অন্তর্নিহিত কালকূট - পর্ব ১০৪ - অনিমা কোতয়াল - ধারাবাহিক গল্প

অন্তর্নিহিত কালকূট
পর্ব ১০৪
অনিমা কোতয়াল
.
.
.
নিজস্ব ধারায় কলকল করে বয়ে চলেছে তুরাগ নদী। শীতকাল, তাই নদীর প্রস্থ সংকীর্ণ। বিরুলিয়া ব্রিজের ওপর পা ঝুলিয়ে, নদীর দিকে মুখ করে বসে আছে রুদ্র। উদাস চোখে কুয়াশার দিকে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। আবছা কুয়াশায় ধূসর দৃশ্যপট। অথচ বেলা হয়েছে অনেকটাই। আপাতত কোন কাজ নেই ওর। চাইলে ফিরে যেতে পারে আমের ভিলায়। কিংবা প্রিয়তাকে যেখানে বন্দি করে রেখেছে, সেখানে। কিন্তু ইচ্ছে করছেনা। রাজা থেকে যেদিন পরিপূর্ণ রুদ্র আমের হয়ে উঠল; সেদিনই নিজেকে নিয়ে ভাবা ছেড়ে দিয়েছিল। একান্ত সময়টাতে হয় বিশ্রাম নিয়েছে, নয়তো দলীয় কাজের চিন্তায় ডুবিয়ে রেখেছে নিজেকে। আর যবে থেকে প্রিয়তা এলো। অবশিষ্ট সেই সময়টুকু মেয়েটাকে ভালোবেসেছে রুদ্র। প্রচণ্ড ভালোবেসেছে। মায়ের পরে অন্যকোন নারীকে এতোটা ভালোবাসতে পারেনি ও। কিন্তু আজ হঠাৎ, বহুবছর কিছুটা সময় নিজেকে দিতে ইচ্ছে করছে ওর। শুধুই নিজেকে। 
চাপা এক দীর্ঘশ্বাস ফেলল রুদ্র। জ্যাকেটের পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। দক্ষ হাতে ধীরেসুস্থে ধরিয়ে নিল একটা সিগারেট। লম্বা এক টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই শীতল, তীক্ষ্ম এক বাতাস এলো উল্টোদিক থেকে। নিকোটিনের ধোঁয়াগুলো এসে আঘাত করল চোখমুখে। চোখটা সামান্য জ্বলে উঠল রুদ্রর। সামনের দৃশ্যপট হয়ে উঠল আরও ধোঁয়াশাময়। চোখের সামনে ভেসে উঠল অপূর্ব সুন্দর একজোড়া চোখ। প্রিয়তা, ওর বিবাহিত স্ত্রী। ঐ মেয়েটা ওর জীবনের সবচেয়ে বড় সত্যি। সে যেমন সত্যিই হোক। যে ওর হৃদয়ের স্পন্দন হয়ে এসেছিল। রুদ্রর আজও মনে পড়ে সেই জঙ্গলে ঘেরা শীতল, নির্জন রাতটা। যেদিন রুদ্রর প্রবাহমান জীবনে স্থিরতা এসেছিল প্রিয়তা। থমকে গিয়েছিল রুদ্র আমের। প্রথমবার। এরপর? এরপর সবটাই যেন ঘটল স্রোতের বিপরীতে। অমন কট্টর প্রেম বিরোধী হৃদয়ে কীকরে যেন ভালোবাসার জন্ম হল। সেও এমন তীব্র ভালোবাসা যা সব এলোমেলো করে দিল রুদ্রর। যা কোনদিন হওয়ার ছিলোনা তাই হল। বিবাহ নামক বৈধ এক সম্পর্কে জড়ালো। টানা দুটো বছর মেয়েটাকে অসম্ভব যত্নে, ভালোবেসে বুকে জড়িয়ে রেখেছিল রুদ্র। প্রিয়তাও যেন বিনা শর্তে নিজের সর্বস্ব সমর্পন করে দিয়েছিল রুদ্রর কাছে। অন্তত রুদ্র তাই অনুভব করেছে। প্রত্যেক দিন একটু একটু করে সাজিয়েছিল ওদের ভালোবাসার মহল। রুদ্র-প্রিয়তার সুখমহল। সেই মহলে রাজা ছিল, রাণী ছিল। আকাশের মতো অসীম, সাগরের মতো গভীর ভালোবাসা ছিল। একটা ছোট্ট রাজকন্যা কিংবা রাজকুমার আসার স্বপ্ন ছিল। সেইসব স্বপ্ন নিয়ে দুইবছরে একটু একটু করে সাজিয়েছিল ওরা সেই সুখমহলকে। 

কিন্তু হঠাৎই এক দমকা হাওয়ায় নড়ে উঠল সেই মহল। চমকে উঠল রুদ্র। বাস্তবতা নামক তিক্ত সত্যর ঘ্রাণ আবছা হয়ে নাকে ধাক্কা লাগল। সেইদিন! যেদিন মিসক্যারেজের পর প্রথমবার প্রিয়তাকে ফিরিয়ে আনতে গিয়েছিল রুদ্র। স্কুলের গেইটের সামনে। প্রিয়তার জেদ আর রুদ্রর ক্রোধের মিশ্রণে তর্ক শুরু হল দুজনের মাঝে। আর সেই তর্কের মাঝেই হঠাৎ প্রিয়তা বলে ওঠে, 'নিজের বোনকে রক্ষা করতে পেরেছিলেন? বাবাকে বাঁচাতে পেরেছিলেন? আর আমার রাজপুত্র? ওকে বাঁচাতে পেরেছিলেন? রঞ্জুকেও ম-রতে হলাে। পেরেছেন বাঁচাতে? অথচ এটা ভাবছেন যে আপনি আমাকে বাঁচাতে পারবেন। চমৎকার!'

রুদ্রর মস্তিষ্ক তখন অন্যভাবে চলছিল। সবদিক থেকে বিদ্ধস্ত রুদ্র জানতো ওকে ধোঁকা দেওয়া হয়েছে। আর সেটা দিয়েছে ওর খুব কাছের কেউ। গুপ্ত সেই শত্রুর খোঁজে সদা সজাগ ছিল ওর মস্তিষ্ক। সজাগ সেই মস্তিষ্কে সঙ্গে সঙ্গে ধাক্কা লাগে "রঞ্জুকেও মরতে হল" কথাটা। রুদ্রর স্পষ্ট মনে আছে রঞ্জু মারা গেছে এমন কথা সে কাউকে বলেনি। এমনকি বৈঠকঘরে উচ্ছ্বাস কিংবা জাফরকেও বলেনি। ওর আহত হওয়ার খবরটাও ডাক্তার রতন ছাড়া আর কেউ জানেনা। তাহলে প্রিয়তা কীকরে জানলো? প্রশ্নটা খচ করে বেঁধে রুদ্রর মনে। তর্কে মেজাজ হারিয়ে ফেলা রুদ্র মুহূর্তেই শান্ত হয়ে যায়। ঠান্ডা হয়ে প্রিয়তাকে প্রশ্ন করে সে কী চায়। উত্তরে প্রিয়তাও নিজের ইচ্ছা জানায়। যা সে আগেও বলেছে।
সংশয়ের শুরুটা আসলে সেদিন থেকেই। কিন্তু এটুকুতেই নিজের প্রিয়তমা স্ত্রীকে সন্দেহ করতে পারছিলনা রুদ্র। ঐসময় রুদ্রর মনে হল, কথার ধারাবাহিকতায় বেরিয়ে গেছে মুখ দিয়ে। কিংবা রুদ্রর কথায় প্রিয়তার মনে হয়েছে রঞ্জু মারা গেছে। কিন্তু অজানা এক কারণেই ব্যপারটা চেপে যায় রুদ্র। প্রশ্ন করেনা। অবচেতন মনে নিজের মৌনতা দিয়েই হয়তো প্রিয়তার জন্যে প্রথম ফাঁদ পেতেছিল রুদ্র সেদিন।

এরপর কুহু-নীরবের বিয়ে ঠিক হয়। রুদ্র তখন চাইছিল প্রিয়তা ফিরে আসুক আমের ভিলায়। তবে সেটা শুধুমাত্র ওর নিরাপত্তা বা কাছে রাখার জন্যে না। সেদিন খচ করে বেঁধা প্রশ্নটার অস্থিরতা যাচ্ছিলনা রুদ্রর ভেতর থেকে। সচেতন মস্তিষ্ক বারবার বলছিল কিছু একটা ঘটছে ওর অগোচরে। সেই অস্থিরতা ঘোঁচানোর জন্যে নিজে একবার প্রিয়তাকে বাজিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নেয় ও। সেকারণেই রুদ্র কুহুকে বলে, প্রিয়তাকে গিয়ে নিয়ে আসতে। কারণ রুদ্র জানতো একমাত্র কুহুই পারে প্রিয়তাকে নিয়ে আসতে। আর ওর ধারণাই সঠিক ছিল। সফল হয় কুহু। কুহুর বিয়ে উপলক্ষ্যে হলেও ফিরে আসে প্রিয়তা। 
প্রিয়তা ফিরে আসার পর বাজিয়ে দেখার কাজটা করতে সময় নেয়না রুদ্র। ঐদিন রাতে ফিরে প্রিয়তাকে দেখেই ভেবে নেয় সচেতন মনে প্রথম চালটা ঠিক কীভাবে দেবে। তবে রুদ্র মনে-প্রাণে চাইছিল সংশয়ের সেই বিজটা সেখানেই মুষড়ে পড়ুক। সেটা চারায় পরিণত না হোক। সেই আশা নিয়েই হুট করে কথার মাঝে রুদ্র বলে বলে বসে, রাশেদ আমেরকে বি*ষ দিয়ে খুন করা হয়েছে। কথাটা বলে খুব সুক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করে প্রিয়তার প্রতিক্রিয়া। কারণ রাশেদের মৃত্যুটাযে স্বাভাবিক না সেটাও একমাত্র রঞ্জু জানতো। সে ছাড়া আর একজনের পক্ষেই জানা সম্ভব ছিল এই কথা, স্বয়ং রাশেদের খুনি। কিন্তু প্রিয়তার মধ্যে চমকে ওঠার কোন লক্ষণ দেখতে না পেয়ে ভেতরে ভেতরে ভয়ংকরভাবে চমকে ওঠে রুদ্র। প্রিয়তাকে বুঝতে না দিলেও মনের মধ্যে ঝড় বইতে থাকে ওর। প্রকাশিত সূর্যের মতোই পরিষ্কার হয়ে যায় প্রিয়তা এমন আরও অনেককিছু জানে। এবং সেটা মোটেও কোন ভালো উদ্দেশ্যে না। কারণ ভালো উদ্দেশ্যে আর যাই হোক রুদ্রর কাছ থেকে এভাবে কিছু লুকিয়ে যাওয়ার মানে নেই। তাও এরকম এক বিষয়ে। ভয়ংকর হলেও সত্যিটা বুঝে ফেলল রুদ্র। তবে মনকে মানাতে পারল না কিছুতেই।

কুয়াশার ধূসরতায় আরও খানিকটা নিকোটিনের ধোয়া উড়িয়ে দিয়ে দিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিল রুদ্র। নিজের প্রতি এমন তাচ্ছিল্য আগে কখনও আসেনি ওর। এ ঘটনার পরেও রুদ্র পুরোপুরি অবিশ্বাস করতে পারেনি প্রিয়তাকে। সন্দেহের বিজ তখন চারায় রূপ নিয়েছে। তাতে মাঝেমাঝে নিজেকে অপরাধী ভাবতো ও। নিজের প্রিয়কে সন্দেহ করতে বিবেক বাঁধা দিতো। মস্তিষ্ক সংকেত দিলেও মন মানতে চাইছিল না। বরং মন মস্তিষ্ককে বোঝাতো, হয়তো প্রিয়তা কথাটা সেভাবে খেয়াল করেনি। উত্তেজিত ছিল তখন, হতেই পারে! এই দ্বিধাদন্দেই একেকটা দিন পাড় হচ্ছিলো রুদ্রর। কিছুতেই কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছিলনা। মানসিক অশান্তিতে বেশিরভাগ সময়ই মেজাজ খারাপ থাকতো ওর। যার কারণে প্রিয়তার সঙ্গে স্বাভাবিক থাকার আহামরি কোন চেষ্টা ও করেনি।

সন্দেহের সেই চারাটা ডালপালা মেলল কুহুর হলুদের দিন রাতে। সেদিন রাতে যখন আগ বাড়িয়ে ঝগড়া বাঁধিয়ে প্রিয়তা বেরিয়ে গেল, এবং ওকে উচ্ছ্বাসের সঙ্গে রাস্তায় দেখল। রুদ্র সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেলল কোন পরিকল্পনা ছিল সেদিন প্রিয়তার। নয়তো আর যাই হোক ঝগড়ার নাম করে মাঝরাতে বাড়ি থেকে বের হতোনা সে। কিন্তু চুপ ছিল তখনও। ওদের নিয়ে বাড়ি ফিরে যখন গ্লাসে ঢেলে রাখা পানি খেল, পানির সামান্য উট্কো স্বাধ স্পষ্টই টের পেয়েছে রুদ্র। তবুও থামেনি। ইচ্ছে করেই শেষ করেছে পুরোটা। তবে শুয়ে পড়ার আগে করেছে একটা ছোট্ট কাজ। নিজের ফোনের ক্যামেরায় ভিডিও রেকর্ডার অন করে বালিশের সঙ্গে এমনভাবে রেখেছে যাতে দরজার দিকটা স্পষ্ট রেকর্ড হয়ে যায়। হয়েছেও তাই। পরেরদিন সারাদিন কুহুকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ভিডিওটা চেইক করা হয়না রুদ্রর। চেক করে একেবারে রাতে। সব কাজ সেড়ে যখন রুমে যায়, তখন। আর সেই রেকর্ডিং ওকে জানায়, ওর ধারণাই ঠিক ছিল। মাঝরাতে বেরিয়েছে প্রিয়তা। আর এটাও বুঝে ফেলল ঘুমের ঔষধ দেওয়া হয়েছে ওকে। ভেতর থেকে সেদিনই কেমন মুষড়ে পড়ে রুদ্র। একের পর এক প্রকাশিত সত্য মানসিকভাবে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকে ওকে। ওর প্রিয় ওকে ঠকাচ্ছে। খুব বাজেভাবে ঠকাচ্ছে। এই নিদারুণ সত্যটা এতোদিন নানা অযুহাতে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও সেদিন আর পারেনা। সত্য মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকেনা ওর কাছে। ফোনটা হাতে নিয়ে স্থির হয়ে বসে থাকে আধঘন্টা। মনে হয় কেউ মুচড়ে ধরে রেখেছে হৃদপিণ্ডটা। চোখ ভয়ংকরভাবে জ্বলতে থাকে একফোঁটা অশ্রুর আশায়। রুদ্রর সেই সুখমহলকে নিতান্তই তাসের ঘর ছাড়া আর কিছুই মনে হয়না। ওর মনে হয় ওর সুখমহল ভেঙে গুড়িয়ে গেল। ওর চোখের সামনে। কিছুই করতে পারল না ও। কিছুই না।
নিজের সর্বোচ্চ মানসিক শক্তি নিয়ে যখন রুদ্র নিজেকে সামলাচ্ছে। ভেতরের তীব্র যন্ত্রণাকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। সেমুহূর্তে ওর জন্যে খাবার নিয়ে আসে প্রিয়তা। রুদ্রর ইচ্ছে করছিল তখনই চেপে ধরতে মেয়েটাকে। এমন ভয়ংকর ছলনা আর বিশ্বাসঘাতকতার জবাব চাইতে। কিন্তু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে রুদ্র। কারণ তখনও ওর আরও অনেককিছু পরিষ্কার হওয়া বাকি। প্রিয়তা ওকে ঠকাচ্ছে সেটা পরিষ্কার হলেও ঠিক কী নিয়ে ঠকাচ্ছে, কেন ঠকাচ্ছে আর কতখানি ঠকাচ্ছে, তা তখনও জানা বাকি ছিল। প্রিয়তা যখন ওকে খাইয়ে দিচ্ছিল তখন পলকহীন চোখে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল রুদ্র। মন বারবার প্রশ্ন করছিল সবটাই অভিনয়? সবটাই ছলনা? এই দুটো বছরের সংসার, ভালোবাসা সবকিছুতে শুধুমাত্র ওই ছিল। প্রিয়তা কোথাও ছিলোনা? কোথাও না? ভেতরে ভেতরে সবকিছু গুড়িয়ে যাচ্ছিল রুদ্রর। কিন্তু রাশেদ আমেরের সেই শিক্ষাটাই যেন জাদুর মতো কাজ করল সেদিন। ছোট রাজার চোখের সামনে তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ, তার মায়ের শেষ স্মৃতি নষ্ট করেও তাকে কাঁদতে না দিয়ে যে ভয়ংকর রুদ্র আমেরেকে তৈরী করেছিল। সেই রুদ্র আমের এমন বিভৎস ধাক্কার পরেও শক্ত থাকল। ভেতরে ভেতরে চূর্ণবিচূর্ণ হয়েও অটল পাহাড়ের মতো দৃঢ় রাখল নিজেকে। কিন্তু প্রিয়তা যখন ওর বুকে মাথা রেখে আবেগি কথা বলছিল। অসম্ভব যন্ত্রণায় ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছিল ওর। চাপা রাগ, দুঃখ, যন্ত্রণাকে দমিয়ে রাখতে না পেরে সেদিন প্রিয়তাকে ছুঁয়েই করে ফেলল এক ভয়ংকর প্রতিজ্ঞা। বলল, সেই বিশ্বাসঘাতক যেই হোক, তার বিনাশ রুদ্রর হাতেই লেখা আছে।

এরপরেই প্রিয়তার বাইরে বের হওয়া বন্ধ করে রুদ্র। কোন কারণে বের হলেও পাহাড়ায় রাখে রাজুকে। কিন্তু প্রিয়তার আসল উদ্দেশ্য তখনও ধরতে পারেনা। মাঝখানে ডেলিভারি আর ডিলের টাকা জোগাড়ের ঝামেলায় সবদিকে পরিপূর্ণ নজর দেওয়া সম্ভব হয়না কোনভাবেই। কিন্তু ঝামেলাটা হয় তখন, যখন পুনরায় লিক হতে থাকে বৈঠকঘরের ভেতরকার খবর। উধাও হতে থাকে একের পর এক ডোনাররা। বিষয়টা নিয়ে একদিন বৈঠকঘরে বসে চিন্তা করতে থাকে রুদ্র। একা। ঘরে জ্বলছিল শুধুমাত্র একটা টেবিল ল্যাম্প। কেউ কীকরে সবটা জানছে? সে যদি প্রিয়তাও হয় সেই বা জানবে কীকরে? বৈঠকঘরে মেয়েদের প্রবেশ নিষেধ। পাহারাও থাকে সবসময়। তাহলে কীকরে? সারা বৈঠকঘরে যে কোন ডিভাইস নেই তা তন্নতন্ন করে খুঁজে নিশ্চিত হয়েছে রুদ্র। জাফর, এমনকি উচ্ছ্বাসের সঙ্গেও সবসময় একটা করে মাইক্রোফোন আছে। ওরা সেটা প্রকাশ করলেও জেনে যাবে রুদ্র। তবে? বাকি কে থাকে। ও নিজে!
ব্যপারটা সঙ্গেসঙ্গে ধাক্কা দেয় রুদ্রর মগজে। ও নিজে! অর্থাৎ ওর সঙ্গেই এমনকিছু আছে যা দিয়ে ভেতরের সব পরিকল্পনা বাইরে যাচ্ছে! নিজের দিকে একবার তাকায় রুদ্র। এমনকিছু যা সবসময় ওর সঙ্গে থাকে। উত্তরটা জ্বলজ্বল করতে থাকে ওর বাঁ হাতে। প্রিয়তার দেওয়া সেই ব্রেসলেট। যা ও সবসময় পড়ে। স্নান আর রাতে ঘুমোতে যাওয়ার সময়টা বাদে। জিনিসের সঙ্গে নামের সংযোগটাও পরিষ্কার! সময় নষ্ট না করে সঙ্গে সঙ্গে ব্রেসলেটটা খোলে রুদ্র। চারদিকে খুব ভালোভাবে পরীক্ষা করেও কোন ডিভাইস পায়না। কিন্তু কিছুতো অবশ্যই আছে। হঠাৎই রুদ্রর চোখ পড়ে মাঝের পাথরটার দিকে। জিনিসটা অনেকটা লকেট সিস্টেমের মতো। একটু কষ্ট করলে খোলা যায়, তবে ভেঙে যাওয়ার ভয় থাকে। সেকারণেই অতীতে কখনও খোলার চেষ্টা করেনি রুদ্র। কিন্তু আজ আর বসে থাকল না। খুলে ফেলল ওপরের পাথরটা। সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে দৃশ্যমান হল খুবই ছোট একটা মাইক্রোফোন। সেটাকে বৃদ্ধা আর তর্জনী আঙুল দিয়ে হাতে তুলল রুদ্র। চোখের সামনে তুলে ধরল ছোট্ট সেই ডিভাইসটা। সেই সঙ্গে পুরোপুরি গুড়িয়ে গেল রুদ্রর সেই সুখমহল। 
তিক্ত এক হাসি ফুটে উঠল রুদ্রর। সেই হাসিতে ছিল জঘন্যভাবে ঠকে যাওয়ার অসীম যন্ত্রণা। অপলক চোখে ও কেবল দেখেই গেল ডিভাইসটা। যে হৃদয়ে ঐ মেয়েটার জন্যে আকাশসম ভালোবাসা পুষে রেখেছিল। সে হৃদয়টা কোন প্রশিক্ষণের ধার ধারল না আর। টপ করে এক ফোটা জল গড়িয়ে নামল চোখ দিয়ে। সেদিন রুদ্র স্পষ্ট বুঝল, প্রিয়তা কেন এসেছে আমের ভিলায়। কেন বিয়ে করেছে ওকে। শুধুমাত্র নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্যেই রুদ্রর কাছে নিজেকে সমর্পন করেছিল প্রিয়তা। গোটা ব্যপারটায় কোথাও ভালোবাসা ছিলোনা। কোথাও না। যে মেয়েটাকে গভীর প্রনয়ে ও বুকে আগলে রেখেছিল। সে মেয়েটাই খুব দক্ষভাবে আঘাত করেছে ওর হৃদপিণ্ডে। বুকে মাথা রেখে পিঠে ছু*রি বসিয়েছে সে। আর রুদ্র! রুদ্রও অন্ধের মতো শুধু ভালোবেসে গেছে। বিশ্বাস করে গেছে। হাজারটা আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েও মেয়েটাকে দুহাতে আগলে রেখেছে। সবকিছু হারিয়েও যেই অবলম্বনটুকু আগলে রুদ্র স্বাভাবিক জীবনে ফেরার স্বপ্ন দেখছিল; সে এসেছিলই ওকে ধ্বংস করতে। এই ভয়াবহ, নিদারুণ সত্য হজম সহজ ছিল রুদ্রর কাছে? কখনই না। সারারাত সেদিন বৈঠক ঘরেই কাটিয়ে দেয় রুদ্র। পাগলের মতো ছটফট করে। যাকে ভালোবেসে ও সব করেছে সে তাকে কখনই ভালোবাসেনি। ব্যবহার করেছে, ভালোবাসার নাটক করেছে। জঘন্য অভিনয় দিয়ে প্রতিনিয়ত ওকে ঠকিয়েছে। নিজের অনাগত সন্তানকে হারানোর পর আবার সেদিন কেঁদেছিল রুদ্র। আবছা অন্ধকারে ঘেরা বৈঠক ঘর ওর নীরব হারাকারে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।

প্রিয়তাকে কাছে না টানার প্রক্রিয়া সেদিন থেকেই শুরু হল। মনকে শক্ত করে রুদ্র শুধু এটা জানার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠল কেন এই ফাঁদ? কী এমন কারণ যার জন্যে সোলার সিস্টেমকে ধ্বংস করতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল প্রিয়তা! নিজের সর্বোস্ব বিসর্জন দিয়ে দিল! কীসের এতো ক্ষোভ? কীসের রাগ? সেই সত্য উদ্ঘাটনেই ঠান্ডা মাথায় আরও এক ফাঁদ পাতে রুদ্র। সেই ফাঁদে খুব চমৎকারভাবে পা দিয়ে ফেলে প্রিয়তা। দিতেই হতো। কারণ এবার চালটা চেলেছিল রুদ্র আমের! প্রিয়তার আসল পরিচয়টা সেদিনই আসে রুদ্রর সামনে। শওকত মীর্জার মেয়ে রাণী মীর্জা নামক রমনীর সঙ্গে সেদিন প্রথম পরিচয় হয় ওর। কিন্তু সেদিন কষ্ট নয় ভয়ংকর রাগ হয় রুদ্রর। বিশ্বাসঘাতকাকে তীব্র ঘৃণা করে আসা ওর সঙ্গে এমন নোংরা প্রতারণা হয়েছে জেনে নিজের ওপরেই রাগ হয় ওর। সেই রাগে পৃথিবী ওলটপালট করে দিতে ইচ্ছা করে। কিন্তু রুদ্র আমের নামক পুরুষ যেনো আলাদাই কোন এক ধাতুতে তৈরী। সেকারণেই স্থির থেকে অপেক্ষা করে ও। সঠিক সময়ের অপেক্ষা! 

কিন্তু রুদ্রের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যায় সেই সন্ধ্যায়! যেদিন ইকবালকে খু*ন করে প্রিয়তা। সময়টা ছিল গোধূলি। গুরুত্বপূর্ণ এক কাজ সেড়ে রুদ্র নিজের জিপে উঠে বসে। আমের ভিলায় ফিরবে। ফোনটা তখনও বন্ধ ছিল ওর। অন করার সাথেসাথেই হোয়াটস্অ‍্যাপে একটা ভয়েসমেইল পায় রুদ্র। আননোন নাম্বার। আরও আগেই পাঠিয়েছে কেউ। কিন্তু ফোন বন্ধ ছিল বিধায় দেখতে পায়নি। ভয়েসমেইলটা শোনার সঙ্গেসঙ্গেই থম মেরে যায় রুদ্র। সেখানে ইকবাল তার যন্ত্রণামাখা অস্পষ্ট গলায় প্রিয়তার সব অপকর্ম সংক্ষেপে বলে যাচ্ছে। সেই জঙ্গলের প্রথম দেখা থেকে শুরু করে নিজের অনাগত সন্তানের হত্যা। সাব্বিরের খু*ন সবটাই বলেছে। যা সে জানতো। ইকবালের গলায় একেকটা বর্ণনা মেরুদণ্ড দিয়ে শীতল স্রোত নামিয়ে দেয় রুদ্রর। ঘাড়ের পেছনের চুলগুলো দাঁড়িয়ে যায় ভয়ংকর শিহরণে। চারপাশটা কেমন ঝিম ধরে রুদ্রর। শক্ত হয়ে জমে যায় গোটা শরীর। মস্তিষ্ক অকেজো হয়ে যায় কিছুক্ষণের জন্যে। 
যে প্রিয়তাকে ও ভালোবেসেছে। যে প্রিয়তার সত্তাকে ও ভালোবেসে। সে সত্তাটুকুই পুরোপুরি মিথ্যা! একবিন্দুও সত্য ছিলোনা সেখানে। রাণী মীর্জাই হল বাস্তব। প্রিয়তা কেবল রুদ্রকে ধ্বংস করার একটা অস্ত্র ছিল। চারপাশে বিভ্রান্তের মতো তাকায় রুদ্র। গোটা জগতটাকেই মিথ্যা, ভ্রম, ছলনা মনে হয় ওর। অদ্ভুত এক যন্ত্রণাময় ঘোরে চলে যায় রুদ্র। 

সেই ঘোর কতক্ষণ ছিল জানা নেই রুদ্রর। তবে ইকবালের কথা মনে পড়তেই নিজেকে সামলে নেয় ও। দ্রুত কল করে সেই নাম্বারে। রিসিভ করে সেই সিএনজি ড্রাইভার। ইকবালের বিষয়ে জিজ্ঞেস করতেই সে জানায়, কোথায় ছেড়ে এসেছে তাকে। ইকবালের ভয়ংকর শারীরিক অবস্থার কথাও জানায় সেই ড্রাইভার। সেই মুহূর্তেই উন্মাদের মতো গাড়ি চালিয়ে আমের ভিলায় পৌঁছেছিল রুদ্র। কিন্তু দেরী হয়ে যায়! ততক্ষণে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে ইকবাল। লাশটা দেখামাত্র রুদ্র বুঝে যায় খু*ন করা হয়েছে ইকালকে। আর সেটাযে প্রিয়তাই করেছে তা বোঝার বাকি থাকেনা ওর। সেইসময় ভেতরে কী তীব্র ক্রোধ পুষে দাঁড়িয়ে ছিল তা কেবল রুদ্র জানে। ইকবাল নামক মানুষটাকে ও ভালোবাসতো। গোপনে বড় ভাই মেনে শ্রদ্ধা করতো। সে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, বিষয়টা ভেতরে ভেতরে আঘাত করেছিল রুদ্রকে। সেদিন আঘাত করে মানুষটাকে ভুল বোঝার গ্লানি! ঐ মুহূর্তে রাগ এতোটাই মাত্রা ছাড়িয়েছিল ঐ মুহূর্তেই প্রিয়তার গলা চেপে ধরতে ইচ্ছা করছিল রুদ্রর। অথচ সে মুহূর্তেও অসম্ভব ধৈর্য্যের পরিচয় দেয় ও। 
এরপরেই রুদ্র ঠিক করে আর নয়! থামাতে হবে প্রিয়তাকে। তবে সেটা প্রিয়তা রূপে নয়। রাণী মীর্জা রূপে। এবার স্বয়ং রাণী মীর্জার মুখোমুখি হবে ও। দুবাই যাওয়ার বন্দবস্ত আগেই করেছিল রুদ্র। সেদিন দিনটা এগিয়ে আনে। আর সেই প্রস্থান ঘীরেই সাজায় নিজের শেষ চাল।

কুয়াশা ভেদ করে মৃদু রোদের আলো চোখে লাগতেই অতীত থেকে বেরিয়ে আসে রুদ্র। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলতে গিয়েও কীকারণে যেন চেপে যায়। দুবাই যাওয়ার আগের দিন রাতে মনে রাগ, দুঃখ, ক্ষোভ নিয়েও প্রিয়তাকে কাছে টেনেছিল রুদ্র। কারণ ও জানতো সেটাই শেষবার। এরপর আর কোনদিন প্রিয়তাকে কাছে টানবেনা ও। কারণ এরপর ওর সামনে আর কোনদিন প্রিয়তা আসবেই না। আসবে রাণী মীর্জা। প্রিয়তাকে অসম্ভব ভালোবাসলেও রাণী মীর্জাকে ঘৃণা করে রুদ্র। তাকে আর যাই হোক, ভালোবেসে ছোঁয়া যায়না। সেইসঙ্গে নিজের প্রতিটা স্পর্শে ও প্রিয়তাকে এটাও অনুভব করিয়েছে এই শেষ! আর কোনদিনও এমন মুহূর্ত আসবেনা। রুদ্রর বিশ্বাস, প্রিয়তা অনুভব করেছে সেটা।
হাতের সিগারেটটার দিকে তাকিয়ে দেখল পুড়ছে সেটা। কিন্তু তারচেয়েও ভয়ংকরভাবে পুড়ছে রুদ্রর হৃদয়। জীবনে দুজন নারীকে ভয়ংকর ভালোবেসেছিল রুদ্র। অথচ দুজনেই ওকে ভয়ংকরভাবে ঠকিয়েছে। একজন অকালে চলে গিয়ে ওর 'রাজা' নামক সত্তাকে কেড়ে নিয়েছে। আরেকজন ছলনা করে ওর সমস্ত অস্তিত্বকেই বিষাক্ত করে দিয়েছে। ভালোবাসা নামক শব্দটাই কেড়ে নিয়েছে। ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে ওকে।

রুদ্র নদীর জলে ছুড়ে মারল সিগারেটটা। নিশ্চয়ই এখন আগুন নিভে গেছে। শীতল জলে ঠান্ডা হয়ে গেছে সেটা। কিন্তু রুদ্রর বুকের দহনযে চিরস্থায়ী। মৃত্যু ছাড়া জগতের কোন শীতলতা সেই দহনকে নেভাতে পারবেনা। কোনভাবেই না।

*

বদ্ধ ঘরটার পিনপতন নীরবতায় আরও বেশি আবদ্ধ মনে হচ্ছে পরিবেশ। প্রিয়তা স্থির হয়ে বসে আছে। রুদ্র এখন সব জানে! সব! বিষয়টা জেনেও মানতে চাইছেনা ওর মন। কিন্তু দিনটাতো আসারই ছিল! তবে আর কটাদিন দেরীতে এলে বোধহয় ভালো হতো। চাপা এক যন্ত্রণায় ভাড় হয়ে আছে ভেতরটা। 

' আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছেনা ম্যাডাম?'

জয়ের প্রশ্নে সম্বিত ফিরে পেল প্রিয়তা। নিজেকে সামলে বলল, ' এসব তোমাকে রুদ্র বলেছে?'

' হ্যাঁ।'

' কখন?'

' যখন আমার কাছ থেকে সে অবশিষ্ট সত্য জানছিল, তখন।'

প্রিয়তা বিরক্ত হল, ' কথা না ঘুরিয়ে সরাসরি বল। কী হয়েছিল?'

প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে মুচকি একটু হাসল জয়, 'বেশ। বলছি।'

***

চোখেমুখে গরম পানি পড়তেই ঝাঁকি খেয়ে নড়ে ওঠে জয়। পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। ঝাঁপসা লাগে সামনেটা। নড়তে গিয়ে টের পায় আটকে রাখা হয়েছে ওর হাত-পা। সঙ্গে ব্যথায় টনটন করে ওঠে মাথাটা। পিটপিটে দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে দেখে এক মানব অবয়ব বসে আছে ওর ঠিক সামনে। অস্পষ্ট। দু'বার মাথা ঝাঁকিয়ে দৃষ্টি পরিষ্কার করে নেয় জয়। দৃষ্টি স্পষ্ট হতেই চমকে ওঠে ও। ওর ঠিক সামনে কাঠের একটা চেয়ারে পায়ে পা তুলে বসে আছে রুদ্র আমের। হাতে এম.টি.নাইন। চোখদুটো কেমন লালচে হয়ে আছে। সারা শরীর জমে গেল একপ্রকার। এই একটা দৃশ্যটাই জয়ে হৃদপিণ্ডে হাতুরির আঘাত করার জন্যে যথেষ্ট। 

জয়ের যতদূর মনে আছে, সন্ধ্যায় মারা গেছে ইকবাল। মারা গেছে বলতে খুন করেছে রাণী ম্যাডাম। সেদিনকার সব কাজ শেষ করে নিজের জন্য বরাদ্দ ফ্ল‍্যাটে ফিরেছিল ও। খুব বেশি রাত হয়নি তখনও। অন্ধকার ফ্ল্যাটে লাইট জ্বালাতেই নিচ্ছিল তখনই কেউ সজোরে আঘাত করে মাথায়। তীব্র যন্ত্রণায় অন্ধকারকেও আরও বেশি গাঢ় মনে হয় জয়ের। ঝিঁ ঝিঁ করে ওঠে ভেতরটা। এরপর? এরপর আর কিছু মনে নেই। নিজের দিকে তাকাল জয়। দুটো হাত টেবিলের ওপর টানটান করে শক্তিশালী টেপ দিয়ে আটকে রাখা হয়ে। পা সহ গোটা শরীর চেয়ারের সঙ্গে। শুকনো গলায় একটা ঢোক গিলে রুদ্রর দিকে তাকায় জয়। মাথার ব্যথাটা এখনো ভোগাচ্ছে। রুদ্র শীতল চোখে দেখছে ওকে। কিছু বলছে না।
জয় বুদ্ধিমান, চতুর। সেকারণে শুরু থেকেই প্রিয়তার খুব পছন্দের ছিল ও। নিজের ডান হাত হিসেবে জয়কে রাখার মূল কারণই ছিল জয়ের বুদ্ধি, সাহস আর পরিস্থিতি সামলানোর দারুণ দক্ষতা। সুতরাং কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিস্থিতি বুঝে ফেলে ও। ওকে রুদ্র এখানে তুলে নিয়ে এসেছে। এভাবে! যার অর্থ সত্যি জেনে গেছে রুদ্র। সেটা যেভাবেই হোক। এবং ওকে না খু*ন না করে এভাবে ধরে নিয়ে আসার কারণও স্পষ্ট। কিছু জানতে চায় রুদ্র। কিন্তু কী?

' কেমন লাগছে?'

রুদ্রর শীতল গলায় করা প্রশ্নটায় চমকে ওঠে জয়। বিভ্রান্তি নিয়ে তাকিয়ে থাকে কেবল। মুচকি একটু হাসে রুদ্র। হাতে রাখা এম.টি.নাইন টা নাড়াতে নাড়াতে বলে, ' কী নামে ডাকব তোকে? রাজু? নাকি_ জয়!'

ঘনঘন দুটো শ্বাস ফেলে জয়। ওর ধারণাই সত্যি। সোজা হয়ে বসে রুদ্র। টেবিলের ওপর দু হাত রেখে বলে, 'তোর প্রশংসা না করে সত্যিই পারছিনা। সোলার সিস্টেমে সবচেয়ে দীর্ঘসময় টিকে যাওয়া বিশ্বাসঘাতক তুই। এতো দীর্ঘদিন তোর ম্যাডামও টেকিনি। কনগ্রাচুলেশনস্। রেকর্ড করেছিস!'

মাথায় এখনো যন্ত্রণা হচ্ছে। কিন্তু তবুও শান্ত থাকে জয়। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কেবল। চোখে প্রশংসা ফুটে ওঠে রুদ্রর। সামান্য মাথা দুলিয়ে বলে, ' অতীতে তোর সাঙ্গপাঙ্গ যারা ছিল তারা ধরা পড়ার পর আমার হাতে-পায়ে ধরে কান্নাকাটি করেছে। তপু যদিও পাল্টা আঘাত করেছিল। তবে সেটা সাহস দেখিয়ে নয়, প্যানিক করে। এমনকি ওদের সবার মরার খবর পেয়েও পালাসনি! সেক্ষেত্রে তুই ব্যতিক্রম। বোঝা যাচ্ছে, কেন আড়াইটা বছর টিকে ছিলি।'

 'আমি জানতাম আপনি একদিন সবটা জেনে যাবেন।'

'তবুও ভয় হয় একবারও?' রুদ্রর কন্ঠে চাপা ক্রোধ। পারলে এক্ষুনি খু*ন করে জয়কে। 'বেশ, সাহস আছে। যন্ত্রণা সহ্য করার ক্ষমতা ঠিক কতটা সেটাও পরীক্ষা করি।'

বলেই টেবিলের জিনিসপত্রের দিকে তাকায়। রুদ্রর দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকায় জয় নিজেও। কতগুলো পেরেক রাখা আছে, সঙ্গে একটু হাতুরি। রুদ্র বলে, ' তোকে এখানে এনেছি একটা এক্সপেরিমেন্ট করতে। টানা আড়াইবছর যে এমন সাহসিকতার পরিচয় দিল তার সহ্য ক্ষমতা পরীক্ষা করব আজ। কয়েকটা প্রশ্ন করব আমি তোকে। আর সেই প্রশ্নের উত্তর যদি আমার মনমতো না হয় তবে এই টেবিলের ওপর রাখা তোর হাত দুটোতে একটা একটা করে পেরেগ বসাব আমি। খুব সময় নিয়ে, যত্ন করে। এরপর হাঁটুতে গু*লি করে একটা একটা করে পা অকেজো করব। এরপরেও যদি কাজ না হয়। তাহলে তোর আর এই ধরণীতে কোন কাজ নেই বৎস। ওপারে পাঠানোর ব্যস্ততা আমার বু*লে*টই করে দেবে। আরেকটা কথা। আমি সবটাই জানি। শুধু কিছু জিনিসটি একটু বিরিফলি শোনার আছে। সুতরাং, চালাকি করলেও লাভ হবেনা।'

বলেই টেবিল থেকে একটা পেরেগ হাতে তুলে নেয় রুদ্র। অপর হাতে নেয় হাতুরি। ভেতরে ভেতরে হৃদপিণ্ড অস্বাভাবিক গতিতে লাফাচ্ছিল জয়ের। ভয়ে টিপটিপ করছিল ভেতরটা। কিন্তু অদ্ভুত এক আনন্দও হচ্ছিল। এই দিনটার অপেক্ষাইতো করছিল ও। জয় ক্লান্ত গলায় বলে, ' যদি বলি এসবের কোন দরকার নেই। আমি নিজেই বলব সবটা?'

ব্যঙ্গাত্মক হাসি দেয় রুদ্র, ' এতো তাড়াতাড়ি ভয় পেয়ে গেলি?'

' একটুতো পেয়েছিই স্যার। তবে ভয়ের সঙ্গে খুশিও হয়েছি। দেড় বছর যাবত এই দিনটার জন্যে অপেক্ষা করছি আমি। তাই আজ আমি বলব সব।'

' আর সেগুলো যে সব সত্যি হবে, সেটা কেন বিশ্বাস করব আমি? যে নিজের মালকিনের বিশ্বাস ভাঙতে পারে। সে আমার বিশ্বাস ভাঙবেনা সেটা বিশ্বাস করব কীকরে?'

ঠোঁটে নিষ্প্রাণ এক হাসি ফোটে জয়ের। বলে, ' বিশ্বাস জিনিসটা এই মুহূর্তে আপনি আর কাউকে করতে পারবেন না। সেটা আমি জানি স্যার। তবে একটা গল্প শোনাব। সেটা শুনলে আপনি বুঝে যাবেন আমি মিথ্যে বলছিনা।'

নির্বিকারছন্দে হাতুরি আর পেরেগটা নিচে নামিয়ে রাখে রুদ্র, 'বেশ। শোনা তোর গল্প।'

এরপর জয় যা বলে তা কয়েক মুহূর্তের জন্যে হলেও স্তব্ধ করে দেয় রুদ্রকে। বিস্ময় আর অবিশ্বাসের স্পষ্ট ছাপ ফুটে উঠে চোখেমুখে। একটা মেয়ে এতোটা নিকৃষ্ট হয় কীকরে! সেই মেয়েটাকে কি-না ও ভালোবেসেছে! চারপাশটা কেমন গুলিয়ে ওঠে রুদ্রর।
নিচের দিকে তাকিয়েই বলছিল জয়। কিন্তু কথা শেষ হতেই জলভর্তি চোখে তাকায় রুদ্রর দিকে। সঙ্গে সঙ্গে দুফোটা অশ্রু গড়িয়ে নামে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে নিজেকে। ভাঙা গলায় বলে, ' বিশ্বাস হচ্ছেনা স্যার? যাকে এতোটা ভালোবাসেন তার এমন ঘৃণ্য রূপ মানতে পারছেন না তাইনা?'

চোখ সরিয়ে নেয় রুদ্র। গভীর এক শ্বাস নেয়। সঙ্গে সঙ্গে শক্ত হয়ে ওঠে ওর চোয়াল। কঠোর হয়ে ওঠে দৃষ্টি। গালের পেশিগুলো কেঁপে ওঠে পরপর দুবার। কঠিন দৃষ্টিতেই জয়ের দিকে তাকায় রুদ্র, ' যদি এতোটাই ঘৃণা করো তোমার ম্যাডামকে। তাহলে এই দেড়বছর তাকে সার্ভিস দিয়েছো কেন? আর আমার কাছে এসে কেন বলে দাওনি সবটা?'

জয় বিষাদ মাখানো হাসি দিয়ে বলে, ' ডার্ক নাইট ছাড়লে নিজের প্রাণ দিয়ে ছাড়তে হয়। সেটাতো আপনার জানাই আছে। আর আপনাকে বললে আপনি বিশ্বাস করতেন না। ম্যাডামের ব্যপারেতো একদমই না। প্রমাণ চাইতেন। আর সেই প্রমাণ জোগাড়ের বিন্দুমাত্র চেষ্টা করলেও জেনে যেতেন ম্যাডাম। ফলাফল সেই একই হতো। মৃত্যু।'

থম মেরে কিছুক্ষণ বসে থাকে রুদ্র। ঝট করেই নিজেকে সামলে ফেলে বলে, ' তুমি সোলার সিস্টেমে জয়েন করেছিলে আড়াই বছর আগে। স্বপন, তপু, সবুজ, খোকন সবাই ধরা পড়েছে, তুমি বাদে। কীকরে? টেকনিক টা কী ছিল?'

' কিছুই না করা। ম্যাডাম এমনটাই পরিকল্পনা সাজিয়েছিল। দলের হয়ে কিছু করবনা আমি। আর যদি কিছু না-ই করি তো ধরা পরার কোন কারণও থাকবেনা। আমাকে স্টকে রেখেছিলেন ম্যাডাম। শেষ মুহূর্তে কাজে লাগানোর জন্যে। যেমনটা আপনি দেখেছেন।'

ছোট্ট করে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দেয় রুদ্র। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে যায় সেই হাসি। পুনারায় শক্ত হয়ে ওঠে চোয়াল। কঠিন হয় দৃষ্টি। টেবিলে দুহাত রেখে ঝুঁকে গিয়ে বলে, 'বাবাকে কে বিষ দিয়েছে?'

' ম্যাডাম নিজে।'

' সম্ভব না। ঐদিন রাত থেকে সকাল অবধি আমার বুকে শুয়ে ছিল ও। এক মিনিট কেন এক সেকেন্ডের জন্যেও কোথাও যায়নি।'

ঠোঁট বাঁকিয়ে সামান্য একটু হাসে জয়, 'ঠিক! কিন্তু রাশেদ বাবা সুগার ফ্রি খেতেন।'

বিস্ফোরিত চোখে জয়ের দিকে তাকায় রুদ্র। জয় বলে, ' হ্যাঁ। আগেরদিন রাতে সুগারফ্রির সঙ্গে বিষ মিশিয়ে রেখেছিলেন ম্যাডাম। উনি জানতেন সকালে চা করা হবে রাশেদ বাবার জন্যে। আর সুগার ফ্রি এই আমের ভিলায় একমাত্র রাশেদ বাবাই সুগার ফ্রি খেতেন। পরে আপনি টেস্ট করিয়ে কিছু পাননি কারণ তার আগেই ম্যাডাম ওটা সরিয়ে অন্য একটা টিউব সেখানে রেখে দিয়েছিলেন।'

অজান্তেই কখন যেন হাত মুঠো হয়ে গেছে রুদ্রর। দাঁতে দাঁত চেপে বসে আছে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে রাশেদ আমেরের সেই তেজস্বী মুখটা। একটা ঢোক গিলে রুদ্র বলে, 'কক্সবাজার যাওয়ার পর যা হয়েছিল সে সবই ওর প্লান ছিল?'

' হ্যাঁ।'

মনে মনে তাচ্ছিল্যের হাসি দেয় রুদ্র। তারমানে ওকেও মা*রতে চেয়েছিল প্রিয়তা! ওর নিষ্পাপ বোনটার সাথে_' সর্বাঙ্গ জ্বলে ওঠে রুদ্রর। বহু কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে বলে, ' রাতুলকে ওকে সিঁড়ি থেকে ধাক্কা দেওয়ার অর্ডার কে দিয়েছিল? ও নিজে?'

' না। সম্রাট তাজওয়ার। তবে ম্যাডামকে না বলে উনি কোন সিদ্ধান্ত সাধারণত নেননা।'

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে রুদ্র। সম্রাট! নিজের প্রেমিকা আর হবু বউয়ের গর্ভে অন্যকারো সন্তান সহ্য হয়নি বা*স্টার্ডটার! রাগে ভেতর ভেতর কেঁপে কেঁপে উঠছিল রুদ্র। এমন সময় জয় বলে, ' ম্যাডামের বিষয়ে আরও একটা কথা আপনি জানেন না স্যার। যদিও সেটা আপনার জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। কিন্তু হ্যাঁ, ওনার চরিত্র সম্পর্কে খুব ভালোভাবে ধারণা হয়ে যাবে আপনার।'

ভ্রুকুটি করে রুদ্র, ' কী সেটা?' 

' নিজের মাকে খু*ন করেছেন উনি। তাও ষোল বছর বয়সে!'

বাক্যদুটো ভয়ংকর বজ্রপাতের মতো ধাক্কা দেয় রুদ্রর কানে। এতক্ষণ যা যা শুনেছে তাতে আহামরি চমকায়নি ও। কারণ অনেককিছুই সে আগেই মোটামুটি জানতো। কিন্তু এই কথাটা ভেতর থেকে নাড়িয়ে দেয় রুদ্রকে। রুদ্রকে চমকাতে দেখে জয় বলে, ' আর এই কথাটা ম্যাডাম নিজে বলেছিলেন আমাকে। ব্রিটেনে থাকতে, ড্রাংক অবস্থায়। মিথ্যে হওয়ার কোন সুযোগ নেই। আর এতোটাই নৃশংসভাবে মে*রেছে শুনলেও গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠবে। শুধু এইটুকু বলতে পারি, শরীরের একটা অঙ্গও অক্ষত ছিলোনা তার।'

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে রুদ্র। শওকত মীর্জার বউ অন্য পুরুষের হাত ধরে পালিয়ে গিয়েছিল। এমনটাই জানতো রুদ্র। কিন্তু পালিয়ে গেলে কেউ এভাবে হাওয়া হয়ে যায় কীকরে সেটাই বুঝতে পারতো না। সেদিন বুঝতে পারল। কিন্তু এর পেছনের অন্তর্নিহিত ঘটনাটাযে এতোটা ভয়ংকর সেটা জানতোনা। মুখের সামনে ভেসে ওঠে প্রিয়তার নিষ্পাপ, মায়াবী মুখটা। যে মায়ায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গিয়েছিল রুদ্র। অথচ সেই মুখের পেছনে এতোটা হিংস্রতা লুকিয়ে আছে! ও ভেবেছিল এতোটা হিংস্র প্রিয়তা কীকরে হলো ওর পরিবারের প্রতি, ওর প্রতি। যারা ওকে এতো ভালোবাসা দিয়েছে তাদের এতোবড় ক্ষতি করল কীকরে! রুদ্র কিংবা রাশেদের কথা যদি বাদও দেয়। কুহু? ওই মেয়েটার জন্যে একটুও মায়া হলোনা ওর! কিন্তু সে মুহূর্তে আয অবাক হয়নি রুদ্র। নিজের জন্মদাত্রী মাকে যে শেষ করতে পারে, সে সব পারে! 
অথচ কী নিঁখুত মিথ্যে বলেছিল প্রিয়তা ওকে। ওর নাম, পরিচয় সবটাই ছিল মিথ্যে দিয়ে ঘেরা! নিজেকে এতিম দাবি করেছিল। মাকে হারানোর যন্ত্রণার কথা বলেছিল। নিজেকে যতটা অসহায়, নিষ্পাপ দেখানো সম্ভব দেখিয়েছে সে। আর রুদ্রও বোকার মতো বিশ্বাস করেছে সব। সবহারা মেয়েটাকে সবকিছু দিয়ে আগলাতে চেয়েছিল ও। কিন্তু সবটাই ছিল ছলনা! প্রতারণা! সেই মিথ্যে, ছলনা, প্রতারণার খেলা টানা দুটো বছর! সারা শরীর গরম হয়ে ওঠে রুদ্রর। বুকটা অসম্ভব ভারী মনে হয়। প্রচণ্ড ঘৃণায় ভেতরসহ কেঁপে ওঠে ওর।

জয় বলে, ' ম্যাডাম কোন সাইকোর চেয়ে কম না স্যার। র*ক্তের পিপাসা উঠলে পাগল হয়ে যায় সে। তখন শুধু খু*ন করার বাহানা খোঁজে। ঐ মুহূর্তে একমাত্র রক্ত দেখলেই শান্ত হন উনি।'

দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুদ্র। এ বিষয়ে আর কিছু শুনতে চাইছিলনা ও। সবচেয়ে বড় কথা মেনে নিতে পারছিলনা। ভেতরটা ঝলসে যাচ্ছে জয়ের একেকটা কথায়। 

' আপনি হয়তো এখন আমাকে মেরে ফেলবেন। কিন্তু বিশ্বাস করুন এখন আমার মরলেও আর কোন আফসোস নেই। যে কারণে এতোদিন বেঁচে ছিলাম তা আজ পূরণ হয়েছে। জীবন থেকে আর কিছু চাওয়ার বা পাওয়ার নেই আমার।'

জয়ের দিকে স্থির চোখে তাকায় রুদ্র। থমথমে গলায় বলে, 'কেউ নিজে মরতে চাইলে তাকে মারতে ইচ্ছা করেনা আমার। তোমাকে মারবনা আমি আজকে। কিন্তু আমার কথামতো কিছু কাজ করতে হবে তোমাকে। ঠিক আমি যা, যা বলব তাই। তবে মনে রেখো, তোমার প্রতিটা পদক্ষেপের ওপর নজর থাকবে আমার। সামান্যতম চালাকি করলে সেদিনটাই তোমার শেষ দিন হবে।'

থেমে গেল জয়। প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে দেখল অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। চোখেমুখে অন্যমনস্ক একটা ভাব। কিন্তু প্রিয়তা ওর কথা শুনতে সেটাও টের পেল স্পষ্ট। তাই বলে চলল, ' তাদের পরেরদিন সকালে স্যার দুবাই চলে গেলেন। এরপর থেকে ওনার ইনস্ট্রাকশন অনুযায়ীই সব করেছি। রাতুলকে আপনি কোথায়, কীভাবে মারতে চেয়েছিলেন সেটাও আমিই জানিয়েছি স্যারকে। তবে সেসব প্রাণের ভয়ে নয়; নিজের ক্ষোভ থেকে। ঐযে বললাম দেড় বছর যাবত এই দিনটার অপেক্ষা করেছি আমি।'

এবার জয়ের দিকে তাকাল প্রিয়তা। চোখদুটো লালচে হয়ে আছে। শান্ত গলায় বলল, ' দুবাই কেন গিয়েছিল ও। জানো?'

' না। জানলেও বলতাম না।'

' আরেকটা ফাঁদের কথা বলছিলে তুমি। যেটা দিয়ে রুদ্র আমার রাণী মীর্জা পরিচয় জেনেছিল। সেটা কী?'

' সেটা স্যার আমাকেও বলেনি।'

চাপা শ্বাস ফেলল প্রিয়তা, 'আমার প্রতি তোমার এতো ক্ষোভ কীসের জয়? যতটুকু মনে পরে তোমার কোন ক্ষতি করিনি আমি।'

তাচ্ছিল্য করে হাসল জয়, ' আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা আপনিই করেছেন ম্যাডাম।'

' কী সেটা?' সত্যিই অবাক হয়েছে প্রিয়তা।

হালকা করে মাথা নাড়ল জয়, ' এখন না। যদি কখনও আপনাকে দেখে আমার করুণা হয়,সেদিন বলব।'

' জয়!'

আর কিছু বলল না জয়। উঠে এঁটো প্লেটটা নিয়ে বেরিয়ে গেল ঘরটা থেকে। সঙ্গে সঙ্গে তোষকের কোণায় তাকাল প্রিয়তা। যেখানে জয় বসেছিল, সেখানে জয়ের বাটন ফোনটা রাখা। ফোনটা প্রিয়তাই দিয়েছিল জয়কে। ওর সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্যে। 
ফোনটা শুরু থেকেই লক্ষ্য করেছে প্রিয়তা। মনে মনে চাইছিল যেন ঝোঁকের ফেলে যায় জয়। হয়েছেও তাই। বসা অবস্থাতেই দ্রুত ফোনটার দিকে এগিয়ে গেল প্রিয়তা। দরজার দিকে সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে নিল। এরপর পা দিয়ে কাছে টেনে নিল ফোনটা। আগে থেকেই ভেবে রেখেছিল কী করবে। পায়ের আঙুল দিয়েই ডায়াল করল একটা নাম্বারে। কয়েকবার উল্টোপাল্টা চাপ লাগল, ফোন সরে গেল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অনেক কসরত করে সফল হল প্রিয়তা। কল রিসিভ হতেই প্রিয়তা বলল, ' রাণী বলছি।'

সঙ্গেসঙ্গে ব্যস্ত হয়ে উঠল কলের ওপাশে থাকা সম্রাট। উত্তেজিত গলায় বলল, ' রাণী! ঠিক আছো তুমি? তোমার কিছু হয়নিতো। ঐ বা*স্টার্ডটা _'

' শাট আপ সম্রাট!' রেগে উঠল প্রিয়তা। ' বেশিক্ষণ কথা বলতে পারবনা আমি। শর্টকাটে যা বলছি শোন। কোথায় আছি আমি জানিনা। যে নাম্বারে কল করেছি তার লোকেশন ট্রাক করে জানার চেষ্টা করো আমি কোথায় আছি। দ্রুত! জানার সঙ্গে সঙ্গে কাউকে পাঠাও এখানে। কিছু করার জন্যে না নজর রাখার জন্যে। তোমরা কিছু করতে আসলে বিপদে পড়ব আমি। আমি নিজেই বের হওয়ার চেষ্টা করব রাতের মধ্যে। তখন বাইরে কাউকে দরকার হবে আমার। যদি আজ নাও বের হতে পারি; প্রতিদিন পালা করে একজন করে থাকতে বলবে। ফর গট সেইক, যেটুকু বলেছি শুধু সেইটুকু করবে। নয়তো খু*ন করব তোমাকে আমি।'

কথাটা বলেই বুড়ো পায়ের আঙুল দিয়ে কল কেটে দিল প্রিয়তা। কল হিস্ট্রি থেকে মুছে ফেলল নাম্বারটা। এরপর আবার পিছিয়ে গিয়ে বসল নিজের জায়গায়। জানেনা কতটা কী লাভ হবে। তবে বের হওয়ার চেষ্টা ওকে করতেই হবে। সময় ঘনিয়ে আসছে।

*

কিছুক্ষণের আগেই রাতের খাবার নিয়ে এসেছিল রঞ্জু। খায়নি প্রিয়তা। হাজার খুঁজেও বের হওয়ার কোন উপায় খুঁজে পায়নি। ভাবসাব দেখে মনেও হচ্ছেনা আজ বের হতে পারবে। জয়ের বিষয়টা নিয়ে এখন আর ভাবছেনা প্রিয়তা। জয় কেন এসব করেছে তা জানার ইচ্ছা নেই এখন ওর। এখন মনে-প্রাণে শুধু মুক্তির পথটাই খুঁজছে ও।

শটান করে দরজা খোলার শব্দ হতেই চমকে উঠল প্রিয়তা। একপ্রকার ঝড়ের বেগেই ভেতরে প্রবেশ করল রুদ্র। রুদ্রর রাগে ভয়ংকর হয়ে ওঠা চোখমুখ দেখে কেঁপে উঠল প্রিয়তা। অবাক হওয়ার সুযোগটা অবধি পেলোনা ও। তার আগেই ওর পা ধরে নিজের দিকে টেনে নিল রুদ্র। দ্রুতগতিতে খুলতে শুরু করল পায়ের বাঁধন। প্রিয়তা কিছু বলবে তার আগেই হাতের বাহু ধরে টেনে দাঁড় করাল ওকে রুদ্র। রাগে হিসহিসিয়ে বলল, ' এতোদিন শুনেছো। আজ দেখাব তোমাকে। চলো!'

বলেই টেনেহিঁচড়ে প্রিয়তাকে নিচে নিয়ে গেল রুদ্র। আচমকা হামলায় স্তব্ধ হয়ে গেছে প্রিয়তা। বিস্ময়ে একটা শব্দও বের হলোনা মুখ দিয়ে। কিন্তু নিচে যেতেই সে বিস্ময় আরও বাড়ল। দেখল, একটা ছেলে হাত বেঁধে গেড়ে বসিয়ে রাখা হয়ে। তার দিকে ব*ন্দু*ক তাক করে আছে রঞ্জু। পেছনে দাঁড়িয়ে আছে জয়। ছেলেটাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভীষণ জোরে মারা হয়েছে ওকে। ওকে চেনে প্রিয়তা। সম্রাটের সঙ্গে দেখেছে বহুবার। শুধু নামটা মনে পড়ছেনা। সুতরাং যা বোঝার বুঝে যায় ও। 

প্রিয়তাকে ঝাড়ি দিয়ে ছেড়ে দেয় রুদ্র। এগিয়ে গিয়ে কলার ধরে দাঁড় করায় সেই ছেলে। টেনে নিয়ে এসে দাঁড় করায় প্রিয়তার সামনে। শক্ত চোখে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বলে, 'বলেছিলাম কোনরকম চালাকি করোনা। ক্ষতিটা তোমারই হবে। কিন্তু কেমন ক্ষতি হবে সেটা বোঝনি, তাইনা? বোঝাচ্ছি!'

বলতে বলতে পকেট থেকে একটা নাইফ বের করল রুদ্র। প্রেস করতেই বেরিয়ে এলো ধারালো ফ*লা। থতমত খেয়ে গেল প্রিয়তা। অস্ফুট স্বরে বলল, ' রুদ্র_'

বিদ্যুৎ গতিতে পরপর দুটো ছু*রির টান পড়ল ছেলেটার গলায়। র*ক্ত ছিটকে এলো প্রিয়তার মুখে। পেছনমোড়া করে হাত বাঁধা অবস্থায় মাটিয়ে পড়ে ছটফট করতে থাকল ছেলেটা। ঠিক গলা কা*টা মুরগির মতো। প্রিয়তা বিস্ফোরিত চোখে তাকাল রুদ্রর দিকে। রুদ্র দু'কদম এগিয়ে গেল প্রিয়তার দিকে। শীতল গলায় বলল, 'এরকম ক্ষতি হবে।'
.
.
.
চলবে..............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন