বাবুইয়ের বাসা - বেলা শেখ - অনু গল্প


-"বাজার স্টেশন তো এইখানেই! বিশটাকার বেশি এক টাকাও দেব না! যাবেন?"
রিকশাওয়ালা খানিক সময় ভেবে মলিন মুখে বলে,
-" আইচ্ছা ওঠেন!"

মহিলাটি উঠে বসলে রিকশা ওয়ালা রিকশা টান দেয়! একটু দূরে যাওয়ার পর পরই ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে উচ্চ স্বরে! রিকশাওয়ালা এক হাতে রিকশা সামলিয়ে প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করবে গাড়িতে বসা মহিলাটি বিরক্তের সুরে বলে,
-" গাড়ি চালানোর সময় কথা বলা ট্রাফিক রুলসের বাইরে জানো না?"

রিকশাওয়ালা আর ফোন বের করে না। তবে ফোনটার অপাশের ব্যাক্তির যেন এতেও ক্ষ্যান্ত হয় না। একের পর এক কল করতেই থাকে। মিনিট দশের মধ্যেই রিকশা তার গন্তব্যে পৌঁছে যায়। ভাড়া নিয়ে ফোন হাতে নেয়। এখনো বেজেই চলেছে। ফোন রিসিভ করেই দেয় এক ধমক!
-" খেলবার আসি আমি? এল্লা পর পর খালি ফোন আর ফোন! বাত্তে খালি বইসা থাকতে থাকতে তেল গজাইছে? ফোন ধরি নাই মানে রিকশা চালাইতেছি! ঘটে এটুকু ঘিলু নাই লো?"
অপাশের ব্যাক্তি ধমক শুনে চুপসে যায়। মিনমিনে গলায় বলে,
-" আপা আইছে! বাজার ঘাট.."
তাকে শেষ না করতে দিয়েই এপাশ থেকে ধমক দিয়ে বললো,
-" তোর বইন মাসে দশ বার আসবো আর আমি কামাই কইরা তাগোরে গিলা ভরমু? পারমু না বাজার করতে! রাখ!"
অপাশের অভিমানীনি টইটুম্বুর নয়নে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে,
-" মুক্তা আপা আইসে! সাথে আপনের বোনের জামাই, ভাগ্নে ভাগ্নি!"
রিকশা চালক এবার অস্বস্তিতে পড়লো বোধকরি! আমতা আমতা করে বলল,
-" কহন আইছে?"
-" ঘন্টা খানেক হইবো!"
-" আমি বাজার নিইয়া আইতেছি! তুই সব রেডি কর! রাখতেছি!"
এবার শান্ত গলায় বলে লোকটা! অপাশে থেকে নাক টেনে এক অভিমানে ভরপুর ভগ্নকন্ঠ শোনা যায়,
-" শোনেন? কাছে বাড়ি হওয়ার লাইগা আমার বইন মাসে দুই একবার আসে। হাতে পায়ে ধরে বসাইলেও এক থাল ভাত খায় না। উপরন্তু মাইয়ার জন্য এতো এতো সদাই আনে! তাই কথা বার্তা একটু ভাইবা চিন্তা কইবেন!"
খপ করে কল কেটে দেয়! মনিরুজ্জামান নামক রিকশাওয়ালা ঝাকরা চুলে হাত চালায়! দিন দিন কেমন খিটখিটে মেজাজের হয়ে যাচ্ছে সে। মুখ দিয়ে একটুও ভালো কথা বের হয় না। সে রিকশায় বসে বড় বাজারের দিকে যায়। আপা এসেছে অনেক দিন পর একটু ভালোমন্দ না খাওয়ালে হয়?

••••••••••••

এক তেইশ চব্বিশ বয়সের নারী পড়নের মলিন কাপড়ের আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছে নেয়। মুচকি হেসে এগিয়ে আসতেই চারবছরে এক মেয়ে এগিয়ে এসে মায়ের হাত ধরে বলে,
-" ও মা আব্বাকে কইছো আমার জন্যে আইসক্রিম আনতে?"
নারীটি মেয়ের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলে,
-" না আম্মা! তোমার ফুপু ফুপা আইছে! তাদের জন্য বাজার করতেই তো সব টাকা ফুরাই যাইবো! অন্যদিন আনবো নে!"
মেয়েটির মুখ মলিনতায় ছেয়ে যায়! এরমধ্যে ঘরের কাঠের দরজা ঠেলে এক মধ্যবয়সী মহিলা বেড়িয়ে এসে বলে,
-" এই বিথী? কারেন্ট চইলা গেলোগা! তোর দুলাভাই গরমে হাপিত্যেশ করতাছে! হাতপাখা নাই?"
বিথী মুচকি হেসে বলে,
-" আছে আপা! ওই টিনের বাক্সের উপর! দাঁড়ান আমি বাইর কইরা দিতেছি!"
বলেই সে ঘরে ঢুকে। উচ্চ নিম্ন বিত্তের ঘর যেমন হয়! তেমনি ছোট ঘর! একটা খাট, কাঠের টেবিল, শোকেস ও একটা বাক্স! বিথী হাত পাখা বের করে বিছানায় বসে থাকা বয়স্ক গোছের লোকটাকে বাতাস করতে করতে বলে,
-" দুলাভাই? বেশি গরম লাগতেছে? রাস্তার ওপাশে দাঁড়াইলে অনেক বাতাস!"

লোকটি হেসে বিথীর হাত থেকে হাত পাখা নেয়! পাখা ঘুরাতে ঘুরাতে ঘরে থেকে বেড়িয়ে যায় একটু বাতাসের খোঁজে! বেশ গরম পড়েছে আজ! মোটা গোল মোল সাইজের হওয়ায় গরমটা তার বেশিই!

বিথীও ঘর থেকে বেরিয়ে এসে পাশের বাড়িতে গিয়ে ফ্রিজে রাখা গরুর দুধ, মাছের টোপলা নিয়ে ভিজিয়ে রাখে। পেঁয়াজ, রসুন ছিলে নেয়। অল্প আদা, রসুন, জিরা বেটে রাখে। তারপর মেয়ের খোঁজে যায়! মেয়েটাকে সে চোখ চোখে রাখে আজকাল। যুগ জামানা ভালো না। যেখানে মেয়ে নিজের বাড়িতেই সুরক্ষিত নয় অন্যের বাড়ির তো কথাই নেই। 
-" বাবুই? এই বাবুই? আম্মা?"

না কোন সাড়া নেই। বিথী পাশের বাসার ফারজানাদের বাসায় যায়। ফারজানার মেয়ে ফারিয়া বাবুইয়ের সমবয়সী সাথে খেলার সাথীও! ওদের বাসায় টিভি থাকার দরুণ মেয়েটা সুযোগ পেলেই কার্টুন দেখতে যাবে। বিথী এতো বকে শাসায় মেয়েটা যেন কানেই নেয় না। আজ একটা থাপ্পড় লাগাবে। ফারজানার বড় ছেলে সিক্সে পড়ে। ছেলেটা মোটেও সুবিধার নয়! তাই বাবুইকে ফারিয়ার সাথেও মিশতে বারণ করে বিথী। কিন্তু বাবুই এ কান দিয়ে ঢুকিয়ে ও কান দিয়ে বের করে দেয়। মেয়েটা যত বড় হচ্ছে ততই যেন অবাধ্য হচ্ছে। বাবুইয়ের বাবা এলে বলবে একটা ছোট টিভি কিনতে! মেয়েটা অন্যের বাড়িতে টিভি দেখতে যায়! বিষয়টা তার মোটেও ভালো লাগে না। বিথী গিয়ে দেখে বাবুই পাকা ফ্লোরে বসে টিভি দেখছে আর ফারজানার পা টিপে দিচ্ছে। বিথীর বুকটা যেন চৌচির হয়ে যায়। গরীবের ঘরে জন্ম তো কি হয়েছে? তার মেয়েকে সে কম যত্নে রাখে নি! সেই মেয়ে একটু টিভি দেখার লোভে অন্যের পা টিপে দেবে? সে বাবুইকে ডাকে! বাবুই লাফ দিয়ে উঠে। মা কে দেখে দৌড়ে বেড়িয়ে যায়! ফারজানা হেসে বলে,
-" পা টা অনেক ব্যাথা করতেছিল! তাই একটু! তুমি কিছু মনে নিও না!"
-" হুম!"
বলেই বিথী বেড়িয়ে আসে তাদের বাড়ি থেকে। নিজ বাড়ির আঙিনায় আসতেই দেখে বাবুই ঘরে ঢুকলো। সে কিছু বলে না‌ বাড়িতে মেহমান আছে! তাঁরা গেলে আজ মেয়েটার হচ্ছে!

হাত ভর্তি বাজার নিয়ে টিনের গেট খুলে বারান্দায় ঢোকে মনিরুজ্জামান ওরফে মনির! ছোট টিনের বাড়ি! হাফ ওয়াল টিনশেডের দুটো ঘর! গোসলখানা ও টয়লেট। উঠান নেই! শুধু একটা বারান্দাই বাড়তি জায়গা হিসেবে। সেখানেই রান্না বান্না করা হয়! বিথী বাড়ির নাম রেখেছে 'বাবুইয়ের বাসা'! মনির বাজার বারান্দায় রেখে ডাকে,
-" আপা? মুক্তা আপা? ময়না? সবুজ?"

একে একে সবাই ঘর থেকে বের হয়! ময়না, সবুজ মনিরের ভাগ্নে ভাগ্নি! মনির তাদের সাথে ভালোমন্দ কথা বলে! বিথীকে ডাকে। বিথী ঘর থেকে বের হয়! তার পিছনে বাবুই! মনির ব্যাগ থেকে তিনটা চিসস বের করে দুটো ময়না ও সবুজের হাতে দিয়ে আরেকটা বাবুইকে দেয়! বাবুই চিপস পেয়ে খুব খুশি হয়! তবে তার খুশি বেশিক্ষণ থাকে না। বাবুইয়ের থেকে বছর দুয়েক বড় সবুজ তার হাত থেকে চিপস নিয়ে বলে,
-" মামা আমি দুটো নিই?"
মনির মলিন মুখে দাঁড়ানো মেয়ের দিকে তাকায়! 
-" বাবুই তরে আবার কিইনা দিমুনি আচ্ছা?"
বাবুই মিনমিনে গলায় বলে,
-" আচ্ছা আব্বা!"

বাবাকে সে বেশ ভয় পায়! ভয় পাওয়ার কারণও আছে বটে। মেজাজি মনির যখন তখন মেজাজ হারিয়ে খেখিয়ে ওঠে। চর থাপ্পড় দিতে ভোলে না। আবার ভালোও বাসে তবে ভয়ের দরুণ ভালোবাসলেও কাছ ঘেঁষার সাহস হয় না! বিথী বাজারের ব্যাগ থেকে একে একে সব বের করে। মাংস, সেমাইয়ের প্যাকেট,পোলার চাউল সহ হাবিজাবি অনেক কিছুই এনেছে। বিথী তাঁর কাজে লেগে পড়ে। ময়না সবুজ ঘরে গিয়ে বসে। মনির গোসলখানায় ঢুকে পড়ে। বিথী আঁচলের গিট খুলে পাঁচ টাকা বের করে মেয়ের হাতে দেয়! বাবুই মা' য়ের গালে চুমু দিয়ে দৌড়ে যায় মনোহারি দোকানে।
 মুক্তা ও তার জামাই আরেক ভাইয়ের বাড়ি যায় বেড়াতে! মনির গোসল সেরে বেড়িয়ে আসে। বিথীর পাশে পিঁড়িতে বসে বলে,
-" দাউ দে? আলু আমি ছিইলা দিতাছি?"
-" দরকার নাই!"
মনির কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,
-" দে?"
বিথী দেয় না! চুপচাপ নিজের কাজ করতে থাকে। রগচটা মনির ক্ষেপে যায়। তবে বাড়িতে বড় বোন এসেছে দেখে মেজাজ নিয়ন্ত্রণে এনে বলে,
-" কুত্তার লাহান মুখ বানাইয়া কাম করনের দরকার নাই! উঠ? আমার বইনের জন্য আমিই রান্ধমু!"

বিথীর চোখ ভরে ওঠে। সে উঠে চলে যায় ঘরের ভিতরে। মনির চুলার পাশে বসে নিজেই সব কাজ করতে থাকে। রান্না বান্না সে মোটামুটি সামলাতে পারে। সে আলু ছিলে নিয়ে মাংস সহ ধুয়ে নেয়। এর মাঝেই বাবুই আপন মনে বরফ খেতে খেতে আসে। মনির তার হাতে বরফ দেখে বলে,
-" টাকা পাইলি কই? তোর ফুপা কিইনা দিছে?"

বাবুইয়ের চোখে ভয় স্পষ্ট! একবার বাবার পকেট থেকে না বলে টাকা নেওয়ায় মনির তাকে পঞ্চাশ বার কান ধরে ওঠবস করিয়েছিল! সেই দৃশ্য মানসপটে ভেসে আসায় সে মাথা নিচু করে বলে,
-" আব্বা বিশ্বাস কর আমি তোমার পকেট থাইকা নিই নাই! মা দিছে আমারে!"
মনির তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে বলে,
-" তোর মায়েরে ডাক?"

বাবুই আরো ভয় পায়! আব্বা মা কে আবার বকবে না তো? সে গলা উঁচিয়ে মা কে ডাকে। বিথী ঘর থেকে বেরিয়ে আসে মেয়ের আওয়াজে! মেয়ের ভিতু মুখটা দেখে মনিরের দিকে তাকায়! মনির তার দিকে না তাকিয়েই বলে,
-" নুন মরিচ কতটুক দিমু?"
বিথী মনে মনে ভেংচি কাটলো। কেন? তুই একাই রান্ধবি তোর বইনের জন্য এখন আবার দরকার পড়ে কেন?
বিথী বসে যায় পিঁড়িতে। হলুদ লবন সব মশলাপাতি পরিমাণ মোতাবেক দেয়! মনির ভালোকরে মেখে নিয়ে গ্যাসের চুলায় বসিয়ে দেয়। বিথী পোলার চাউল ধুয়ে এনে অপর চুলায় পোলাও বসিয়ে দিল। মনির টুকটাক কথা বলে বিথী হু হা তে জবাব দিল। সব রান্না বান্না শেষ শুধু পায়েস টা বসানো বাকি! মনির বলে,
-" তুই যা গোসল কইরা নিই! বাকি আমি সামলে নিব নে!"

বিথী তার কথামতো গোসলে যায়। সাত আট বছরের সংসার জীবন তার। বিথীর পরিবার অতি সচ্ছলতায় ঘেরা না থাকলেও মোটামুটি সচ্ছল ছিল! লোকটার সাথে বিয়ের কালে ঘটক এর পরিবারের গল্প করেছিল! ছেলে আই এ পাশ! গার্মেন্টসে উচ্চ পদে চাকরি করে। তখন অবশ্য গার্মেন্টসেই চাকরি করতো! তবে উচ্চ পদে নয়। সামান্য কর্মচারী! কিন্তু ঘটকের চাপাবাজিতে ফেসে যায়। ভালোকরে খোঁজ খবর না নিয়েই বিথীর পরিবার তাকে পাত্রস্থ করে। বিয়ের পর সত্যিটা জানাজানি হয়! ছেলের ঘর নেই! মেট্রিক ফেল! বিথীর পরিবার অনেক রেগে যায়! ছেলে সামান্য গার্মেন্টসের শ্রমিক! নিজের ঘর দুয়ার নাই ভাইয়ের দেয়া একটা ছোট খোপের মতো ঘরে থাকে। এ নিয়ে বাকবিতন্ড হয়। তবে এখানে মূল দোষী ঘটক! সেই কারসাজি সাজিয়ে দু পক্ষকে ঘোল খাইয়েছে! এরপর শালিষি বসে। বিথীকে বলে সে সংসার করবে কি না? বিথী রাজি হয় সংসার করতে। বিয়েটা কোনো ছেলে খেলা নয়! পরিবারের লোকজনের বিরুদ্ধেই সে সংসার করার সীদ্ধান্তে উপনিত হলে পরিবারের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। মনিরুজ্জামানও সহ্য করতে পারে না বিথীর পরিবারের লোককে! তবে বিথীকে সে মন থেকেই মেনে নিয়েছে। প্রথম কয়েকবছর বলা যায় মাথায় তুলে রাখতো! ঢাকায় এক গার্মেন্টসে চাকরির দরুণ সেখানেই থাকতে হতো। ছুটি পেলেই বউয়ের কাছে ছুটে আসতো! তবে এসে বউয়ের করুণ অবস্থা দেখে মায়া হতো। বাড়ির সব কাজ বিথীর উপরেই চাপিয়ে দেয়া হতো। অথচ অন্য বউয়েরা কাজের ধারের কাছেই ঘেঁষতো না। মনির সিদ্ধান্ত নেয় বউকে নিয়ে যাবে ঢাকায়। তার সিদ্ধান্তে কেউই খুশি হয় না। তবে বাধাও দিতে পারে না। মনির বউকে নিয়ে পারি জমায় ঢাকা শহরে। মাস তিনেক যাওয়ার পর বিথী হাঁপিয়ে ওঠে। ওই ব্যস্ত ঘটা শহরে তার ভালো লাগে না। সারাক্ষণ একা বাসায় থাকতে কারই বা ভালো লাগে? সেও জয়েন করতে চেয়েছিল গার্মেন্টস! কিন্তু মনির রাজি হয় না। সে সুস্থ থাকতে তার বউ কেন চাকরি করবে? দুই পয়সা কামাই করা শিখলেই তার উপর কথা বলবে? সেটা সে হতে দিবে না। এদিকে বিথীও জেদ করে সে বাড়ি চলে যাবে। মনির যেতে দেবে না‌। দিন শেষে কলুর বলদের খাটুনি খেটে রাতে নরম তুলতুলে বউকে পেয়ে তাঁর সকল ক্লান্তি দূর হয়ে যায়! মনের সুখ দুঃখের কথা বলার একজন সঙ্গী পায়! আদর যত্ন করার এক আদুরে বউ না থাকলে এখন সে থাকতে পারবে না। বিথীর যাওয়া হয় না। মাস যায় বছর। এর মধ্যে বিথী সন্তান সম্ভবা। একা ছোট ভাড়া বাড়িতে মনির সন্তান সম্ভাবা বউকে রেখে গিয়ে বুকে পাথর চেপে কাজ করতো! বিথীর ছয়মাস হলে মনির বিথীকে নিয়ে গ্রামে বাড়িতে চলে আসে। কিছুদিন সেখানে থাকার পর ভাইয়েরা কথা শোনায়। কাজ করে না ওকে এভাবে বসে কে পালবে? তাঁর উপর পোয়াতি বউ? অথচ মনিরের কাছে কিছু ক্যাশ ছিল! সেগুলো দিয়েই সে সংসারের খরচাপাতি দিতো মায়ের হাতে। কিন্তু খোঁটা ঠিকই শুনতে হতো। বিথীকে দিয়ে কাজ করানো হতো অভাঙ্গা। মনির মায়ের কাছে গিয়ে বলে সে আলাদা হতে চায়। ব্যস এতেই মনিরের মা রেগে যায়। আলাদা করে দেয় তাদের। দিন যায় মাস পেরোয়! বিথী এক মেয়ে সন্তানের জননী হয়‌। সবাই নাক সিঁটকায়! প্রথমেই মেয়ে? এতো পরের ঘরেই দিতে হবে। মনির অবশ্য এসবে কান দেয় নি। মেয়েকে সে আদর যত্ন করতো! তবে বিথীকে সে আরো আদরে সোহাগে রাখতো! গ্রামের এক চালের আড়তে কাজ করতো। প্রথম প্রথম ভালো চললেও মেয়ে এলে খরচ বেড়ে যায়! মেয়ের ওষুধ পত্র, বউয়ের ওষুধ পাতি! বিথী বাচ্চা প্রসব করে যেন শুকে কাঠ হয়ে গেছে। তাকে ভালোমন্দ খাওয়াতে হবে না? মাকে ভালোমন্দ খাওয়ালেই না বাচ্চা খাবার পাবে। মনির সিদ্ধান্ত নেয় আবার ঢাকা যাবে। বিথীও করুণ অবস্থা বিবেচনা করে সায় জানালো। চলল সবাই ঢাকা! সেখানে গিয়ে ভালোই চলছিলো। মেয়ে বড় হলো ধীরে ধীরে। হঠাৎ একদিন বিথী জেদ করে সে ঢাকায় থাকবে না! কেন? মনির জিজ্ঞেস করলেও কিছু বলতো না। তার জেদে হার মেনে মনির আবার বাড়িতে ফেরে। পৈতৃক সূত্রে ভাগে পাওয়া অল্প জমিতে ঘর বাড়ি তোলা হয়। এতেই হাতের ক্যাশ কড়ি শূন্যের কোঠায়। কাজ পায় না মনির! কি করবে ভেবেও পায় না। মেজাজ সবসময় তার সপ্ত আসমানে ভেসে বেড়ায়। বিথীর উপর রাগ হয়। ওর জন্যেই তো এখানে আসা! এখন বেকার হয়ে ঘোরো! বিথী মনিরের সব রাগ সহ্য করে নেয়‌ মাঝেমধ্যে অভিমান করে বসে থাকে। কখনো মনির দু এক মিষ্টি কথা বলে অভিমান ভেঙ্গে দেয় তো কখনো চিল্লাচিল্লি করে চড়াও হয়। কখনো কখনো থাপ্পড়ও জোটে বিথীর কপালে। বিথী থাপ্পড় খেয়েও স্বাভাবিক আচরণ করে যেন কিচ্ছুটি হয় নি! তখন মনিরের অনুশোচনা হয়। বিথীর আগেপিছে ঘুরঘুর করে খানিক আহ্লাদ করে। ফুচকা চটপটি আচার এনে খাওয়ায়‌। এর মধ্যে আরেক সংবাদ আসে। বিথী আবার মা হতে চলেছে! মনির এ সংবাদ শুনে বাকহারা হয়ে পড়ে। এটা খুশির সংবাদ নাকি দুঃসংবাদ ঠাহর করতে পারলো না। এই দুর্ভোগের সময় আরেক প্রাণের আগমন? নিজেরাই কত কষ্টে দিনাতিপাত করছে তারাই জানে! ঋনে ঋনে জর্জরিত হয়ে আছে সে। তার মধ্যে আরেকজনের দায়িত্ব কাঁধে কি করে তুলে নেবে? মেয়েটাকে কতমাস হলো দুটো ভালোমন্দ খাওয়াতে পারে না। মেয়েটাও কখনো আবদার করে না। দু পয়সা সদাই খাওয়ার জন্য দিলে খুশির ঠেলায় পারে না নেচে দিতে। এরমধ্যে এরকম সংবাদে মনির খুশি হতে পারে না। বিথীর উপর চটে যায়। কথায় কথায় খেকিয়ে ওঠে। মাস দুয়েক হবে ভাড়ায় রিকশা চালিয়ে কোনো মতে চলছে। অভাবের দায়ে রিকশা চালাতে মনির বাধ্য হয়। প্রথম প্রথম বেশ লজ্জায় পড়তো। পড়ে দু এক পয়সা কামানোর পর লজ্জা ভেঙ্গে গেছে। যেখানে অভাবে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে সেখানে লজ্জা ধুয়ে ধুয়ে সে পানি খাবে? তবে সে ভালো একটা কাজের খোঁজে আছে। রিকশা চালাবে না। লোকে মোটেও সম্মান দেয় না। যা তা বলে অপমান করে। ভাইয়েরাও টিটকারী গায়। মনির মুখ বুজে সহ্য করে। তবে বিথীর উপর তার চাপা রাগ হয়! কি হতো ঢাকায় থাকতে? এতো অভাব দেখতেই হতো না তাদের!
বিথীর পাঁচ মাসে চলছে। পেটটা এখন দেখা যায়! তবে মেয়েটাকে না। শুকিয়ে একদম কাঠ হয়ে গেছে। মনিরের রাগ হয় ওর উপর আবার মায়াও হয়। সব মিলিয়ে চলছে তাদের অভাবের সংসার! 

মনির পায়েসের পাতির চুলা থেকে নামিয়ে নেয়। একটা বাটিতে ঢেলে নেয়। এর মাঝে পায়েসের মিষ্টি ঘ্রাণ শুঁকে শুঁকে বাবুই ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে। চুলায় বাবাকে দেখে মুখ ছোট হয়ে যায়। মা থাকলে একটু চেখে দেখা যেতো! বাবা না আবার বকে দেয়! তবুও পায়েসের লোভ সামলাতে না পেরে বাবুই মিনমিন গলায় বলে,
-" আব্বা একটু পায়েস দাও না? এই অল্পই!"

মনির কপালে ভাঁজ ফেলে মেয়ের দিকে চায়। রাশভারী গমগমে গলায় বলে,
-" পেট ভাইঙ্গা পড়লো তোর? পরে খাইতে পারবি না?"
বাবুই মাথা নিচু করে বাড়ির বাইরে পা বাড়ায়। মনির ডাকে,
-" বাবুই?"
বাবুই বাবার কাছে এসে দাঁড়ায়। মনির মেয়েকে কোলে বসিয়ে দিয়ে টপাটপ চুমু দেয় গালে।
-" এখন অল্প খেয়ে কিছুই হইবো না। তোর ফুপুরা গেলে বেশি কইরা দিমু নে তোরে খাইস!"

বাবুই খুশি হয়ে হাততালি দেয়। বাবার গালেও চুমু দেয় এক বুক সাহস নিয়ে। মনির হেসে উঠলো। মেয়ের কপালে গালে আদর করে। এরইমধ্যে গোসল খানা থেকে বিথী বেড়িয়ে আসে। সদ্য স্নান সেরে বেরিয়ে আসা স্নিগ্ধ শোভন বউকে দেখে মনিরের ভিতরটা আনন্দে নেচে ওঠে। টগবগিয়ে বেড়ে যায় ভালো লাগা। তবে লম্বা চুল বেয়ে টপটপ করে পানি পড়তে দেখে গমগমে সুরে বলে,
-" চুল তো ভালো কইরা মোছসও নাই! ঠান্ডা লাগানোর পাঁয়তারা? হুম? লাগুক ঠান্ডা আমি এক টাকারও ওষুধ কিইনা দিমু না!"

বিথী গামছা দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বলে,
-" লাগতো না কারো ওষুধ! কঠিন অসুখ হউক! মরি তারপর আপনের শান্তি হোক!"

মনিরের মুখটা অসম্ভব রকমের কঠিনতায় ছেয়ে যায়। মুক্তা ও তার জামাই বাইরে টিনের গেট খুলে ভিতরে আসে। তারা অল্প দূরে আরেক ভাইয়ের বাড়িতে গিয়েছিল।বড় বোন, বোন জামাইকে দেখে মনির মুখটা স্বাভাবিক হয়। আজ আপারা আছে বলে বিথী বেঁচে গেল! নইলে গোটা কয়েক থাপ্পড় নিশ্চিন্ত কপালে ছিল! মনির বোন জামাইকে বলে,
-" দুলাভাই? হাত মুখ ধুয়ে আসেন! দুপুর গড়াইতে চলল খাইয়া লন কয়টা! আপা তুইও বাচ্চাগোরে হাত মুখ ধুইয়া দে?"

মুক্তা, তার জামাই, ময়না ও সবুজ খেতে বসেছে পাটিতে। মনির বেড়ে খাওয়াচ্ছে তাদেরকে। বিথী চুপচাপ বিছানায় বসে বাবুই‌কে মাংস দিয়ে পোলা ভাত খাওয়াচ্ছে। মেয়েটা অনেক দিন পর মাংস ভাতের মুখ দেখলো! তাই আস্তে আস্তে স্বাদ করে খাচ্ছে কোনো বাহানা করছে না। মনির সকলের খাওয়া শেষে পাতে পায়েস দেয়। বোন জামাই শ্যালকের হাতের পায়েসের প্রশংসা করলেন। মনির মুচকি হেসে সবাইকে আরো এক চামচ করে দিলো! সবাই খাওয়া শেষ করেই বাড়ি যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো শুরু করলো। মনির বিথী থাকতে বলল তাঁরা মানা করে বলল আবার আসবে। বাড়িতে ফিরতে হবে জলদি। জরুরী কাজ আছে। তাঁরা সবাই রেডি হয়ে বের হলো। মনির এগিয়ে দিতে গেলো!
বাবুই সব ভাত ধীরে সুস্থে খেয়ে মায়ের কাছে আবদার করলো পায়েস খাবে। বিথী মেয়ের মুখ মুছে দিয়ে পায়েসের জন্য গেলো! বাটি ফাঁকা দেখে পাতিলের ঢাকনা সরায়। সেখানেও নেই। বাবুই কান্না করে দিলো,
-" আব্বা আমার জন্যে এইটুকুও রাখলো না!"

বিথীর চোখ ভরে ওঠে। সে ধীরে ধীরে পা মেলে ফ্লোরে বসে পড়ে। পাতিল মুছে অল্প খানিক পায়েস বাটিতে ঢেলে বলে,
-" এই টুকু খাও আম্মা! আবার রাইন্ধা দিমু নে!"
বাবুই কান্না থামিয়ে বাটি হাতে নেয়। অল্পক্ষণ পায়েস। দু বার মুখে দিলেই শেষ হবে। অথচ বাবা বলেছিল বেশি করে রাখবে। বাবুই গাল ফুলিয়ে বাটি রেখে বলে,
-" আব্বাকেই দিও! আমি‌ খামু না!"
বলে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। 

ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে মনির সবটা দেখলো ব্যথিত নয়নে। সে মেয়ের জন্য পায়েস রেখেছিল। কিন্তু আপাকে যখন ভদ্র সুলভে একবার জিজ্ঞেস করে 'আপা আরেকটু পায়েস দিই?' আপা মাথা নাড়ে। মনির ভাবে নি আপা স্বীকার হবে। অগত্যা বাকি পায়েস টুকু বোনের পাতে দিয়েছিলো। মনির ঘরে ঢুকে পকেট হাতরায়। কিছু টাকা পেলে চিনি আনবে। পোলার চাউল আছে পোয়া খানিক। সেটা দিয়ে মেয়েকে রেঁধে দিবে‌ কিন্তু পকেটো বোধহয় ফাঁকি দিলো। মনির বিছানায় বসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-" বাবুই? আম্মা? আবার রান্ধে দিমু নি! রাগ করিস না! চাল আছে তো! টাকা থাকলে ওহনি চিনি আইনে বানাইতাম!"
বাবুই উঠে বসে। চোখ ডলে বলে,
-" সত্যিই তো? মিছা কইতাছো না তো?"
মনির মুচকি হেসে মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করে বেশ সময় নিয়ে।
-" একশ ভাগ সত্যি! আর আইসক্রিমও কিইনা দিমু!"
বাবুই খুশি হয়ে বাবার গলা জড়িয়ে চুমু খায়!

বিথী মুচকি হেসে এঁটো বাসন কোসন জড়ো করে। মনির মেয়েকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে কমদামি এন্ড্রয়েড ফোনে কার্টুন দিয়ে মেয়ের হাতে দেয়। বাবুই যেন খুশিতে আকাশ জুড়ে উড়ে বেড়ায়।
মনির বিথীর হাত থেকে এঁটো বাসন নিয়ে বলে,
-" আমি করমু নি সব। তুই পাটিতে বয়! ভাত দিই!"

বিথী কথা না বাড়িয়ে পাটিতে বসে। লোকটা এমনি! সুযোগ ও সময় পেলে বাড়ির সব কাজ একাই করবে। রান্না বান্না, বাসন ধোয়া; ঘর মোছা ইত্যাদি। বিথীকে একটা কাজও করতে দেবে না।আর বাচ্চা পেটে আসার পর থেকে তো কাজের ধারের কাছেও ঘেঁষতে দিবে না। মনির প্লেটে অল্প পোলাও , সাদা ভাত ও গরুর মাংস দেয়! ঝোল দেয় না। অবশিষ্ট এক পিস ভাজা মাছ দিলে বিথী মানা করবে কিন্তু মনিরের চোখ রাঙানিতে গিলে নেয়। মনির প্লেট রাখে বিথীর সামনে। বিথী প্লেটে হাত দেয়। তবে উঁকি দিয়ে এটাও দেখে ভাতের বোলে ভাত নেই। পাতিলে আছে কিন্তু পোড়া ভাত! বিথী মাংস ছিঁড়ে ভাতের লোকমা বানিয়ে মনিরের মুখের সামনে ধরল। মনির ভ্রু কুঁচকে বলে,
-" দরদ দেখাইতে হইবো না। গিলা ভইরা খা! পেটের টারে একটু শান্তি দে! না খাইয়া খাইয়া কি হইছোস দেখোস আয়নায়? ফুঁ দিলিই উইড়া যাবি!"
বিথী হাসে। মনিরের মুখে জোর পূর্বক লোকমা পুরে দিয়ে বলে,
-" খাই তো! এহন শুইকা গেলে আমি কি করমু!"

মনির চোখ রাঙায়। বিথী ভয় পায় না এবার। পাতিলের পোড়া ভাত সহ প্লেটে ঢেলে নিয়ে সেও খায় মনিরকেও খাইয়ে দেয়। খাওয়া দাওয়া শেষে বিথী মনিরকে বলে একটু বিশ্রাম নিতে। মনির নেয় না। রিকশা নিয়ে বের হয়ে যায়। মহাজনকে জমা দিতে হবে। আবার তার পকেটও ফাঁকা।

••••••••••••

ভ্যাপসা গরমে জনজীবন বিপর্যস্ত। অসহ্যনীয় গরমে কারেন্ট না থাকলে মানুষের শোচনীয় অবস্থা বিরাজ করে। রাতের রান্না শেষ। তিন টুকরা মাংসসহ ঝোল ছিল। আর ডাল আছে ‌ওতেই হবে শুধু ভাত রেঁধেছে। বিথী মেয়েকে নিয়ে বিছানায় বসে। মেয়েকে অ আ পড়াচ্ছে। মেয়েটার হাতেখড়ি হয়েছে। টুকটাক পড়তে পারে। রোজ সকালে উঠে মসজিদে যায় মক্তব পড়তে। আমপাড়া পড়ছে সে। বিথী ভেবেছে সামনে বছর স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবে। তারই প্রস্তুতি চলছে পুরো দস্তুর। এরমধ্যে গেট ধাক্কায় কেউ। বিথীর বুঝতে বাকি নেই কে ধাক্কাছে। সে আস্তে ধীরে হেঁটে গেট খুলে দেয়। মনির ভিতরে ঢুকে রাশভারী গলায় ধমক দেয়
-" কহন থাইকা ধাক্কাই কানে ঢোকে না? নাকে সরষে তেল দিয়া ঘুমাস!"

বিথী ঘরে ঢুকে বিছানায় বসে বলে,
-" হ ঘুমাই! আপনে এতো রাত কইরা আইসেন কেন? ভয় করে না আমাগোর! কহন চোর ডাকাত আইসে!"

মনির পরনের গেঞ্জিটা খুলে হেসে বলে,
-" কি নিবো চোর? তয় একটা সুন্দরী বউ আছে! সেটাই ভাববার বিষয়!"

বিথী খানিক লজ্জা পায়। লজ্জা লুকাতে মেয়েকে পড়ানোয় মনোযোগ দেয়। মনির হাত মুখ ধুয়ে এসে বিছানায় বসে। মেয়ের পড়া দেখে খুশি হয়। একটা বিস্কুটের প্যাকেট বের করে মেয়েকে দেয়। বাবুই খুশি হয়ে তখনি ছিঁড়ে খেতে শুরু করে। মনির একটা আচারের প্যাকেট বের করে বিথীর কোলে ফেলে।
-" তোর জন্য না! তোর পেটেরটার বুঝলি?"

বিথীর অধরকোনে হাসি ছড়িয়ে পড়ে। আঁচল দিয়ে মনিরের ভেজা মুখটা মুছে দিয়ে বলে,
-" বুজছি! আমি খাবার বারি!"
-" তুই থাক আমি নিইয়া আসি এইহানে। তিনজনে একসাথে খামু!"

মনির গামলায় বেশি করে ভাত মাংস ও ডাল নিয়ে আসে‌ নিজের হাতেই বিথী ও মেয়েকে তুলে খাওয়ায়। সাথে নিজেও খেয়ে নেয়। হাসি তামাশা ও মেয়ের গল্পে তিনজনের খাওয়া দাওয়ার সমাপ্তি ঘটে। বাবুই ঘুমিয়ে পড়ে। বিথী বাইরে থেকে ঘুরে এসে মেয়ের পাশে শোয়! কিন্তু হাত পায়ের বিষে চোখে ঘুম ধরা দেয় না। মনির দরজা বন্ধ করে এসে বিথীর পাশে বসে বলে,
-" কি হইছে?"
বিথী ঠোঁট উল্টে বলে,
-" পা গা গতর ব্যাথা করে!"
-" এতো রোগ বালাই তোর শরীরের ভিতর!"

বিরক্তের সাথে বলে মনির লাইট নিভিয়ে দিয়ে বিছানায় বসে। বিথীর পা দুটো কোলে নিয়ে টিপে দেয়। বিথী বাঁধা দেয় না। আরামে চোখ বুজে আসে। 
-" হাতে টাকা পয়সা হইলে একটা পুরান ধুরান টিভি কিইনেন!"
মনিরের কপালে ভাঁজ পড়ে।
-" নুন আনতে পান্তা ফুরায় মহারানী টিভি দেখবেন!"
-" আমি দেখমু না। বাবুই ফারিয়া গোরে বাত্তে টিভি দেখতে যায়। ওর ভাইটা ভালো না তেমন‌। তার উপর আইজ যাইয়া দেহি মেয়েটারে দিয়ে ফারজানা ভাবি পা টিপাইতেছে। মেয়ে টিপা দিতাছে আর হা করে টিভি দেখতাছে!"

বলতে বলতে তার কথা জড়িয়ে আসে। মনিরের হাত থেমে যায়। মেয়েকে দিয়ে কখনো সে লবনের বাটি আনায় নাই আর মানষে পা টিপাইছে! বিথী কান্না গিলে নিয়ে আবার বলে,
-" এক কাজ কইরেন আমার বাটন ফোনে একটা ম্যামরি তুইলা কিছু কার্টুন দিয়েন। ওইটাই দেখবো।"
-" হুম!"

ছোট জবাব মনিরের। বিথীও কিছু বলে না। চুপচাপ থাকে দুজনেই। মনির বিথীর পা টিপে পেটের আঁচল সরিয়ে দিয়ে আদর করে ফুলো পেটে। চুমু দিয়ে বলে,
-" চল ঢাকায় যাই! ঢাকায় টাকার খনি আছে রে। এইহানে কয় টাকা কামাই ওখানে তার ডাবল বেতন তুলতাম!"
বিথী খানিক ভাবে।
-" শহরের পরিবেশ ভালো না। মাইয়াটা এখানে ওইখানে ঘোরে। আজকালকার মানুষের ভরসা আছে?"
মনির কথা বলে না। বিথী আবার বলে,
-" আগের বাড়ির মালিক লুচ্চা ছিল! কেমন কইরা তাকাই থাকতো! মেয়েটারে কোলে নিয়ে.. ছিঃ!"
মনিরের চোয়াল শক্ত হয়।
-" আগে বলিশ নাই ক্যান?"
-" কি করতেন আপনে? খালি ঝামেলা হইতো! ওরা বড়লোক মানুষ। কিছুই করতে পারতেন না। উল্টা আপনারেই ফাসাই দিতো!"

মনির চুপ করে থাকে। কথা সত্য! দুনিয়াটা যে বড়ই স্বার্থপর! জালিমের যুগ! তবে সে দুঃখ বোধ করে। এতোদিন না বুঝেই মেয়েটার উপর রাগ দেখাইতো। বিথী নাক পরিষ্কার করে আবার বলে,
-" আচ্ছা। যাবো ঢাকা। তবে ভালো একটা বাড়ির ব্যবস্থা কইরবেন!"
-" যামু না ঢাকা!"
-" না আমি ভাবছি! এভাবে আর কয়দিন চলবো? মেয়েটা বড় হচ্ছে তার পড়ালেখা! আরেকটা আসছে তার খরচাপাতি!"

মনির বিথীর বুকে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। বিথী সযত্নে তার ঝাকরা চুলে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। মনির দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
-" আচ্ছা ভাইবা দেহি! তুই আবার পরে বাড়ি আসার জন্য জেদ করবি না তো?"
-" না! তবে আমাগোরে সুরক্ষা নিশ্চিত করা লাইগবো!"
-" আমি আছি তো!"

বিথীর অধরকোণে হাসি ফুটে উঠলো নিমিষেই! ঠিকই তো! লোকটা আছে না? মনির বিথীর বুক থেকে মাথা তুলে আঁচল সরিয়ে দেয়। হাতটা গভীরে নিয়ে গালে মুখে গলায় এলোপাথাড়ি চুমু দিতে থাকে। বিথী আৎকে উঠে চেনা পরিচিত স্পর্শে! চাপা স্বরে বলে,
-" কি করছেন?"
মনির নিজ শক্তি প্রয়োগ করে! গলার ভাঁজে চুমুতে ভরিয়ে দিয়ে বলে,
-" হাড্ডিসার বউকে একটু সোহার করতেছি! বউটা আদরের অভাবে শুইকা যাইতেছে!"
বিথী খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো মধ্যরাতে। মনির তার অধরজোড়া বন্ধ করে হাসি থামায় !

••••••••••••

 ঘড়িতে সকাল দশটা। মনির রিকশা নিয়ে বেড়িয়েছে সেই ভোর সারে ছয়টার দিকে। বেশ ভালোই কিছু কামিয়েছে। সে তার বাড়ির এলাকার কাছে এক ব্যাক্তিকে নামিয়ে দেয়। রিকশা এক দোকানের সামনে দাঁড় করিয়ে এক পোয়া চিনি কেনে পঁয়ত্রিশ টাকায়। মেয়ের জন্য দুইটা চিপস কিনল। আশার সময় দেখে এক ছোট বাচ্চা আইসক্রিম খাচ্ছে। মনির সেটা দেখে আইসক্রিমের দোকানে যায়। একটা কোন আইসক্রিম দেখিয়ে দাম জিজ্ঞেস করে। আশি টাকা শুনে মনির আর সেদিকে তাকায় না। ত্রিশ টাকার একটা বাটি আইসক্রিম কিনে চট জলদি রিকশা হাঁকিয়ে বাড়িতে যায়। গিয়ে দেখে মা মেয়ে বসে মোবাইল দেখছে! তারই রেখে যাওয়া এন্ড্রয়েড ফোন! সে রেখে গিয়েছিল মেয়ের জন্য। মনিরকে দেখে বিথী উঠতে নিবে মনির থামিয়ে বলে,
-" উঠা লাইগবো না। ধর! পায়েস রান্ধবি স্বাদ কইরা! আম্মা এই যে তোর আইসক্রিম চিপস! একা একা খাইস না তোর মায়েরেও দিস এটটু! আমি যাই! রিকশা রাইখা আছি রাস্তায় !"

বলে বেড়িয়ে যায়! বাবুই মোবাইল মায়ের কাছে দিয়ে আইসক্রিম খেতে থাকে। মাঝে মাঝে মায়েকে সাধতেও ভোলে না। বিথী একবার মুখ নিয়ে মেয়ের গাল টিপে বলে,
-" আপনেই খান আম্মাজান!"

বাবুই খুশি মনে খেতে থাকে আইসক্রিম। আইসক্রিম শেষ হলে চিপসের প্যাকেট মায়ের কাছে দেয় ছিঁড়ে দিতে। বিথী দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে একটা একটা করে মেয়ের মুখে দেয়। বাবুই উম উম শব্দ করে সবটুকু খায়। বিথী এক ধ্যানে মেয়ের ফর্সা সুন্দর মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটা তার বেশ দেখতে।যেন গরীবের ঘরে কোন রাজকন্যার জন্ম হয়েছে। বাবুই একটা চিপস শেষ করে আরেকটা খাওয়ার আবদার করলে বিথী মানা করে। বাবুই হাসিমুখে মেনে নেয়। মা মেয়ে ফোনে কার্টুন দেখে বেশ সময় ধরে। ফোনের চার্জ ফুরিয়ে গেলে তবেই উঠে। বিথী ফোনটা চার্জে লাগিয়ে মেয়েকে গোসল করিয়ে হাতে মুখে একটু লোশন মাখিয়ে দেয়‌। একটা ফ্রক ও হাফ প্যান্ট পড়িয়ে ছোট চুলে ঝুটি বেঁধে দেয় তালগাছের মতো। দুটো পুতুল ক্লিপ দু পাশে লাগিয়ে দিয়ে ফোনে বেশ কয়েকটা ছবি তুলে। মেয়েকে ভর পেট খাইয়ে নিজেও খেয়ে নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই গেট ধাক্কানোর আওয়াজ শোনা যায়। বিথী আস্তে করে উঠে বসে। পেটে ক্ষিন ব্যাথা অনুভব করে। তবুও গুটি গুটি পায়ে হেঁটে গেট খোলে। বাবুইও বিছানা থেকে নেমে মায়ের পিছনে আসে। গেট খুলে বিথী দেখে, ফারজানা ভাবী চিন্তিত মুখে। সে জিজ্ঞেস করবে এর আগেই ফারজানা ভাবী বলে,
-" মনির ভাই নাকি এক্সিডেন্ট করছে! পেছনের প্যাসেঞ্জারের গুরুতর অবস্থা! সদরে নিয়া গেছে!"

বিথী মনে হয় শক খেলো! মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। বুকটা ভারী অনুভূত হয়। পেটের ক্ষীন ব্যাথা যেন তীব্রতর হয়! হাত পা বরফ হয়ে গেল নিমিষেই! ভাবীকে কিছু জিজ্ঞেস করবে কিন্তু কথা বলার শক্তি ফুরিয়ে যায়। পেটে হাত রেখে পড়ে যেতে নিলে বাবুই মা বলে কেঁদে ওঠে। ফারজানা কোনো মতে ধরে বিথীকে। আরো কয়েকজন গৃহস্থ বধু এগিয়ে আসে। বিথীর হাত পা ঘষে। একটু পর বিথী যেন হুঁশে ফিরে। মেয়েটি বুকে চেপে কেঁদে ওঠে। 
-" ভাবি ওনার কিছু হইছে? কে বলল? আপনারে কে বলছে?"
বিথীর কথায় ফারজানা বলে,
-' আমারে ফারিয়ার বাপে কইলো! মনিরের কিছু হইছে কি না তা বলতে পারলো না! সদরে নিয়া গেছে বললো!"
-" আমিও যামু! ভাবি একটা রিকশা ডাইকা দিবেন?"

ফারজানা সায় জানিয়ে উঠে যায়। বিথী উঠে ঘরে যায়। বাক্স খুলে কাপড়ের ভাঁজ থেকে কিছু টাকা বের করে। তার কাছে ছিল কিছু গচ্ছিত! সে টাকা গুলো নিয়ে আর দেড়ি করে না। মেয়েকে নিয়ে ঘরে তালা ঝুলিয়ে বের হয়। ফারজানার ঠিক করা রিকশায় চড়ে বেড়িয়ে যায় হাসপাতালের উদ্দেশ্য। ফোন লাগায় লোকটার কাছে থাকা তার মোবাইল নম্বরে। বেজে বেজে বন্ধ হয়ে যায় রিসিভ হয় না। বিথী ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। তার কান্না দেখে ছোট বাবুই মা বলে কাঁদে উচ্চ স্বরে। বিথী কান্না বন্ধ করে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নেয়। আজ লোকটার কিছু হলে তার কি হবে?এই ছোট মেয়েটার ভবিষ্যত কি হবে? আর পেটে যে আরেকজন বেড়ে উঠছে তারই বা ভবিষ্যৎ কী হবে? এই নিকৃষ্টতম সমাজ তাদের বাঁচতে দিবে? বিথী উপর ওয়ালার কাছে পার্থনা কমে লোকটার যেন কিছু না হয়। সুস্থ সমেত তাদের কাছে যেন ফিরে আসে। রিকশাওয়ালা যতো দ্রুত সম্ভব সদরে পৌঁছে দেয়। বিথীর কোল থেকে বাবুইকে নামিয়ে দিল। বিথী বাড়ন্ত পেট ধরে আস্তে করে নামে। চল্লিশ টাকা রিকশা ওয়ালার দিকে বাড়িয়ে দিলে মধ্যবয়সী লোকটা বলে,
-" দেওয়া লাগবো না বউ! মনি আমার পোলার মতোই! আমি রিকশা ওইহানে রাইখা আসি। একলা যাইয়ো না। খুঁইজা পাইবা না!"

বিথী যেন একটু স্বস্তি পেল। সত্যিই সে খুঁজে পেতোনা। আর এই অবস্থায় বেশি হাঁটাচলাও করতে পারে না। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে অনেক বেগ পোহাতে হয়। তার উপর মেয়েকেও আগলে নিতে হবে। লোকটা রিকশা রেখে এসে বাবুইকে কোলে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। বিথী তার পিছনে হাঁটতে থাকে। পেটে চিন চিন ব্যাথা অনুভব করে কিন্তু গ্রাহ্য করে না। এগিয়ে যায় আঁচলে মুখ ঢেকে। তাঁরা রিসেপশনে গিয়ে খোঁজ করে। তাঁরা সঠিকভাবে বলতে পারে না। এক্সিডেন্টের রোগি অনেক। এরমধ্যে পাঁচজন স্পট ডেট। তাদের মধ্যে দু জন জোয়ান ছেলে। বিথীর বুক কেঁপে ওঠে। তাদের জেনারেল ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে অনেক এক্সিডেন্ট কেসের রোগি আছে। বিথী মনিরের ফোনে কল লাগায় অনবরত! জেনারেল ওয়ার্ডে গিয়ে বিথী শত মানুষের ভিড়ে আপন মুখ খোঁজে। চোখে পড়ে না। এরমধ্যে বাবুই আব্বা বলে চিল্লিয়ে ওঠে। হাসপাতালে নীরব জায়গায় এরকম চিল্লানোতে সবাই বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে থাকে। বাবুই লোকটার কোল থেকে নেমে দৌড়ে একজোড়া পা জড়িয়ে হিচকি তুলে কেঁদে ওঠে। বিথী পা জোড়ার মালিককে দেখে স্বস্তির শ্বাস ছাড়ে। 
মনির মেয়েকে কোলে তুলে নেয়! অবাক চোখে ক্রন্দনরত বিথীর দিকে তাকিয়ে থাকে। তার রিকশায় চড়ে এক মহিলা নিউমার্কেটে যাচ্ছিলো! বিথীর বয়সী হবে। বেশ স্মার্ট আর বেশভূষায় বেশ বড়লোক মনে হলো। মহিলাটি শাড়ি পড়ে আঁচল শূন্যে ছেড়ে আপন মনে ফোনে কথা বলছিল কারো সাথে। মনির রিকশা চালাচ্ছিল আপন গতিতে। এর মাঝে মহিলাটির আঁচল রিকশার চাকায় পেঁচিয়ে যায়। ব্যস! ঘটনা শুরু! মনির মহিলাটিকে হাসপাতালে নিয়ে এসে ভর্তি করে। মহিলাটি ভালোই আহত হয়েছে। মাথা ফেটে গেছে। হাত পা গলা ছিলে যাতা অবস্থা। কিন্তু এরা এখানে কেন? 

বিথী এগিয়ে আসে পেটে হাত রেখে মনিরের বুকে মাথা রেখে হাঁউমাঁউ করে কাঁদতে থাকে।মনির একহাতে মেয়েকে সামলিয়ে বিথীকে ধরে। এতো মানুষের মাঝে এভাবে জড়িয়ে ধরায় বেশ লজ্জায় পড়ে মনির। ধমকে বলে,
-" হচ্ছে টাকি! ছাঁড়! মরছি আমি যে মরা কান্না জুড়াই দিছোস?"

বিথীর কান্না কমে না। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাবুইও কাঁদে। মনির কিভাবে জানবে কিছু মুহূর্ত আগেও তাঁরা কোন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল! কতটি অসহায় বোধ নিয়ে তাঁরা এতটুকু রাস্তা এসেছে। ভয় নামক মহামারী তাদের কতটা গ্রাস করেছিল! মনির স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে। কিছুটি হলেও আঁচ করতে পারে বউ বাচ্চার কাঁদার কারণ কি! তার মনটা অসম্ভব ভালো লাগায় ছেয়ে যায়। এতো বকে, শাসন করে! তবুও বউ বাচ্চা তাকে প্রাণ উজাড় করে ভালোবাসে! এতো অভাব অনটনের ভিতর রাখে এদের! তবুও কখনো তার প্রতি অনিহা প্রকাশ করে না। তার পরিস্থিতি বুঝে আবদার করবে না। মেয়েও না মেয়ের মাও না। যখন যা দেবে খুশি মনে গ্রহণ করবে। মাঝে মধ্যে নোক ঝোক হয় তবে উচ্চ পর্যায়ের না। রাতের ব্যবধানেই তা মিটে যাবে। মনির বুঝতে পারে অভাব অনটন থাকলেও তার বাবুইয়ের বাসায় ভালোবাসার খাদ নেই। তারাই তো এক সুখি পরিবার!
.
.
.
সমাপ্ত........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp