আশিয়ানা - পর্ব ৩২ - শারমিন আক্তার বর্ষা - ধারাবাহিক গল্প


শুভ্র নীলাভ মেঘ সারা আকাশ জুড়ে অনড় হয়ে রয়েছে। সারাটা বিকেল শপিংমলেই কেটে গেল। এক নাগাড়ে বিরতিহীনভাবে বসে থাকার জন্য পিঠ খানিক টনটন করছে। বাহির থেকে একটু ঘুরে আসার জন্য শপিংমল থেকে বের হলো জুবিয়া। ফারিয়া বেগম অবশ্য বলে দিয়েছেন, বেশি দূরে না যাওয়ার জন্য। জুবিয়া বাহিরে এসে রাস্তার এপাশ-ওপাশে চায়ের দোকান খুঁজতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যে রাস্তার মোড়ে ছোটো এক টংয়ের দোকান দেখতে পেল সে। একরাশ আগ্রহ নিয়ে এসে হতাশ হতে হলো তাকে। টংয়ের দোকানে চায়ের কোনো সরঞ্জাম নেই। জুবিয়া চলে আসার জন্য পিছু ঘুরতে হঠাৎ থমকে গেল। তূর্ণ তার ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। জুবিয়া ইতস্তত করে শুধাল,

' আপনি?'

তূর্ণ মুখে কিছু বলল না। একপলকে চারদিকে পর্যবেক্ষণ করে সে এগিয়ে এলো জুবিয়ার সামনে। এরপর একহাতে জুবিয়ার হাতখানা চেপে ধরে বলল,

' ও-ই দিকটা চলুন। এখানে কেউ আমাকে দেখে চিনতে ফেলতে পারে।'

হেঁটে হেঁটে দুজন প্রায় অনেকটা দূরে চলে গেল। এদিকটায় লোকজনের তেমন কোলাহল নেই। চারিদিক অন্ধকার ও শান্ত পরিবেশ। ঠাণ্ডা বাতাসে শীতেল হয়ে উঠল চারপাশ। অন্ধকারে ভীষণ ভয় জুবিয়ার, চোখ তুলে আকাশ দেখে ভয় ঢুকল মনে। তাত্ক্ষণিক সে এগিয়ে গেল তূর্ণর দিকে। তূর্ণর সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটার চেষ্টা করে। জুবিয়া দ্রুত হাঁটতে না পারায় বারংবার পিছিয়ে পরছে। তূর্ণ ঠোঁট মিলিয়ে প্রশস্ত হাসল। জুবিয়া রাস্তার মাঝখানে একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে সিরসিরে হাওয়ায় একটু কেঁপে উঠে চিৎকার করে তূর্ণকে ডাকলো, 

' একটু ধীরে হাঁটো! আমার জন্য দাঁড়াও...'

তূর্ণর জবাব এলো না। অন্ধকারেই যেন মিইয়ে গেল আস্ত এক মানব। ভয় প্রগাঢ় হলো জুবিয়ার ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলতে লাগল। জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর হঠাৎ পায়ে পায়ে পিছিয়ে এলো কয়েক কদম। বিশাল বড় বটগাছটা নজরে আসতে গা ছমছমে হয়ে উঠে। জুবিয়ার একবার ইচ্ছে হলো উত্তর দিকের সরু গলি দিয়ে দৌঁড়ে চলে যাওয়ার কথা তারপর দ্বিতীয় চিন্তায় সে থেমে গেল। 

তূর্ণ বটগাছটার পিছন দিয়ে গিয়ে এসে জুবিয়ার ঠিক পিছনে এসে দাঁড়াল। তারপর কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, 

' ভয় পাচ্ছ? কতবার বলেছি আমি থাকতে ভয় নেই।'

মেঘেরা তার চাদর সরিয়ে মূহুর্তে উন্মুক্ত করে দিল এক পশলা নিটোল চাঁদের। সহসা জ্যোৎস্নার আলোয় চারিদিক আলোকিত ও স্পষ্ট হতে শুরু করল। জুবিয়া আঁতকে ওঠা ভঙ্গিতে পিছন ফিরে তূর্ণর মুখোমুখি হলো। তূর্ণ ওষ্ঠকোণে মৃদু হাসি ফুটিয়ে তুললো। এরপর এক পা দু পা করে জুবিয়ার আরেকটু কাছে এলো সে। জুবিয়া বুঝতে পারলো না তূর্ণর মনে কি চলছে? বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল সে। 

