শাহজাহান তন্ময় - পর্ব ৬২ - নাবিলা ইষ্ক - ধারাবাহিক গল্প


আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ। কোমল উষ্ণতাহীন বাতাস শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি নামছে। সবেমাত্র মাগরিবের আজান পড়েছে। লেকপাড়টা আঁধারে অদেখিত কাব্যিকে রূপান্তরিত হয়েছে। নিবিড়ভাবে নীরব চারদিক। আলোছায়াতে জড়ানো লেকপাড়টা মনোমুগ্ধকর। নৈকট্যে দুজন কপোত-কপোতীর আদল বোঝা যাচ্ছে। পাশাপাশি বসে নিঃশব্দে ভিজছে বৃষ্টির ছোঁয়ায়। তিমিরাচ্ছন্নতায় ডুবে থাকা লেকের পানি দেখছে অনন্যচিত্তে। অদূর হতেই সেই দৃশ্য অরু মুগ্ধ চোখে দেখছে। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে তন্ময়ও একপলক তাকায়। ভ্রুদ্বয়ের মধ্যিখানে চারটে ভাঁজ পড়ে সঙ্গে সঙ্গে। অসন্তোষ হয় বড়ো। অনিন্দ্যসুন্দর কিছু তো নয়। এমনভাবে দেখার কী আছে? তন্ময় মাথা ঝুঁকিয়ে চাপাস্বরে শুধায়,

‘কী দেখছিস এত?’

অরু দৃষ্টি ফিরিয়ে আনে। সরল ডাগরডোগর চোখদুটোতে সুস্পষ্ট মুগ্ধতা। রিনরিনে কণ্ঠে বলে, ‘দেখেন তাদের কী দারুণ লাগছে দেখতে!’

তন্ময় বাধ্য হয়ে পুনরায় দৃষ্টি ফেলে অদূরে। অজানা মানব দেহ দুটোর অবয়ব দেখে। প্রিয়তমার মুখের ‘দারুণ’ শব্দের যথার্থ কোনো অনুভূতি তার অনুভব হয় না। তবুও নাকমুখে ‘হুম’ ধ্বনি তুলে ঐক্যমত্যতা প্রকাশ করে। এতে অরু উৎসাহিত হয়। আপ্লুত বদনে ফের চাইতে নিতেই— তন্ময় হাত বাড়িয়ে থুতনি ধরে আলতোভাবে। নিজের দিকে ওর মাথাটা ফিরিয়ে বলে,

‘অন্যদের দিকে চেয়ে থাকাকে অভদ্রতা বলে।’

অরু ঠোঁটে ঠোঁট টিপে। মাথা দুলিয়ে জানায়, ‘আর তাকাব না।’

তন্ময় সন্তুষ্ট হয়। থুতনি ছাড়ে। ডান হাতে ওর চুল বুলিয়ে আওড়ায়, ‘গুড গার্ল।’ পরপর সটানদেহে সামনে দৃষ্টি ফেলতেই আঁতকে ওঠে। রুস্তম, সৈয়দ, রিয়ান এবং মাহিন নির্নিমেষ নেত্রে চেয়ে। ওদের ঠোঁট দুটোর মাঝে সুবিস্তৃত ফাঁক। একই অবস্থা ঐশী এবং এলিজার। অন্যদিকে ইব্রাহিম, শুহানি শান্ত। নিঃশব্দে সকলের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। তন্ময় সামান্য কাশে। উঠে দাঁড়ায়। অপ্রস্তুত গলায় বলে,

‘চল ওঠ সবাই।’

মাহিন বত্রিশ দাঁত দেখাল এযাত্রায়। এক ঝটকায় দাঁড়াল। দ্রুতপায়ে তন্ময়ের কাছাকাছি এসে বামহাতে গলা পেঁচিয়ে ধরল। গাঢ়ভাবে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে নিম্নস্বরে বলল, 

‘মামা, তুই তো পুরাই গেছস। নিজেরে আয়নায় আজকাল দেখস? নাকি শুধু অরুকেই? মহা সৈকতের কত গভীরে আছস— জানস? ঠাঁই পাচ্ছস তো? তুই বোধহয় ডুবে ম র বি বলতেছি আমি।’

তন্ময় নির্বিকার ভঙ্গিতে হাত সরায়। পিছু ফিরে চায়। অরু শুহানির পাশে। ওদের সঙ্গে ধীরেসুস্থে হাঁটছে।
এখনো ঝিরঝিরে বৃষ্টি নামছে। সেই বৃষ্টি মাথায় নিয়েই মাইক্রোর দিকে এগুচ্ছে সবাই। হাঁটতে হাঁটতে তন্ময় অনাগ্রহী কণ্ঠে বলে,

‘ডুবেও শান্তি।’

 মাহিনের মুখটা দৃশ্যকর ভঙ্গিতে হা হয়ে আসে। নিজেকে চটপট সামলে দানবের মতন অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। গেয়ে ওঠে উচ্চকণ্ঠে, 

‘গভীর জলের ফিশ রে তুই,
গভীর জলের ফিশ। 
আমরা তাই নাম দিয়েছি…
তন্ময় একটা চিইজ।’

মাহিন গেয়েও থামে না। নিরাশ গলায় ব্যক্ত করতে থাকে, ‘কথায় আছে ‘ডু নট জাজ আ বুক বায় ইট'স কভার।’ এই বাক্যটি তোর ক্ষেত্রে শতভাগ মিলতেছে।’

রিয়ান ভেজা গলায় সুরে সুর মেলায়, ‘ইব্রাহিম দোস্ত আমার! আমারে মাফ করে দিস রে। আগে যখন তুই আমাদের তন্ময়ের কীর্তিকলাপ সম্পর্কে বলতি—তখন আমরা হেসে উড়িয়ে দিতাম। আজ তার কারণে অনেকগুলো সরি।’

ঐশী তন্ময়ের দিকে একপলক চায়। পরপর দৃষ্টি সামনে রেখে বলে, ‘ভার্সিটিতে দেখতে চার্মিং বয় হলেও তন্ময়ের পার্সোনালিটি ছিল গম্ভীর। চুপচাপ। এখনো গম্ভীর এবং স্বল্পভাষী। তবে কে জানতো ও এমন রোমান্টিক! এতো ভালোবাসতে জানে! স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করার মতন না।’

রুস্তম হেসে মাথা দোলায়, ‘আমরা আগে থেকেই জানতাম। তবে ওর প্রেমিক সত্তা সামনাসামনি দেখা এই প্রথম। তাই রীতিমত ধাক্কা খাচ্ছি।’

মাহিন আফসোস সুরে বলে ওঠে, ‘কী ভাগ্য মানুষের! চাচাতো বোনকে কোলেপিঠে বড়ো করে এখন বউ বানিয়ে নিয়েছে। এমন সুযোগ যদি আমাদেরও হতো…’ বাকি কথাটুকু আর মাহিন শেষ করতে পারল না। তন্ময় কঠিনভাবে চোখ রাঙাল। দাঁতে দাঁত পিষে বলল,

‘শাট-আপ, মাহিন।’

রিয়ান শব্দ করে হাসে। সৈয়দ বলে, ‘এই তোদের মনে আছে সেদিনের কথা? তখন অরু দশম শ্রেণিতে। ফুল দিয়ে অরুকে প্রপোজ করায় বাচ্চা ছেলেটাকে কী বেধড়ক মা ই রই না দিয়েছিল।’

তন্ময় আড়চোখে পিঁছু চেয়ে চাপাস্বরে ধমকাল, ‘থামবি তোরা?’ কথাটুকু বলে তন্ময় স্টিয়ারিং-এ উঠে বসল। এযাত্রায় তার পাশে এসে বসল রিয়ান। উচ্চকণ্ঠে গাড়ির সবার উদ্দেশ্যে জানাল,

‘আজ থেকে মেয়েরা এক সাথে থাকবে, সাথে অরুও। আমরা ছেলেরা একসাথে থাকব, সাথে তন্ময়ও।’

কিংকর্তব্যবিমূঢ় তন্ময় গাড়ি স্টার্ট করতে ভুলে যায়। ভ্রু তুলে শুধায়, ‘কী বললি?’
‘শুনিস নাই? আবার বলতেছি, শোন ভালো করে।’

তন্ময় আশ্চর্য না হয়ে পারল না। গতকাল থেকে সবগুলো তাকে জোরপূর্বক পারছিল না মধুচন্দ্রিমায় ডুবাতে। আর আজ সুর পরিবর্তন করে ফেলল? তন্ময়ের মুখ মুহূর্তে থমথমে হয়ে এলো। গম্ভীর হলো ভ্রুদ্বয়ে ছ'খানেক ভাঁজ। আড়চোখে সাইড মিরোরে দৃষ্টি ফেলল। অরু খোশমেজাজ নিয়ে গল্পগুজবে বিভোর। ও কি শুনেনি? 

 ——
 
বাগানবাড়ির দরজা খুলে দিয়েছেন দারোয়ান ইয়াসিন মোল্লা। কেয়ার টেকার বাবু মিঁয়া তখন বাগানে দাপাদাপি করছেন। সবকিছু পরিপাট্য ভাবে বন্দোবস্ত করা শেষ। বড়ো ছাতার ছাউনি লাগিয়েছেন। গুণে-গুণে চেয়ার পেতেছেন। গোরুর গোশত, মুরগি, মাছ ম্যারিনেট করে রেখেছেন। সাউন্ড বক্সের ব্যবস্থা করেছেন। চারটে সাদা বাল্ব লাগিয়েছেন। অল্প সময়ের মধ্যে চমৎকার সব আয়োজন করে ফেলেছেন ভদ্রলোক। মাইক্রো পার্ক করতেই হুড়মুড়িয়ে বেরুলো সবাই। শুহানি অরুর হাত ধরে রাখল। বাধ্য করল নিজের সাথে বেরুতে। তন্ময় এই দৃশ্যে কুণ্ঠিত হলো। গাড়ি থেকে বেরিয়ে চাইল বন্ধুদের দিক। অথচ কেউই তার দৃষ্টিতে দৃষ্টি রাখল না। মুখ খোলার পূর্বেই শুহানি অরুকে টানতে টানতে বলল,

‘অরু, চলো ফ্রেশ হয়ে একটু রেস্ট নেবে। এরপর পার্টি হবে আজ।’ 

তন্ময় ভ্রু কুঁচকে দেখল। অরুর বদন ঘরের ভেতর হারিয়ে যেতেই বন্ধুদের দিকে তাকাল, ‘এসবের মানে কী?’

রিয়ান যেন কিচ্ছুটি বুঝছে না, ‘কীসের কথা বলছিস?’ কথা শেষ করে সেও ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। একে-একে বাকিরাও। রুস্তম তন্ময়ের কাঁধ চেপে বলল, ‘দোস্ত, শুধু অরু অরু করলে হইব? আমাদের একলা সময় লাগব না? আজকে মাল আনছি। ইতালিয়ান বিউটি। এত্তো জোস ভাই। ১৯৭৫ এর মাল। টেস্টিইই…’

তন্ময় গম্ভীরমুখে বাঁধ সাধল সোজাসুজিভাবে, ‘আমি এসব খাচ্ছি না।’

সৈয়দ পেছন থেকে গুঁতো মারল, ‘তুই খাবি তোর বন্ধুগোষ্ঠীও খাবে।’

তন্ময় বাধ্যভাবেই ওদের সাথে রুমে এলো। বিছানায় মাহিন শুয়ে আছে। ইব্রাহিম চেয়ারে পায়ের ওপর পা তুলে বসে। রিয়ান জমিনে হাত-পা ছড়িয়ে– উদোম শরীরে শুয়ে; আপাতত সেলফোন টিপছে। তন্ময় ভালোভাবে ওদের মুখাবয়বে দৃষ্টি বিচরণ চালাল। তার মন খুঁতখুঁত করছে। কুঁ ডাকছে। কিন্তু কেন? এরমধ্যে বাবু মিঁয়া তন্ময়ের ল্যাগেজ হাতে দুয়ারে এসে দাঁড়ায়। তন্ময় বিস্ময়ে হকচকিয়ে ওঠে। বাবু মিঁয়া হেসে বলে,

‘বাবা, ল্যাগেজ নিয়ে আসছি। এইযে…’

রুস্তম আদেশ ছুঁড়ে, ‘ভেতরে রাখো, চাচা। অরুর ল্যাগেজ দিয়ে এসেছ না?’
‘হো। দিয়াই আইলাম মাত্র।’

রুস্তম মাথা দোলায় সন্তুষ্ট ভঙ্গিতে, ‘ঠিকাছে। আগুন ধরাও। আমরা আসতেছি।’
‘আইচ্ছা।’ 

বাবু মিঁয়া যেতেই তন্ময় রাগান্বিত চোখে বন্ধুদের দিকে চাইল। দাঁতে দাঁত পিষে গম্ভীরমুখে শুধাল, ‘হচ্ছেটা কী?’

মাহিনের সহজসরল জবাব, ‘কী হবে? ড্রিংক-ফ্রিংক করে তো আর অরুর কাছে যেতে পারবি না। তাই আজ আমাদের সাথেই থাকবি।’

‘আমি কখন বলেছি ড্রিংক করব?’ তন্ময়ের কণ্ঠে বিরক্তিপ্রকাশ ঝর্নার ন্যায় ঝরছে। তা বুঝেও যেন বুঝল না কেউ। প্রত্যুত্তরও করল না। নিজেদের মতন ব্যস্ত। তন্ময় হতাশায় মাথা নাড়ায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মেয়েটা কি করছে কে জানে! ওরা ডাকল আর সাথে-সাথে ধেইধেই করে চলে গেল। কই তন্ময়কে তো জিজ্ঞেস করল না! ফিরে একটিবার তাকাল অবদি না। কী আশ্চর্য! কী নিষ্ঠুর ব্যাপারস্যাপার। সবাই আজ এমন তার বিপক্ষীয় দলে নাম লেখাল কেন? 

———

সাউন্ড বক্স দুটো ছেড়েছে মাহিন। একটি ইংরেজি গান চলছে। রিয়ান ম্যারিনেট করা মুরগির পিসেস পুড়তে দিয়েছে। বাবু মিঁয়া উনুনের কার্যক্রমের দায়িত্বে অব্যাহত। সৈয়দ আধবসে দু'পায়ের পাতায় ভার ছেড়ে—মুরগির পিসেস গুলোতে তেল লেপ্টে দিচ্ছে। তন্ময় পায়ের ওপর পা তুলে গম্ভীরমুখে বসে। হাত ঘড়িতে নয়টা বিশ। আড়চোখে ঘনঘন চাইছে দুয়ার পানে। বাগানে আসবার পূর্বে অবশ্য একবার মেয়েদের রুমের সামনে গিয়েছিল সে। অরুকে সঙ্গে আনতে। দরজা লাগানো অবস্থাতেই শুহানি পরিষ্কার গলায় জানাল, অরু ব্যস্ত! আশ্চর্য রকমের কথাবার্তা! তন্ময়ের জন্য অরু কীভাবে ব্যস্ত হয়? অসম্ভব! অবিশ্বাস্য। সে বিশ্বাস করতে অপারগ। আর অরুটা কি করছে কী, হুঁ? তন্ময়ের গলার স্বর কী ও চেনে না? ডাকার পরও কোনো প্রত্যুত্তর করল না! পুরুষভাবাপন্ন এক সুগভীর অভিমান তন্ময়ের গলা রোধ করে বসল। পুরুষালি হাতটা ব্যস্ত হলো একটা সিগারেট ধরাতে। সে সিগারেট খাওয়া বন্ধ রাখবে কেন? কার জন্য? আগেপাছে ঘুরে বেরানো, চব্বিশঘণ্টা ভ্যাবলার মতন চেয়ে থাকা প্রিয়তমার এইরূপ তার ঠিকঠাক হজম হলো না। সিগারেটে দুটো অবহেলিত টান মেরে ফের চাইল। সেসময় ঐশীকে দেখতে পেলো বেরোতে। কালো জামদানি শাড়ি পরেছে। পরপর এলিজাকেও দেখা গেল। দুজনের শাড়ি একইরকম প্রায়। তন্ময় ডান হাতটা নিচু করল। সিগারেট লুকাল। দৃষ্টি দুয়ারপানে নিবিড় হলো। অথচ মিনিটখানেক পরও অরুকে দেখা গেল না। এলিজা এসেই অশান্ত তন্ময়কে দেখে মুখ টিপে হাসল। তন্ময় বিরক্ত গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ল,

‘অরু কোথায়?’

ঐশী ভেংচি কাটল, ‘কোথায় আবার? রুমে!’
‘ওকে আনিস নাই কেন?’ 

এলিজা দাঁত দেখিয়ে হাসল, ‘গল্প করছে শুহানির সাথে। শুহানি আর রিয়ানের প্রেম কাহিনী শুনছে।’

এই কথা শুনে রিয়ান পিলে চমকে ওঠে। চোখমুখ কালো করে ফেলে। বিড়বিড়িয়ে বলে, ‘ওর প্রেম কাহিনী বলা মানে একই ব্যাপার বলা। আমি প্লে বয় ছিলাম। অনেক মেয়ের সাথে প্রেম করেছি এটসেট্রা!’

তন্ময় যেন এই সুযোগটুকুর অপেক্ষাতেই ছিল। মুহূর্তেই লুফে নিলো, ‘ছিলিই তো? কতশত মেয়ের সাথে তরঙ্গলিলা করছিস তা গুণে শেষ করা সম্ভব না। আমি মিথ্যে বললেও শুহানি তো আর মিথ্যে বলবে না। ও আসুক। জিজ্ঞেস করব। সরাসরি প্রমাণ হবে।’

রিয়ান আশ্চর্য হলো, ‘খবরদার দোস্ত! এই ব্যাপারটা তুলিস না। ও শুরু হলে আর থামবে না। জানিস না তো কিছুই। গতমাসে আমার সাথে চারদিন যোগাযোগ রাখেনি। আমি ম রতে ম রতে বেঁচে ফিরছি। এই আলাপ শুনলে আবার কথা বলা বন্ধ করবে।’

তন্ময়ের সাবলীল স্বীকারোক্তি, ‘আমি তাই চাচ্ছি।’

হেসে উঠল উপস্থিত সকলে। তন্ময় ফের সিগারেট ঠোঁটে ছোঁয়াল। বাম হাতে ফোন বের করল। অরুকে ইতোমধ্যে দুটো মেসেজ পাঠিয়েছে। জবাব আসেনি। এবারে কল করল। রিং হচ্ছে, তবে রিসিভ হলো না। প্রেম কাহিনীতে কি এমন আছে যে ও তাকেও মনে রাখেনি। আসুক একবার। খবর আছে ওর। ধপধপ করে বুকের মধ্যিখানে জ্বলতে থাকা আগুন যেন বেড়েই চলেছে ক্রমান্বয়ে। নেভার নাম মাত্র নেই। মাহিন সহ বাকিরা মিটিমিটি হাসছে। এযাত্রায় চেয়ারে শব্দ করে বসল মাহিন। চিন্তিত গলায় শুধাল,

‘কীরে আমাদের বেইবি কই?’

রাগে তন্ময়ের কপালের শিরা ফুটে উঠল। অতিমাত্রা বিরক্ত দৃষ্টি কঠিনভাবে তাঁক করল। মুখ খুলে কিছু ভাষণ ছাড়বে পূর্বেই এলিজার গলা শোনা গেল,

‘এইতো চলে এসেছে শুহানি, অরু!’

তন্ময়ের ভ্রুদ্বয় শিথিল হলো। অশান্ত হৃদয় শান্ত হওয়ার পথে। ততক্ষণাৎ ঘাড় ফেরাতে নিয়েও ফেরাল না। একটু সময় নেয়ার চেষ্টা করল। লাভের লাভ কিচ্ছুটি হলো না। মন লাভলোকসান মানল না। দ্রুত গতিতে তাকাতে বাধ্যই হলো। ক্ষণিকের জন্য স্তম্ভিত হয় হৃদয়। দৃষ্টি নিষ্ঠুরভাবে থমকে পড়ে। গভীর হতে থাকে দৃষ্টির মানে। হাতের জ্বলন্ত সিগারেটটা পড়ে গেছে। সেলফোনটা পড়ার ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। তন্ময় আচমকা দাঁড়াতেই চেয়ার উলটে যায়। উচ্চধ্বনিতে হেসে ওঠে বন্ধুরা। এতেও তন্ময়ের হেলদোল হয় না। অদূরেই হাসতে থাকা শুভ্র রঙের জর্জেটের শাড়ি পরিহিত অরু ছাড়া যেন পৃথিবীতে কিচ্ছুটি নেই। কোনো শব্দ নেই। মাহিন চেঁচিয়ে উঠল,

‘শুহানি, ইউ ডিড আ গ্রেট জব, ম্যান!’

শুহানি শব্দ করে হাসল। অরুর হাতটা তখনো ধরে থাকল। ছাড়ল না। তন্ময়ের কাছাকাছি যেতেও দিলো না। অরু তখন লজ্জায় নেতিয়ে আছে গোলাপ ফুলের ন্যায়। চোখ তুলে তাকাতেও পারছে না। তন্ময় যেন সম্মোহন হলো। কিছুই আর চোখে লাগল না। এযাত্রায় আর বাঁধসাধ, চোক্ষুলজ্জাও মানল না। সবার সম্মুখেই অরুর সামনে চলে এলো। হাতটা ধরল প্রথমে আলতোভাবে। অতঃপর গাঢ়ভাবে, শক্ত করে। টেনে নিজের দিকে আনতেই পুনরায় শোরগোল শুরু হলো। সিটি বাজার আওয়াজ শোনা গেল। হাততালির, হাসাহাসির উচ্চ শব্দ। তন্ময় যেন ওসব কানেও তুলল না। অন্যদিকে অরুর আজ নাজুক অবস্থা। সে হাত আলগোছে ছাড়াতে চাইল। ফিসফিস করে বলল,

‘তন্ময় ভাই, সবাই হাসছে।’

তন্ময় হাত ছাড়ল না। উলটো দ্বিগুণ শক্ত করে ধরল। অন্যরকম হয়ে এলো তার কন্ঠের সুর, ‘তাতে কী?’

অরু হকচকাল। মাথা তুলে চাইল। ফের দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। তন্ময় ওকে নিয়ে পাশাপাশি চেয়ারে বসল। সৈয়দ গিটার এনে রেখেছে চেয়ারে। ইতোমধ্যে বারবিকিউ রেডিই। টেবিলে পরিবেশন করা হয়েছে।
সাউন্ড বক্স বন্ধ। সৈয়দ গিটারে সুর তুলছে। মুখে গুনগুন করছে। এরমধ্যে দু'চার ফোঁটা করে পুনরায় বৃষ্টি নামতে শুরু করেছে। মুশলধারা বৃষ্টি নামল এক মুহূর্তেই। চোখের পলকে! সৈয়দও উচ্চকণ্ঠে গাইতে শুরু করল। তন্ময়ের দৃষ্টি সামনে তবে ওদিকে মনোনিবেশ নেই। তার সকল ধ্যানধারণা কাছে –বড্ড পাশে বসা রমণীতে। অরু চুপচাপ কুণ্ঠিত হয়ে বসে। দৃষ্টি সামনে। সৈয়দের গান শুনছে একচিত্তে। গানটা হয়তোবা ওর পছন্দ হয়েছে। অপ্রস্তুত, লজ্জা ভাবটা কাটিয়ে উঠেছে। শুহানির দেখাদেখি নিজেও গুনগুন করছে। তন্ময় এক সেকেন্ড চোখ বন্ধ করল। ভেসে উঠল সাদা শাড়ি পরিহিত অরু। চোখের পর্দায় ভাসল সাদা শাড়িতে লেপ্টানো ফরসা পেট, পাতলা কোমর। পরমুহূর্তেই চোখ খুলে পাশে তাকাল। তার দৃষ্টি অনুভব করে অরু মিইয়ে গেল দৃশ্যমান রূপে। লাল হয়ে উঠল কানের লতি। তন্ময় রক্তিম কান ছুঁয়ে দেয়। বুকের ভেতর জ্বলতে থাকা আগুন যেন কণ্ঠে এসে ভীড় জমিয়েছে,

‘শাড়ি পরেছিস কেন?’

অরু নড়েচড়ে ওঠে। হাঁসফাঁস করে জানায়, ‘আপু বললেন পরতে।’
‘পরতে বললেই পরতে হবে? তাও এমনভাবে!’

অরু চোখ তুলে তাকায়। কেমন ভাবে? ওর প্রশ্নাত্মক চাহনিতে দৃষ্টি রেখে তন্ময় সরাসরি অরুর পেটের কাছটায় চায়। অরুও দৃষ্টি অনুসরণ করে চাইল। কাছাকাছিভাবে পরিষ্কার পেট দেখা যাচ্ছে। মুহূর্তেই মেয়েটা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়। দ্রুত আঁচল জড়ো করে পেটের দিকে। চিন্তিত গলায় বলে, 

‘আমি খেয়াল করিনি। আপু নিজের মতন পরিয়ে দিলেন।’

তন্ময় দেখল নিগূঢ়ভাবে কিয়ৎক্ষণ। অরুর পেছনে —ঠিক চেয়ারের ওপর থাকা তার হাতটা উশখুশ করছে। কয়েকবার ইচ্ছেটুকুকে ক বর দিতে চেয়েও পেরে উঠল না। আকস্মিক সে পেছন থেকেই অরুর শাড়ির ভাঁজ ভেদ করে কোমর ছুঁয়ে দিল। থরথর করে কাঁপল স্পর্শিত দেহটি। অরু ভয়ার্ত চোখে চাইল একপলক। সরে যাবার সামান্য প্রচেষ্টা। তন্ময় গ্রাহ্য করল না। শুধুমাত্র ছুঁয়েও থামল না। পুরুষালি রুক্ষ, শক্ত হাতে চেপে ধরল তুলতুলে পাতলা কোমর। পেটের কাছটা ছুঁতেই অরু নড়েচড়ে ওঠে। তন্ময় সেভাবেই শুধাল দাম্ভিক ভাবে,

‘ফোন কোথায়? কল ধরিস নাই কেন?’

অরু তোতলাল। পরিপূর্ণ প্রত্যুত্তর করতে পারল না। তন্ময় ঘনঘন শ্বাস ফেলল, ‘তুই কি চাচ্ছিস আমি ম রে যাই? ওরা চাচ্ছে আমাকে মা রতে, আর তুইও রেডি, হুঁ?’

অরুর নরম হাত দুটোও পেটে কাছটায়। বারংবার বৃথা, দুর্বল চেষ্টা শক্তসমর্থ পুরুষালি হাতটা সরানোর। তন্ময়ে আরেকটু গভীর হয়ে বসল। কণ্ঠ আকাশের মতন বিস্তৃত তবে সমুদ্রের ন্যায় গভীর,

‘তোকে দেখে একশো তিন ডিগ্রী জ্বর উঠে গেছে শরীরে।’
.
.
.
চলবে..............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন