পর। নাসিমা বেগম দুজনের জন্য খাবার নিয়ে আসেন। ট্রেটা একপাশে রেখে বললেন, 'কিছু খাও বাবা।'
শাওন বলল,
'আন্টির এত কিছুর দরকার ছিল না। আপনি সব কিছু নিয়ে যান।'
নাসিমা হাসল। অন্যদের থেকে ছেলের স্বভাব ভিন্ন। এটা প্রমাণ পেল তিনি। কোম্পানির এক কর্মচারীর কাছ থেকে শাওনের কথা জানতে পারেন ইফাদ সিকদার। খুব ভালো শিক্ষক বলে মেয়ের জন্য বাছাই করেন। গত মাসে দুটো টিউশনি বাদ পড়েছে এজন্য এই টিউশনটি করতে রাজি হয় শাওন।
ইতি সন্দেহ চোখে তাকিয়ে আছে। বিড়বিড় করে বলল,
'স্যার কি আসলেই এত ভালো না কি নাটক করছে?'
অনেক রকমের খাবার দেখে ইতির খেতে ইচ্ছে করে। শাওন তাকে খেতে দেয়নি। দৃঢ়ভাবে বলল, 'পড়াশোনার সময় খাবার খাওয়া আমার পছন্দ না। পড়া শেষ করে খাবেন।'
'আমি একটু খাবো স্যার।'
'একদম না। খাবারের সাথে পড়া গিলে ফেলবেন।'
ইতি মায়ের দিকে তাকিয়ে করুণ গলায় বলল,
'মা, আমাকে একটু দাও। '
নাসিমা খাবার নিয়ে চলে গেল। ইতি মুখ ঘুরিয়ে শাওনের দিকে তাকাল। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বইটা বের করল। শাওন বাঁকা করে হাসল। ইতি বলল, 'আপনি ইচ্ছা করেই এমন করেছেন।'
'আমি কি করলাম?'
'আমাকে খেতে দেননি।'
শাওন কিছু বলল না।
ইতি ঠিক করল। এর প্রতিশোধ সে তুলবে। লেখার মাঝখানে হঠাৎ বলল, 'স্যার আমার কলমের কালি ফুরিয়ে গেছে। ওই টেবিলের দুই নম্বর ড্রয়ারে কলম রাখা আছে। আমাকে একটু এনে দিবেন।'
'আচ্ছা, আমি নিয়ে আসছি।'
ড্রয়ারে কলম না পেয়ে স্যার বলল, 'এখানে কলম নেই।'
'নাই মানে? সরুন, আমি দেখছি।'
ইতি হঠাৎ স্যারের পায়ে পা রেখে দাঁড়াল। শাওন অস্ফুট স্বরে বলল, 'ইতি আপনি আমার পায়ের উপর দাঁড়িয়েছেন।'
'স্যরি স্যার। আমি দেখিনি।'
ইতি নতুন স্যারকে তাড়ানোর বুদ্ধি এঁটে আগে থেকে উঁচু জুতা পরেছিল। শাওনের পায়ে জুতোর দাগ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সে পা নাড়াতে পারছে না। মজা করতে গিয়ে সে বেশ ভালোই ব্যথা পেয়েছে। ইতি ছুটে নিচে চলে গেল। সে একটা বরফের ব্যাগ এনে শাওনের পায়ে চেপে ধরল। জায়গাটা লাল হয়ে ফুলে উঠেছে। ইতি বলল, 'স্যার, আপনার ব্যাথা কমছে?'
'মোটামুটি। এগুলো রাখুন, আপনি পড়তে বসুন।'
'এই অবস্থায় শেখাবেন কী করে স্যার? আজ থাক। আপনি বরং বাড়ি যান, আজ আমি একাই পড়ে নিবো।' চিন্তিত হয়ে বলল ইতি।
'আপনার বাবা আমাকে বিশ্বাস করেছেন। প্রথম দিনেই কিভাবে তার বিশ্বাস ভাঙব? সামান্য ব্যথা সয়ে যাবে। আমি কাউকে প্রতিশ্রুতি দিলে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করি না।' বলল শাওন। শাওন ঘড়ির দেখে দুই ঘণ্টা পড়াল। এতক্ষণ দাঁত চেপে যন্ত্রণা সহ্য করেছে। সে ঠিকমতো হাঁটতে পারছে না দেখে ইতি শাওনের সাথে গেটে এলো। ইতি চলে আসবে সে-সময় শাওন ইতির পিছনে ডাকল, 'ইতি।'
ইতি থেমে গেল। স্যারের দিকে তাকিয়ে দেখল স্যার কিছু বলতে চান। শাওন স্যার বলল, 'এখানে আসার আগে আপনার সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছি। আমি জানি সবাই আমাকে সতর্ক করেছিল যে আপনি আগের স্যারদের কীভাবে হেনস্তা করেছিলেন। আমি আসছি আপনার বাবাকে দেওয়া কথা রাখতে। আর আমি জানি আপনি স্বেচ্ছায় আমার পায়ে পা রাখছেন। যেন আমি চলে যাই। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত আমাকে এসে আপনাকে পড়াতে হবে। আপনার বাবার এটাই শর্ত।
আমি গ্রাজুয়েশন শেষ করার পর দুই বছর ধরে চাকরি খুঁজছি। আমি যত টিউশনি পাই যদি আমার ভাল মনে হয় তবে আমি করি। মা অসুস্থ থাকায় সবার নিষেধ সত্ত্বেও আপনাকে পড়াতে এসেছি। আমি তখন বুঝতে পারি যে আপনি সেই সকালে আচরণ করেছিলেন কারণ আপনি ক্লাস মিস করার ভয় পেয়েছিলেন। কিন্তু এখন আপনি ইচ্ছে করে এমন করলেন। কিন্তু আমি আপনার উপর রাগ করিনি। আঘাত আপনি দিয়েছেন মলম ও আপনি লাগিয়েছেন। তবে হ্যাঁ আপনাকে দেখলেই বুঝা যায় কাউকে কষ্ট দেওয়ার পর আপনি বেশি কষ্ট পান। এজন্য একটা পরামর্শ দেব, রাগ ধীরে ধীরে বাড়লে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকুন। ভয় পাবেন না আমি আপনাট বাবা-মায়ের কাছে অভিযোগ করব না। আজ আসি।'
ইতি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। সে কি বলবে? শব্দ খুঁজে পেল না। খানিকটা পা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে স্যার চলে যাচ্ছেন। ইতির চোখ জলে ভিজে গেছে। খালেদা আবর্জনা ফেলতে বেরিয়ে এল। হঠাৎ ইতিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন, 'ইতি মামণি তুমি রোদে দাঁড়িয়ে আছ কেন?'
ইতি উত্তর দিল না। ছুটে গেল রুমে। দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদে।
.
.
.
চলবে..............................