জুবিয়া অবাক চোখে চারপাশে তাকাল। সড়কের দুইপাশের ল্যাম্পপোস্ট গুলো একে একে জ্বলে উঠল। আবছা আলোয় গাছপালা গুলো দেখে দ্বিগুণ চমকে গেল জুবিয়া। বাগানবিলাস গাছের লতাপাতায় মরিচবাতি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। ছোট্ট ছোট্ট বাতিগুলো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। গাছের ফুলগুলো মাটির দিকে নেতিয়ে রয়েছে। জুবিয়া জিজ্ঞেসু চোখে তূর্ণর দিকে তাকাল। 

তূর্ণ মুচকি হেসে বলল,

' একটা কথা বলি শোনো মেয়ে, তুমি আমার ফিলিংস বুঝো না। তোমার উপেক্ষায় আমার মনে দুঃখবিলাস চলে। তুমি আমার মন বুঝো না। আমার মন ভালো করার ক্ষমতা টুকু তোমার রয়েছে। আমার মনের রাজ্যের রাণী ওই দূরের আকাশ থেকে শুধু তোমার কথাই বলে।' 

জুবিয়ার ঠোঁট থেকে হাসির ঝিলিক ঝরছে। সে শীর্ণ পায়ে হেঁটে গেল বাগানবিলাস গাছের দিকে। রাতের বেলা গাছ থেকে লতাপাতা ছিঁড়তে নেই। সাদা রঙের ফুলগুলো ভালো করে দেখতে লাগল। সোনালী রঙের বাতির আলোতে ফুলটাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। তূর্ণ তাকিয়ে দেখল জুবিয়া তার থেকে অনেকটা দূরে চলে গেছে। সম্ভাবনা রয়েছে তার বলা কথা কিঞ্চিৎ পরিমাণও সে শোনেনি। তূর্ণ আরও খেয়াল করে। জুবিয়ার মুখখানা হাসি হাসি। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে তার সাথে খুব আনন্দময় কিছু ঘটেছে। পূর্ণিমা রাত ও নিশ্চল বাতাসে জুবিয়ার কপালের ছোটো চুলগুলো মৃদু উড়ে উড়ে উঠল। ফোনের রিংটোন শুনে প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করে তূর্ণ। সাদাফ কল করছে।  

তূর্ণ কলটি রিসিভ করে, ফোনের ওপাশ থেকে সাদাফ জিজ্ঞেস করল,

' তোকে কোথাও দেখতে পাচ্ছি না। কোথায় তুই?'

প্রশ্নের উত্তরে তূর্ণ বলল,

' এই আশেপাশেই আছি। কিন্তু কেন বল তো?'

' বাড়ি ফিরতে হবে। যেখানে আছিস তারাতাড়ি চলে আয়।'

তূর্ণ সাদাফের উপর বিরক্ত হয়ে জুবিয়ার দিকে এগিয়ে গেল। শত নিয়ম কানুন ভেঙে মনের ডাকে সাড়া দিয়ে ফেলল জুবিয়া। বাগান বিলাস গাছ থেকে এক টুকরো ফুল যত্ন করে তুলে নিল। তূর্ণ পাশে এসে দাঁড়ানো মাত্রই হাসি হাসি মুখে ফুলখানা তূর্ণর কানে গুঁজে দিল সে। তূর্ণ মুচকি হাসল। এরপর শপিংমলে যাওয়ার জন্য দুজন রওনা হলো। জুবিয়া আগে আগে একটু হেঁটে আরেকটু লাফিয়ে যাচ্ছে। তার আনন্দ বলে দিচ্ছে ওর জীবনের আনন্দ ও স্মৃতিময় রাত। তূর্ণ আলতো হাতে কানে গোঁজা ফুলটা হাতে নিয়ে নিল এরপর প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে জুবিয়ার পিছন পিছন হাঁটতে লাগল সে। জুবিয়া হঠাৎ একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে পড়ল। পা খানিক উঁচু করে একটা ডাল ধরে নিল সে। তূর্ণ এসে ডালটার নিচে দাঁড়াতেই দু'হাতে ডালটা ঝাঁকাতে লাগল জুবিয়া। চামেলিফুল গুলো ঝরঝর করে তূর্ণর মাথায় পড়তে লাগল। তা দেখে খিলখিলিয়ে হেসে উঠল জুবিয়া। 
.
দেখতে দেখতে হলুদের দিনক্ষণ এগিয়ে এলো। বাড়ির মুরব্বিদের মুখে খৈ ফুটেছে, সবাই একে অপরকে ঠেলাঠেলি করছে। বেশ কয়েকজন মেহেদী গাছের গোড়ায় গিয়ে কুলা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এবং অনেকজন ডাল থেকে মেহেদী পাতা তুলছে। দুজন কৃষক এসে বেশ কিছু হলুদ দিয়ে গেছেন। ফারিয়া কাজের মেয়েটাকে ধান দুবলা নিয়ে আসার জন্য পাঠিয়েছেন। তারাহুরো করতে গিয়ে গোলমাল পাকিয়ে ফেলছেন সকলে। কিছুক্ষণ পর সাদাফ এবং আরুশিকে হলুদ মাখিয়ে একবার গোসল করানো হবে। বিকেলে স্টেজে চারজনকে একসঙ্গে হলুদ মাখানো ও মেহেদী লাগানো হবে। তারপর রাতে আরও একবার গোসল করিয়ে শেষ করবেন। টিউব মেহেদী আছে তবুও গাঁয়ের লোকেদের কথামতো গাছের মেহেদী ও থাকবে। সকলের মন রেখেছে চার জনের সংসার গড়ে দিবেন ফারিয়া। বড় ছেলে সোহান সকালে নাস্তা করে হাঁটে গিয়েছে এখনো ফিরেনি। সঙ্গে করে ছোট্ট মেয়েটা কেও নিয়ে গেছে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে নাতনির জন্য ও চিন্তা হচ্ছে ফারিয়ার। শরিফুল চৌধুরী বারান্দায় বসে বাহিরের তরজমা দেখছেন। এমন সময় সুহানা খাতুন আসলেন। শফিকুলের খালা সুহানা। মা মরার পর মায়ের ভালোবাসা সুহানার কাছেই পায় সে। খালার কাছ থেকে মায়ের ঘ্রাণ নেয় শফিকুল। সুহানা এগোল, শফিকুলের মাথায় হাত রেখে শুধাল,

' বাপ তোর মনডা ভালা নি? এমন উদাস লাগতাসে কেন?'

শফিকুল ভারী নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,

' একমাত্র মেয়ে খালা। তারও বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। সব কিছু ফারিয়া আর দুই ছেলে দেখছে আর আমাকে দেখো হুইলচেয়ার বসে আছি। এই প্রথম নিজের পঙ্গুত্বের জন্য অসহায় লাগছে। মেয়ের জন্য কিছুই করতে পারছি না।'

সুহানা মাথায় হাত রেখে বললেন,

' তোর মাইয়ার কপাল অনেক ভালা বাপ। তোর মতন একজন বাপ ও পাইছে। ছোটো থেকা তিন পোলাপানের লাইগা কম করস নাই। আর নিজের জন্য আফসোস করস কেন পাগল? সন্তানের কাছে বাপের পা থাকনের চেয়ে বাপ থাকাই অনেক সুখের। তুই বাঁইচা আছস। তোর মাইয়া ঘুইরা আইসা তোরে বাপ কইয়া ডাকা পারে। এর চেয়ে শান্তির কিছু আছে? হুদাহুদি নিজেরে দুষ দিস না বাপ। এহন আমার লগে চল বাইরে যাবি। তোর মাইয়া পোলার বিয়ার হলুদ, মেন্দি বাটা দেখবি।'

ফারিয়া বেগম হুট করে ঘরে আসলেন। গলা তুলে বললেন,
' কই গো, তোমার ছোটো ছেলে কী কাণ্ড বাঁধিয়েছে। দেখবে এসো।'
.
.
.
চলবে....................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন